আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অতল জলের টান


শাহজালাল ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে বলাকা ভিআইপি লাউঞ্জে মুখ গম্ভীর করে বসে ঝিমোচ্ছেন সরকারের হোমরাচোমরা গোছের কিছু কর্মকর্তা। বাংলাদেশী বংশদ্ভূত ব্রিটিশ বিজ্ঞানী এম জি রাসেলের বাংলাদেশ সফর উপলক্ষের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রনালয় থেকে স্বয়ং মন্ত্রীসহ এরা এসেছেন। সন্ধ্যা ৬:৩০ মিনিটে এম জি রাসেলকে বহনকারী সৌদি এয়ালাইন্সের বিমানটি অবতরনের কথা থাকলেও দোবাইয়ে উড্ডয়ন সময়ের জটিলতার জন্য নির্দিষ্ট সময়ে বিমানটি অবতরন করেনি। এখন ১০ বেজে ১৫ মিনটি। সন্ধ্যায় অবতরন করছে না জেনে হোটেল ওয়েস্টিনে একটা প্রোগ্রামে যোগদান শেষে বিজ্ঞান মন্ত্রী ইয়াফেজ ওসমান এই মাত্র এসে পৌছালেন।

ভি আইপি লাউঞ্জের কর্মকর্তাসহ সব্বাই নড়েচড়ে উঠল। এইমাত্র ঘোষণা হলো কিছুক্ষণের মধ্যেই সৌদি এয়ারলাইন্সের টি-৭০৭ বিমানটি ১নম্বর টার্মিনালে অবতরন করবে। ১১ বছর আগে এইডস প্রতিরোধে কার্যকরী এক ধরনের বেকটেরিয়া থেকে এইডসের এন্টিবায়োটিক আবিষ্কারের কথা সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা করার দিনই হরকাতুল জিহাদ নামে একটি চরমপন্থী গোষ্ঠির হত্যার হুমকির মুখে বাংলাদেশ ছেড়ে ব্রিটেনে আশ্র্য় নেন এম জি রাসেল। সে বছরই নেচার জার্নালে গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশের তিন বছর পর চিকিতসা সাস্ত্রে নোবেল পান রসায়নের এই অধ্যাপক। রিসিসিভ অটিজমের চিরকুমার এই বিজ্ঞানীর অটিস্টিক শিশুদের নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশ নিতে বাংলাদেশে আগমণ।

ঈদের ছুটিতে ফাঁকা রাজধানীতে তার আগমণ উপলক্ষে নিরাপত্তা ব্যবস্থা চোখে পড়ার মত। সেনাবাহিনীর টহল বিমান বিকাল থেকেই ঢাকার আকাশে চক্কর দিচ্ছিল। এইমাত্র সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট পরিহিত উসকোখুশকো চুল আর মুখ ভর্তি খোঁচা-খোঁচা দাড়ির একজন মানুষকে বরণ করতে সবার মধ্যে সাড়া পড়ে গেল। ব্যুকেট হাতে বিজ্ঞানমন্ত্রীর সাথে এগিয়ে গেলেন বিজ্ঞান মন্ত্রনালয়ের অতিরিক্ত সচিব অবন্তিকা বড়ুয়া। মন্ত্রীমহোদয়ের সাথে কথা শেষে বিজ্ঞানীর চোখ আটকে গেল অবন্তিকা বড়ুয়ার উপর।

লাল পাড়ের সবুজ শাড়ীর সাথে লাল ব্লাউজ আর কপালে লাল টিপে অবন্তিকা বড়ুয়ার ভারি শরীর ঢেকে বেশ কোমল বোধ আর তারুণ্যের দীপ্তি ঠিকরে বেরুচ্ছে। চল্লিশোর্ধ বিজ্ঞানীর তাতেই হৃদয়ের তলায় একটা অতল জলের টান অনুভূত হল। বর্ষার ভাসা পাতার মত সে টান তাকেও ভাসিয়ে নিল। যেন এই মুহুর্তে সে ঘরহীন এক মাসাই। কোন এক দিগন্ত রেখায় তাকে ভিজিয়ে দিল প্রনোদনা বৃষ্টি।

গাড়ি রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মার উদ্দেশ্যে এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে এলো। ১৯৯৫ সালে দিনাজপুরের ভাটিতলী গ্রাম থেকে রাখাল বালক মোহাম্মদ গোলাম রাসেল উচ্চ শিক্ষায় ভর্তি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে। সদ্য কৈশোর ঊত্তীর্ণ হ্যাংলা-পাতলা গড়নের নাকের নিচে গোফের হালকা রেখা আর গালের এখানে সেখানে অসমভাবে মাথা তুলে উঠা দাড়িতে তেল ভর্তি মাথার এক ভোলাভালা যুবক। কয়েক মাসের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠীদের কাছে মোহাম্মদ গোলাম রাসেল হয়ে উঠল এমজি রাসেল, সংক্ষেপে মঙ্গা রাসেল। যদিও সহপাঠীদের কিছু করার ছিল না।

ক্লাসে পাঁচজন রাসেল ছিল। সহপাঠীরা সবারই একটা বিশেষ নাম দিয়েছিল। ৩১৫ নম্বর রুমের রাসেল ছিল ছ্যাঁক রাসেল_ক্লাসের প্রীতিকে প্রপোজ করে রিফিউজ হওয়ার পর থেকে তার নাম হয়ে গেল ছ্যাঁকা রাসেল। মীরপুর-২ থেকে যে আসত তার নাম হয়ে গেল চিরিয়া রাসেল। এভাবে কবি রাসেল ও নেতা রসেল নামকরণ করা হয়েছিল।

এম জি রাসেল কে এই ঝামেলায় পড়তে হত না, যদি না সে মোহাম্মদ গোলাম রাসূল থেকে রাসেল হয়ে যেত। ক্লাস নাইনে রেজিস্ট্রেশনের সময় রাসূলের জায়গায় রাসেল হয়ে আসল। হ্যাড স্যার বলল, ঐ একই তো হলো রাসূল আর রাসেল। ঠিক করার দরকার নেই যা। ঠিক করতে ম্যালা ঝামেলা।

অটিজমের জন্য কারও চোখে চোখে রাখতে পারত না রাসেল। ক্লাসের ফার্স্ট বয় না হলেও ম্যাথ আর ফিজিক্যাল ক্যামিস্ট্রিতে ছিলা তার আসাধারণ দখল। আর তার মাথায় সব সময় খেলতো অদ্ভুদ অদ্ভুদ চিন্তা। মাথার ভিতরেই অনেক বড় বড় অংক করে ফল বলে দিতে পারত রাসেল। থার্ড ইয়ারে এসে চেয়ারম্যান স্যারের কোয়ান্টাম মেকানিকসের একটা সূত্র পড়ানোর সময় রাসেল বলে উঠল স্যার এখানে ধ্রুবকটা টেন টু দি পাওয়ার ফাইভ নয় টেন টু দি পাওয়ার পনের হবে।

সবাই হাসাহাসি করলেও স্যার বলেছিলেন হেসো না, রাসেল যখন বলেছে হতেও পারে। পরের দিন স্যার জার্নাল ঘেটে এসে বললে হ্যাঁ ওটা বইতে ভুল ছাপা হয়েছে। তখন থেকে মঙ্গা রাসেল নামটা মুছে গিয়ে নাম হলো বিজ্ঞানী রাসেল। আর তারপর থেকেই ক্লাসের ১৩ জন মেয়ের মধ্যে হার্ট থ্রুব বলে পরিচিত অবন্তিদের দলের সাথে আড্ডা, লাইব্রেরী ওয়ার্ক আর নিউমার্কেটে-চাঁদনীচক ঘুরে ফুচকা খেয়ে হলে ফেরার দলের একজন হয়ে গেল রাসেল। ক্লাসের সাইফুল অবন্তিকাকে সেই কবে থেকেই পছন্দ করতো।

সেখানেই থেমে থাকেনি। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ভাবে বোঝাতেও চেয়েছে। বিভিন্ন জনের কাছে বলেছিল, অবন্তি রাজি হলে সে অবন্তিকে বিয়ে করে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণে রাজি আছে। ইরা ঈর্ষায় জ্বলে বলেছিল, তোরই কপাল। মোহসীনা বলেছিল, আমাকে এ ভাবে কেউ বললে আমি রাজি হয়ে যেতাম।

এমন স্যাকরিফাইজ হয়না। সাইফুল একটা কবিতাও লিখে পাঠিয়েছিল। অবন্তি ও আমার প্রাণের অবন্তি/ কাছে এসে পাশে বসে আমায় দাও দু’দন্ড শান্তি/ শয়নে স্বপনে জাগরণে আমি তোমাকেই ভাবি/ দেবে কি তুমি আমায় তোমার দিলের চাবি? উত্তরে অবন্তি একদিন সাইফুলকে সবার সামনে ডেকে ব্যাগ থেকে কবিতাটা বের করে সবার সামনে পড়ে শুনিয়ে বলল, সাইফুল তোরার কবিতা খারাপ না, আরও একটু ভাল করতে হবে, ট্রাই কর হয়ে যাবে। সবার মধ্যেই হাসির রোল উঠলো। সেই থেকে সাইফুল বোঝে নিয়েছিল, এ ঘাটে নৌকা ভেড়ার নয়।

তার পর সে অন্য পাড়ের অন্য অনেক ঘাটে নৌকাও ভিড়িয়েছে। ধর্মও হয়তো কত জায়গায় চেঞ্জ করবে হলেছে। এখনো কোথাও থিতু হয়নি। কিছু দিন পরপর ফোনে নতুন গার্লফ্রেন্ডের ছবি দেখে ক্লাসমেটরা। সেবার ফর্ম ফিলাপের সময় রাসেলের বার্থডে জেনে কার্জন হলের পিছনে পুকুর ঘাটে কেক কেটে আচমকাই রাসেলকে চমকে দেয় অবন্তিরা।

এর আগে কখনো রাসেল সে ভাবে বার্থডে পালন করেনি। ফোর্থ ইয়ারের শেষের দিকে। রাত আটটা। শহীদুল্লাহ হল গেটের মামা খবর নিয়ে এলো রাসেলের জন্য কেউ গেটে দাঁড়িয়ে আছে। গিয়ে দেখে অবন্তি দাঁড়িয়ে আছে।

রাসেল আসতেই বলল নিউমার্কেট চল, ফুচকা খাব। রিক্সা দোয়েল চত্তর আসতেই হিলিয়াম আলোর আচমকা অবন্তি রাসেলের মুখটা টেনে এনে চুমু দিয়ে দিল। কি ঘটছে বোঝার আগেই অবন্তি বলল আমাকে জড়িয়ে ধর। শেষে নিজেই হাত টেনে এনে নিজেকে জড়িয়ে নিল অবন্তি। সেদিন মনের গহীনের অতল জলে যেমন একটা টান পড়েছিল তেমনি আজও এয়ারপোর্টে অবন্তিকে দেখে সেই টান অনুভব করলো বিজ্ঞানী রাসেল।

রাসেলের কাঁধে মাথাটা এলিয়ে দিয়ে বলেছিল, আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। এখন এনগেজমেন্ট, ফাইনালের পর বিয়ে। রিক্সা নিউমার্কেট আসতেই রিক্সাওয়ালাকে অবন্তি বলল , মামা ফিরে চলেন। অবাক হয়ে রাসেল অবন্তির দিকে তাকালো । অবন্তি তাকাতেই চোখ তাকাতে পারলো না রাসেল।

বার দুয়েক মাথাটা নড়াচড়া করে এদিক ওদিক তাকালো। রসেলকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে অবন্তি বলল, ফুচকা আর খাব না। ফুচকা খেলে ঠোঁটে তোমার স্পর্শ মুছে যাবে। অন্তত একটা রাত হলেও তোমার স্পর্শ আর গন্ধ গায়ে মেখে আমি কাটাতে চাই। চল ফিরে যাই।

বেইলী রোডের গেট গলিয়ে পদ্মায় ঢুকল গাড়ি। ইউনিভার্সিটি থেকে বের হওয়ার পর আর অবন্তির সাথে আর যোগাযোগ ছিল না। অবন্তিও আর যোগাযোগ রাখেনি। ওর ক্যারিয়ার, সংসার, সন্তান সব কিছু নিয়ে বেশ ভালই হয়তো ছিল, আছেও। কিছুই আর জানায়নি।

দেশের রাজনৈতিক চাপ, কাজ আর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করে সময়ই হয়নি রাসেলেরও খোঁজ রাখা। অথবা ইচ্ছে করেই কেউ কারও খোঁজ রাখেনি। এনগেজমেন্টের সেই ছেলেকেই অবন্তি বিয়ে করেছিল। এক ছেলে এক মেয়ে। মেয়েটিকে নিয়ে এসেছিল এয়াপোর্টে।

দেখতে মায়ের মতই হয়েছে। ছেলে নাম নাকি রেখেছে অসেল আর মেয়ে রাবন্তি। অবন্তি কথা রেখেছে_বলেছিল দুজনের নাম মিলিয়ে মেয়ে হলে রাখবে রাবন্তি, আর ছেলে হলে অসেল। অবন্তি চলে গেছে। কাল সেমিনারে থাকবে বলেছে।

পরিবর্তন সামান্যই হয়েছে। সেদিনের সেই স্লিম ভাবটা শুধু মিইয়ে গেছে। একটু ফ্যাট হয়েছে। কালও কি সে অতল জলের টানটা আবার বোধ করবে রাসেল? না তা করতে নেই। এখন সে অন্যের সম্পত্তি, অন্য কেউ তার সম্পত্তি।

সেখানে সে নিশ্চই অনাহুত অনুপ্রবেশকারী হবে। হরকাতুল জিহাদ জানলে তাকে আবার হত্যার হুমকি দিবে। ২ আগস্ট ২০১৩ ৩৮/২ শহীদ ফারুক স্মরণী, যাত্রাবাড়ী।
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।