আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

" ভ্রমণ বাংলাদেশের "- প্রথম ঢাকা-সেন্টর্মাটিন নৌকা ভ্রমণ কাহিনী-২০০৮



লেখক- জামান রাহাত খান এডিট- রবিউল হাসান খান মনা (কিছু বানান ভূল থাকতে পারে ক্ষমাসুন্দর ভাবে দেখবেন ) বাংলার সিন্দবাদের দিনপঞ্জী গত কোরবানির ঈদের পর কোথায় যাওয়া যায় এতা নিয়ে গবেষনা চলছিল। ঠিক হল সুন্দরবন। মোটামুটি সব যখন ঠিক তখন খবর এলো এবার সম্ভব নয়। এর মাঝেই খবর পেলাম সেন্ট মারটিন এর রেসকিউ স্কুবা ডাইভিং এর মালিক মজিব একটা নৌকা কিনেছে। টুটু ভাই কে অনুরোধ করেছে টা সেন্ট মারটিন পৌছে দিতে সাহায্য করার জন্য।

টুটু ভাই এই শুনে " ভ্রমণ বাংলাদেশের " একটা ট্রিপ প্লান ও করে ফেলেছে। জিজাসা করলেন আমি যাব কিনা ? আশ্চর্যতো এটা কোন কথা। আগেরবারে গল্প শুনে আপশোস করছি তখন কেন " ভ্রমন বাংলাদেশের " সাথে পরিচয় হয়নি। এমন সু্যোগ জীবনে কখনো আবার আসবে নাকি। কবে এ ধরনের একটা ট্রিপ দিব এই স্বপ্ন অনেক দিনের ।

এই সুযোগ নস্ট করার কি মানে? সুতরাং জানালাম যাচ্ছি। নৌকায় সেন্ট মারটিন যাওয়া মুখের কথা নয়। নদী-সাগর পারি দিয়ে পৌছাব স্বপ্নের ঠিকানায়। না হয় কাটালাম কিছুদিনের জন্য নাবিক জীবন। হলাম না হয় বাংলাম সিন্দবাদ।

প্রথমে ১২ই ডিসেম্বর, পিছাতে পিছাতে তা গিয়ে ঠেকলো ১৯ তারিখে। আমাদের বাহনের প্রথম দর্শন পেলাম ১৮ তারিখে। এত দিন কল্পনায় দেখতাম নৌকার চেহারা। বাস্তবে দেখে একটু ধাক্কাই খেলাম । ভয়ও পেলাম একটু।

এত ছোট নৌকা আশা করিনি তার উপর সাতার জানিনা। আমাদের নৌকা মাত্র ২০ ফিট লম্বায়| কিন্তু কি আর করার, এখন না বলার কোন উপায় নেই। মান সম্মানের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াবে । ১৮ তারিখ পুরো দিনটাই কাটলো আমাদের সাপ্লাই (মাল পত্র) নৌকায় তুলতে। টুটু ভাই মনে হয় কিছুই কেনা বাদ রাখে নাই।

সন্ধ্যার পরে ছাড়া পেলাম টুটু ভাইয়ের পাল্লা থেকে। নির্দেশ কালকে সকাল ছয়টায় থাকতে হবে ঘাটে। প্রথম দিনঃ ১৯/১২/২০০৮ সকাল বেলায় বাবু ভাইকে সঙ্গে নিয়ে হাজির হলাম ঘাটে 6: 30 টার সময়|শরীফ আগেই পৌছে গিয়েছিল। একে একে টুটুভাই, খোকন ভাই, আনোয়ার ভাই এসে পৌছালেন । দেখা নেই রিমন ভাই ও মুজিব ভাইএর ।

এক সময় এসে পরল তারাও। কিন্তু ততখনে ১০টা বেজে গেছে। আমাদের বিদায় দিতে হাজির হলেন রুমণ ভাই, আফতাব ভাই, রুমা আপা, সম্পা আপা,সালমা আপা, সনি ভাই,লোদি,,মাহাবুব, আপেল ভাই । সবার জন্য অপেক্ষা , কুয়াশা কাটা সব মিলিয়ে দেরি হয়ে গেলো। ১০.৩০ টায় শুরু হলো আমাদের মাঝি দিন ইসলাম ও তার সহযোগি রফিক সহ ১০জনকে নিয়ে ভেসে পরল আমাদের নৌকা।

কুয়াশা তখনো কাটেনি। গন্তব্য নারিকেল জিঞ্জিরা। সময় কত লাগবে কেও নির্দিষ্ট করে জানে না | একে একে পার হয়ে গেলাম পোস্তগোলা ব্রিজ, মেরি এন্ডারসন। ১২। ৪৫ নাগাদ ফতুল্লা পৌছালাম ।

ফতুল্লায় থামা হয় তেলের জন্য। এই সুযগে ২-৩ জনকে নামিয়ে দেয়া হয় পানি আনতে, কারন এত দূরে এসেও নদীর পানি এখন ব্যবহার যোগ্য নয় | কাল কুচকুচে-দুর্গন্ধ যুক্ত পানি এখন পর্যন্ত আমাদের অনুসরণ করছে যাত্রার শুরু থেকে। আমরা যে নদীকেও মেরে ফেলতে পারি তার উদাহরন পেলাম হাতে নাতে। আমরা সবাই চুপচাপ বসে চারপাশ দেখছি আর মাঝে মাঝে ছবি তুলছি আমি আর শরীফ। টুটু ভাই আনোয়ার ভাই কে নিয়ে রান্নায় ব্যস্ত।

প্রায় দুইটায় মুন্সিগন্জ ব্রিজ পার হলাম। কিছুক্ষন পর টুটু ভাইয়ের ডাক, খাবার প্রস্তুত। প্রথম দিনের খাবার হল খিচুরি আর ডিম ভুনা| এই দিকে মুন্সিগন্জের পর শহর ভাব আর নেই। নদীর প্রস্ততাও বাড়ছে। প্রক্বতির রুপে আমরা সবাই বিভর।

পার হয়ে যাচ্ছে ৪.৩০ টার দিকে দীন ইসলাম নৌকা নৌকা থামানোর অনুমতি চায়। আমাদের বাম পাশেরটা তার গ্রাম। কিছু কাপড় ও তার বিছানা পত্র আনাতে হবে। কিছুক্ষনের বিরতি কি কারনে যেনো সবাইকে স্বস্তি দিলো। আজ প্রথম বারের মত সূর্যের চেহারা দেখা গেল হঠাৎ করে ।

৫ টা নাগাদ আবার চালু হলো নৌকা। আজকের গন্তব্য চাঁদপুর এখন ঘন্টা তিনেকের পথ। সূর্যও ডুবে গেছে মাত্র এমন সময় ঘটে গেল এক বিপত্তি , ইন্জিনের বেল্ট ছিড়ে গেল । আমাদের নৌকা কোন মতে তীড়ে ভিড়ানো হলো। এখন কি হবে ? ভাগ্যক্রমে পাশ দিয়ে যাচ্ছিল আর একটি ইন্জিন নৌকা।

তারা রাজি হলো আমাদের সামনের ঘাটে পৌছে দিতে। আধ ঘন্টা পর আমরা পৌছালাম ফরাইজি কান্দি । মতলব থানার একটি ঘাটে। রিমন ভাই চালু করলেন তার ভটভটি (জেনারেটর)। আলোকিত হল নৌকা।

শুরু হল দৌড়াদৌড়ি। কেউ গেল বাজারে মিস্ত্রি খুজতে। । কেউ বা নৌকা গোছাতে লেগে গেলো। সাথে লোক নিয়ে টুটু ভাই লেগে গেলেন রান্নার কাজে।

মিস্ট্রি এসে দেখে বলল আজকে সম্ভব নয়। এই বেল্ট বাজারে নাই। এইদিকে এরমাঝেই টুটু ভাই রান্নার ব্যবস্থা করে ফেলেছে । 8: 30 নাগাদ খেয়ে নেই সবাই । আমার আর শরীফের ঘাড়ে পরলো ট্রিপের সবচেয়ে কষ্টকর কাজটা পরেছে আমাদের উপর।

ফিরত এসে দেখি জেনারেটর বন্ধ হয়ে গেছে। আর সবাই ঘুমানোর আয়োজন করছে। প্রচুর ঠান্ডা পরেছে, তাড়াতাড়ি শ্লিপিং ব্যাগের মধ্যে ঢুকতে পারলেই যেন বাচি। কিন্তু প্রথম রাতের আরাম আর আমার ভাগ্যে ছিলনা। টুটু ভাইয়ের ঘোষণা নৌকা পাহারা দিতে হবে সারা রাত।

সেই নাকি এই দায়িত্য পালন করবে। বড় ভাই জেগে থাকবে আর আমি ঘুমাব এটা কেমন দেখায়। সুতরাং তাকে বললাম ঠিক আছে আপনি কিছুক্ষণ পর আমাকে ডেকে দিয়েন। দুই জনে ভাগ করে পাহারা দিব । এই শুনে টুটু ভাই বললো,” বরং এই বেলা তুই দে, ঘন্টা খানেক পর আমি উঠে তোকে ছেড়ে দিব”।

কিন্তু ঘন্টা খানেক আর শেষ হয়না। এদিকে মাঝে আওয়াজ দিলেও, টুটু ভাই আর জেগে উঠে না। রান্নাবান্না আর সব আয়োজন নিয়ে একটা ব্যস্ত দিন গিয়েছে টুটু ভাইয়ের। সুতরাং ডাকতেও খারাপ লাগছিল। ক্লান্তি, কণকনে ঠান্ডা, শিশির , বসার জায়গার অভাব, আগের কয়েক রাতের ঠিক মত না ঘুমানো, কোন কাজ না থাকা সব মিলিয়ে রাতটাকে করে তুললো বিরক্তিকর দীর্ঘ।

এর মাঝে দুটা লঞ্চও ভিড়লো ঘাটে। শেষ দিকে কি ঘটেছে মনে নেই। ফজরের আজান শুনে আর বসে থাকতে পারিনি। কোন মতে শ্লিপিং ব্যগে ঢুকে পরলাম। এভাবেই পার হল যাত্রার প্রথম রাত্রি।

২য় দিনঃ ২০/১২/২০০৮ তীর ঘেসে এগিয়ে চললাম। কিন্তু কতক্ষন তা আর সম্ভব । গিয়ে পরলাম বিশাল এক নদীতে। চাঁদপুর তিন নদীর মোহনায় আবস্থিত। বন্ধু মহলের কারনে চাঁদপুর প্রায়ই আসা হয়।

গত ১৫ তারিখই চাঁদপুর থেকে ফিরেছি। আমাদের পরিকল্পনা শুনে চাঁদপুরের বন্ধু বান্ধব প্রথমে বিশ্বাস করেনি। পরে ভয় দেখাতে শুরু করেছে। আগে থেকে তিন মোহনার ভয়ঙ্কর সব গল্প শুনেছি। কিন্তু শীতকাল হবার কারনে নদী এখন শান্ত।

অতিরিক্ত একটু দুলনি ছাড়া তেমন কোন সমস্যা হল না। চাঁদপুর পৌছালাম তখন ১২তা বাজে। ৫ নম্বর চৌধুরী ঘাটে নৌকা ভেড়ানো হল। টুটু ভাইয়ের থেকে অনুমতি নিয়ে আমি আর শরীফ চাঁদপুর শহর ঘুরতে। আগেই বলেছি আমার কিছু বন্ধু আছে এখানে | তাদের সাথে দেখা করে ৩টা নাগাদ ফিরে এসে দেখি সবাই আমাদের জন্য আপেক্ষা করছে খাবার জন্য।

খেয়ে সবাই যে যার মত ঘুরতে বের হলো বা কাজে লেগে গেল। আমরা চলে গেলাম চাঁদপুরের বিখ্যাত ঠোডার মাথায়। চাঁদপুরে শহরের বিখ্যাত স্পট । আবার শহর ঘুরে ৮.৩০ নাগাদ ফিরে এসে দেখি মেশিনের কাজ চলছে। এই দিন তাড়াতাড়ি খেয়ে নিলাম।

গত রাতের মত আর ভূল করলাম না। এক দিকে জায়গা করে শ্লিপিং ব্যগে নিজেকে ঢুকিয়ে দিলাম। তখন নৌকার কাজ তখনও চলছে । কালকে হয়তবা আবার রওনা দিতে পারব এই আশায় ঘুমিয়ে গেলাম| ৩য় দিনঃ ২১/১২/২০০৮ সকালে উঠেই আমার আর শরীফের লেগে পরতে হল দায়িত্য প্রাপ্ত সবচেয়ে বিরক্তিকর কাজের জন্য। আমি আর শরীফ চলে গেলাম পানি আনতে।

পানি এনে শরীফ আর দীন ইসলাম চলে গেলো তেল আনতে। আর খোকন ভাই গেল নাস্তার ব্যবস্থা করতে। প্রয়োজনীয় সব কিছু উঠেছে নৌকায়। কিন্তু কুয়াশা দুর হবার কোন লক্ষন নাই। কিন্তু দেরি করা যাবে না।

৮টায় রওনা দিলাম। কুয়াশার কারনে বেশী দূর দেখা যাছেনা। শুরুতেই ডাকাতিয়া ছেড়ে মেঘনায় পরলাম। চাঁদপুরের শেষের দিক থেকে নোয়াখালী ঢুকতেই চোখে পরল নদী ভাংগনের ভয়াল চিত্র। গাছ পালা , বাড়ি ঘর পোরে আছে নদীর উপর।

প্রচুর রং-বেরং এর পতাকা ওয়ালা জেলে নৌকাও চোখে পরল। কিছু পরেই বুজলাম আমরা এখন বাংলাদেশের নদী পথের কোন ব্যস্ত রুটে আছি। প্রচুর লঞ্চ, নৌকা জাহাজ চোখে পরতে থাকলো। দেখা পেলাম বিখ্যাট রকেট এর ও। হাইম চর পার হয়ে যখন রামগতির দিকে যাচ্ছি তখন নৌকার পাখা আটকাল মাছ ধরার জালে।

প্রায় কিলোমিটার ছড়িয়ে ইলিশ মাছ ধরে জেলেরা। জালে নৌকা আটকাতে দেখে হায় হায় করে ছুটে আসলো জালের মালিক। কিন্তু কাছে আসতেই আমাডের মাঝি উলটা ঝারি। ঝারি খেয়ে জেলেরা একটু বিভ্রান্ত হোয়ে গেলো। তার উপর ব্যবহার করছে কারেন্ট জাল।

বেড়াতে বের হয়েছি কল্পনাও করে নাই। তাহলে কে ? আবার ঝারিও মারে। নিজেরাই জাল খুলে দিল। তারপর ঘটল আরেক মজার কাহিনী। আমাদের চোখ পরল ওদের নৌকায়।

মাত্র ইলিশ তুলেছে নৌকায়। এখন নড়ছে। প্রায় চার কেজি ওজনের চারটি মাছ বাগিয়ে নিল দীন ইসলাম ১৩০ টাকায়। তারপর জেলেদের ছাড়িয়ে এগিয়ে চললাম রামগতির দিকে। দুপুরের খাওয়ার ডাক আসলেই দেখি প্লেটে ইলিশ মাছের টুকরা।

এদিকে আমাদের নৌকা এগিয়েই চলছে| চারপাশের দৃশ্য দেখতে দেখতে এগিয়ে চললাম। একেক জায়গায় নদীর রূপ একেক রকম। এর মধ্যে ঘটলো চরম বিপত্তি। ডুব চরে আটকে গেল আমাদের নৌকা। চর থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা চলল অনেক ।

কিন্তু দেখা গেল যত চেষ্টা নৌকা বরং আরো আটকে যাছে। । পরে সবাই পানিতে নেমে ধাক্কিয়ে চর থেকে নামানোর চেষ্টা করা কিন্তু লাভ কিছুই হলনা । যখন নামি তক্ষন কোমর পানি ছিল, আর উঠে আসার সময় দেখলাম তা নেমে গেছে হাটুর নীচে। তাই বাধ্য হয়ে আপেক্ষা করতে লাগলাম জোয়ারের জন্য।

এদিকে আটকানোর পর থেকেই মুজিব ভাই তার আগের সহকর্মীদের (মুজিব ভাই আগে নৌবাহিনীতে চাকুরী করতেন) সাথে যোগাযোগ করলেন। অনেকেই জানালো জায়গাটা ভালো নয়। ৭টা নাগাদ জোয়ার আসতেই আবার এগিয়ে চলা শুরু হল। এরই মধ্য দীন মোহাম্মদ সম্পর্কে সবার সন্দেহ সত্যি প্রমানিত হল। সে এদিকে কোনদিন আসেনি।

তার ধারনা ছিল তীর ধরে চলে গেলেই পৌছে যাব। সুতরাং কোন দিকে যাব আমরা জানিনা । নৌকা আস্তে আস্তে এগিয়ে চললো। সামনে লগি দিয়ে পানি মাপছে আমাদের কেওনা কেও। আর চরে আটকাতে রাজি নই।

একটা খালের ভিতরে নৌকা ঢুকিয়ে আজকের মত বিরতি দিলাম। এদিকে আমাদের বেশীর ভাগের মনে ঢুকে গেছে ডাকাতের ভয়। টর্চ জালিয়ে খেয়ে নিলাম রাতের খাবার। 9: 30 সব আলো নিভিয়ে সবাই চলে গেল যে যার শ্লিপিং ব্যগে। পাহারার দায়িত্বে থাকল রিমন ভাই।

কিন্তু শান্তি নাই রিমন ভাইয়ের জ্বালায়। কোথাও কোন আওয়াজ পেলে বা আলো দেখলেই রিমন ভাইয়ের ডাকাডাকি। এত ভিতু যে রিমন ভাই তা জানতাম না। এরই মধ্যে এক সময় ঘুমিয়ে পরলাম। ৪র্থ দিনঃ ২২/১২/২০০৮ ঘুম ভাঙ্গল নাম না জানা এক চরে্র ধারে।

ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে দেখলাম ছয়টা ত্রিশ বাজে। রিমন ভাই এখন পাশ দিয়ে কোন নৌকা যেতে দেখলে তা সন্দেহের চোখে দেখছে। আর এখানে নয়| রওনা দিয়ে দিলাম প্রায় তখনই। রাস্তায় যাকেই রামগতি কতদুর জিজ্জাসা করলাম সবাই বলল এই সামনেই। রাস্তা আর শেষ হয়না।

এক ঘন্টা পর পার হাইম চর, চর আলেকজেন্ডার। সেখানেও একই উত্তর , সামনেই রামগতি। রামগতি পৌছালাম তখন প্রায় সোয়া নয়টা বাজে। এখানেই আমাদের নিতে হবে সামনের দিনের সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্তর উপরই নির্ভর করবে আমাদের যাত্রার সফলতা।

কারন আমরা বুঝে গেছি দীন ইসলাম এই নদীতে কোন কাজের নয়। সুতরাং সিদ্ধান্ত নিতে হবে কি করা যায়। সিদ্ধান্ত হল কোন মাঝি কে ভাড়া করা হবে । টুটু ভাই, বাবু ভাই আর দীন ইসলাম নেমে গেল মাঝি ঠিক করার জন্য। খোকন ভাই কে পাঠান হল বাজারে।

আমি আর শরিফ গেলাম পানি আনতে, গতরাতে নৌকায় পানি নেয়া সম্ভব হয় নি। মাঝি পাওয়া গেল দুইজন। তারা আমাদের চট্টগ্রাম পর্যন্ত পৌছে দিতে রাজি হল। আর দেরি করার কোন মানে নেই। সবাই উঠতেই আবার যাত্রা শুরু।

মাঝিদের থেকে জানা গেল আজকে সব কিছু ঠিক থাকলে সন্দীপ পৌছাব। বড়ার চর, টাঙ্গী বাজার, নামার চর পার হয়ে পৌছালাম লেস্কির চর নামক মানব বর্জিত এক চরে। এ চরটা আসলেই আন্য রকম। মানুষ নেই কোন বা মানুষ থাকতে পারে এমন কোন চিহ্নও নেই। আগেও বিভিন্ন চরে বড় বড় মহিষের পাল দেখেছি কিন্তু এটার কাছে ঐগুলা কিছুইনা।

হাজার হাজার মহিষ চরে বেড়াচ্ছে চরে। নৌকা থামান হল। লেস্কির চর আমরা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। বাবু ভাই নেমে গেলেন চরে। একটা মহিষও যদি তেড়ে আসে তাহলে বাবু ভাইকে বাঁচানোর কেউ নেই।

তেমন কিছুই ঘটলনা। বাবু ভাই নৌকায় উঠেই নৌকা চালু করা হল। রামগতি থেকে উঠা মাঝিরা বলল মহিষগুলা নাকি চরমপন্থিরা দেখাশুনা করে। দূরে একটা লঞ্চ দেখা গেল। মাঝিরা জানাল ঐটা হাতিয়া থেকে ছেড়ে চট্টগ্রাম যাচ্ছে।

তাছাড়া হাতিয়া থেকে নোয়াখালি যাবার ট্রলার ও দেখলাম। হাতিয়া থেকে নোয়াখালির ট্রলার কিছুদূর এগুতেই প্রথমবারের মত সমুদ্রে পরলাম। সমুদ্র শান্ত। ছোট ছোট ঢেউ। সত্যি কথা বলতে আলাদা ভাবে সমুদ্রের অস্তিত্য বোঝা গেলনা।

হাতিয়ার কিছু আগে রাতের জন্য মাছ কিনলাম। সাড়ে চারটা নাগাদ সন্দীপ পৌছে গেলাম। দূরে দাঁড়িয়ে আছে নৌ-বাহীনির একটি জাহাজ। মুল ঘাটে ঢুকা সম্ভব নয়। তাই একপাশে নৌকা ভিড়ালাম।

সন্ধ্যা প্রায় হয়ে আসছে। তাই খোকন ভাইকে পাঠানো হল বাজারে। গত ৩৬ ঘন্টার বেশী নৌকায় বসে আছি। সুতরাং তা বুঝতে পেরে টুটু ভাই ছুটি দিয়ে দিলেন। কোমর পর্যন্ত পানিতে ভিজিয়ে, হাটু সমান কাদা ভেঙ্গে তীরে পৌছে সন্দীপকে তেমন আকর্শণীয় কিছু মনে হল না।

আমার গ্রামের বাড়ীর নদী তীরের সাথে কোন পার্থক নাই। পাথ্যক শুধু আমার গ্রামের নদীটার আপর তীর দেখা যায়, কিন্তু এর সামনে শুধুই দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি। ঘুরতে ঘুরতে বাজারে গিয়ে পৌছালাম। বাজারের পিছনে গিয়ে দেখলাম শতশত জেলে নৌকা ডাঙ্গায় পরে রয়েছে। আদ্ভুত লাগছে সব।

মনে হচ্ছে কেউ হাত দিয়ে পানি থেকে মাটিতে তুলে রেখেছে। আসে পাশে পানির কোন নাম গন্ধ নেই। আসলে বর্ষায় জোয়ারের সময় নৌকা গুলো এখানে তুলে রাখা হয়েছে। সন্ধার আগেই সবাই ফিরে এলাম। ডাঙ্গায় নৌকা সিদ্ধান্ত হল , নিরাপত্তার কারনে পাশের ফেরিতে নৌকা বাঁধব।

ফেরির লোকদের সাথে কথা বলতে তারা আনন্দের সাথে আমাদের অনুমতি দিল। ঐটা ছিল একটা উদ্ধারকারি ফেরি। একটা চিনির জাহাজ ডুবে যাওয়ায় তা তুলতে এসেছে ফেরিটি। নৌকা ভিড়ানোর পর টুটু ভাই আর আনোয়ার ভাই লেগে গেলেন রান্নার কাজে। খাওয়ার সময় অনুমতি চাইলাম ফেরিতে তাবু খাটিয়ে থাকতে।

অনুমতি মিলল। যাত্রা শুরুর পর এই প্রথম নৌকার বাইরে রাত কাটালাম। কিন্তু গত কয়েক দিনের নৌকায় থাকার ফলে শুলেই যেন সব কিছু দুলে। এক তাবু বিছিয়ে আমি , শরিফ আর রিমন ভাই ঘুমিয়ে পরলাম। ৫ম দিনঃ ২৩/১২/২০০৮ ঘুম ভাঙ্গল সকাল আটটা নাগাদ।

রাতেই ঠিক হয়েছিল আজকে একটু দেরি করে রওনা দিব| ভাটার জন্য অপেক্ষা করব। ভাটার সময় রওনা দিতে পারলে কম সময়ে লাগবে পৌছাতে । নাস্তা করে আমি আর শরিফ গেলাম আমাদের গুরু দ্বায়িত্ব পালনে। ফেরির ছোট ডিঙ্গি নৌকায় করে পারে গিয়ে খুজতে বের হলাম নিরাপদ পানির উৎস। ছোট দিঙ্গিতে পারে যাচ্ছি পানি আনতে প্রায় কিলোমিটার দূরে গিয়ে মিলল পানির উৎস।

পানির জার হাতে পানির উৎসের খোজে পানি ভরতে শুরু করা মাত্র টিউবওয়েল মালিক এসে বাধা দিল। সবাই ব্যবহার করে নাকি তার টিউবওয়েল নস্ট করে ফেলছে। আমরা আমাদের অবস্থান বুঝিয়ে অনুরোধ করাতে সে পানি দিতে রাজি হলো। ৫লিটারের ৭ টা পানির জার ভরতে হবে । একবারে পানি নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় আমাদের দুইজনের পক্ষে।

তাই প্রথমবার চারটা রেখে এসে দেখি বাকি গুলোর মুখ নেই। বুঝলাম কেউ ফাজলামি করেছে । সুতরাং সেই দিকে খেয়াল না করে অর্ধেক ভিজে , অর্ধেক পানি ফেলে কোনমতে পারে নিয়ে আসলাম পানি। পারে যখন ডিঙ্গি নৌকাটার জন্য অপেক্ষা করছি , তখন দেখি পেছন দিয়ে কে যেন গেঞ্জি টানছে। ফিরতেই দেখি একটা ছোট ছেলে পানির জারের মুখ গুলো নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

কোনমতে আমার হাতে মুখ গুলো দিয়ে সে এক দৌড়। ডিঙ্গি নৌকা আসতেই তাতে করে ফেরিতে পৌছালাম। হাতে তখন ও ঘন্টাখানেক সময়। তাবু ভাজ করে আশে পাশের ছবি তুলে সময় কাটতে থাকল। সন্দীপের তট এইদিকে ফেরির লোকজন তাদের কাজে লেগে গেছে ।

একজন প্রস্তুতি নিচ্ছে পানির নিচে ডুব দিতে তাদের প্রাগৈতিহাসিক প্রযুক্তি ও পুরানো সরঞ্জামাদি নিয়ে। গেলাম সেই দিকে। এরা সিলিন্ডার নিয়ে নামে না। শুধু একটা স্কুবা মাস্ক ও চেইন দিইয়ে তৈরি ওয়েট বেল্ট সাথে থাকে। উপর থেকে পাইপের মাধ্যমে মেশিন থেকে বাতাসের যোগান দেয়া হয় ডুবুরিকে।

মুজিব ভাই বুঝিয়ে দিলেন কোনটা কেমনে কাজ করে। স্কুবা মাস্কটা মুখে দিয়ে ধাক্কা খেলাম । এতে আক্সিজেন কই। ডিজেল এর গন্ধে পুরটাই পরিপূর্ণ। বুঝলাম কতটুকু ঝুকি নিয়ে এই ।

ডুব দিতে প্রস্তুত এইদিকে সময় এর কাটেনা। টুটু ভাইও আর আপেক্ষা করতে রাজি নয়। ফেরির লোকজনের কাছে থেকে বিদায় নিয়ে সড়ে ১০টা নাগাদ রওনা দিয়ে দিলাম। কিছুদুর এগুতেই চারপাশে শুধু পানি আর পানি। কি দেখে , আর কি বুঝে যে মাঝি নৌকা চালাছে সেই জানে।

মাঝে এক নৌকা থেকে কিছু মাছ কিনে নেয়া হলো দুপুরে খাবার জন্য। দুপুর একটা নাগাদ বুঝতে পারলাম আমরা প্রায় চট্টগ্রাম পৌছে গেছি। সামনে দাড়িয়ে আছে বিরাট বিরাট জাহাজ। তাদের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেলাম। তার কিছুক্ষন পর সামনে প্রথমবারের মত চোখে পরল চট্টগ্রামের স্থল।

২০ মিনিট পর পার হলাম পতেঙ্গা সৈকত। অনেক লোকজন দেখলাম সেখানে। এই ঠাঠা রোদে ,বোল্ডারের উপর বসে পুকুরে মত শান্ত সমুদ্র দেখার কি আছে তারাই জানে। কর্ণফুলি নদীতে ঢুকতেই তাজ্জব বনে গেলাম। সামনে শতশত – বিশাল বিশাল জাহাজ।

তাদের বিশালতা মনে ভয় ধরিয়ে দেয়। নৌকা ভিরানো হলো ১৫ নম্বর ঘাটে। তখন প্রায় ৩টা বাজে। রামগতি থেকে আসা মাঝি দের বিদায় জানান হল। টুটু ভাই আর খোকন ভাই গেলেন বাজারে।

আমরা বসে বসে আলস সময় কাটাতে থাকলাম। ঠিক উল্টাদিকেই বিখাত্য সি.ইউ.এফ.এল. এর ঘাট। যেখান থেকে বছর কয়েক আগে উদ্ধার হয়েছিল ১০ ট্রাক আস্ত্র। বাকি সারাটা দিন কেটে গেল নৌকার উপর। মাঝে একবার নামতে পারলাম নৌকা থেকে, তাও পানি আনতে।

দীন ইসলামের উপর যে ভরসা করা যায়না তাই, চট্টগ্রাম থেকে আর একজন মাঝি নেয়া হলো। চারদিকের শতশত বিরাট বিরাট বিরাক জাহাজের মাঝে কেটে গেল কর্ণফুলির মোহনাতে একটি রাত। মাঝরাতে একবার নৌকা ছুটে গেল দড়ি ছুটে। ভাগ্যিস কয়েকটা দড়ি দিয়ে বাধা ছিল। না হলে কপালে কি ছিল আল্লাহই জানে।

হয়বা প্রান যেত কোন জাহাজের তলে পরে। ৬ষ্ঠ দিনঃ ২৪/১২/২০০৮ ভাগ্য ভাল থাকলে আর খুব ভোরে রওনা দিতে পারলে আজকে একদিনে পৌছান সম্ভব কক্সবাজার। আমাদের নতুন মাঝি তাই জানিয়ে ছিল। সে অনুযায়ী পরিকল্পনা করে ঠিক হয়ে ছিল আমরা চারটার মধ্যে রওনা দিব। সাড়ে তিনটায় এলাম বাজতেই সবাই উঠে গেল।

মাঝিও ছিল নৌকায়। চারদিকে ঘুটঘুটে আন্ধকার। সবাই একসাথে হাত লাগানোতে সাড়ে চারটার আগেই আমরা প্রস্তুত হয়ে গেলাম রওনা দিতে। কিন্তু ভাগ্যে থাকলে ঠেকায় কে। নৌকা চালু করতেই বোঝা গেল, আমাদের হালের নীচের আংশ ভেঙ্গে গিয়েছে।

গতরাতে নৌকার দড়ি ছিড়ে এই কাহীনি ঘটেছে। | কনকনে এই ঠান্ডায় তা ঠিক করতে মুজিব ভাই সিলিন্ডার নিয়ে মুজিব ভাই নামলেন পানিতে। হালের নীচের দিকে যে ব্লেডের মত থাকে তা ছুটে গেছে। দড়ি দিয়ে বেধে মুজিব ভাই যখন উঠলেন তখন ৬টা বাজে। যাত্রা আবশেষে শুরু হল।

চট্টগ্রামকে পিছনে ফেলে আগিয়ে চললাম। কুতুব্দিয়া পৌছালাম ১১টা নাগাদ। কুতুবদিয়ার এক জেটি আরও কিছুদুর সমুদ্র পারি দিয়ে একটি খালে ঢুকতেই চোখে পরল একটি ম্যনগ্রোভ বন। পাসের দৃশ্যটি অনেকটা সুন্দরবনের মত। মাঝিকে জিজ্ঞাসা করতেই জানলাম, এটাকে বলা হয় চকোরিয়ার সুন্দরবন।

চকরিরার সুন্দরবন কিন্তু এর মাঝেই ঘটল আবার ঝামেলা। হাল আবার ছুটে গেছে। আরো এক ঘন্টা নস্ট হল এর পিছনে। মুজিব ভাই আবার নামলেন হাল ঠিক করতে। মুজিব ভাই হাল ঠিক করছেন রওনা দিতেই সামনে পরল পদ্মখালি ব্রিজ।

এইটাই সড়ক পথে চট্টগ্রাম থেকে মহেশখালি যাবার উপায়। পদ্মখালি ব্রিজ কুতুব্দিয়া পার হবার সময় চোখে পরল আনেক মাছ ধরা নৌকা ও লবন ক্ষেত। লবন উৎপাদন হচ্ছে মাচ্ছ ধরার নৌকা মহেশখালিতে ঢুকতেই পাহারের চিহ্ন চোখে পরতে লাগলো। আমরা মহেশখালি জেটিতে পৌছালাম ৫টা নাগাদ। মহেশখালি জেটিতে পৌছে ঠিক হল আজ এখানেই।

নৌকা ভিড়তেই নেমে পরলাম ব্রিজে। কেউ কেউ ঘুরে আসল বাজারে। আমি বাজার করে আসতেই, টুটু ভাই আমাকে আর শরীফকে পাঠাল পানি আনতে। পানি আনা, তেল আনা, বাজার করা, রান্না করা সহ বিভিন্ন কাজে কেটে গেল বাকি সময়। খেয়ে দেয়ে আজকে ঘুমালাম বাংলাদেশের সবচেয়ে লম্বা জেটিতে, তাবু খাটিয়ে।

৭ম দিনঃ ২৫/১২/২০০৮ রওনা দিলাম তখন প্রায় ৬টা বাজে। চা খাচ্ছি তখন চোখে পরল এক জেলে নৌকা। তার থেকে কিছু মাছ কিনা হল। ৭ টা নাগাদ দূরে দেখা গেল কক্সবাজার সৈকত। সৈকতের খুব কাছ দিয়ে চলে গেল আমাদের নৌকা।

খুব বেশী লোক দেখা গেলনা সৈকতে । কক্সবাজার সৈকত সৈকত পার করে কিছুদূর যেতেই প্রথমবারে মত সমুদ্রের ঢেউ অনুভব করা গেল। কিন্তু এই অল্প ঢেউই সবাইকে কিছুটা হলেও অসুস্থতা অনুভব করল। আজকে আর রান্না হলনা। শুকনো খাবার দিয়ে কাটিয়ে দিলাম দিন।

কিন্তু ঘন্টা খানেক পরই শরীর সয়ে নিল দুলোনির সাথে। চারপাশের মাছ ধরার নৌকা এগিয়ে এলো কৌতুহলি হয়ে। সাগরে নৌকা হিমছড়ি , ইনানি পার হয়ে এক সময় পৌছালাম টেকনাফের সীমানায়। দূরে ছোট ছোট বাহারি নৌকা সৈকতে । এর ফাঁকে একপ্রস্ত ঘুমিয়ে নিলাম।

উঠে দেখি আজকে রান্না হয়নি। আমাদের বাবুর্চীদ্বয় (টুটু ভাই আর আনোয়ার ভাই) অসুস্থ বোধ করছে। শেষ পর্যন্ত টুটু ভাই উঠে ডিম ভাজলেন। বেঁচে থাকা শুকনো খাবার দিয়ে দুপুরের খাওয়া চালিয়ে নিলাম। আজও আমরা ভাগ্যের উপর নির্ভরশীল।

ভাগ্য সদয় হলে আজকেই আমাদের যাত্রার শেষ দিন। কিন্তু ভাগ্যে আরো একদিনের যাত্রা জমা আছে। বদরে মোকাম পার হতেই ইঞ্জিন সমস্যা দেয়া শুরু করল। মাঝি ঘোষণা দিল কোন কারনে ইঞ্জিন একবার বন্ধ হয়ে গেলে আর চালু করা যাবেনা। সিদ্ধান্ত হল নৌকা ভিড়ানো হবে শাহ পরীর দ্বীপের জেটিতে।

জেটিতে পৌছানো মাত্রই নৌকার ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেল। কোন মতে তাড়াতাড়ি নৌকা বাধা হল জেটির সাথে। আল্লাহ বাচিয়েছে। কোন কারনে যদি নৌকা যদি মাঝ সাগরে বন্ধ হয়ে যেত তাহলে কি কপালে ছিল তা চিন্তা করেই ভরকে গেলাম। সাড়ে চারটা বাজে।

শাহ পরির দ্বীপ পৌছে খুজে পেতে মিস্ত্রি আনা হলো। সে জানাল আজকে ঠিক করা সম্ভব নয়। কাল টেকনাফ থেকে মাল এনে নৌকা মেরামত করতে হবে। থাকতে হবে এইখানে । আমাদের সাথে থাকা মাঝি কাম পাইলটকে বিদায় দিলাম।

সুতরাং শুরু হলো টুটু ভাইয়ের জ্বালাতন। আমাকে নিয়ে বাজার করে এসে সে বসে গেল রান্নার কাজে। এসে দেখি মুজিব ভাই পানিতে নেমে গেছেন হাল আবার ঠিক করতে। মুজিব ভাই হাল ঠিক করছেন যথারীতি পানি আনতে গেলাম আমরা দু’জন। আসে দেখি রান্না শেষ।

কিন্তু নৌকায় খাওয়া যাবে না। প্রচন্ড রকম দুলছে। শেষ পর্যন্ত খাবার পর্ব সারলাম জেটির সিড়িতে। খেতে খেতে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো , এভাবে নৌকা রাখা যাবেনা। যেভাবে দুলছে তাতে জোয়ার এলে নৌকা ভেঙ্গে যেতে পারে।

সুতরাং খাওয়া শেষে আনুষ্ঠিত হল এই যাত্রার সবচেয়ে রোমাঞ্চকর পর্ব। লিখে বা বলে তা বোঝানো যাবে না। প্রথমে রশি দিয়ে টেনে নৌকা নিয়ে যাওয়া হলো জেটির অন্য প্রান্তে। ঢেউ-স্রোতের সাথে যুদ্ধ করে নৌকা নিরাপদ স্থানে বাধতে সেই আধা ঘন্টায় যে কি হয়েছে তা জীবনেও ভুলব না। তার পরও নৌকার দুলোনি কমে না।

শেষ পর্যন্ত সকলেই বাধ্য হলো নৌকা ছাড়তে। প্রথমবারের মত সবাই রাত কাটালো নৌকার বাইরে। চার তাবুতে সবাই উঠে এলো জেটিতে। ৮ম দিনঃ ২৬/১২/২০০৮ জেটির উপর আমাদের তাবু সকাল ৫টায় উঠে এদিক সেদিক ঘুরে বেরালাম। এখানে একটা শুল্ক দপ্তর আছে।

মুল পণ্য মায়ারমার থেকে আসা গরু। শতশত গরু দেখলাম নামতে ও আফিসের সামনের মাঠে বেধে রাখা। টেকনাফ থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস এনে মিস্ত্রি লেগে গেল কাজে। আমাদের সময় কেতে গেল মাছ ধরা দেখতে দেখতে। এখানে কিছু মানুষ আছে যাদের পেশাই বড়শি দিয়ে মাছ ধরা।

অবশেষে রওনা দিলাম তখন প্রায় ১১টা বাজে। দ্বীন ইসলামের উপর আর ভরসা না করে মুজিব ভাই নিজেই হাল ধরলেন। ঢেউ কেটে আস্তে আস্তে আগুতে থাকল আমাদের নৌকা। আন্দাজের উপর আমাদের নৌকা এগিয়ে নিয়ে গেলেন। এগুতেই দেখা পাওয়া গেলো পথ পরিদর্শক বয়া।

বয়া দেখা নৌকা এগিয়ে নিয়ে গেলেন মুজিব ভাই। মাঝে গভীরতা কম হওয়ায় নৌকা ঢুকানো হল মায়ারমারের সীমান্তে। অবশেষে দেখা গেল সেন্ট মাটিন। শেষ হতে চলল আমাদের নাবিক জীবন। সেন্ট মার্টিনে নৌকা পৌছাল তখন বাজে সাড়ে বারটা।

দেখে এলাম বাংলার রূপ। নদী ও নদী পারের মানুষের জীবন। দেখতে দেখতে কেটে গেল ৮টা দিন কখনও নদীতে , কখনও বা সাগরে। বাংলার সিন্দবাদরা আবার রূপ নিলাম সাধারন মানুষে।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।