আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নামহীন

একবার আপনারে চিনতে পারলে রে , যাবে অচেনা রে চেনা

গ্যান্দাকে ঠিক আমাদের বন্ধু বলা যাবেনা। তবে আমরা ওকে আমাদের সাথে খেলতে নিতাম। ওকে আমাদের দলে নিতাম কারণ মাস্টারের বাড়ীর যে বড় কদ্বেলের গাছটা আছে ওটাতে আমরা কেউ উঠতে না পারলেও গ্যান্দা তরতরিয়ে উঠে যেতে পারত। ওর সাহসটাও ছিল আমাদের সবার থেকে বেশী। শালবনের ভেতরে কিছু কিছু গাছের খোঁড়লে টিয়া পাখির বাসা থাকে।

টিয়াপাখির বাচ্চার জন্য আমাদের সবারই কি যে লোভ ছিল সেটা আর বলার নয়। কিন্তু ঐ শালগাছের গর্তে হাত ঢুকাতে সাহস ছিল না কারো, যদি সাপ থাকে! গ্যান্দার ওসব ভয় টয় ছিল না। টিয়া পাখির বাচ্চা আনতে গিয়ে সে টিয়া পাখির ধারালো ঠোঁটের ঠোকর খেয়েছে। তবে তাতে তার তেমন কোন যায় আসেনি। এসব কাজ সে আমাদের মুগ্ধ করার জন্যই করত, যাতে আমরা তাকে আমাদের সাথে খেলতে দেই।

তাছাড়া আরেকটা কারন থাকতে পারে। পরিস্কার জামা কাপড় পড়া, স্কুলে যাওয়া আর পাকা দালানে থাকা ছেলেদের জন্য কিছু করাটাও হয়ত বা তার জন্য গর্বের বিষয় ছিল। গ্যান্দার নাম যে আসলে গ্যান্দা নয় সেটা ওর নাম শুনেই বোঝা যায়। ওর আসল নামটা যেকি তা কেউ জানতো না। এমন কি ওর যে গর্ভধারিণী মা সে ও না।

ওর নামটা নিয়ে আমার প্রথম প্রথম খুব কৌতুহল হত। ওর মাকে জিজ্ঞেস করলে বলত ‘ভুলে গেইছি। ’ গ্যান্দার মার নিজের নামটাই কি মনে আছে? গত দশ বার বছর ধরে তার নাম ‘গ্যান্দার মা’। গ্যান্দার বাপটা থাকলে অবশ্য তাকে পুছ্ করেদেখা যেত। তবে সে সম্ভাবনাও নেই্ কারণ গ্যান্দার বাপ তার এই পুত্রধনের জন্মের ছয় মাসের মাথায় ‘নাই’ হয়ে গেছে।

গ্যান্দার মার ভাষায় ‘পালাইছে’। এটা অবশ্য এই দিনাজপুর অঞ্চলে নতুন কোন ঘটনা নয়। এখানকার পুরুষমানুষ অনেকেই এরকম হঠাৎ হঠাৎ পালিয়ে যায়। আবার হঠাৎই একদিন ফিরে আসে। গ্যান্দার বাপ আসেনি।

গ্যান্দার মা কাজ করে নজমুল মন্ডলের রাইস মিলে। বয়লার থেকে সিদ্ধ ধান চাতালে ফেলে নাড়ানি দিয়ে নাড়িয়ে নাড়িয়ে শুকানো এই তার কাজ। রাতে চাতালেই ঘুমায়। গ্যান্দাও মার সাথেই ঘুমায়। আমাদের দশ বারো জনের যে দলটা প্রতিদিন বিকালে ফুটবল খেলতে যেতাম তারা সবাই যে খুব অবস্থাপন্ন পরিবারের ছিলাম তা কিন্তু নয়।

যখন আমরা নতুন কোন খেলার সামগ্রী কিনতে যেতাম একটা ঝামেলা বেঁধে যেত। আব্বার কাছে চাইতে গেলে আব্বা পরীক্ষার রিপোর্ট কার্ডটা সামনে নিয়ে বসতেন। আমাদের সেই আমলনামার ভয়ে বাসায় কোন কিছুর আব্দার করতাম না। টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে সবাই মিলে চাঁদা দিয়ে তারপর কেনা হত আমাদের খেলার জিনিস। সবার জন্যই আইন সমান।

খেলতে হলে চাঁদা দিতে হবে। সেবার যখন আমাদের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়ে গেল আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম এবার চুটিয়ে ফুটবল খেলা হবে। সকালে ঘুম থেকে উঠে শুরু হবে খেলা। দুপুরে বিরতি দিয়ে আবার বিকেল তিনটা থেকে শুরু হবে। আমাদের সেই তুমুল খেলার চোটে আমাদের চার নম্বরি রাবারের ফুটবলটা একদিন ফেটেই গেল।

সুতরাং নতুন ফুটবল দরকার। সবাইকেই চাঁদা দিতে হবে দশ টাকা করে। মুখ চুন হয়ে গেল অনেকেরই। তবে তিনদিনের মাথায় সবাই দশ টাকা করে চাঁদা দিয়ে দিল। গ্যান্দা বেচারা দিতে পারল না।

শর্ত সাপেক্ষে ওর চাঁদার ভাগটা মন্ডলের ছেলে (আমাদের বড়লোক বন্ধু, যার বাবার তিনটি রাইস মিল এবং বেশ কয়েকটা ট্রাক ছিল) দিয়ে দিল। শর্ত হলো এক সপ্তাহের মধ্যে গ্যান্দাকে এই টাকাটা শোধ করে দিতে হবে। এই এক সপ্তাহ ও আমাদের সাথে খেলতে পারবে তবে মাঝ মাঠে নয় গোল কীপার হিসেবে। গ্যান্দা যথারীতি অর্থ সংগ্রহে নেমে পড়ল। অগ্রহায়নের শেষের ঐ সময়টা ছিল নতুন ধানের মৌসুম।

ধান কাটার পর নাড়া ক্ষেতটাকে দেখায় তখন সোনালী রঙের রাংতা দিয়ে মোড়ানো মাঠের মতো। ঐ জমিটাই তখন হয়ে ওঠে গুপ্তধনের খনি। সারা বছর কৃষকের সাথে শত্রুতা করেযে ইঁদুরের দল গর্ত খুঁেড় রাখে জমির মধ্যে আর তাতে যক্ষের ধনের মত একটু একটু করে জমিয়ে তোলে ধানের স্তুপ তাতেই ভাগ বসায় একদল নারী কিশোর আর শিশু। নাড়া ক্ষেতগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয় প্রথমে। জানের ভয়ে ইঁদুরগুলো তাদের জমানো সম্পদ ছেড়ে যখন পালায় তখন সরু সরু হাত ঢুকিয়ে দেয় সেই সব গর্তে।

একমুঠ আধমুঠ পেলেই খুশীতে ঝলমল করে ওঠে। ধানগুলোকে ঝেড়ে মুছে বাজারে বিকায়। নবান্নের আনন্দ সমাজে ইদুরের মত বেঁচে থাকা মানুষগুলোকেই এভাবেই ছুঁয়ে যায় ধেঁড়ে ইদুঁর গুলোর কল্যানে। গ্যান্দাও এদের দলে যোগ দেয়। দুই কেজি ধান বেচতে পারলে দশ টাকা।

দ্রুত হাতে একটার পর একটা গর্ত ভাঙ্গে আর গান গায় ‘পিতলের কলসী হলে’। শীতকালের বিকেলটা এক ঘড়িতেই শেষ হয়ে যায়। সন্ধ্যায় আকাশে চাঁদনী থাকলে ধান কুড়ানোটা সন্ধ্যা গড়ালেও বেশ খানিকক্ষণ চালানো যায়। দেড় কেজির মত ধান হয়েছে। আর আধ কেজির মত হলেই... ব্যাস।

বেশবড় একটা গর্তের দিকে চোখ যায় গ্যান্দার। হাতটা ঢুকাতেই মনে হয় ঠান্ডা একটা দড়ি যেন পেঁচিয়ে আছে গর্তের ভেতরে। পাকা ধানের খসখসে শরীর নয়, ঠান্ডা পিছল একটা কি যেন। সাথে সাথেই ঘটনাটা ঘটে যায়। প্রথমে তেমন একটা বুঝতে পারে না।

টিয়া পাখির ঠোকরের চেয়েও দুর্বল একটা কামড়। ঝটকা টানে বের করে আনে জিনিসটাকে। চাঁদনী রাতে চকচক করে উঠে গোখরা সাপের শরীর। বাম হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে ডান হাতের কব্জিতে। সাপ কামড়ালে নাকি এমনি করতে হয়।

দৌড়ে আসে মন্ডলের রাইস মিলের চাতালে। রাইস মিলের পাহারাদার হামেদ আলি একটা দড়ি দিয়ে বাঁধে ওর ডান হাতের কনুইয়ের উপরে। গ্যান্দার মা তখনো খবর পায়নি। বন্দরে গেছে কি যেন কিনতে। ঘন্টাখানেক পরে মিলের ম্যানেজার একজন ওঝা ডেকে নিয়ে আসে।

ওঝা নানান সব মন্ত্র পড়তে থাকে। খবর পেয়ে আমরাও ছুটে যাই। ওঝা তার লাঠি দিয়ে দাগ কেটে দেয়। আমরা গোল হয়ে দাঁড়াই দাগের ওপারে পা রেখে। গ্যান্দাকে দেখলাম বেশ ভয় পেয়েছে।

কান্নাকটি হৈ চৈ কিছু করছে না। শুধু জোরে জোরে শ্বাস ফেলছে। শ্বাস নিতে ওর বেশ কষ্ট হচ্ছিল। একঘন্টা নানান সব কেরিকেচার করার পর ওঝা রণে ভঙ্গ দিল। গ্যান্দা নেতিয়ে পড়ল চাতালের শানের ওপর।

‘ওক কালনাগিনী কামড়াইছে’ ওঝার এই কথায় সবাই হতাশ হয়ে পড়ে। গ্যান্দার মা এমন সময় ছুটে আসে। চিৎকার দিয়ে জাপটে ধরে গ্যান্দার নিস্তেজ শরীরটাকে। “ওরে হামার ‘অমূইল্য’ তুই মোক ছাড়ে কোটে পালাছিস বাপধন। ” গ্যান্দার নাম তাহলে অমূল্য! গ্যান্দার মা মন্ডলের চাতালের ওপর ফিট হয়ে পড়ে যায়।

তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে আর সব চাতাল শ্রমিকেরা। অগ্রহায়নের শেষ অথবা পৌষের শুরুর দিকের সেই হিম হিম সন্ধ্যায় চাঁদের আলোয় গ্যান্দা ওরফে শ্রী অমূল্য চন্দ্রের নীল শরীরটা আরো নীল দেখাতে লাগল।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।