আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নিঝুম দ্বীপের আঙিনায় কয়েকজন যুবক (পর্বঃ২)



প্রথম লিখাটি লিখাছিলাম অনেক নিঝুম দ্বীপ ঘুরে আসার ঠিক কয়েক দিন পর । ব্লগে হয়তো গতকাল দিয়েছিলাম। আর দ্বিতীয় পর্বটি লিখতে বসলাম অনেক দিন পর। ইতি মধ্যে অনেক মজার স্মৃতি হয়তোবা ফিকে হয়ে গিয়েছে... অথপরঃ ৩১শে ডিসেম্বর,রোজ শুক্রুবার ২০১০, ভোর সাড়ে ৫টা। তড়িঘড়ি করে ঘুম থেকে উঠে রেডি হলাম।

ব্যাগ আগের দিন রাতেই গুছানো ছিল। একরাম আর সিউল কে উঠিয়ে তাড়া দিলাম সকাল ছয়টার মাঝে যেন আমরা গৃহত্যাগ করতে সফল হই তার জন্যে। অশুভ আলামত নম্বর ১ এদিকে বলে রাখি, আমার বড় ভাইয়ের এক বন্ধুর বাড়ড়ি আবার হাতিয়া। তো তার কাছ থেকে জেনেছিলাম চট্টগ্রাম থেকে হাতিয়া সরাসরি স্টিমারে যাওয়া যায়। সদরঘাট থেকে সকাল ৯ টায় স্টিমার ছাড়ে, পৌছায় সন্ধ্যা ৬ টায়।

তো আমরা ঠিক করলাম যিকো আর জাহিদ যেহেতু আসছেনা, খামোখা আর নোয়াখালী হয়ে যাওয়ার দরকার কি? সরাসরি সদরঘাট থেকে গেলেই পারি। তাই সঞ্জীবকে বলে রাখলাম সকাল সকাল যেন সে সদরঘাট চলে আসে। কারন তাড়াতাড়ি না আসলে আবার স্টিমার এ মনমত জায়গা পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে। আমরাও রওনা দিলাম। আব্বু আমাদেরকে গাড়ি করে পোছে দিল সদরঘাট।

কিন্তু সদরঘাট গিয়ে তো মাথায় হাত!!! শুক্রুবার আর রবিবার দিন নাকি স্টিমার বন্ধ!!! অশুভ আলামত নম্বর ২ এই ট্যুরটার শুরু থেকেই সব অশুভ আলামত। কি আর করার... আগের পথই অবলম্বন করতে হবে। তাই ঠিক করলাম সোনাপুর হয়ে চেয়ারম্যান ঘাট হয়ে যাব। তাই সঞ্জীবকে নিউমার্কেট মোর এ দাড়াতে বলে আমরা একসাথে মিট করলাম। এর পর কদমতলী বাস স্ট্যান্ড।

সুব্রতর মারফতে আমরা জেনেছিলাম এখান থেকে চেয়ারম্যান ঘাট পর্যন্ত সরাসরি বাস সার্ভিস আছে। ভাড়া ১২০ টাকা। তো আমরা সেই বাসে যাওয়ার আগেই সব সিট ফিলাপ !!! ওই সার্ভিসের পরবর্তী বাস হল আরো এক ঘন্টা পর। তাই পরবর্তী বাসের জন্য আর অপেক্ষা না করে আমরা আরেকটি বাসের সন্ধান করতে শুরু করলাম। প্রতিজনের ভাড়া ১০০ টাকায় দরদাম করে আমরা যখন বিজয়ের হাসি !!! হাসছিলাম তখন ও বুঝতে পারিনি আমাদের অলক্ষে আমাদের বাসের কন্টাক্টর ও বিজয়ের হাসি হাসছিল!!! সেটা টের পেলাম বাস কিছুক্ষন চলার পর।

বাস কিছুক্ষন পরপর থেমে থেমে মানুষ তুলছে... হাজার গালাগালি করেও যখন বুঝলাম কোন লাভ হবে না তখন খেমা দিলাম। বুঝলাম বাংলাদেশের মানুষের নীতি কোথায় গিয়ে ঠেকেছে। শালা আমাদেরকে বলেছে সরাসরি বাসসার্ভিস, আর এখন বলছে ভাই আমি তো আপনাদের কে বলেছিলাম সরাসরি বাস সার্ভিস, কিন্তু আমি তো বলি নাই যে, বাস কোথাও থামবেনা!!! কি আর করার জোর যার, মুল্লুক তার। দুপুর বারোটা, আমরা তখনো নোয়াখালী পৌছাই নি। চেয়ারম্যান ঘাটা থেকে দিনে দুটো লঞ্চ ছাড়ে।

একটি সকাল ৯টায় আরেকটি দুপুর আড়াইটায়। সকালেরটি তো এমনিতেই মিস করলাম। এখন তো মনে হচ্ছে, বিকালের টি ও মিস করব। বাসের কন্টাকটর কে হুমকি দিলাম, আমরা যদি লঞ্চ মিস করি তাহলে কিন্তু তোমার এই রোডে তোমার গাড়ি চালানো বন্ধ করে দিব। সে আমাদের কে আশ্বস্ত করল, ভাই আপনেরা লঞ্চে বসে থাকতে থাকতে এমন বিরক্ত হয়া যাবেন যে, কেন লঞ্চ ছাড়ে না।

তখন সে আমাদেরকে আরো কিছু যাত্রী দেখিয়ে আশ্বস্ত করল যে, ওরাও হাতিয়া যাবে। এভাবে করতে করতে দুপুর দেড়টায় সোনাপুর পোছলাম। সেখানে গিয়ে জানলাম চেয়ারম্যান ঘাটা আরো ১ ঘন্টার পথ!!! ভাড়া সাড়ে তিনশ টাকা... শালার বাংলাদেশটা পুরা টাউটবাটপারে ভরে গেছে... একজন বলল লঞ্চ ছাড়বে দুপুর তিনটায়। এদিকে পেটের মধ্যে চিকা বুকডন মারা শুরু করেছে। তাই আমরা আগে কিছু খেয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।

একটা ভালো হোটেল দেখে ঢুকলাম তবে খাওয়ার পর যাতে গলা টা কাটতে না পারে (পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে) তাই দরদাম করে নিয়ে খেতে বসলাম। এরপর খেয়ে দেয়ে রওনা দিলাম চেয়ারম্যান ঘাটের উদ্দেশ্যে। চেয়ারম্যান ঘাট পৌছে লঞ্চ দেখে বুকে জল এল... কিন্তু কতক্ষন পর যখন শুনলাম এই লঞ্চ আর যাবে না। দশমিনিট আগে দিনের শেষ লঞ্চ টা চলে গিয়েছে, তখন বুঝলাম, উপরওয়ালা আসলেই চান না আমরা হাতিয়া পৌছাই। কি আর করা।

যা ভয় পেয়েছিলাম, ঠিক তাই হল। বাসা থেকে পই পই করে বলে দিয়েছে, ভুলেও যাতে ট্রলারে না চড়ি। এত মানা করা সত্ত্বেও ট্রলার এর খোজ করতে লাগলাম। অনেকেই আমাদের বলেছিল ট্রলার এ যাওয়া খুবই ঝুকিপূর্ণ। কারন এই ট্রলারগুলোতে জলদস্যুদের উৎপাত খুব বেশি।

তার উপর এখন নাকি শীতের মৌসুম, মাছ না পাওয়ায় জলদস্যুরা বেপোয়ারা হয়ে উঠেছে। কিন্তু ঘাটে অনেক লোকজন দেখে আমরা আশ্বস্ত হলাম যে, কি আর হবে। এতগুলো লোকজন আছে। অশুভ আলামত নম্বর ৩ অগ্যতা ট্রলারেই উঠতে হল। ট্রলার ভর্তি কন্ডেন্সড মিল্কের কৌটা, তার উপর ৩৭ জন মানুষ !!! বুঝতেই পারছেন কি অবস্থা... আমাদের সবার তো আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার যোগাড়।

মনে মনে চিন্তা করলাম জিকো এই অবস্থায় পড়লে কি করত। চিন্তা করেই নিজে নিজে হাসলাম। সঞ্জীব জিজ্ঞেস করল হাসি কেন? তখন বললাম, জিকোর কথা... সঞ্জীব তখন খানিকটা অভিনয় করে দেখালো জিকো কিভাবে কি করত। প্রিয় পাঠক, আপনারা যারা আমাদের জিকোকে চিনেন না, তাঁদের উদ্দেশ্যে বলি, জিকো হল আমাদের ভ্রমণ গ্রুপের ম্যানাজার। প্রত্যেকবার আমাদের ভ্রমণের যতরকম ব্যবস্থাপনা করার দরকার, এই যেমন কিভাবে যাব, কি কি দেখব, কি কি খাব, কোথায় থাকব এই সব জিকো চোখের পলকে করে ফেলে।

এগুলো নিয়ে আমাদের কোন টেনশন ই করতে হয় না। তাই এই বারের ট্যুরে অর অভাব টা খুব ফিল হচ্ছে। কিন্তু ওর একটায় সমস্যা। খালি টেনশন করে একটু থেকে একটু হলেই টেনশন। তাই এরকম সিচুয়েশান এ পরে ওর “খোমা”খানা চিন্তা করার লোভ সামলাতে পারলাম না... তো যাই হোক প্রসঙ্গে ফিরে আসি।

ট্রলারে উঠলাম বিকাল সাড়ে তিনটায়। মাঝ নদীতে সন্ধ্যা হলে দুটো বিপদ, একনম্বর বিপদের কথা তো আগেই বলেছি... জলদস্যু। এখানকার লোকজন আবার আদর(!!!) করে ওদের কে মামু ডাকে... তো মামুরা নাকি আসলে শুধু জিনিসপাতি নেয় না, সেইরকম নাকি পিটায়। আমার তো এই কথা শুনে হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেলো, কারন আমার সাথে আমার জানের চেয়ে প্রিয় ক্যামেরা, আর আমার স্মৃতিময় মোবাইল খানা... ভাই তাও নিয়ে যা... তারপর ও পিডাইস না। যাই হোক এই হল এক নাম্বর বিপদ।

আর দ্বিতীয় বিপদ হল নেভিগেশান। শীতকালে বিকাল বেলা তাড়াতাড়ি কুয়াশা পড়ে। তাই কুয়াশার মধ্যে আবার কিছু দেখা যায় না। আর এইসব ট্রলারে তো আর জি,পি,এস, নেই যে তারা স্বয়ংক্রিয় ভাবে নির্ধারিত জায়গায় পৌছে যাবে। সুতরাং সন্ধ্যা হলেই বিপদ।

কিন্তু কথায় আছে না, যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত হয়। এখানে রাত নয়, তবে সন্ধ্যা হল। অবিশ্বাস্য হলে সত্যি কথা, কিছুক্ষন চলার পর ট্রলার এর কিট (পাখা) সমুদ্রে পাতা জালে লেগে গেল নষ্ট হয়ে!!! যেখানে নষ্ট হল সেখান থেকে আমাদের যাত্রাস্থল চোখে দেখা যায়। তাই আমরা সবাই মাঝিকে বললাম ওইখান থেকে আরেকটি ট্রলারে করে আমাদের কে পৌছে দেয়ার জন্য কিন্তু মাঝি হল এক নাম্বারের বদমাইশ। সে বলল, আপনারা বসেন, আমরা ইঞ্জিন ঠিক করতাসি... কি আর করার... কিছুক্ষন পর আবার ইঞ্জিন ঠিক হল, কিন্তু গতি এবার আগের বারের অর্ধেক কারন কিট টা কোনমতে দড়ি দিয়ে বেধে দেয়া হয়েছে তাই বেশি জোরে ঘুরলেই যেকোন মুহূর্তে খুলে পড়তে পারে।

চলতে চলতে মাঝ নদীতে এসে আবার কিট গেল!!! বামপাশে তখন আবছা আবছা ডাঙার মত দেখা যাচ্ছে। আমি মাঝিকে বললাম ও ভাই ওই তীরে নৌকা ভেরান যায় না? তখন নৌকার সব যাত্রী একসাথে হেসে উঠল। ওদের দেখে আমার মেজাজ পুরা খারাপ হয়ে গেল। আমি হেসে উঠার কারন অনুসন্ধানের জন্য পাশের এক লোককে জিজ্ঞাস করায় সে যা জবাব দিল তাতে আমার হাত পা ঠান্ডার মধ্যে আরো ঠান্ডা হয়ে গেল... কারন ঐ এলাকাটি হল জলদস্যুদের এলাকা!!! পাঠক আমি কোন গল্প লিখছিনা, কিংবা বাড়িয়ে লিখছি না... যা ঘটেছিল তা অবিকল বলে যাচ্ছি। আমাদের গ্রুপের মধ্যে আমি একটু পাগল টাইপের পাবলিক।

আমি মাঝিরে ঝাইরা গালি দিলাম, পুরা দেশীয় গালি। এমন গালি যা আমার পোষাকাশাকের সাথে যায় না (আমার পড়নে ছিল একটা জিন্সের থ্রি-কোয়ার্টার, আর গেঞ্জি, পুরা উরাধুরা টুরিস্ট), যা শুনে ট্রলারের লোক গুলা পুরা থঃ। এরপর মাঝিকে শুদ্ধ বাংলায় বললাম, দেখেন ভাই, আপনার জানের মায়া না থাকতে পারে, আমাদের আছে। বলেই নিজের মনেই খটকা লাগল। কি বললাম? এই মানুষ গুলো, যারা আমাদের সাথে বসে আছে তাঁদের তো হারানোর কিছু নেই... তাই এরা অনেক নিশ্চিন্ত মনে বসে বসে আমার মাঝির চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধারের মজা নিচ্ছে।

আমি ভালো করে লক্ষ করলাম এই ট্রলারে শুধু আমিই চিৎকার করছি। মাঝি বলল ভাই আমি ট্রলার আরেকটা আনার জন্য বলে দিসি... ঐটা রওনা দিসে। আমি বললাম আমাদেরকে মামু হাতায়া দেয়ার পর তো আপনার ট্রলার আইসা কোন কাম নাই। তখন লোকটা খালি হাসে... শালার চেহারাটা এমনিতেই চোরের মত তার উপর যখন হাসে তখন খুবই বিদঘুটে লাগল। ওর হাসি দেখার পর আমার মেজাজ আরো খারাপ হয়ে গেল।

কিন্তু কি আর করার। বসে থেকে নিয়তির অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন উপায় নাই। মাঝিরা লোকরা যখন বোট ঠিক করায় ব্যাস্ত ততক্ষনে আমার ১০০ বারের উপর দোয়া ইউনুছ পড়া হয়ে গেছে... আর আমি আল্লাহর কাছে ওয়াদা করলাম, হে আল্লাহ, এইবারের মত হাতিয়া পৌছায়ে দাও। আমি আর জিন্দেগীতে মা-বাবার অনুমতি ছাড়া কোন টুরে যাব না (আমার আব্বা-আম্মা এই টুরে যাওয়ার জন্য আমারে খুব মানা করেছিল, কিন্তু ছেলে বড় হয়েছে তাই জোর করে কিছু বলতে পারে নাই)। অবশেষে প্রায় ৫০০ বারের কাছাকাছি দোয়া ইউনুছ পড়ার পর ট্রলার ঠিক হল আর এইবার গতি আগের বারের চেয়ে ও কম।

তবে ট্রলার চলছে। এতক্ষন যেই মাঝির মুখ এত ঝামেলার মধ্যেও হাসিতে ছিল তার মুখ-চোয়াল তখন শক্ত হয়ে গেছে। কিন্তু আমি বুঝতে পারলাম না কেন। কিছুক্ষন পর বুঝতে পারলাম আমরা দিক হারিয়েছি (!!!) একজন বলে এই দিকে, আরেক জন বলে ঐ দিকে। একজন বলল ঘড়িতে কয়টা বাজে? মাঝি সময় বলার সাথে সাথে লোকটি সূর্যের দিকে তাকিয়ে কি যেন মাপল (তখন সূর্য প্রায় ডুবি ডুবি) তারপর বলল এই দিকে চালান।

মাঝি কিছু না বলে কনফিউসড মুখে লোকটার কথা অনুসরন করল। এভাবে চলতে চলতে একসময় ট্রলার আবার নষ্ট হল (!!!) এবং এবার আর ঠিক করার মত অবস্থা নেই। তবে প্রিয় পাঠক ভয় পাবেন না। কারন আশার কথা হল তখন আমরা আবছা আবছা ভাবে তীর দেখতে পাচ্ছি। এবং সবাই নিশ্চিত করল যে, ঐটাই হাতিয়ার জাহাজমারা ঘাটা।

এবং এখন আর মামু আসার কোন ভয় নাই। এর পর আমাদের পথপ্রদর্শক সেই লোকটি তার মোবাইল থেকে কাকে যেন ফোন করল। আর আর তার প্রায় পনের বিশ মিনিট পর আরেকটি ট্রলার এসে হাজির হল যেটার সাথে আমাদের ট্রলারকে বেধে ঘাটের দিকে নিয়ে যাওয়া হল। অবশেষে আমরা ঘাটে পৌছলাম (!!!) আর ঘাটে পোছানোর পর আমি মাঝিকে বললাম ভাই আমি আপনাকে অন্তরের অন্তস্থল থেকে বদ দুয়া দিলাম। কারন আপনি আমাদেরকে অনেক অনেক কষ্ট দিসেন... শালা আবার হাসে আর আমার আবার মেজাজ খারাপ হয়।

এর পর আমরা সেই পথপ্রদর্শক লোকটিকে ধন্যবাদ জানিয়ে তার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। পাঠক এখানে শেষ নয়। (চলবে) সাফিউল

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।