আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

Part-6==Genocide======[[1971]]======Genocide==Part-6

The truth is, everyone is going to hurt you. You just got to find the ones worth suffering for

হত্যা আর অগ্নিকাণ্ড: তাদের শাস্তির নমুনা পৃথিবীর অন্যতম জনবহুল অঞ্চল কুমিল্লার জনসংখ্যার ঘনত্ব হলো প্রতি বর্গমাইল ১,৯০০ জন। অথচ কোথাও কোনো মানুষ দেখা গেলো না। ”বাঙালিরা কোথায়?” কিছুদিন আগে ঢাকার রাস্তাঘাট একেবারে নির্জন দেখে সেনাদলের লোকদের আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম। ওদের তৈরী করা উত্তর ছিলো, “সবাই গ্রামে গেছে। ” অথচ গ্রামেও কোনো বাঙালি দেখা যাচ্ছিল না।

ঢাকার মতো কুমিল্লাও একেবারে জনশূন্য। লাকসাম দিয়ে আসার সময় দশ মাইল পথে হাতে গোনা কয়েকজন কৃষককে দেখলাম। অবশ্য খাকি-পোশাক-পরা পাকসেনারা গম্ভীর মুখে অটোমেটিক রাইফেল হাতে রাস্তায় অবস্থান করছিল। আদেশমাফিক রাইফেল হাতছাড়া করেনি কেউ। ট্রিগার-সুখী কঠিন লোকজন সবসময় রাস্তা পাহারা দিচ্ছে।

যেখানে পাকসেনা, সেখানে কোনো বাঙালিকে পাওয়া যাবে না। রেডিও এবং খবরের কাগজে সামরিক আইন ঘোষণা করা হচ্ছে মুহূর্মুহু — চোরাগোপ্তা হামলার জন্য ধরা পড়লে শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। রাস্তা বা ব্রিজ ধ্বংস বা খোঁড়ার চেষ্টা করলে ক্ষতিগ্রস্থ অঞ্চলের একশ গজের ভেতর সমস্ত বাড়িকে এর জন্য দায়ী করা হবে এবং সেগুলোর ধ্বংসসাধন করা হবে। কার্যক্ষেত্রে ঘোষণাগুলোর চাইতে ভয়াবহ সব পদক্ষেপে নেয়া হয়েছে। ‘শাস্তিমূলক ব্যবস্থা’ এমন একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে যে বাঙালিরা বেপরোয়া ও সহিংস হতে বাধ্য হয়েছে।

এর যে কী ভয়াবহ অর্থ তা দেখেছি ১৭ এপ্রিল চাঁদপুর যাওয়ার পথে হাজীগঞ্জে। বিদ্রোহীরা, যারা এখনো এ-অঞ্চলে তৎপর, গত রাতে ১৫ ফুট দীর্ঘ একটা ব্রিজ ভেঙে ফেলেছে। মেজর রাঠোরের (জি-২ অপারেশনস্) মাধ্যমে জানা গেলো, তৎক্ষণাৎ এই এলাকায় একদল সেনাদল পাঠিয়ে দেয়া হলো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য। ব্রিজের সিকি মাইলব্যাপী অঞ্চলে পেঁচিয়ে ওঠা ঘন ধোঁয়া দেখা যাচ্ছিল তখনও। সাময়িকভাবে কাঠের তক্তা দিয়ে সারানো ব্রিজটি সাবধানে পার হওয়ার সময় দেখলাম ডানদিকের গ্রাম্য বাড়িগুলোতেও আগুন লকলকিয়ে উঠছে।

গ্রামের পেছন দিকে কিছু জওয়ান আগুন ছড়ানোর চেষ্টা করছিল নারকেলের ছোবড়া দিয়ে। এগুলো কাজও দিচ্ছিল ভালো। কারণ সাধারণত রান্নার কাজে এগুলো ব্যবহার করা হয়। পথের অন্যদিকে ধানক্ষেতের ওপারের গ্রামেও আগুনের চিহ্ন দেখা গেল। বাঁশঝাড় আর কুঁড়েঘরগুলো তখনও পুড়ছিল।

শত শত গ্রামবাসী পাকসেনা আসার আগের রাতেই পালিয়ে গেছে। যাওয়ার সময় মেজর রাঠোর বললেন, ”এই দুর্দশাকে তারা নিজেরাই ডেকে এনেছে। ” আমি বললাম, “সামান্য কিছু বিদ্রোহীর জন্য নিরপরাধ লোকদের ওপর এটা বড় বেশি নির্মমতা হয়ে গেছে। ” তিনি কোনো উত্তর দিলেন না। কয়েকঘণ্টা পরেই চাঁদপুর থেকে ফেরার সময় আমরা আবার হাজীগঞ্জ দিয়ে আসছিলাম।

‘হত্যা আর অগ্নিকাণ্ড অভিযান’-এর বর্বরতা আমি স্বচক্ষে দেখলাম তখন। দুপুরবেলা সে-এলাকার ওপর দিয়ে বেশ কড়া ঝড় বয়ে গেছে। এখন শহরের ওপর পড়েছে মসজিদের মিনারের ভৌতিক ছায়া। পেছনের খোলা জিপে ক্যাপ্টেন আজহার আর চারজন জওয়ানের ইউনিফর্ম গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে চুপসানো। বাঁক নিতেই মসজিদের বাইরে আমরা ট্রাকের একটা বহর থেমে থাকতে দেখলাম।

গুনে দেখলাম জওয়ান-ভর্তি সাতটা ট্রাক। বহরটির সামনে ছিল একটা জিপ। দু’জন লোক তৃতীয় একজনের নেতৃত্বে পথের পাশে একশোরও বেশি দোকানের বন্ধ দরজা ভাঙার চেষ্টা করছে। দু’টো কুঠার দিয়ে এই ভাঙার চেষ্টা চলছিল, মেজর রাঠোর তার টয়োটা সেখানে থামালেন। “তোমরা এখানে কী করছ?” তিনজনের মধ্যে লম্বা লোকটা, যে ভাংচুরের তত্ত্বাবধান করছিল, আমাদের দিকে চেঁচিয়ে উঠল, “মোটু, আমরা কী করছি বলে তোমার মনে হয়?” কণ্ঠস্বর চিনতে পেরে, মেজর রাঠোর মিষ্টি একটা হাসি দিলেন।

আমাকে জানালেন তিনি হলেন তার পুরনো দোস্ত ইফতি — টুয়েলভথ ফ্রন্ট্রিয়ার্স ফোর্স রাইফেলের মেজর ইফতিখার। রাঠোর বললেন, “আমি ভেবেছিলাম কেউ লুট করছে। ” “লুট? না না। ” জবাব দিল ইফতিখার, “আমরা শুধু খুন করছি আর আগুন জ্বালাচ্ছি। ” হাত নাড়িয়ে তিনি বোঝালেন যে এসব তিনি ধ্বংস করবেন।

“ক’জনকে ধরতে পেরেছ?” রাঠোর জিজ্ঞেস করলেন। ইফতিখার ভ্রূঁ নাচিয়ে হাসলেন। “বল। ” রাঠোর আবার জিজ্ঞেস করলেন। “ক’জনকে ধরেছ?” “মাত্র বারোজন।

” তিনি জবাব দিলেন, “আল্লাহর রহমতে আমরা ওদের পেয়েছি। লোকদের ধাওয়া করার জন্য না পাঠালে তো ওরা পালিয়েই যেত। ” মেজর রাঠোরের উৎসাহে ইফতিখার তার ঘটনার বর্ণনা শুরু করলেন বিস্তৃতভাবে। কীভাবে হাজীগঞ্জে ব্যাপক অন্বেষণের পর একটা বাড়িতে লুকিয়ে থাকা বারোজন হিন্দুকে তিনি খুঁজে পেয়েছেন তা রসিয়ে বললেন। তাদের সবাইকে ‘নিকাশ করে দেয়া হয়েছে।

’ এখন মেজর ইফতেখার এখন ব্যস্ত তার দ্বিতীয় অভিযানে, অগ্নিকাণ্ডে। ইতোমধ্যে একটি দোকানের দরজা ভেঙে ফেলা হয়েছে। বাংলায় দোকানটিতে লেখা আছে ‘মেডিকেল এন্ড স্টোরস’। বাংলা লেখার নিচে সেই সাইনবোর্ডে ইংরেজিতে লেখা আছে ‘অশোক মেডিকেল এন্ড স্টোরস’। তার নিচে লেখা ছিল ‘প্রোপাইটর এ এম বোস”।

তালা মেরে অন্যান্যদের মতো জনাব বোসও হাজীগঞ্জ থেকে পালিয়েছেন। দোকানের সামনে ছিল একটা প্রদর্শন কক্ষ। ওষুধ, কফ সিরাপ, ম্যাঙ্গো স্কোয়াসের বোতল, ইমিটেশনের অলঙ্কার, রঙিন পোশাকের প্যাকেট ইত্যাদি অনেক কিছু ওতে সাজানো ছিল। ইফতিখার লাথি মেরে সব ভাঙ্গতে লাগলেন। তিনি কিছু চটের ব্যাগ নিলেন।

অন্য একটি তাক থেকে নিল কিছু প্লাস্টিকের খেলনা আর রুমালের বাণ্ডিল। তারপর মেঝেতে সব জড়ো করে টয়োটায় বসা এক জওয়ানের কাছ থেকে দেশলাই নিয়ে এলেন। ওই জওয়ানের মাথায় বুদ্ধিসুদ্ধি ভালোই ছিল। সে গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে নেমে দৌড় দিয়ে দোকানে ঢুকে একটা ছাতা বের করে আনল। ইফতিখার তাকে বেরিয়ে যাওয়ার আদেশ করলেন।

লুট করা, তিনি মনে করিয়ে দিলেন, নিয়মবিরুদ্ধ। এরপর দ্রুত আগুন ধরিয়ে দিলেন ইফতিখার। চটের জ্বলন্ত স্তূপ তিনি ছুঁড়ে দিলেন দোকানের এক কোণে, অন্য কোণে কাপড়ের বাণ্ডিল। মুহূর্তেই দোকানটি দাউদাউ করে জ্বলে উঠল। মিনিটখানেকর মধ্যেই একটি দোকান পরে তেলের দোকানে আগুন পৌঁছলে বন্ধ শাটারের পেছনে আগুনের আওয়াজ শোনা গেল।

এ-সময়ে ঘনায়মান অন্ধকার দেখে রাঠোর উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। আবার আমাদের যাত্রা শুরু হল। পরদিন দেখা হতেই মেজর ইফতিখার আমাকে বললেন, “আমি মাত্র ষাটটা ঘর জ্বালিয়েছি। বৃষ্টি না এলে সবগুলোই শেষ করে করে ফেলতাম। ” মুজাফফরগঞ্জের কয়েক মাইল দূরে এক গ্রামে আমাদের থামানো হলো।

দেখা গেল একজন মাটির দেয়ালের সঙ্গে কুঁকড়ে রয়েছে। এক জওয়ান সর্তক করে দিল যে সে ফৌজি হতে পারে। কিন্ত কিছুক্ষণ সর্তক নিরীক্ষণের পর বোঝা গেলো, সে একটি মিষ্টি হিন্দু মেয়ে। আর খোদাই জানে কার জন্য মেয়েটি নিরবে অপেক্ষা করছিল। এক জওয়ান দশ বছর ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলে কাজ করার সুবাদে কিছু বাজারী বাংলা রপ্ত করেছিলো।

সে মেয়েটিকে গ্রামে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিলো। ওখানে বসে থেকেই মেয়েটি কী যেন বিড়বিড় করল। তখন তাকে দ্বিতীয়বার নির্দেশ দেয়া হল। তবু চলে আসার পরও সে ওখানেই বসে রইল। আমাকে জানানো হল, “মেয়েটির যাওয়ার জায়গা নেই — না আছে পরিবার না আছে ঘর।

” হত্যা ও অগ্নিকাণ্ড অভিযানের অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে মেজর ইফতিখারও একজন। বিদ্রোহীদের খুঁজে বের করার নামে হিন্দু ও ‘দুষ্কৃতিকারীদের’ (বিপ্লবীদের অফিসিয়াল পরিভাষা) অবাধে খুন করার এবং আশপাশের সবকিছু জ্বালিয়ে দেবার অনুমতি তারা পেয়েছে। এই টিঙটিঙে পাঞ্জাবী অফিসারটি নিজের কাজ নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করেন। কুমিল্লার সার্কিট হাউজে ইফতিখারের সঙ্গে যাবার সময় তিনি তার সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডের ফিরিস্তি দিলেন। “আমি এক বুড়োকে পেয়েছিলাম”, তিনি বললেন।

“হারামজাদার দাড়ি ছিলো, আর ভান করছিলো পাক্কা মুসলমানের মতো। এমনকি নিজের নাম বলল আব্দুল মান্নান। কিন্তু মেডিক্যাল ইন্সপেকশনে পাঠাতেই ওর খেল খতম হয়ে গেল। ” ইফতিখার বলে যাচ্ছিলেন, “আমি তাকে তক্ষুণি সেখানে শেষ করে ফেলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার লোকেরা বললো — এরকম জারজের জন্যে তিনটা গুলি দরকার।

তাই আমি তাকে একটা গুলি করলাম গোপনাঙ্গে, একটা পেটে। তারপর মাথায় গুলি করে তাকে খতম করে দিলাম। ” আমি যখন চলে আসি তখন তাকে নেতৃত্ব-ক্ষমতা প্রদান করে উত্তর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পাঠানো হয়েছে। আবারো তার অভিযান হত্যা আর অগ্নিকাণ্ড। আতঙ্কে মুহ্যমান হয়ে বাঙালিদের দুটো প্রতিক্রিয়া হয়।

যারা পালাতে পারে তারা সঙ্গে সঙ্গে অন্তর্হিত হয়। পাকসেনার উপস্থিতিতে যারা পালাতে পারে না তারা বশ্য ক্রীতদাসের মতো আচরণ করে — যা তাদের কপালে দুর্ভোগ ছাড়া অন্য কিছুই বয়ে আনে না। চাঁদপুর ছিল প্রথমটির উদাহরণ। মেঘনা নদীবন্দর সংলগ্ন এই অঞ্চল আগে ব্যবসা-কেন্দ্র হিসেবে খুবই বিখ্যাত ছিল। রাত্রিবেলা নদীর পাড়ে ভেড়ানো হাজারো নৌকা আলোয় আলোয় এক রূপকথার রাজ্য বানিয়ে ফেলে।

চাঁদপুর জনমানবহীন হয়ে পড়ে ১৮ই এপ্রিলে। না ছিল মানুষ, না কোনো নৌকা। বড়জোর এক শতাংশ মানুষ সেখানে ছিল। বাদবাকিরা, বিশেষ করে মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধাংশ হিন্দুরা, পালিয়ে গিয়েছিল। ওরা পালিয়ে গেলেও বাড়িতে, দোকানে, ছাদে হাজার হাজার পাকিস্তানী পাতাকা উড়ছিল।

মনে হচ্ছিল জনমানুষ ছাড়াই জাতীয় দিবস উদযাপিত হচ্ছে। হিংস্র দৃষ্টি থেকে বাঁচবার জন্যেই ছিল এই ব্যবস্থা। এই পতাকা ছিল তাদের আত্মরক্ষার উপায়। কীভাবে যেন তারা জেনেছে পাকিস্তানী পতাকা ওড়ালে পাকসেনাদের হিংস্র ও নির্মম ধংসাত্মক তৎপরতা থেকে রক্ষা পওয়া যাবে। পতাকা কীভাবে বানানো হচ্ছে সেদিকে কোনো খেয়াল রাখা হয়নি, কোনো রকমে একটা চাঁদতারা থাকলেই যথেষ্ট।

ওগুলোর রঙ, কাঠামো গড়ন তাই হয়েছে বিচিত্র। সবুজের জায়গায় কোনোটার জমি নীল। তারা যে বাংলাদেশী পতাকার মালমশলা দিয়ে এই পতাকা বানিয়েছে এটা নিশ্চিত। সবুজের জায়গায় সর্বত্র দেখা গেছে নীল পতাকা। চাঁদপুরের মতো একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে হাজীগঞ্জ, মুজাফফরগঞ্জ, কসবা আর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়।

কিন্তু পতাকা উড়েছে — ভৌতিক পতাকা।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।