আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দিন দিন অলস হয়ে যাচ্ছি

কাঁদো, যখনি কাঁদতে ইচ্ছে করবে। কান্না শুদ্ধতম আবেগ প্রকাশের একমাত্র উতকৃষ্ট মাধ্যম। অতি সুখের সংবাদ এ মানুষ শুদ্ধতা খুজে পায়, অতি দু:খের সংবাদ এ মানুষ শুদ্ধতা খুজে পায়। কাজেই কাঁদো, কেঁদেই তোমার জীবনকে তুমি শুদ্ধতা দান করো। - তুর্কী মরমী কবি দাদায়েম ঈমাস

শিবরাম চক্রবর্তীকে একবার তার সারাদিনের রুটিন সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছিলো।

প্রশ্নকর্তা বোধ হয় লেখকের লেখার ধারাটা জানতে চাইছিলেন বা দিনের কোন সময়টাতে লেখক লেখাজোকায় কাটান তাতে হয়তো তার আগ্রহ ছিলো। শিবরাম নিতান্তই অনাগ্রহের সাথে উত্তর দিলেন, "এই সকালে ঘুম থেকে উঠি, তারপর মুখ-হাত ধুয়ে প্রাত:রাশ সেরে একটু বিছানায় গড়িয়ে নিই। গড়াতে গড়াতে এই বেলা মধ্যাহ্নে চাঁনটা সেরে আবারো কিছু সময় গড়িয়ে নিই। তারপর দুপুরের খাবারটা সেরে একটি ভাত-ঘুম দিই। সন্ধ্যার দিকে উঠে এক কাপ চায়ের সাথে একটু কিছু খেয়ে আবার একটু গড়িয়ে নিই।

গড়াতে গড়াতে রাত একটু গভীর হলে রাতের খাবারটা খেয়ে বিছানায় যাই। তারপর ঘুমিয়ে পড়ি। আবার সকালে উঠি......" কিংকর্তব্যবিমূঢ় (বানান নিশ্চিতভাবে ভুল) প্রশ্নকর্তা হতভম্ব হয়ে লেখকের দিকে তাকিয়ে রইলেন। পুরো লেখাটা এখন তেমন মনে পড়ছেনা। তবে ভাবটা এমনই ছিলো যে দিনের কোন অংশেই লেখক আর যাই করেন লেখালেখি করেন না।

অথচ শিবরামের কাছ থেকে আমরা পেয়েছি অতি মনোহর কিছু কিশোর সাহিত্য। "বাড়ী থেকে পালিয়ে" বইটি মুগ্ধ হয়ে পড়েছিলাম। যদিও উপন্যাসটি অবলম্বনে ঋত্বিক ঘটকের ছবিটা দেখা হয়নি। পিচ্চি ছেলেটার নামটাও ভুলতে বসেছি। যাই হোক, আমারো হয়েছে শিবরামের মতো অবস্হা।

সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠা অবদি রাতে বিছানায় যাওয়ার মূহুর্ত পর্যন্ত অদ্ভুত এক অলসতায় সময়গুলো কেটে যায়। সারাদিন কি করি হিসেব মেলে না, কি ভাবি হিসেব মেলেনা। যা করতে চাই তা করার সুযোগ মেলে না। যা করতে চাইনা তার সুযোগ মাঝেই মাঝেই চলে আসে এবং ভুল বশত; করে ফেরে অসহায়ের মতো সময়ের স্রোতে গা ভাসানো ছাড়া কোন উপায় থাকেনা। সাধ ও সাধ্যের সেই চিরাচরিত পাকচক্রে পড়ে মাঝে মাঝে বিহ্বল বোধ করি।

দ্বন্দ আর মেটেনা। সারাদিন কি করি? শিবরাম তো গড়াগড়ি খেতে খেতেই লিখে ফেলেছিলেন "বাড়ী থেকে পালিয়ে" এর মতো মনোরম উপন্যাস। আমি তো গড়াগড়ি খাইনা, রীতিমতো হাটাচলা করি, দৌড়োই, কথা বলি, ঝগড়া করি, স্বার্থপর হই, উপভোগ করি, বিরক্ত হই, ভালোবাসি, ঘৃনা কম করার চেষ্টা করি, প্রায়ই রেগে উঠি, ঝিমোতে ঝিমোতে গল্পের বই পড়ি, ছবি তুলি, ধুকতে ধুকতে জীবন পার করি, খেয়া নৌকোর মতো। মনে রাখার মতো কোন কিছুই করা হয়ে উঠেনা। যেন আমি শর্ট টার্ম মেমরি লুজের শিকার হয়েছি।

আগের দিনের তেমন কিছুই মনে থাকেনা। ভুলে ভরা জীবন...ভুলে থাকার জীবন। অনেক আগে এক বন্ধু বলেছিলো, দোস্ত, স্মৃতি মানেই কষ্ট। প্রথমে বুঝিনি স্মৃতি কিভাবে কষ্ট হয়ে উঠে। পরে বুঝলাম, স্মৃতি আসলেই কষ্টের জন্ম দেয়।

মধুর স্মৃতি দেয় একরাশ দীর্ঘশ্বাস...এমন দিন কি আর আসবে? যায় দিন ভালো, আসে দিন খারাপ। কষ্টের স্মৃতি তো কষ্টকেই ত্বরান্বিত করবে। কষ্টের স্মৃতিতে মুখে যে হাসি ফোটে তাতেও বিষাদ মাখানো থাকে। আমরা মানুষ, ভন্ডামীর সূতিকাগার, হাত নাড়িয়ে উপেক্ষার সুরে বলি, "ধুর...এইসব মনে করে কি হইবো...যা গ্যাছে গ্যাছে...। " পরে কিন্তু দরজা লাগাইয়া ঠিকই গলায় গামছা বাইন্ধা কান্দি।

গড়াগড়ি খাবার মতোই অর্থহীন লাগে সবকিছু। নিজের অলস সত্বাটাকে স্বিকার করে নিতে কষ্ট হয়। তবু আবার ঘুম থেকে জেগে উঠেই দৌড়োই অফিস পানে। না হলে চাকরী থাকবেনা, উতপাদিত হবেনা প্রয়োজনীয় অর্থ, সংসার চলবেনা, সমাজে মুখ দেখানো যাবেনা, ঢলে পড়তে হবে ব্যর্থতার মায়াবীতে। ক্যামু'র বিশাল প্রবন্ধের কথা মনে পড়ে।

The Myth of Sisyphus। আমি এমন বিশাল কোন পন্ডিত হয়ে উঠি নাই যে এই প্রবন্ধখানা আমি পড়ে ফেলবো এবং এর মূল ভাব বুঝে বিজ্ঞের মতো মাথা ঝাকিয়ে বলবো, "হুমমমম...ক্যামু সাহেব বেশ ভালো লিখেছেন"। আমি অলস মানুষ। পড়া হয়ে উঠেনা তাই অনেকটা অলসতায়, অনেকটা বুদ্ধিবৃত্তিক সীমাব্ধতার কারনে। তবুও মনে পড়ে যায়, সেই কাব্যিক বানী।

জীবন দৈনন্দিনতা প্রসন্গে লেখকের হতাশা ফোটে উঠে কথাটির পরতে পরতে। ঘুম, অফিস, খাওয়া, বাড়ীফেরা, সোমবার মন্গল বুধ বৃহ:শ্পতি শুক্র শনি একই ছন্দে, একই গতিতে একই পথ ধরে চলে আসা যাওয়ার পালা। "It happens that the stage sets collapse. Rising, streetcar, four hours in the office or the factory, meal, streetcar, four hours of work, meal, sleep and Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday and Saturday according to the same rhythm — this path is easily followed most of the time. But one day the "why" arises and everything begins in that weariness tinged with amazement." তবে হুমায়ূন আজাদ নিশ্চিত পড়েছিলেন উপরে বর্নিত ক্যামুর কথাটি। তিনি নিরর্থক জীবনের যে ফিলোসফী সবসময় কপচাইতেন ইহা নির্ঘাত ক্যামু'র এই প্রবন্ধ থেকে নেয়া। "আমার অবিশ্বাস" গ্রন্থে'র পরতে পরতে তার ছাপ পাওয়া যায়।

জীবনটা নিরর্থক, এর আগেও কিছু নেই পেছনেও কিছু নেই। জীবনটা হলো দুই আঁধারের একটুখানি আলোর ঝলক। শুনতে বেশ লাগে, কিন্তু মানতে গেলেই হাজার বছরের প্রথা'র নাগপাশে জড়িয়ে পড়ি বিপুল বিক্রমে। তাই আমি ভাবি, জীবনের এবসার্ডিটি জেনে কি হবে। জ্ঞানী'র অনেক দু:খ।

জেনে ফেলার দু:খ। মুর্খরাই প্রকৃত অর্থে সুখী। জ্ঞানে কোন সুখ নেই। গড়িয়ে চলে জীবন চরম অলসতায়। নিরর্থকতার নাগপাশে।

ভাবি, আসলেই দিন দিন অলস হয়ে যাচ্ছি। সবকিছু স্মৃতি হয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘশ্বাস হয়ে যাচ্ছে..... নোট: লেখাটি ইতিপূর্বে আমরাবন্ধু ব্লগে পোষ্টিত

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।