আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

'ভালো থেকো বক, আড়িয়ল বিল'



শিরোনামটি অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের জনপ্রিয় কবিতা 'শুভেচ্ছা' থেকে নেওয়া। এভাবে তার নানা লেখায় যদিও ঘুরেফিরেই আড়িয়ল বিলের নাম এসেছে; যদিও এটি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিল; যদিও এই বিলের ধান সারাদেশের জন্য সাত দিনের অন্নসংস্থান করে বলে প্রবাদ রয়েছে; যদিও বিলটি প্রাকৃতিকভাবেই বিপুল মৎস্যসম্পদের উৎস; যদিও এখানে উৎপন্ন লাউ-কুমড়া বছরব্যাপী রাজধানীর চাহিদা মেটায়- ঢাকার দোহার ও নবাবগঞ্জ এবং মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর ও সিরাজদিখান উপজেলায় বিস্তৃত বিস্তীর্ণ এ জলাভূমিটি কয়েক মাস আগ পর্যন্তও অনালোচিতই ছিল। প্রমত্ত পদ্মার পাশে নিরিবিলি শুয়ে থাকা বিলটি প্রায় জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হয়েছে আসলে একটি বিমানবন্দরের জন্য সম্ভাব্য স্থান হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর। ইতিমধ্যে এ জন্য ওই এলাকার ২৫ হাজার একর ভূমি অধিগ্রহণের প্রশাসনিক প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। শুরু হয়েছে আড়িয়ল বিলে বিমানবন্দর নির্মাণের পক্ষে-বিপক্ষে আন্দোলন-সমাবেশ, আলোচনা, লেখালেখিও।

এক্ষেত্রে অন্তত তিনটি প্রবল অবস্থান দেখা যাচ্ছে। প্রথমত, ওই এলাকায় বিমানবন্দর স্থাপনের ঘোরতর বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে একদল মিছিল-সমাবেশ, সড়ক অবরোধ করছে। তাদের প্রধান দাবি বসতি উচ্ছেদ করে বিমানবন্দর করা চলবে না। তারা বিলটির অর্থনৈতিক গুরুত্বও তুলে ধরছেন। দ্বিতীয় পক্ষে আছেন মূলত ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় এমপি ও নেতাকর্মীরা।

তাদের বক্তব্য, বিমানবন্দর হলে আড়িয়ল বিল দেশের উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হবে। বিমানবন্দরের পাশে গড়ে উঠবে আধুনিক নগর, বঙ্গবন্ধু সিটি। সেখানে প্রশাসনিক রাজধানীও স্থানান্তর করা যেতে পারে। প্রতিষ্ঠা করা হবে আইটি ভিলেজ ও পর্যটন কেন্দ্র। যদিও 'উন্নয়নের মূল্য' হিসেবে কিছুটা ক্ষতি হবে; আড়িয়ল বিলের যাদের জমি আছে, তারা বেশ আকর্ষনীয় মূল্য তো পাবেনই, গোটা এলাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য, কর্মসংস্থানও বাড়বে বহুগুণে।

এসব সম্ভাবনার কথা তুলে ধরে তারাও অপেক্ষাকৃত সুশীল কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন। তৃতীয় আরেকটি পক্ষ বলছে বিলে বিমানবন্দর নির্মাণের কারিগরি সীমাবদ্ধতার কথা। তাদের মতে, বিমানবন্দরের জন্য সম্ভাব্য স্থান বন্যামুক্ত, ভূগঠনের দিক থেকে শক্ত হতে হবে। কিন্তু আড়িয়ল বিল প্রতিবছর ১৫-২৫ ফুট বন্যায় তলিয়ে যায়। বিমানবন্দর ও নগরী করতে হলে ২০-৩০ ফুট বালু ভরাট করতে হবে।

বিলটিতে গভীর পিট কয়লার স্তর থাকায় বিমানবন্দরের মতো ভারী স্থাপনা দেবে যাওয়ার হুমকি থেকেই যায়। আড়িয়ল বিলে বিমানবন্দর নির্মাণের পক্ষে যারা অবস্থান নিয়েছেন, তাদের কথা বাদ। এর পেছনে নিছক উন্নয়ন চিন্তা কতটা, তা হলফ করে বলা মুশকিল। যে দুই পক্ষ সামাজিক প্রতিক্রিয়া কিংবা কারিগরি সীমাবদ্ধতার কথা বলে আড়িয়ল বিলে বিমানবন্দর নির্মাণের বিরোধিতা করছে, তাদের কাছে প্রশ্ন। আড়িয়ল বিলে যদি বসতি না থাকত, যদি মৎস্য ও ফসল উৎপাদিত না হতো, তাহলে কি আপত্তি থাকত না? আড়িয়ল বিলের ভূ-প্রকৃতি বিমানবন্দর নির্মাণের উপযুক্ত হলেই কি আপত্তি মিটে যেত? মধুপুর গড় কিংবা ভাওয়াল শালবনের মাটি তো উপযুক্ত; গাছ-পালা উজাড় করে সেখানে কি বিমানবন্দর নির্মাণ করতে দেব আমরা? এসবের পাশাপাশি যদিও কেউ কেউ বিমানবন্দর নির্মাণের সঙ্গে রাষ্ট্র, শ্রেণীচরিত্র ইত্যাদি ধ্রুপদী তাত্ত্বিক বিতর্ক তুলছেন; বস্তুত পরিবেশ-প্রতিবেশ সুরক্ষার প্রশ্নেই আড়িয়ল বিলে বিমানবন্দরের মতো যে কোনো স্থাপনার বিরোধিতা করতে হবে।

বসতি, অর্থনীতির পাশাপাশি প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের দিক থেকে আড়িয়ল বিলের গুরুত্ব কম নয়। এটি অনেক বিরল প্রজাতির পাখি ও জলজ প্রাণীর আবাস। সেখানে রয়েছে বিপন্ন কিছু উদ্ভিদও। আড়িয়ল বিলের বাসিন্দাদের হয়তো অন্যত্র পুনর্বাসন সম্ভব। ধান-মাছের উৎপাদনের ক্ষতিও পুষিয়ে নেওয়া কঠিন নয়।

কিন্তু বিরল এইসব উদ্ভিদ ও প্রাণী হারিয়ে গেলে ফিরিয়ে আনা অনেকটা অসম্ভব। বাংলাদেশে আরেকটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণ কিংবা রাজধানী স্থানান্তরের প্রয়োজনীয়তা এর আগে বহুবারই উচ্চারিত হয়েছে। কিন্তু সেটা আড়িয়ল বিলে কেন? স্থানীয় জনসাধারণের প্রতিবাদ দূরে থাক; ২০০০ সালের প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইনে এমন উদ্যোগ স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আমার মতে, সবদিক থেকে ভালো হয়, বিমানবন্দর কিংবা নতুন নগরীর জন্য অন্য স্থানের কথা ভাবলে। তাতে করে, মহাত্মা হুমায়ুন আজাদের প্রত্যাশামতো, আড়িয়ল বিল যেমন ভালো থাকবে, ভালো থাকবে প্রস্তাবিত বিমানবন্দর তথা বাংলাদেশ বিমানের প্রতীক বলাকাও।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.