আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমি নীড় হারা এক ফেরারি

ja

‘ডিউরিং হিজ টেনিউর, উই ফাউন্ড হিম টু বি ডিলিগেন্ট, সিন্সিয়ার, হার্ডওয়ার্কিং, এন্ড হি একম্পলিশড হিজ টাস্কস উইদিন ডিডলাইন্স। হি ইজ এন এসেট টু দ্য অর্গানাইজেশন উই উইশ হিম লাক ফর অল ফিউচার এন্ডেভরস। ‘ যেকোনো এক্সপেরিয়েন্স সার্টিফিকেটেই এসব গৎবাঁধা কথা লেখা থাকে তবে নিজের স্বল্পদৈর্ঘ্য কর্মজীবনে অনন্য নিজের সবটুকু দিয়েই তার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করেছে। অফিস থেকে পাওয়া সর্বশেষ পেপারস ফাইলে ঢুকিয়ে রাখে অনন্য। তিন বছরের কর্মজীবন আজ শেষ করে এসেছে সে।

দীর্ঘদিন এক অফিসে কাজ করে খানিকটা ক্লান্ত হয়ে উঠেছে। প্রথম জব করতে গিয়ে অনন্য অনেক ধরনের অভিজ্ঞতাই অর্জন করেছে, বিভিন্ন ধরনের মানুষ, বিচিত্র মানসিকতা, অদ্ভুত সব প্যাচ, এই তিন বছরে অনেকটা হাপিয়ে উঠেছে; তাই ঠিক করেছে এবার জবটা চেঞ্জ করবে। গতমাসে রিজাইন লেটার বসের টেবিলে দেয়ার পর বস ডেকে প্রশ্ন করেছিলেন রিজাইনের, ‘কারন কি?’ সে সরাসরি বলে দিয়েছে এই অবস্থায় সামনে এগুনো সম্ভব হচ্ছেনা, নিজের প্রয়োজনেই এখন অধিক আয় দরকার। গত জানুয়ারিতে ইঙ্ক্রিমেন্ট হওয়ার কথা থাকলেও কোন অজানা কারনে হয়নি। বর্তমান আয়ে এই জব চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।

বস বললেন, ‘দেখ, কোম্পানি এবার আমাদের কাউকেই ইঙ্ক্রিমেন্ট দেয়নি, উপরওয়ালাদের মতি বুঝা যাচ্ছেনা। ঠিক আছে তুমি যখন যেতে চাচ্ছ আমার আটকে রাখার অধিকার নেই। তা কোথায় জয়েন করছ?’ - কয়েকটা দিন একটু রেস্ট নেব তারপর দেখি, আশা করি পেয়ে যাব কিছু, ইনশাআল্লাহ্‌। - ওকে, বেস্ট অব লাক। আজ সব পাওনা বুঝে নিয়ে বিদায় হয়ে আসল অনন্য।

আসার সময় অবশ্যক খুব কষ্ট হচ্ছিল, কতসুন্দর একটা পরিবারের মত কাজের পরিবেশ তৈরি হয়েছিল কলিগদের সাথে। সবাই অনেক আন্তরিক, অনেক প্রাণখোলা। কখনো তার মনে হয়নি আনুষ্ঠানিকতার বেড়াজালে সে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। বসের কাছ থেকে বিদায় নিতে গিয়ে একটু কান্নাই এসে গিয়েছিল, এই কয় বছরে কত ঘটনাই ঘটে গেল!! কিছু দুঃখের কিছু সুখের, কখনো উৎসাহ কখনো ভুলের কারনে ঝাড়ি। কর্মজীবনে কেউই ঝাড়ির হাত থেকে বেঁচে থাকতে পারেনা।

মানুষ মাত্রই ভুল, ২-১টা ভুল হতেই পারে আর ভুলের শাস্তি সর্বনিম্ন একটা ঝাড়ি সরবোচ্চ ডিসমিস। ডিসমিস হওয়ার মত ভুল সাধারণত অভিজ্ঞরা তেমন একটা করেননা, কিছু লোভী ব্যক্তিই আপন হীনউদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে গিয়ে ধরা পড়ে এহেন অবস্থার সম্মুখীন হতে পারেন। আজ যেন পৃথিবীর সকল আবেগ অনুভুতি ঘিরে ধরেছিল অনন্যকে, খুব ইমোশনাল হয়ে পড়েছিল দুপুরে কলিগদের সাথে কথা বলতে গিয়ে। যাইহোক, শেষ বিকেলে ঘরে ফিরে অনন্য শুয়ে শুয়ে ভাবছে কি করা যায়!! আজ নিজেকে অনেক হাল্কা মনে হচ্ছে কিন্তু এই অবস্থা দীর্ঘায়িত করা উচিৎ হবেনা। আরেকটা জব ঠিক করতে হবে, এর মধ্যে এদিক সেদিক একটু ঘুরে বেড়াতে হবে।

ছাত্রজীবনে তেমন একটা ঘুরাঘুরি হয়নি, পড়া আর পড়া, এর বাইরে সহ-পাঠক্রমিক কিছু করেনি সে। পড়াশোনা শেষ করতে না করতেই এই জবটা পেয়ে যায় তাই কোন অবসর মিলেনি। একটু অন্তর্মুখী তার চলাফেরা। এখন খুব ইচ্ছা করছে ঘুরাঘুরি করতে। বাসায় জানিয়ে দিয়েছে সে এই জবটা ছেড়ে দিয়েছে, প্রথমে বাবা আপত্তি করেছিল কিন্তু পরে মেনে নিয়েছে।

কি করতে চায় করুক। এসব ভাবতে ভাবতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। মাগরিবের নামাজ পড়ে হাল্কা নাস্তা সেরে বারান্দায় গিয়ে বসে অনন্য। আশেপাশের বাড়িগুলোতে বাতি জ্বলছে। বাড়িতে আলো জ্বলা অদ্ভুত অথবা দেখার মত কিছুই নয় তবু কেন যেন আজ ওকে এই সাধারণ বস্তুনিচয় খুব আকৃষ্ট করে তুলল।

বোধহয় নস্টালজিয়া পেয়ে বসেছে!! অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে আর বাতিগুলো আর সপ্রতিভ হয়ে উঠছে। এরমধ্যে রুমের ভিতর থেকে ফোনের আওয়াজ ভেসে আসে। একটু ধিরেই সে রুমে ঢুকে সেলফোন হাতে নেয়। রিনি’র ফোন। ‘হ্যালো’।

রিনি অনন্যর বন্ধু। দীর্ঘ তিন বছর ধরে এই বন্ধুত্বের সম্পর্ক। বুয়েটে ফাইনাল দিচ্ছে এবার। এই একটা মানুষ পেরেছে অনন্যর কাছের বন্ধু হতে। মেয়ে বলে নয়, মানুষ হিসেবেই।

ছাত্রজীবনে অনেকে বন্ধুই এসেছিল, বন্ধু-বান্ধবী, দীর্ঘস্থায়ী হয়নি কোনটাই। কখনো স্বার্থের টানে কখনো হেয়ালি করে, কখনো আবার ছোটখাটো ব্যাপারে রাগারাগি করে ওর বন্ধুত্ব ছিন্ন হয়ে গেছে। মেয়েবন্ধুদের ব্যাপার একটু অদ্ভুত বটে। সাধারণত ওদের সাথে অনন্যর সম্পর্ক, যোগাযোগ, বোঝাপড়া ভালই থাকত কিন্তু মাঝেমাঝে ২-১ জনের কিছু আপত্তিকর কর্মকাণ্ডে বিরক্ত হয়ে উঠত সে। তাই একসময় মেয়েদের সাথে সকল যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল।

বছর তিনেক আগে ফেসবুকের স্যাড বাট ট্রু পেইজে মেয়েদের (কিছু) ফাজলামি নিয়ে পোস্ট করা একটা ফটোতে কমেন্ট করতে গিয়ে পরিচয় হয় রিনির সাথে। রিনির অকাট্য যুক্তিপূর্ণ রম্য কমেন্টগুলো অনন্যকে খুব আকৃষ্ট করে। অফিসে কাজের ফাঁকেফাঁকে ফেসবুকিং ভালই করে অনন্য। সাধারণত কিছু বড়ভাই আর স্কুল, কলেজ লাইফের কিছু ফ্রেন্ডকে নিয়েই তার ফ্রেন্ডলিস্ট। নিজের পরিচিত কোন মেয়ে না থাকায় তার ফ্রেন্ডলিস্ট মেয়ে শূন্যই থাকে।

অন্তর্মুখী স্বভাবের কারণে কারো সাথে নতুনভাবে রিলেশন করার কথা কখনো মনেও হয়না তার। অথচ রিনির কমেন্টগুলো কেন যেন তার কাছে অনেক ভালো লেগে যায়। যদিও সে জানে ফেসবুকে মেয়ে নাম দিয়ে অনেক ছেলেই প্রোফাইল খুলে দুষ্টামি করে তবু এখানে তার সেই ধারনা মোটেই মাথা ঘামায়না। ২-৩ দিন ভাবতে ভাবতে হুট করে একদিন ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায় রিনিকে। এড পার্সোনাল মেসেজ বক্সে টাইপ করে, ‘হি, আই ওয়ান্না বি এ ফ্রেন্ড অব ইউ, আইন্ট শিউর ওয়েদার ইট উড প্রসিড অর নট।

বোথ উইল এপ্রিশিয়েটেড হাইলি। ইন্টেনশনালি ওয়েটিং ফর ইউর মেইল। থ্যাঙ্কিং ইউ। অনন্য’ হয়ত একমাত্র এটেম্পট বলেই এই রিকোয়েস্ট নিয়ে অনন্য একটু টেনশনে ছিল। ২-৩ দিন পেরিয়ে গেলেও কোন সাড়া না পেয়ে হাল ছেড়ে দেয়েছে সে।

রিকোয়েস্ট ইগ্নোর করতে গিয়েও কেন যেন পারলনা। মনে মনে ভাবল, ‘মনে হয় বিজি আছে, অন্তত মেইলতো করবে। ‘ ঠিক ৫ দিন পর নোটিফিকেশন এল, ‘অপরিচিতা রিনি এক্সেপ্টেড ইউর ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট’। 'যাক, শেষ পর্যন্ত ঘুম ছুটল নিদ্রাকুমারির!!!' অনন্যর মেসেজ। রিপ্লাই এল, ‘সরি, কয়েকদিন অনেক বিজি ছিলাম’।

- দ্যাটস ওকে, থ্যাংকস। এভাবেই অনন্য আর রিনির পরিচয়, যোগাযোগ, বন্ধুত্ব শুরু। এরপর ধীরেধীরে তাদের মধ্যে সুন্দর একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং গড়ে উঠে। পাশাপাশি চলতে থাকে একে অপরকে খোঁচানো, পচানো, ব্যাম্বু মারা, বন্ধুরা ফেসবুকে/অনলাইনে যা করে আরকি!!! শেয়ারিং প্রসঙ্গে তাদের মাঝে বাঁধা বলতে থাকে শুধু নিজেদের অতি-ব্যক্তিগত বিষয়গুলো। বাকি পৃথিবীর কোন বিষয় বাকি থাকেনা তাদের চ্যাট, ম্যাসেজিং, কমেন্টস’এ।

নিজেদের জীবনের সুখদুঃখ, আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্না, পরিবার পরিজন, অতীত বর্তমান, ভবিষ্যৎ লক্ষ্য সব নিজেদের মধ্যে শেয়ার করে ওরা। মাঝেমাঝে আবার রাগারাগিও হয়, মান-অভিমান চলে, আবার নিজেরাই মিটিয়ে নেয় সব। এভাবে হেলতে দুলতে সময় গড়িয়ে যায়। দীর্ঘ তিন বছরের এত ভালো সম্পর্ক থাকা সত্তেও তাদের চাক্ষুস সাক্ষাৎ মিলেনি। অনন্য কখনো রিনির সামনে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি আর রিনিও কখনো বলেনি যে চল একটু বসি।

তাই পৃথিবী তার কক্ষপথে সূর্যকে প্রদক্ষিন করছে আর চাঁদ তার কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করছে পৃথিবীকে। যারযার পথে তারা নিজেদের মত সদাই বেগবান। একবার অনন্য কথার ছলে রিনিকে প্রশ্ন করেছিল, ‘তোমার কি পার্সোনাল কোন এফেয়ার আছে?’ রিনি বলেছে, ‘এসবে আমার কোন ভক্তি নেই তাই কখনো কাউকে নিয়ে ভাবিনি, কাউকে প্রশ্নও করিনা। তবে তুমি যখন প্রশ্ন করেছ তোমার জবাবটাও দিয়ে দেয়া উচিৎ’। এই পরিস্থিতিতে কেন যেন অনন্য একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল, তাই কি বলবে ভেবে পাচ্ছিলনা।

- ‘কি হল অনন্য? চুপ মেরে গেলা যে!!’ - ওঃ নাহ, আসলে কি জবাব দেব তাই ভাবছিলাম। - এত ভেবে কথা বলতে হয়!! কুছ তো হুয়া হ্যায়!!! তা কে সেই মহামানবি? - পাগলামি কইরনা, আমি এসব পছন্দ করিনা। - কোনটা? পাগলামি নাকি পিরিতি!!! হাহাহা - আরে ধুর!!! পৃথিবীতে পিরিতের চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। আমি এসব লাইক করিনা। - ম্মম... বিশ্বাস হলনা।

তাইলে এত দেরি কইরা উত্তর দিলা ক্যান!!! - উহু... আসলে আমি তোমাকে প্রশ্নটা করে নিজেই অবাক হয়ে গেলাম!! আর প্রশ্ন খুঁজে পেলামনা!! - হুম... আচ্ছা বল, তোমার সপ্নরানির কথা। - হোপ!! পড়ালেখা চলছে কেমন? - হুম... সেইরকম... সারাদিন ঘুরাঘুরি আর আড্ডা মারা, ঘ্যানঘ্যানানি, প্যানপ্যানানি... এক্সামে কি বাঁশ যে খামু তা বলাই বাহুল্য। পরিস্থিতি এড়াতে এর চেয়ে আর উপযুক্ত প্রশ্ন খুঁজে পায়নি অনন্য, রিনিও বুঝে ফেলেছে সে ব্যাপারটা বলতে চাইছেনা। সকাল আটটা। সূর্যের আলো জানালা গলে পিঠের উপর এসে পড়েছে।

বিছানা ছাড়তে মোটেই ইচ্ছা করছেনা অনন্যর। তবু ঘুম নেই চোখে, শুধু এপাশ ওপাশ করে কিছু সময় আড়ষ্ট হয়ে পড়ে থাকে। দীর্ঘদিন সকাল সাতটায় উঠতে উঠতে অভ্যাস হয়ে গেছে তাই ইচ্ছা করলেও ঘুমানো সম্ভব নয়। পাশের রুমে ছোটবোন তানির গলার আওয়াজ শুনে ডাক দেয়, ‘তানি’। ‘আসছি’ বলে তানি’টাও দেরি করে আসে।

‘বল, কি?’ ‘চুল টেনে দে তো, মাথাটা ব্যাথা করছে। ‘ ‘পারবোনা’ বলেই চলে যেতে উদ্যত হয়। ‘তানি, ফাজলামি করিসনা’ বলে জোরে চিৎকার দেয় অনন্য। মুখে বিরক্তির ভাব ফুটিয়ে ফিরে এসে ভাইয়ের চুলে হাত দিয়ে আম্মুকে ডাক দিয়ে বলে, ‘আম্মু, তোমার এই ছেলেটাকে বিয়ে দাওনা কেন!!’ আম্মুর হাসির শব্দ ভেসে আসে। ‘আচ্ছা তানি, তুই ফাজলামি ছাড়া কথা বলতে পারিসনা!!’ অনন্য একটু গম্ভীর হয়ে প্রশ্ন করে।

‘পারবোনা’ বলে একটু জোরে এলোমেলো করে চুলে টান দেয়। ‘আচ্ছা ভাইয়া, আমি একটু আসছি’ বলে তানি বের হয়ে যায় রুম থেকে, কিছুক্ষন পর ফিরে আসে সেলফোন চাপতে চাপতে। পাশে বসে সেলটা অনন্যর হাতে দিয়ে বলে, ‘ভাইয়া, দেখতো’। রিনি’র ফটো!!! অনন্য একটু অবাক হয়ে তানির দিকে তাকিয়ে আবার সেলের ডিসপ্লেতে চোখ রেখে বলে, ‘এই ফটো তোর কাছে কিভাবে!’ ‘তোর পিসি থেকে নিলাম’। তানির ঠোট বাঁকিয়ে নিরুত্তাপ জবাব।

‘থাপ্পড় মারমু একটা!! আমার কাছে রিনির কোন ফটো নাই’। ‘শিউর?’ ‘আবার কি!! কই পেলি?’ ‘কলেক্ট করলাম, আপুর কাছ থেকেই, আম্মুকে দেখালাম, আম্মুরও অনেক ভালো লেগেছে’ বলে তানি গাল বাঁকিয়ে এমন ভাব করে যেন দুর্গম কোন পর্বত জয় করেছে। ‘ভালো লেগেছে মানে!! তুই আবার আম্মুকে কি বলেছিস?’ ‘যা বলেছি, বলেছি। আচ্ছা বল রিনিপু কি করছে এখন?’ ‘তুই চুল টান, কাজের কাজ বাদ দিয়ে বাজে প্রশ্ন। আমার কাছে কি সারারাগুলের যাদুর আয়না আছে!! দেখে বলব কে কি করছে!!’ ‘ন্যাকামি করিসনে, আমি সিরিয়াসলি প্রশ্নটা করলাম।

‘ ‘এবার ফাইনাল দিচ্ছে’ ‘তার মানে তোরা এক্সামের পর বিয়ে করবি?’ ‘তোরা মানে!! কারা?’ অবাক হয়ে অনন্য তানির দিকে চেয়ে আছে, তানি ভাবলেশহীনভাবে মুখে দুষ্টামির হাসি টেনে বলে,’ভাইয়া, তোদের দুজনকে খুব মানাবে’। অনন্য বোনের কমপ্লিমেন্ট শুনে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। তারপর একটু ভেবে বলে, ‘তানি, তুই যা ভাবছিস, আদতে রিনির সাথে আমার সেরকম কোন সম্পর্ক নেই। তুই আমার বোন আর রিনি বন্ধু, ব্যস। ‘ ‘কথাটা মন থেকে বলছিস?’ চুল টানা ছেড়ে তানি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে জবাবের অপেক্ষায়।

অনন্য আর তানিয়া, বাবা-মার ছোট সংসারে দুই ভাইবোন। সেই শৈশব থেকেই ওরা বন্ধুর মত থাকে। তাদের সব কিছুই নিজেদের মধ্যে শেয়ার করে। তানি ভালো করেই তার ভাইকে জানে। জবে যাওয়ার কিছুদিন পর থেকেই অনন্য হঠাত একটু কম্পলিকেটেড হয়ে উঠে, ঘরে এসে নিজের রুমেই বেশীরভাগ সময় কাটায়।

মনে হয় কিছু একটা লুকানোর চেষ্টা করে, কিন্তু তানির কাছে কিছু লুকাতে পারেনা। যতই সে হেলাফেলা করে এড়িয়ে যাক না কেন তানি বুঝে ফেলে তার ভাই কারো প্রেমে পড়ে গেছে। যদিও আজ পর্যন্ত অনন্য ব্যাপারটা সরাসরি প্রকাশ করেনি তার কাছে, তবু সে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে অনন্য রিনিকেই ভালোবাসে আর রিনিকেই জীবনসঙ্গী করে ঘরে তুলবে। কেননা ফ্যামিলির বাইরে পৃথিবীতে এই একটা মানুষই পারে অনন্যর কোন সিদ্ধান্তে ভুমিকা রাখতে, আর অনন্যও কিছু করতে গেলে রিনির সাথে আলোচনা করে। তাই নিজেই রিনির সাথে যোগাযোগ করে ছলেবলে ফটো কলেক্ট করে আম্মুকে দেখানোর জন্য, রিনিকে যদিও এসব কিছু বলেনি।

কিন্তু আজ অনন্যর কথাবার্তা তার কাছে খুব অচেনা আর অদ্ভুত মনে হয়। জব ছেড়ে দেয়ার সাথে কি এর কিছু জড়িত!! ‘কিরে! কি ভাবছিস এভাবে?’ তানির উদাস দৃষ্টি দেখে অনন্য প্রশ্ন করে। হঠাত একটু অপ্রস্তুত হয়ে উঠে তানি। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, ‘ভাইয়া, তুই কি সত্যি রিনিপুকে লাইক করিসনা?’ ‘কেন করবনা! কিন্তু তার মানেতো এই নয় যে আমি তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখব’। ‘ভাইয়া, তুই ওকে ছাড়া সুখি হতে পারবিনা’।

‘কি যা তা বলছিস!! রিনির কথা বাদ দে, ও ভালো আছে। ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করেই হয়ত জাপান বা অস্ট্রেলিয়া চলে যাবে। হাইপ্রোফাইল মেয়ে, ওদের অনেক বড় স্বপ্ন। আর ওদের দরজায় শতশত ইমিগ্রান্ট পাত্র হামাগুড়ি দিচ্ছে, খামোখা আমি এসব ভাববো কেন!!’ তানি অনন্যর দিকে তাকিয়ে থাকে নিরুত্তাপে। তার মাথায় কিছুই ঢুকছেনা, এও কি সম্ভব!! তিনটি বছরধরে দুইটি মানুষ কি মায়ার জালে সম্পর্ক টিকিয়ে রেখেছে! কেমন বন্ধুত্ব এটা!! কিছুক্ষন পর গলার স্বর হালকা করে বলে, ‘বাবা তোর জন্য পাত্রী দেখছে, আর তুই এখন জব ছাড়লি কেন!’ অনন্য অনেক্ষন চুপ করে শুয়ে থাকে, চোখে তার বিশাল শূন্যতা।

সেলফোন হাতে নিয়ে সময়টা দেখে নেয়, নয়টা বেজে গেল। বিছানা থেকে নেমে তানির পাশে এসে বসে ওর মাথায় হাত দিয়ে কাছে টেনে বলে, ‘বাবাকে বলিস আরো কিছুদিন পর’ ‘পিছুটান যদি না থাকে তবে দেরি করছিস কেন?’ তানির কণ্ঠে চাপা অভিমান ফুটে ওঠে। অনন্য ঠোটের কোণে কৃত্রিম একটা হাসি ফুটিয়ে বলে, ‘আমি একটা ঘটনার জন্য অপেক্ষা করছি’। অনন্য ওয়াশ রুমে চলে যায় তানি উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে তার যাওয়ার দিকে চেয়ে থাকে। জব ছেড়ে এমনিতেই অনেক মুক্ত হয়ে গেছে অনন্য, কাল সন্ধ্যার পর থেকে আরও মুক্ত হয়ে গেল।

যেন মনে হচ্ছে মাথার উপর থেকে একটা আস্ত পাহাড় সরে গেছে। শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে। ঠান্ডা পানি মাথা ভাসিয়ে পিঠের উপর দিয়ে গড়িয়ে পড়ে ফ্লোরে। মেরুদণ্ডে অদ্ভুত এক শিহরণ জাগে ক্ষণেক্ষণে। সময় পেলে অনন্য গোসলের সময় কিছুক্ষণ এভাবে বসে থাকে।

মনে হয় নিজের মনের বিষণ্ণতা ধুয়ে মিশে যাচ্ছে অজানার দিকে। আজ সে নিজের আবেগের কাছে অনেকটাই ঋণমুক্ত। ইচ্ছে করছে জোরে কিছুক্ষণ হেসে উঠে, তা আর হয়না। উপরের দিকে তাকায়, পানি এবার মুখের উপর পড়ে। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে বসে ভাবতে থাকে কাল সন্ধ্যায় রিনির বলা কথাগুলো।

কখনোই হালকা আমেজে কথা না বলা রিনি কাল ফোন ধরার পর থেকেই একটা অপরিচিত চাপা কন্ঠে বলে, ‘কেমন আছ?’ ‘ভালো, তুমি?’ ‘এইতো, ভালই। অফিস থেকে ফিরছ কখন?’ ‘বিকেলের দিকেই ফিরেছি, তোমার কি কোন সমস্যা হয়েছে?’ ‘নাতো, কেন?’ ‘মনে হচ্ছে টেনশনে আছ’ ‘না এমনি, আচ্ছা তুমি অফিস থেকে ১৫,১৬,১৭ তিনদিনের ছুটি নিওতো। ‘ ‘কেন?’ ‘ঢাকায় আসবে, তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে। ‘ ‘ফাজলামি না করে বল কি হয়েছে। ‘ ‘তোমার প্রিয় বন্ধু খুব শীগগির পরবাসী হবে’ বলে রিনি হাসতে শুরু করে... ‘মানে!!’ কথাটা অনন্যর কাছে একটু ধাক্কা মনে হয়।

‘কাল আমার এনগেইজমেন্ট, ১৬ তারিখ বিয়ে’ ‘হুম... ভালইতো, বর কি করেন?’ নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে অনন্য। ‘এক্স-বুয়েটিয়ান, জাপানে আইটি স্পেশিয়ালিস্ট হিসেবে কাজ করছে’ ‘ওয়াট্টা লাক!! স্বপ্নের পূর্ণ বাস্তবায়ন! স্বপ্ন পুরুষ, স্বপ্নিল ভবিষ্যৎ! এবার তোমাকে পায় কে!! হাহাহা... তা সময় আর পেলনা!! ‘কেন!’ ‘আমি ১০ তারিখ ঢাকা যাচ্ছি, একটা অফিসিয়াল কাজ আছে। কাছাকাছি ডেট হলে মিলিয়ে নেয়া যেত, দেখা যাক। ‘ ‘অফিসিয়াল কাজে এসে লাভ কি! কতবারই তো আসলে, দেখা করা হলনা। আসলে তুমি একটা কি মানুষ!!! তিন বছরে আমরা একবারও দেখা করতে পারলামনা।

‘ ‘দেখা না করলেইবা কি হয়!! হাহাহা... আসলে কেউইতো ফ্রি ছিলামনা, তোমার পড়ালেখা, আমার কাজ, এইতো... আচ্ছা শোন, ১০ তারিখ সন্ধ্যায় আমি ফ্রি হব, তখন কোথাও বসা যাবে। ‘ ‘হুম... আচ্ছা, তুমিও এবার কিছু করে ফেল। ‘ ‘ইমিগ্রান্ট না হলে পা বাড়াই কি করে!’ ‘ফাজলামি করবানা। জব করছ, অনেকদিনতো হল, এবার সুন্দর দেখে একটা বউ তোল ঘরে। ‘ ‘ম্মম... দেখি।

‘ ‘আজ রাখি, একটু কাজ আছে। ‘ ‘ওকে’ এক ঘন্টার মত সময় কেটে গেল বের হওয়ার নামগন্ধ নেই দেখে তানি এসে ডাকাডাকি শুরু করল। তখন সম্বিৎ ফিরে পেয়ে তাড়াতাড়ি গোসল সেরে বের হয় অনন্য। নাস্তা সেরে বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়। উদ্দেশ্য অজানা।

বন্ধুরা সবাই এখন ব্যস্ত নিজেদের জীবন নিয়ে। নিউ-মার্কেটে এক বন্ধু ব্যবসা করে। ঠিক করে আজ সেখানেই কাটাবে। আজ সবে আট তারিখ। দশ তারিখের সুবর্ণ’র একটা টিকিট নিতে হবে।

জব ছাড়ার কথাটা বলা হয়নি রিনিকে, আসলে বলার ইচ্ছাও হয়নি। ভেবেছিল ঢাকায় গিয়ে সামনে বসেই এবার কিছু একটা বলবে। তাই কিছুদিন ফ্রি থাকার প্রয়োজনেই রেজিগনেশন। এখন আর কিছুই বলার প্রয়োজন নেই, যাকে বলবে সেই মুক্তি দিয়ে ফেলেছে। অনন্য জানে রিনিকে সে কনভিন্স করতে পারবেনা।

পরিচয়ের পরে কিছুদিনের মধ্যেই সে জেনে ফেলেছে রিনি কি চায়, তার লক্ষ কতদুর, আবেগের দৌড়টাইবা কেমন। পাওয়ার আশা ছেড়েই কখন যে মনের ভুলে ভালোবেসে ফেলেছে একজনকে অনন্য বুঝতেই পারেনি। যখন বুঝেছে তখন অনেক দেরি, তার অস্তিত্বে রিনির উপস্থিতি টের পায় সে। মেনেও নিয়েছে নিয়তি, তাই ঠিক করেছে এবার জব ছেড়ে তাকে কিছুদিন সময় দিবে, তারপর খুলে বলবে নিজের কথা। তারপর... জানে এ হওয়ার নয়... তাই আর জব করবেনা।

কি প্রয়োজন টাকা পয়সার... বাবার সম্পত্তি দিয়েই তার তিন প্রজন্ম হেসেখেলে চলে যাবে। চট্টগ্রাম শহরের অভিজাত এলাকায় ১টা ৪তলা বাড়ি, ব্যাংক ডিপোজিট... ব্যস। ঢাকায় কোন আত্মীয় না থাকায় মহাখালীতে এক বন্ধুর বাসায় উঠেছে অনন্য। দুপুর বারটায় এসে পৌঁছেছে বিমানবন্দর রেল স্টেশনে। বন্ধু রাজন তাকে রিসিভ করে নিল।

লাঞ্চ সেরে একটু রেস্ট নিতে যাবে তখনি রিনির ফোন, ‘কোথায় আছ?’ ‘এইতো, লাঞ্চ করে অফিসে আসলাম। তোমার কি অবস্থা?’ ‘হুম... ভালো, সন্ধ্যায় কয়টায় ফ্রি হবা?’ ‘আমি আটটার দিকে বসুন্ধরার ফুড কোর্টে থাকব, তুমি ওখানে থেকো’। ‘নাহ, বসুন্ধরায় ভালো লাগেনা। তুমি বেইলি রোডে আস’। ‘বেইলি রোডই তো চিনিনা’।

‘তোমার অফিস কোথায়?’ ‘মতিঝিল’ ‘আচ্ছা, তুমি সিএনজি নিয়ে বেইলি রোড চলে এসে কল দিও, আমি তোমাকে ডিরেকশন দেব। ‘ ‘আচ্ছা’ বলে ফোন রেখে জম্পেশ ঘুম দেয় অনন্য। বিকেল সাড়ে পাঁচটায় রাজনের ডাকে ঘুম ভাঙ্গে তার। ‘চল দোস্ত, ঘুরে আসি একটু’ ‘কই যাবি?’ ‘আশুলিয়ায় যাব, লং ড্রাইভ’ ‘গাড়ি নিছস?’ ‘না, আমার অফিস থেকে গাড়ি আছেতো, ড্রাইভারকে ছুটি দিয়ে দিয়েছি, আমি ড্রাইভ করব। ‘ ‘ওঃ আমাকে সন্ধ্যা সাতটার সময় বেইলি রোড থাকতে হবে, নামিয়ে দিস।

‘ ‘আমার লং ড্রাইভ!!” ‘পরে’ ‘আচ্ছা... তা কি ব্যাপারে যাচ্ছিস ওখানে?’ ‘এক বন্ধুর সাথে দেখা করব, কিছু জরুরি আলাপ আছে’। ঢাকা শহরের জ্যামের গল্প দেশের অন্যান্য এলাকার লোক যারা আসেনি ঢাকায় তাদের কাছে রুপকথার মত ঠেকায়। সিগন্যাল পড়েছেতো পড়েছেই, আর ছাড়ার নামান্তর নেই। একটু সামনে এগুতেই আবার সিগন্যাল! মন মেজাজ যারপরনাই খারাপ হয়ে যাচ্ছে। সামনে চোখ রেখেই রাজন জিজ্ঞেস করে, ‘ব্যাগপত্র নিয়ে নিলি যে?’ ‘আজ চলে যাব’ ‘মানে!’ ‘হুম... তোদের এই অথর্ব শহরে থাকার সাধ মিটে গেছে আমার।

জ্যাম দেখলেই মাথা ঠিক থাকেনা। ‘ ‘সেটা না হয় মানা গেল কিন্তু তুই আজ চলে যাবি কেন! একদিনের জন্যই আসলি?’ ‘হুম... আজকের দিনটাই আমার দরকার’ ‘তোর কি হয়েছে বলতো?’ ‘কি হবে আবার! ঠিকই তো আছে সব’। ‘নাহ, দুপুর থেকে তোকে আমি মনমরা মনমরা দেখছি, কি হয়েছে?’ ‘কিচ্ছু হয়নি, জার্নির কারনে টায়ার্ড ছিলাম আর এখন জ্যামে মেজাজ খারাপ’। ‘বুঝলাম, তা আমরা সবাইতো বিয়ে শাদী করে ফেলেছি তোর কোন খবর নেই কেন?’ ‘ধীরে বন্ধু, ধীরে, আর কয়েকটা দিন সবুর কর। সবুরে মেওয়া ফলে’।

টুকিটাকি কথাবার্তায় সোয়া সাতটায় তারা এসে বেইলি রোডে ‘বুমার্স’ রেস্টুরেন্টের সামনে এসে পৌঁছায়। রিনি এই রেস্টুরেন্টের কথাই বলেছে। রাজনকে বিদায় দিয়ে অনন্য রিনিকে ফোন দেয়। ‘হাঁ, রিনি, কোথায় আছো?’ ‘চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকো, মোটেই নড়াচড়া করবেনা’। ‘মানে!’ ‘হাহাহা... আমি তোমার পিছনেই আছি’ শুনেই অনন্য পিছনে তাকিয়ে দেখে ছাই রঙ্গা একটা লিমুজিন থেকে নেমে আসছে রিনি।

সোডিয়াম বাতির আলোতে একধরণের অসাধারণ চোখ ধাঁধানো আবহ সৃষ্টি করে সে এসে সামনে দাঁড়ায়। ‘চল’। ‘ওঃ হ্যাঁ, চল’ ঘোর ভেঙ্গে তাকে ফলো করে অনন্য। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ডাইনিঙে একপাশের আসন নিয়ে বসে পড়ে ওরা। গাড় মেরুন রঙের শাড়ীতে রিনি আজ অনন্যর সামনে এক স্বর্গের অপ্সরা।

বেশিক্ষন দেখলে তার চোখের জ্যোতিঃ কেটে যাওয়ার সম্ভাবনা ফেলে দেয়া যায়না। অনন্যর অবস্থা কিছুটা হলেও আঁচ করতে পারে রিনি। তাই একটু অস্বাভাবিক বোধ করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য সেই কথা শুরু করে, ‘তোমার ব্যাগ হাতে যে!’ ‘ওঃ অফিস থেকেই আসলাম, আজ রাতেই ফিরব’। ‘বল কি! এত জার্নি সইবে?’ ‘সমস্যা নেই, নাইট কোচে যাব’। ‘হুম... বল, জব কেমন চলছে’ ‘জবের কথা বাদ দাও, নিজেদের কথা বলি, তুমিতো এখন অনেক মৌজে আছো, তাইনা?’ ‘ফাজলামি করবানা, এসব কথা বললে আমি থাকছিনা এখানে’ ‘ওঃ সরি ডিয়ার, একটা কথা বলি, আজ কিন্তু তোমাকে মারাত্নক সুইট লাগছে’।

‘ফ্লারটিং করছ কেন!!’ ‘আচ্ছা আর করলামনা, এখন বল তোমার বরের অবস্থা’। ‘বিয়ের দিনতো দেখবেই, এখন শুনে কাজ নাই’ ‘তা মেনে নিলাম, আচ্ছা রিনি, তোমার জীবন থেকে আমাকে একটা মিনিট দিতে পারবে?’ রিনির চোখে চোখ রেখে অনন্য প্রশ্ন করে। অনন্যর এমন প্রশ্নের জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলনা রিনি। তাই শুনে একটু গাবড়ে যায়। খানিক ভেবে বলে, ‘এভাবে বলছ কেন? কি বলবে খুলে বল’’।

‘রিনি, একমিনিটের জন্য তোমার চোখ দুটি বন্ধ রাখবে, ঠিক এক মিনিট পর চোখ খুলবে’। রিনির কাছে ব্যাপারটা একটু রহস্যজনক ঠেকে, তবু চোখ বন্ধ করে চাপা হাসি নিয়ে বলে, ‘দ্য টাইম স্টারটেড জাস্ট নাউ’ একমিনিট পর চোখ খুলে রিনি বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। এ কি করল অনন্য! বাম হাতের অনামিকার এনগেইজমেন্টের রিংটি খুলে একটা ডায়মন্ডের রিং পরিয়ে দিয়েছে সে। ‘অনন্য, এসব কি!’ ‘কেন? কি হয়েছে?’ রিনির চোখে চোখ রেখে ভাবলেশহীনভাবে প্রশ্ন করে অনন্য। ‘ওটা আমার এনগেইজমেন্টের রিং’ ‘সমস্যা কি! ওটা না থাকলেও তোমার বিয়ে যথারীতি হবে, কিন্তু আমার ভালোবাসার চিহ্নটা না থাকলেতো আমি হারিয়ে যাব লোকান্তরে’।

অনন্যর এহেন নিরুত্তাপ মন্তব্যে কোন থৈ খুঁজে পায়না রিনি। ইতিমধ্যে ওয়েটার দুই গ্লাস জুস রেখে গেছে। অনন্য জুসের স্ট্রতে চুমুক দেয় আর চারপাশের পরিবেশটা চোখ বুলিয়ে দেখে। সুন্দর একটা মনোরম পরিবেশ। ঝাড়বাতিগুলো উজ্জ্বল আলোয় ভরিয়ে তোলে চারপাশ।

মোটামুটি গর্জিয়াস একটা রোমান্টিক আবহ। এই ধরনের রেস্টুরেন্টে তেমন একটা যাওয়া হয়নি তার। কিছুক্ষণ এদিকওদিক তাকিয়ে বাইরে দৃষ্টি নেয়। যান্ত্রিক শহরের যান্ত্রিক শব্দ কাঁচঘেরা কক্ষে না আসলেও স্পষ্টত দেখা যায় মানুষের বিরামহীন চলাচল। রাস্তায় গাড়ির সারি, দীর্ঘ ট্র্যাফিক জ্যাম, দিন শেষে ঘরে ফিরছে ক্লান্ত মানুষ, দামিদামি গাড়ির পাশেই হেলেদুলে চলছে গরিবের অবলম্বন লোকাল বাস।

রাজধানীর ব্যস্ত জীবন, ব্যস্ত নগরবাসী, এভাবেই দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর যায়, লোকান্তরেও এভাবেই চলে জীবনযাত্রা অহর্নিশি। কখন যে দশটা বেজে যায় টেরই পায়না দুজন। রিনি এখনও চুপ করে বসে আছে, কি এত ভাবছে। অনন্যই তার নীরবতা ভাঙ্গার চেষ্টা করে, ‘রিনি’। ‘হুম...’ ‘কি এত ভাবছ! চল উঠি’ রিনি খোলা রিঙটি পার্সে নিয়ে উঠে গেইটের দিকে পা বাড়ায় ধীর পায়ে, অনন্য কাউন্টারে বিল পে করে বাইরে এসে রিনির পাশে দাঁড়ায়।

তাকে দেখে রিনি বলে, ‘আজই ফিরবে?’ ‘হুম... চল আমাকে যাত্রাবাড়ীতে ড্রপ করে দাও’ ‘চল’ রিনির মনের ধাক্কা এখনও সামলে উঠেনি, হঠাত অনন্য এটা কি করল! সে কি তাকে ভালোবেসে ফেলেছে! তবে কখনো কিছু বলেনি কেন! তাদের এই বন্ধুত্তের মাঝে তবেকি ভালোবাসাও বাসা গেড়েছে! হ্যাঁ, ভালো তো আমিও বাসি তাকে। বন্ধুর প্রতি বন্ধুর ভালোবাসা থাকতেই পারে। বিচ্ছেদে মনে কষ্টও আসতে পারে কিন্তু ও রিং নিয়ে এমন করল কেন! এসব ভাবতে ভাবতে গাড়ি এসে যাত্রাবাড়ী বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছায়। অনন্য খেয়াল করেছে রিনি খুব আপসেট হয়ে পড়েছে, তারও কিছুটা অপরাধবোধ জাগে মনে। এমনটা মনে হয় ঠিক হয়নি।

আর রিনিওতো এভাবে মুষড়ে পড়ার মত মেয়ে নয় তবে এত আপসেট কেন! যাক। ব্যাগ নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে রিনির জানালার পাশে এসে দাঁড়িয়ে রিনিকে গ্লাস নামাতে ইশারা করে। রিনি গ্লাস নামিয়ে তার দিকে কাঁপা কাঁপা দৃষ্টিতে তাকায়। অনন্য বলে, ‘রিনি, আল্লাহ হাফেজ। আর দেখা হবেনা, মন চাইলে যোগাযোগ করো, না চাইলে না, আমার কথা ভেবোনা, যা হওয়ার হবে, জব ছেড়ে দিয়েছি, পৃথিবীতে আমার আর কিছু চাওয়ার নেই।

ভালো থেকো’ বলে অনন্য পাশ ফিরে পা বাড়াতেই রিনি ডাক দেয়, ‘অনন্য’। ‘বল’ ফিরে এসে গাড়ির গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বলে অনন্য। ‘তুমি আমায় ভালবাসতে?’ অশ্রুজড়িত কণ্ঠে রিনি প্রশ্ন করে। হঠাত অনন্য হেসে উঠে বলে, ‘বাসতে কেন প্রিয়! অনন্য তোমায় ভালোবাসে, বাসবে। ‘ মনের অজান্তে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে ওর।

‘তবে কখনো বলনি কেন?’ ‘বললে কি হত! আর দশটা ছেলের ভাগ্য বরণ করতে হত’। অনন্য ভুল বলেনি, কৈশর থেকেই রিনি হাজার হাজার প্রপোজাল এড়িয়ে চলেছে শুধু নিজের লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য। এসব কখনোই তার ভালো লাগেনি। আর অনন্য? জীবনে একজনকেই ভালবেসেছে, কারন সে এখানেই খুঁজে পেয়েছে তার স্বপ্ন, আস্থা আর ভালোবাসা। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, আজ তাকে মুক্ত করে দিয়ে ভালোবাসা হাওয়ায় ভাসতে চলেছে।

‘অনন্য’ ‘বল’ ‘একটিবারও পারলেনা নিজের কথাটা বলতে!’ ‘রিনি, যাকে ভালবাসি তার জীবনের সুখই আমার প্রত্যাশা, আজকের এই দিনটাই আমার জীবনের পাওয়া সেরা দিন। এই দিনটিকে পুঁজি করেই হয়ত আমার ভবিষ্যৎ কেটে যাবে। সুখে থেকো রিনি, মনে রেখ একজন তোমায় ভালবাসবে সারাজীবন, কিছু পাওয়ার আশা না রেখেই। একটা কথা জেনে রেখো, তোমার স্বপ্ন পুরনে আমি বাঁধা হয়ে দাঁড়াইনি, এটাই আমার ভালোবাসার পরম প্রাপ্তি। ভালো থেকো’।

অনন্য চোখের জল ধরে রাখতে না পেরে ফিরে চলে কাউন্টারের দিকে, রিনি এক পলকে তাকিয়ে থাকে সেই পথের দিকে। অদৃষ্টে বেজে উঠে- আমি নীড় হারা এক ফেরারি, সুখের খোঁজে হাতড়ে বেড়াই, দুঃখ এসে তাই হাতটা বাড়ায়... অটঃ 'নীড় হারা এক ফেরারি' গানটি ৭-৮ বছর আগে শোনা, এই লাইন কটি মনে আছে। কথাগুলো ঠিক নাও হতে পারে। লেখার মত কঠিন কাজ কি আছে আমার জানা নেই, গল্পটি লিখতে গিয়ে টের পেলাম বানিয়ে বানিয়ে গল্প লেখা আমার কর্ম নয়। এই গল্পটা সম্পূর্ণ লাইনের পর লাইন অনেক মাথা খাটিয়ে লিখলাম।

কারো ভালো না লাগলে ক্ষমা প্রার্থী। উৎসর্গঃ আমার প্রিয় মানুষকে। ছবি সুত্র : গুগল

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।