আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে শেয়ারের অতিমূল্যায়ন যাঁরা সমালোচক, আড়ালে তাঁরাই দাম বাড়িয়েছেন



বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে শেয়ারের অতিমূল্যায়ন যাঁরা সমালোচক, আড়ালে তাঁরাই দাম বাড়িয়েছেন হাসান ইমাম | তারিখ: ২০-০৩-২০১১ Click This Link বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে প্রাথমিক শেয়ারের অতিমূল্যায়নের দায় এড়াতে পারেন না দুই স্টক এক্সচেঞ্জের ব্রোকার-ডিলারসহ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা। এ পদ্ধতিতে বাজারে শেয়ার ছাড়ার জন্য সর্বশেষ অনুমোদন পাওয়া দুটি কোম্পানির প্রকাশিত বিবরণপত্র বা প্রসপেক্টাস পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দুই স্টক এক্সচেঞ্জের অনেক নেতৃত্বস্থানীয় সদস্য শেয়ারের নির্দেশক মূল্যের কম দরপ্রস্তাব করার সুযোগ থাকলেও শেয়ার পেতে তাঁরা সর্বোচ্চ দর হেঁকেছেন। আর কোম্পানি দুটি হলো, এমজেএল বাংলাদেশ লিমিটেড ও এমআই সিমেন্ট ফ্যাক্টরি লিমিটেড। অথচ স্টক এক্সচেঞ্জ দুটির তালিকাভুক্তিকরণ-বিষয়ক উপকমিটির পর্যবেক্ষণে কোম্পানি দুটির শেয়ারের নির্দেশক মূল্যকে অতিমূল্যায়িত বলে অভিমত দেওয়া হয়েছিল। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসি কোনো কোম্পানিকে বাজার থেকে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহের অনুমোদন দেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে দুই স্টক এক্সচেঞ্জের পর্যবেক্ষণ নিয়ে থাকে।

এর অংশ হিসেবে কোম্পানি দুটি অনুমোদন পাওয়ার আগে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) এবং চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) কর্তৃপক্ষ পৃথক পর্যবেক্ষণ দেয় এসইসিকে। এমজেএল বাংলাদেশ লিমিটেডের ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের শেয়ারের বিপরীতে নির্দেশক মূল্য প্রস্তাব করা হয়েছিল ১২৭ টাকা এবং এমআই সিমেন্টের নির্দেশক মূল্য প্রস্তাব করা হয় ৯১ টাকা। এমআই সিমেন্টের খসড়া বিবরণীপত্র বিশ্লেষণ করে ডিএসই তালিকাভুক্তিকরণ কমিটি বলেছিল, প্রস্তাবিত এ নির্দেশকমূল্য অনেক বেশি। কমিটির পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ৩০ জুন ২০১০ পর্যন্ত ডিএসইর গড় বাজার পিই (মূল্য-আয় অনুপাত) ২৪ দশমিক ৬২। আর ৩১ ডিসেম্বর ২০০৯ সমাপ্ত বছরে কোম্পানির শেয়ারসংখ্যা বাড়ার পর শেয়ারপ্রতি আয় বা ডায়লুটেড ইপিএস ছিল এক টাকা ৫৯ পয়সা।

এ বিবেচনায় কোম্পানিটির শেয়ারে আনুমানিক দাম আসে ৩৯ টাকা ১৪ পয়সা। কমিটির পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, বাজারে তালিকাভুক্ত সিমেন্ট খাতের নেতৃস্থানীয় কোম্পানিগুলোর গড় পিই ১৪ দশমিক ৭২। এ বিবেচনায় এমআই সিমেন্টের আনুমানিক মূল্য হতে পারে ২৩ টাকা ৪০ পয়সা। নির্দেশক মূল্য এ পরিসরে (২৩ টাকা ৪০ পয়সা থেকে ৩৯ টাকা ১৪ পয়সার মধ্যে) নামিয়ে আনলে কোম্পানিটির শেয়ার আইপিওর জন্য বিবেচনা করা যেতে পারে। প্রায় একই ধরনের পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছিল এমজেএল বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও।

তবে এ কোম্পানির ক্ষেত্রে বলা হয়েছিল, নির্দেশক মূল্য বেশি হলেও অন্যান্য আর্থিক বিষয় বিবেচনা করে আইপিওর অনুমোদনের বিষয়টি ভাবা যেতে পারে। এ ধরনের পর্যবেক্ষণ দেওয়ার পরও দুই স্টক এক্সচেঞ্জের তালিকাভুক্তিকরণ-বিষয়ক উপকমিটির বেশির ভাগ সদস্যই চূড়ান্ত দরপত্রের সময় নির্দেশক মূল্যের চেয়ে ২০ শতাংশ বেশি দাম প্রস্তাব করেন শেয়ারটি কেনার জন্য। এ তালিকায় ডিএসইর তালিকাভুক্তিকরণ কমিটির আহ্বায়ক এন ইউ এম ওলিউল্লাহও বাদ ছিলেন না। বাদ যাননি সিএসইর তালিকাভুক্তিকরণ কমিটির নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরাও। এর বাইরে দুই স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদেরও একটি বড় অংশ দরপত্রে অংশ নিয়েছে।

এর মধ্যে ছিল ডিএসইর সভাপতি শাকিল রিজভী, জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আহসানুল ইসলাম, সহসভাপতি মো. শাহজাহান, সাবেক জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি নাসির উদ্দিন চৌধুরী, সহসভাপতি রফিকুল ইসলাম, সাবেক সভাপতি রকিবুর রহমান, আহমেদ ইকবাল হাসানের প্রতিষ্ঠানও। আর সিএসইর সভাপতি ফখরউদ্দিন আলী আহমেদসহ নির্বাচিত পরিচালকদের বেশির ভাগের প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশ নেয়। এদের অনেকে দুই কোম্পানিরই, আবার কেউ কেউ কেবল একটি কোম্পানির শেয়ার কিনেছে। এমজেএল বাংলাদেশের প্রসপেক্টাস বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দরপত্রের মাধ্যমে এ কোম্পানির শেয়ার কিনেছে মোট ২৩১টি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে ১৫০টি প্রতিষ্ঠান ডিএসই ও সিএসইর ব্রোকার-ডিলার।

এসব প্রতিষ্ঠান সম্মিলিতভাবে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের জন্য বরাদ্দকৃত শেয়ারের ৬৭ শতাংশ নিয়েছে। বাকি ৩৩ শতাংশ কিনেছে ব্যাংক, বিমা ও অব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ এসইসি অনুমোদিত বিভিন্ন কোম্পানি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএসইর একজন সদস্য বলেন, ডিলার হিসেবে অন্য কারও পক্ষ হয়ে শেয়ার কেনা যায় না। আইনে সেই সুযোগ নেই। তার মানে, ব্রোকাররা নিজেদের জন্য শেয়ারগুলো কিনেছেন।

অতিমূল্যায়িত শেয়ার নিজেরা বেশি দাম দিয়ে কিনবেন আর পদ্ধতির সমালোচনা করবেন, এটি স্ববিরোধিতা। অন্য একটি সূত্র জানিয়েছে, অনেক ব্রোকার আবার ডিলার হিসেবে গ্রাহকের টাকায় শেয়ার কিনেছেন। এ দুটি কোম্পানির শেয়ার কেনার জন্য ডিলার হিসেবে টাকা এসেছে কোথা থেকে, সেটি তদন্ত করলেই তা বেরিয়ে আসবে। বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে বিভিন্ন মনোনীত প্রতিষ্ঠানের প্রাথমিক দরপ্রস্তাবের ভিত্তিতে শেয়ারের একটি নির্দেশক মূল্য নির্ধারণ করা হয়। পরে এ নির্দেশক মূল্যকে ভিত্তি ধরে চূড়ান্ত দরপত্রের মাধ্যমে আইপিওর জন্য শেয়ার প্রস্তাবিত মূল্য ঠিক করা হয়ে থাকে।

চূড়ান্ত দরপত্রের সময় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা নির্দেশক মূল্যের চেয়ে ২০ শতাংশ কম বা বেশি দাম প্রস্তাব করতে পারেন। এ হিসেবে দরপত্রে অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এমআই সিমেন্টের শেয়ারের জন্য সর্বনিম্ন ৭৪ টাকা ৪০ পয়সা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ১১১ টাকা ৬০ পয়সা দরপ্রস্তাব করতে পারত। আর এমজেএল বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দর প্রস্তাব করা যেত সর্বনিম্ন ১০১ টাকা ৬০ পয়সা থেকে সর্বোচ্চ ১৫২ টাকা ৪০ পয়সার মধ্যে। কিন্তু ডিএসই ও সিএসইর তালিকাভুক্তিকরণ কমিটি বা পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের মধ্যে যাঁরা শেয়ারগুলো কিনেছেন, তাঁদের কেউ সর্বনিম্ন দর প্রস্তাব করেননি। অথচ প্রতিষ্ঠানগুলো এই দামে কেনার আগ্রহ না দেখালে কোম্পানি মূল্য সংশোধন করতে বাধ্য হতো।

এমজেএল বাংলাদেশ মোট চার কোটি শেয়ার বাজারে ছেড়েছে। প্রতিটি শেয়ার ১৫২ টাকা ৪০ পয়সা হিসাবে তারা বাজার থেকে প্রায় ৬০৯ টাকা সংগ্রহ করেছে। অন্যদিকে এমআই সিমেন্ট তিন কোটি শেয়ার বাজারে ছেড়ে সংগ্রহ করেছে ৩৩৪ কোটি টাকার বেশি। শাকিল রিজভীর সঙ্গে ডিএসইতে তাঁর নিজ কার্যালয়ে ৮ মার্চ এ প্রতিবেদকের কথা হয়। এ সময় রফিকুল ইসলামও উপস্থিত ছিলেন।

তাঁদের কাছে প্রশ্ন ছিল, ডিএসইর তালিকাভুক্তিকরণ কমিটি যেখানে শেয়ার দুটিকে অতিমূল্যায়িত বলে আখ্যা দিয়েছে, তখন আপনারা কেন তা আরও বেশি দামে কিনলেন। এর জবাবে শাকিল রিজভী দাবি করেন, আইনের দুর্বলতার কারণেই এমনটি হয়েছে। আইনে যদি সর্বোচ্চ সীমা দেওয়া না থাকত তাহলে হয়তো কেউ সর্বোচ্চ দাম প্রস্তাব করত না। কিন্তু সর্বনিম্ন দাম প্রস্তাব করারও সুযোগ ছিল—এর জবাবে তিনি বলেন, সবাই ব্যবসা করতে এসেছে। সর্বনিম্ন দাম প্রস্তাব করলে তো শেয়ার পাওয়া যেত না।

এটা তো অপরিহার্য পণ্য নয় যে আপনি বেশি দাম দিয়ে কিনতে না পারলে অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে—এ প্রশ্ন করলে শাকিল রিজভী বলেন, একটি নতুন নিয়ম যখন আসে সবারই কিছু ভুলভ্রান্তি হয়। আইনেরও ভুলভ্রান্তি রয়েছে। আগে কী হয়েছে সেটা নিয়ে আলোচনা না করে সবার উচিত আইনটি কীভাবে আরও স্বচ্ছ করা যায়, সে ব্যাপারে কাজ করা। তবে রফিকুল ইসলাম বলেন, তাঁর প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বরত কর্মকর্তারা এটি করেছেন। পরে এ ব্যাপারে তিনি তাঁদের কাছে জানতে চান কেন এত দাম দিয়ে শেয়ারগুলো কেনা হলো।

যোগাযোগ করা হলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ও এসইসির সাবেক চেয়ারম্যান এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি জনসমক্ষে এক ধরনের মতামত দেব ও নিজে কার্যক্ষেত্রে অন্য কাজ করব—এ রকম হওয়া উচিত নয়। এটি একটি অনৈতিক কাজ। এ জন্যই তো এ দেশে কোনো আইন ঠিকমতো কাজ করে না। ’ তিনি বলেন, ‘আমার সন্দেহ, তারা জেনেশুনে নিজের পয়সায় এটা করেনি। গ্রাহকের হয়ে শেয়ারগুলো কিনেছে।

যদি তা-ই হয়ে থাকে তাহলে সেটাও আইনের একটা লঙ্ঘন। ’ এর আগে গত ২০ জানুয়ারি তীব্র সমালোচনার মুখে প্রাথমিক শেয়ারের মূল্য নির্ধারণের বুক বিল্ডিং পদ্ধতি স্থগিত করে সরকার। একই দিন কোম্পানি দুটির তালিকাভুক্তির প্রক্রিয়া স্থগিত করে। পরে শর্ত সাপেক্ষে তালিকাভুক্তির অনুমোদন দেওয়া হয়। একই সঙ্গে বুক বিল্ডিং পদ্ধতি সংশোধনের দায়িত্ব দেওয়া হয় এসইসিকে।

এরই মধ্যে আইনটির সংশোধনীর সুপারিশের খসড়া অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে জমা দিয়েছে সংস্থাটি।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।