আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মিথ-থ্রি ওয়ান ওয়ান নাইন



ক নীলাচল পাহাড়টা খুব বেশি উঁচু না। তবে খুব সুন্দর। নিচ থেকে দেখলে গাছগাছালিতে ভরা সবুজ পাহাড়টা দারুন লাগে। পাহাড়ের পেছনে শরৎকালের স্বচ্ছ নীল আকাশ দেখে কেন যেন মন খারাপ হয়ে যায়। অনেক দিন আগের অনেক মায়া ভরা শরৎের কথা মনে পড়ে ।

যারা নেই তাদের কথা মনে পড়ে। তুন হাসল মনে মনে। আজ ওর মনটা খারাপ । তাই এত সুন্দর পাহাড় দেখেও ওর মনটা খারাপ হয়ে গেছে। নইলে এমন চমৎকার পাহাড় , এমন সুন্দর আকাশ দেখে মন খারাপ হওয়ার কিছু নেই।

তুন বড় হয়েছে একটা শিশুকেন্দ্রে। বিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টায় শিশুকেন্দ্রগুলি একেকটা দেবালয়ে পরিনত হয়েছে। শিশুকেন্দ্রে শিশুদের সাথে সাড়াজীবন কাটানোর জন্য যারা সিদ্ধান্ত নেন, তাদের মাথায় ছোট একটা অপারেশন করা হয়। অপারেশন করে মানুষের কুপ্রবৃত্তি সৃষ্টিকরা নিওরনগুলিকে অকেজো করে দেয়া হয়। ফলে একজন মানুষের মধ্যে শুধু ভাল গুন থাকে।

খারাপ কিছু থাকেনা। মানুষ পরিনত হয় মহান মানুষে। বিজ্ঞানীরা 'মহান মানুষ' নিয়ে গবেষনা করছেন কয়েক দশক হলো। এ প্রজন্মের উপর পরীক্ষা-নীরিক্ষা সফল হলে মহান মানুষ তৈরির প্রকল্প আরো বিসতৃত করা হবে। মহান মানুষদের নিয়োগ দেয়া হবে বিশ্বের বিভিন্ন বিদ্যাপীঠে, সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে।

যাতে সাধারন মানুষ এসব যায়গা থেকে আরো বেশি সেবা পেতে পারে। তবে এ অপারেশনের ফলে মানুষের ঘৃনা,রাগ করা,আক্রমন করার ক্ষমতা থাকেনা। ফলে মহান মানুষদের সহজেই আক্রান্ত হওয়ার ভয় থাকে। তাই মহান মানুষদের পাশে সব সময় যোদ্ধা রোবট রাখতে হয়। তাদের রক্ষার জন্য।

তুন যে শিশুকেন্দ্রে থাকতো সেখানকার সবাই এমন মহান মানুষ। ফলে শিশুকেন্দ্রটি আশ্রিতদের কাছে একেকটা দেবালয়ের মতো। বিষয়টি আরো বেশি টের পাওয়া যায় যখন কেউ এসব শিশুকেন্দ্র থেকে বাইরে যায়। একটা নির্দিষ্ট সময় পরে আর শিশুকেন্দ্রে থাকা যায়না। বাইরে বের হয়ে কাজ করতে হয়।

তুন বেশ কয়েকবছর আগেই শিশুকেন্দ্র ছেড়ে বাইরে কাজ করেছে। কিন্তু তার সব কর্মস্থলই ছিলো ওর শিশুকেন্দ্র থেকে গ্রাভিটেশন ট্রেনে এক ঘন্টার দূরত্বের মধ্যে। কিন্তু এবার ও যেখানে কাজ করতে এসেছে সেখান থেকে ওদের শিশুকেন্দ্রের দূরত্ব অনেক বেশি। যেতে হলে কমপক্ষে পাঁচঘন্টার পথ। তাই ইচ্ছে হলেও সহজেই ও শিশুকেন্দ্রে যেতে পারবে না।

তাই এ কাজে যোগ দিতে এসে ওর মন খুবই খারাপ। যদিও এ কাজটাতে ও পারিশ্রমিক আর সূযোগ-সুবিধা পাবে আগের চাইতে অনেক বেশি। পাহাড়ের বেশ খানিকটা উপরে উঠে এলো সে। মহান বা সাধারন কোন ধরনের মানুষকেই দেখা যাচ্ছে না। এখানে বেশ বাতাস।

তুনের রেশমী চুলগুলিকে বারবার এলোমেলো করে দিচ্ছে। ওকে পাহাড়ের উপরে নিতে একটা পিএসভি (পাসের্ানাল সোলার ভেহিক্যাল) পাহাড়ের নিচে থাকার কথা ছিল। কিন্তু সেরকম কিছু দেখা যাচ্ছে না। সে বেশ কিছুদূর উঠে এসেছে। আসতে আসতেও তেমন কিছু চোখে পড়েনি।

তুন অবশ্য যোগাযোগ মডিউলে মেসেজ পাঠালেই পাঁচ মিনিটের মধ্যে একটি পিএসভি চলে আসবে। ওর জন্য যে পিএসভিটা থাকার কথা সেটি কোথায় এটাও সে ইচ্ছে করলে জানতে পারে। কিন্তু ওর জানতে ইচ্ছে করছে না। গাছগাছালির ছায়ায় হেঁটে পাহাড়ে উঠতে ভাল লাগছে। পাহাড়ের রাস্তাটা খাড়া নয়।

এমনভাবে তৈরী করা যে হেঁটে উঠতেও বেশি খারাপ লাগেনা। রাস্তায় একটু পরপর সুন্দর বেঞ্চ পাতা। মরিচারোধী মেটালের উপর কাঠের কারুকাজ। কিছুদূর উঠে তুন বসল একটা বেঞ্চিতে। বেঞ্চের উপরে একটা রডোডেনড্রন ফুল ফুটে আছে।

এখানে রডোডেনড্রন ফোটার কথা না। এটি এ এলাকার গাছ না। কোত্থেকে এলো? কেউ বোধহয় এখানে এনে লাগিয়েছে। বেঞ্চের নিচে অন্য এক ধরনের ফুল বিছিয়ে আছে। নীল রঙের ছোট ছোট অসংখ্য ফুল।

পাহাড়ের নিচ পর্যন্ত এ ছোট ফুলের লতা নেমে গেছে। তুন যখন ফুল নিয়ে ভাবছে তখন ওর সামনে একটা পিএসভি এসে থামলো। পিএসভির রোবট চালক টানা টানা কন্ঠে বলল, 'তুন আপনাকে নেয়ার জন্য আমি এসেছি। আমার সার্কিটে ইদানিং সমস্যা দেখা দিয়েছে। তাই প্রায়ই তথ্য বিভ্রাট হয়।

আমি পাহাড়ের উল্টো দিকের পথে আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। ' 'ভাল করছিলে। আরো কিছুক্ষন অপেক্ষা করে এসো । ততক্ষনে আমি হেঁটে আমার গন্তব্যে পৌছে যাবো। ' রোবট ড্রাইভারটি তার মাথায় প্রোগ্রাম করা বোকা বোকা হাসিটি বের করে আনল।

'হে হে হে হে। আমি কি অপেক্ষা করব না চলে যাবো?' 'তুমি উড়তে থাকো। ' তুনের এ কমান্ডে রোবটটির সার্কিটে বোধ হয় আবার সমস্যা দেখা দিল। হাসি বন্ধ হয়ে গেল। মুখ গম্ভীর করে সে অযথাই কয়েকবার ফ্রন্ট লাইট জ্বালালো- নেভালো।

হঠাৎ কি মনে করে পিএসভি থেকে নেমে এর চার পাশে দু'তিন বার ঘুরে এলো। তারপর আবার পিএসভিতে নিজের সিটে বসে পড়ল। 'ম্যাডাম আমি আপনার কমান্ড অনুযায়ী কাজ করতে পারছিনা। এজন্য দুঃখিত। আমার সার্কিটে সমস্যার জন্য বোধ হয় আমি কাজটা করতে পারছিনা।

ম্যাডাম কি আমাকে একটু বুঝিয়ে দেবেন, কি করলে আমি আপনার কমান্ডটা পালন করতে পারব?' 'বুঝতে হবেনা গাধা। চলো আমাকে পাহাড়ের উপরে সায়েন্টিফিক হাউজে নিয়ে চলো। ' তুন উঠে বসলো গাড়িতে। উড়ার চেষ্টা করতে করতে রোবটটা কি করে ফেলে কে জানে। কমর্ী রোবট তৈরীর কোম্পানী 'রোবোটিকা' তে চাকুরি হয়েছে তুনের।

পিএসভির ড্রাইভারের মতো কমর্ী রোবটদের নিয়েই তার কাজ। এ কমর্ী রোবটটি ৩১১৮ টাইপের। এ ধরনের কমর্ী রোবট মানুষকে সেবা দিতে খুবই নিবেদিত প্রাণ। দেখতে অনেকখানিই মানুষের মতো। শুধু বুকে ঝোলানো একটি সোলার প্যানেলের কারনে বোঝা যায় এটি রোবট।

কিন্তু এসব রোবটের বুদ্ধির স্তর নিচে। বোকা টাইপের। সবসময় মানুষের উপকার করতে চায়। কিন্তু ভাল করতে গিয়ে কম বুদ্ধির কারনে একটা গন্ডগোল বাঁধিয়ে ফেলে। এ কারনে চেষ্টা চলছে উন্নত প্রজাতির (৩১১৯ প্রজাতির) রোবট তৈরীর।

যাদের বুদ্ধির স্তর মানুষের কাছাকাছি। বিজ্ঞানীরা এর মধ্যে এ প্রজাতির এক ব্যাচ রোবট তৈরীও করেছেন। এদের পরীক্ষা-নীরিক্ষার জন্য দেয়া হচ্ছে নির্দিষ্ট কয়েকটি ব্যাক্তির কাছে। এসব নির্দিষ্ট ব্যাক্তির মধ্যে তুন একজন। তার জন্য বরাদ্দ করা সায়েন্টিফিক হাউজে পৌছে এ প্রজাতির একটি কমর্ী রোবট পাওয়ার কথা।

পাহাড় চূড়ায় সায়েন্টিফিক হাউজটা দারুন লাগছে। সায়েন্টিফিক হাউজের দেয়াল, দরজা, জানালার বাইরের অংশটি সোলার প্যানেল বসানো। এসব সোলার প্যানেল সৌরশক্তি সংগ্রহ করে বাড়ির জন্য বিদ্যুৎ তৈরী করতে । কোন সায়েন্টিফিক হাউজে বাইরে থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করার প্রয়োজন পড়েনা। বিকেলের নরম আলো সোলার প্যানেলগুলি থেকে কিছুটা প্রতিফলিত হচ্ছে।

সায়েন্টিফিক হাউজের চারিদিকে নানা ধরনের গাছগাছালি, লতাপাতা। পাখিরা গাছে বসা নিয়ে কিচির মিচির করছে। বাড়ির সামনের খোলা যায়গায় খেলছে তিনটি শিশু । সায়েন্টিফিক হাউজে ঢোকার জন্য পাশাপাশি দ'ুটি দরজা। দ'ুটি দরজার পাশেই টাচ কি।

ডানের দরজাটিতে তুনের নাম ফলক লাগানো। তুন পার্ট থ্রি কমর্ী, রোবোটিকা। বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় কোন অফিসের সবাই কমর্ী। অফিসার বলতে কোন পদ নেই। সবার কাজই গুরুত্বপূর্ন-এটি বোঝাতে এ ব্যবস্থা।

পার্ট দিয়ে বোঝায় সে ঐ কোম্পানীর কোন বিভাগে কাজ করছে। বিশ্ব ব্যবস্থার প্রবক্তারা বলেছিলেন ধীরে ধীরে কোন কোম্পানীর 'মালিক'-নামের বিষয়টিও থাকবেনা। ব্যাক্তিগত সাফল্যের স্বিকৃতি থাকবে ভিন্নভাবে। যেকোন কোম্পানীর মালিক হবে কম বেশি সব কমর্ী। শেষ পর্যন্ত তা আর হয়নি।

এ নিয়ে বেশ হৈ চৈ হচ্ছে । দরজার পাশের টাচ কি'তে বৃদ্ধাঙ্গুল রাখলো তুন। মূহূর্তে ওর হাতের রিডিং পড়ে নিল কম্পিউটার। দরজা খুলে গেল। সয়েন্টিফিক হাউজের প্রতিটি কক্ষ বেশ বড়।

এমনভাবে তৈরী যাতে বাইরে সূর্যের শেষ আলো থাকা পর্যনত্দ এতে ভাল আলো আসে। কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত বাড়ির দেয়ালগুলি প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন দিকে বেঁকে গিয়ে ঘরের ভেতরে যতটুকু বেশি সম্ভব প্রাকৃতিক বাতাস ঢোকানোর ব্যবস্থা করবে। বিভিন্ন উপাদানে তৈরী দেয়ালগুলিতে বেশ কয়েকটি সত্দর রয়েছে। এ সত্দরের মধ্যে থাকা বাতাস গরম ও ঠান্ডার বাঁধা প্রদানকারি হিসেবে কাজ করে। তাই ভেতরে গরম ও শীত দুটিই কম অনূভূত হয়।

তুন বাড়ির পেছনের দরজাটি খুলে দিল। বেশ সুন্দর একটা বাড়ান্দা। নীলাচল পাহাড়ের পেছনে সমুদ্র। বাড়ান্দায় দাঁড়ালে মনে হয় এই একটু দূরেই সমুদ্র। সমুদ্রের বেলাভূমি অনেক দূর পর্যনত্দ দেখা যায়।

পহাড়ে উঠতে উঠতে ও ভাবছিল এখানে এসেই আগে গোসল করবে। কিন্তু বাড়ান্দাটি দেখে এখন আর গোসল করতে যেতে ইচ্ছে করছেনা। তুন একটা চেয়ার টেনে বাড়ান্দায় বসে রইল। অনেক তরুন-তরুনী হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে। কয়েকজন ঝাঁপাঝাঁপি করছে সমুদ্রে।

অনেক দূর থেকে ভেসে এলো জাহাজের ভোঁ । একটা জাহাজ বোধ হয় ফিরে আসছে বন্দরের দিকে। দেখতে দেখতে অসত্দ গেল সূর্যটা। তুনের বাড়ির ভেতরে সোলার লাইট জ্বলে উঠেছে। একটি চমৎকার ঝাড়বাতি জ্বলছে বসার ঘরের মাঝখানে।

সোলার লাইটের দীপনমাত্রা এমনিতেই বেশি। এর উপরে ঝাড়বাতির কারনে পুরো ঘর আলোয় আলোময়। তুন নিজের বাড়িটাকেই দেখছে ঘুরে ঘুরে। ওর জন্য চমৎকার একটা বাড়ি বরাদ্দ করেছে। পৃথিবীর অনেক লোককেই বিশ্বব্যবস্থা এখন ভাল বাড়ি দিয়েছে।

জনসংখ্যা কমিয়ে আনায় এটা সম্ভব হয়েছে। নইলে এটা সম্ভব ছিলনা। তুনের যোগাযোগ মডিউলে বিশেষ সংকেত বেজে উঠেছে। কেউ তার বাড়ির দরজায় এসেছে। তুন এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলে দিলো।

মিষ্টি চেহারার এক কিশোরী দাঁড়িয়ে আছে দরজায়। মাথায় দুটো লম্বা বিনুনী। মুখটা হাসি হাসি। 'ম্যাডাম আমি ৩১১৯ প্রজাতির নতুন রোবট। আমার নাম মিথ।

আমার আপনার সাথে থাকার কথা। ' এমন মায়াকাড়া চেহারার মেয়েটি একটি রোবট? তুনের ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে। ওহ্ কি সুন্দর চোখ মেয়েটির। 'এসো , এসো ভেতরে এসো। ' রোবট মিথ ভেতরে ঢুকলো।

কোত্থেকে যেন একটা বিপ বিপ শব্দ হচ্ছে। তুন মেয়েটির চুল সড়িয়ে দেখলো পেছনে ব্যাটারি। রোবটটির পোষাকের ডিজাইন হিসেবে, হাত-পায়ের নখে শক্তিশালী সোলার প্যানেল খুব সুক্ষভাবে বসানো । এগুলি যে সোলার প্যানেল প্রথমে দেখে তা বোঝার কোন উপায় নেই। এসব প্যানেল থেকেই ব্যাটারিটি চার্জ নিবে।

কিন্তু রোবটটি তৈরী করার কাজ আজই শেষ হয়েছে। তাই ব্যাটারিটি বোধ হয় ঠিকমতো চার্জ নিতে পারেনি। তুন রোবটটির পাওয়ার সাপ্লাই ইউনিট পুরো বন্ধ করে চার্জে দিলো। একবার এটি পূর্ন চার্জ হলে এরপর এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে চার্জ নিতে থাকবে। আর কখনও এর পুরো পাওয়ার সাপ্লাই বন্ধ করে চার্জে দিতে হবেনা।

এমনকি চেষ্টা করলেও এর পাওয়ার সাপ্লাই বন্ধ হবেনা। পাওয়ার সাপ্লাই বন্ধ করতে নির্দিষ্ট সময় পর বিশ্ব ব্যবস্থার কাছ থেকে বিশেষ অনুমোতি নিতে হবে। দরজার বাইরে বাচ্চাদের কোলাহল শোনা গেলো। 'আমি ধাক্কা দিবো, আমি দিবো'। কয়েকজন বাচ্চা একসাথে দরজায় ধাক্কা দিতে লাগলো।

'এই আমি বলেছিনা আমি আগে ধাক্কা দিবো, তুই দিলি কেনো?' নিজেরা ঝগড়া লেগে গেছে। তুন গিয়ে টাচ কি ছুঁয়ে দরজা খুলে দিলো। বাচ্চারা মারমারি বন্ধ করে তার দিকে তাকিয়ে অমায়িক ভঙ্গিতে হাসলো। তিনজন বাচ্চাই একসাথে বললো,'আমরা আপনার গেষ্ট'। 'ও গেষ্ট, আচ্ছা আসেন আসেন, ভেতরে আসেন।

' দু'টি মেয়ে একটি ছেলে। তিনজনই তুনের সোফায় পা তুলে এক হাত অন্য হাতের উপর রেখে গম্ভীর হয়ে বসলো। একজন বড়দের মতো প্রশ্ন করলো, 'আপনাকে দেখলাম এক ঘন্টা পরে বাড়িতে ঢুকতে। কিন্তু আপনারতো একঘন্টা আগে আসার কথা ছিলো। দেরী হলো কেন?' তুন মাত্র উত্তর দিতে যাচ্ছিলো।

ছেলেটি ভ্রু কুঁচকে বললো,'নিশ্চই পথে পরিচিত কারো সাথে দেখা হয়েছে। তাই দেরী হয়েছে। এটা তো অফিস না বাসা। বাসায় আসতে দেরী হলে অসুবিধা কোথায়? এটি কি জিজ্ঞেস করার মতো কোন প্রশ্ন হলো?' আগের মেয়েটি এবার বেনী দুলিয়ে ক্রদ্ধ স্বরে বললো,'কোন প্রশ্নটা করার মতো শুনি?' 'সে কতদূর থেকে এসেছে, বেশি দূর থেকে এসে থাকলে আসতে আসতে শরির খারাপ হয়েছে কিনা, বাসার জন্য মন খারাপ লাগছে কিনা এসব এখন জিজ্ঞেস করতে হবে। ' 'তুই বেশি জানিস না?' 'হ্যা......' ছেলেটি কিছু বলতে যাচ্ছিলো।

' তুন ওদেরকে থামিয়ে দিলো। 'আচ্ছা তোমাদের নাম কি?' ছেলেটিই আগে উত্তর দিলো। রাগী রাগী গলায়। আমার নাম ডিল। বিনুনী দোলানো মেয়েটা বললো,'আমার নাম রেফা।

আর ওর নাম শেন। ' শেন বললো হাসি হাসি গলায়,'হ্যা আমার নাম শে-ন। আপনার নাম কি?' 'আমার নাম তুন। তোমরা কি খাবে?' তিনজন একসাথে উত্তর দিলো 'আইসক্রিম। ' 'আইসক্রিম,আইসক্রিম' নিজের মনে বললো তুন।

আসলে বাসায় কোনো খাবার দেয়া আছে কিনা তাও সে জানে না। আর থাকলেও সেগুলো কোথাও তাও সে জানে না। অবশ্য ওকে বলা হয়েছিলো বাসায় এক মাসের রেশন দেয়া থাকবে। বাসায় ফিরে বাজার করার চিন্তা করতে হবেনা। প্রতিটি সায়েন্টিফিক বাড়িতে হাউজ কম্পিউটার থাকে।

বাড়িতে কোথায় কি আছে, কে কখন কবে এ বাড়িতে এসেছিলো তার সব কিছু থাকে মেমোরিতে। তুন তার হাইজ কম্পিউটার মেমোরিতে সার্চ দিলো। ফ্রিজারটি কাভার্ডের মতো ভেতরের ঘরের দেয়ালে বসানো। সেখানে আইসক্রিম আছে। আরো বেশ কিছু তৈরী খাবার আছে।

সোলার ওভেনে গরম করলেই খাওয়া যাবে। তুন বাচ্চাদের জন্য আইসক্রিম নিয়ে এলো। আইসক্রিম দ্রুত শেষ হয়ে গেলো। 'তোমরা কোথায় থাকো?' তুনের এ প্রশ্নে তিন বাচ্চারই মনে পড়লো তারা এ বাসায় কেনো এসেছে। রেফা বললো,'আপনার বাসায় আমরা যে জন্য এসেছি সে কথাটাই বলা হয়নি।

' 'তাই নাকি ? কেন এসেছো?' 'আপনাকে দাওয়াত দিতে। আজ রাতে আমাদের বাসায় আপনাকে খেতে বলেছে বাবা। আমরা আপনার পাশের বাড়ির দোতলায় থাকি। আমার বাবাকে তো চেনেন?' 'না তো, তোমার বাবার নাম কি?' 'কেন আমার বাবার নাম তো রিফ। আপনাদের কোম্পানীর লোক।

রোবট তৈরী করে। ' 'ভাঙ্গা রোবট তৈরী করে, হাত পা খুলে খুলে পড়ে যায় রোবটের, হে হে হে হে। ' শেন বললো। 'শেন ভালো হবে না বলে দিচ্ছি। ' 'কেন তোমার মা-ই তো কাল বললো।

' 'শেন তোমার কি লাগে?' রেফাকে জিজ্ঞেস করলো তুন। রেফার বদলে শেনই উত্তর দিলো। 'রেফার আর ডিল এর বাবা আমার বাবার সাথে একসাথে কাজ করে। আমরা রেফাদের বাসায় বেড়াতে এসেছি। ' কয়েক প্রজন্ম ধরে জনসংখ্যা ব্যাপকভাবে নিয়ন্ত্রনের কারনে মামাতো ভাই ,খালাতো বোনের মতো সম্পর্কগুলি খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।

দূরের লোকজনকে আপন করে মানুষ এখন সে ঘাটতি মুছতে চাচ্ছে। কবে যে আবার সেসব সম্পর্ক তৈরী হবে কে জানে। খ বাচ্চারা যাওয়ার পর ঘরের কোথায় কি আছে জানতে নেমে পড়লো তুন। রোবট মিথের চার্জ নেয়া শেষ হয়ে গিয়েছিলো। সেও তুনের সাথে কাজ করতে লাগলো।

অনেক দিন কেউ এ বাড়িতে না থাকায় বিভিণ্ন স্থানে ধুলা জমেছে। যদিও বিশ্ব ব্যবস্থার কমর্ীদের মাসে একবার এসব পরিস্কার করার কথা। কিন্তু পরিস্কার করলেও বোধ হয় ঠিকমতো করেনি। বাড়ির বুক শেলফটাতে প্রচুর কাগজের বই। হাউজ কম্পিউটারে অবশ্য এক লাখ ইলেকট্রনিক বইয়ের একটা বিশাল লাইব্রেরী আছে।

তুনের অনেক প্রিয় লেখকের বই-ই পাওয়া গেলো কাগজের বইগুলির মধ্যে। বইগুলিতে বেশ ধুলা। বোধহয় আগে যারা থেকেছেন তারা ইলেকট্রনিক বই-ই বেশি ব্যবহার করেছেন। কাগজের বই ব্যবহার করেনি। মিথকে সাথে নিয়ে ধুলা পরিস্কার করতে লেগে গেলো তুন।

বইয়ের ব্যাপারে মিথের বেশ আগ্রহ দেখা গেলো। বই পরিস্কার করার পর সে প্রায়ই বইগুলি যত্ন করে উল্টে-পাল্টে দেখছে। এখন মিথ যে বইটি উল্টাচ্ছে সেটি একটি কবিতার বই। যে কবিতায় ওর চোখ আটকে আছে সেটিও তুনের খুব প্রিয়। তুন মনে মনে কবিতাটি আবৃত্তি করতে থাকলো।

আমি যদি বনহংস হতাম বনহংসি হতে যদি তুমি। কোনো এক দিগন্তের জলসিড়ি নদীর ধারে ধানক্ষেতের কাছে ছিপছিপে শরের ভিতর এক নিরালা নীড়ে তাহলে আজ এই ফাল্গুনের রাতে ঝাউয়ের শাখার পেছনে চাঁদ উঠতে দেখে আমরা নিম্নভুমির জলের গন্ধ ছেড়ে আকাশের রুপালি শষ্যের ভিতর গা ভাসিয়ে দিতাম...... মিথ বোধহয় কবিতাটি পুরো না পড়েই বই রেখে দিয়েছে। বই গোছগাছ করতে করতে রাতে খাবারের সময় হয়ে এলো। 'মিথ তুমি কাজগুলি গোছাতে থাকো। আমি রেডি হয়ে নেই।

আমার একটু পাশের বাসায় যেতে হবে। ' মিথ কিছু বললো না। আপন মনে কাজ করছে। তুন গেলো ওর শোবার ঘরে। দেয়ালে যে কোনো কাভার্ড আছে তা দেখে বোঝার উপায় নেই।

শুধু একটা টাচ কি দেখা যাচ্ছে। ওর আঙ্গুলের ছাঁপ এখানেও দেয়া। ও না ছুঁলে কাভার্ড খুলবে না। ও ছুঁতেই দেয়ালের খানিকটা অংশে দারুন কারুকার্য্য ফুটে উঠলো। বোঝা গেলো এখানে একটি কাভার্ড আছে।

এর মাঝে ধাক্কা দিতেই খুলে গেলো কাভার্ডের দরজা। এতক্ষন পড়ে থাকা ওর সাদা পোষাকটি খুলে রাখলো কাভার্ডে। দিনের জন্য সাদা পোষাক। আলো প্রতিফলন করে। পড়তে আরামদায়ক।

ভেতরে রাতে পড়ার মতো গাঢ় রঙের বেশ কয়েকটা পোষাক। প্রাকৃতিক তন্তু , কৃত্রিম তন্তু, পলিমার তিন ধরনের পোষাকই আছে। তুন প্রাকৃতিক তন্তুর একটা পোষাক নিলো। তৈরী হয়ে বাইরের কক্ষে এলো তুন । মিথ বইয়ের আলমারির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দাড়িয়ে আছে।

কিছু বলছে না। কিছু কি মনযোগ দিয়ে দেখছে? না আনমনা হয়ে তাকিয়ে আছে? মিথের কি মন খারাপ? তুন বোঝার চেষ্টা করলো। রোবটের তো মন থাকে না। মন খারাপ হবে কিভাবে? যদিও মিথ অনেক আধুনিক রোবট। বুদ্ধিমত্তায় মানুষের কাছাকাছি।

কিন্তু মন খারাপ! মিথ কি করছো? 'কিছু না। ' মুখ বেশ কালো। মন খারাপের স্পষ্ট চিহ্ন চেহারায়। ৩১১৯ প্রজাতির রোবটের চেহারায় নানা ধরনের আবেগ, মিশ্রিত আবেগের প্রকট অভিব্যাক্তি ফুটে উঠবে। এটাই স্বাভাবিক।

সেভাবেই তাদের তৈরী করা হয়েছে। আগের প্রজাতির কিছু রোবটেও এ অভিব্যাক্তি ফুটে উঠতো। কিন্তু এত প্রকটভাবে না। তুন মিথের সামনে গিয়ে ওর কাঁধে হাত রাখলো। 'তোমার কি মন খারাপ?' 'না মন খারাপ হবে কিভাবে, রোবটের কি মন থাকে? মন থাকলেই না মন খারাপ হওয়ার প্রশ্ন।

' তুন কিছুটা ধাক্কা খেলো। ও যেভাবে ভেবেছে রোবট হয়েও মিথও সেভাবেই ভাবছে। এ প্রজাতির রোবটের সাথে মানুষের ব্যবধান কতটুকু ? অনেক কাছাকাছি? কতটা কাছাকাছি? তুন মিথের মাথায় হাত বুলালো। কোন কিশোরী মন খারাপ করলে যেমন স্বজনরা আদর করে- সেভাবে। মিথকে দেখে এখন এক সদ্য কিশোরী ছাড়া অন্য কিছু মনে হচ্ছে না।

'মিথ তুমি মন খারাপ করেছো বুঝতে পেরেছি। কিন্তু কেন তোমার মন খারাপ না বললে তো আমি বুঝতে পারবো না। বলোতো আমাকে কি হয়েছে?' মিথ চুপ করে আছে। তুন বুঝতে পারলো মিথ সময় নিচ্ছে। ও বলবে।

'বলো তো মিথ । ' মিথ বলা শুরু করলো। 'বই মুছতে মুছতে আমি একটা বই পড়ার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু বারবারই মেমোরি আমাকে বাঁধা দিচ্ছিলো। বারবারই মেমোরিতে আসছিলো অ-অনুমোদিত।

আমি যখন বাড়ির ঠিকানা পড়ি, সাইনবোর্ড পড়ি তখনতো অ-অনুমোদিত আসেনা। বই পড়ার সময় কেন অ-অনুমোদিত আসবে? আমাকে কেন বই পড়ার সূযোগ দেয়া হবেনা? রোবট বলে? আমি শুধু মানুষের জন্য কাজই করে যাবো ? নিজের আনন্দের জন্য কিছু করতে পারবোনা? যদি এমনই আপনাদের ইচ্ছে ছিলো, তাহলে কেন আমাকে এমন বুদ্ধি দেয়া হলো যে আমার বই পড়তে ইচ্ছে হয়। আপনারাতো আমাকে সৃষ্টি করেছেন। চাইলেই তো এমনভাবে আমাকে সৃষ্টি করতে পারতেন, যাতে আমার নিজের জন্য কিছু করতে ইচ্ছে না করে। ' তুনের চিন্তার জগতে ঝড় বইতে লাগলো।

মিথ এসব কি বলছে? ৩১১৯ প্রজাতির একটা রোবট কি বলছে? এ-তো সব মানুষের কথা। বিজ্ঞানীরা কি ভুলে মানুষ তৈরী করে ফেলেছেন? তুন ধপ্ করে সোফায় বসে পড়লো। মিথের কথার কোন জবাব দিতে পারলো না। সায়েন্টিফিক বাড়িতে সব সময় তাপমাত্রা কম থাকে। একটু ঠান্ডা ঠান্ডা অনূভূত হয়।

কিন্তু তুনের মনে হচ্ছে বাড়িটির সিষ্টেমে কোন সমস্যা আছে। এটি ঠিকমতো কাজ করছে না। কারন ওর গরম লাগছে। তাপমাত্রা কমিয়ে দেয়ার যন্ত্র সচল করা প্রয়োজন। ধাতস্থ হতে বেশ কিছুক্ষন লেগে গেলো।

যোগাযোগ মডিউলে ওর প্রতিবেশী সহকমর্ী রিফের বাড়িতে যাওয়ার জন্য সংকেত আসছে। রিফের বাড়িতে যাওয়া নিছক সামাজিকতা নয়। ওর নতুন দায়িত্বের বিষয়ে এক ধরনের মিটিংও হবে খেতে খেতে। তাই অন্য দু'জন সহকমর্ীও ওর বাসায় এসেছে। এক দিকে বেড়ানো অন্যদিকে রাতের মিটিংটা সাড়তে।

তুন বেশ মন খারাপ করেই বের হলো। গ তুনের বাড়ি থেকে অল্প কিছু দূর হাঁটলেই রিফের দো'তলা বাড়ি। এ বাড়ির পরে আর একটা মাত্র বাড়ি। সমুদ্রের নাবিকদের সুবিধার জন্য একটা লাইট হাউজ। এরপর চোখের সীমানায় আর কোন জনবসতি নেই ।

অথচ এক সময় এ সমুদ্রের পাড় বাড়িঘরে গিজগিজ করতো। জনসংখ্যা কমিয়ে আনার পরে প্রথমেই সমুদ্রের পার, নদীর পার, বনের প্রাকৃতিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়েছে। রিফের বাড়ির সামনে দাঁড়াতেই দরজা খুলে গেলো। আগে থেকেই হাউজ কম্পিউটারকে নির্দেশনা দেয়া আছে। কম্পিউটার তুনের ইমেজ মিলিয়ে দেখে দরজা খুলে দিয়েছে।

একজন কমর্ী রোবট দরজায় তাকে অভ্যর্থনা জানালো। মিথের চাইতে দু'প্রজন্ম পুরনো রোবট। ও ঢুকতেই বাচ্চারা নিচে নেমে এলো। 'আরে আপনি এতো দেরী করলেন কেন? কখন থেকে সবাই খাই খাই করে খাচ্ছে না। আমরা তো দেরী করতে পারিনা।

আগেই খেয়ে নিয়েছি। ' রেফা বললো। 'ভালো করেছো। দো'তলায় উঠতে হয় কোন দিক দিয়ে?' 'চলেন দেখিয়ে দিচ্ছি। ' মরুভূমি অঞ্চলের সুপের চমৎকার গন্ধ এসে নাকে ধাক্কা দিলো।

সেই সাথে মরুভূমি অঞ্চলের লোক সঙ্গীত খুব হাল্কা শব্দে বাজছে। মনে হচ্ছে অনেক দূর থেকে গানগুলি ভেসে আসছে। রিফ বোধহয় মরুভূমি অঞ্চলের সঙ্গীত আর খাবার পছন্দ করে। হয়তো ওর জন্ম কোন মরুভূমিতে। কম্পিউটারে প্রোফাইল দেখলেই জানা যাবে।

'আরে তুন এসে গেছেন, আমরা তো আপনার জন্য অপেক্ষা করছি। একটু দেরী করে ফেললেন। ' 'হ্যা, গোছগাছ করতে করতে একটু দেরী হয়ে গেলো। দেরীর জন্য আমি দু:খিত। ' 'আসুন পরিচয় করিয়ে দেই।

নিরো ডিল , এ হচ্ছে তুন যার কথা বলছিলাম। এখন আমার প্রতিবেশী। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় যার অসাধারন জ্ঞান। আগে আমাদের কোম্পানীতেই কাজ করতো। ভূ-মধ্য সাগরীয় অঞ্চলে।

আমাদের টিমে ওকে আনা হয়েছে ৩১১৯ প্রজাতির রোবট পরীক্ষার জন্য। এ প্রজাতির রোবট তৈরীর পেছনেও ওর যথেষ্ট অবদান আছে। ' 'ও হ্যা, এ প্রজাতির রোবট তৈরীর ব্যাপারে আপনার লেখা আমি পড়েছি। আমি মিশেন মির। আমিও আগে ভূ-মধ্য সাগরীয় অঞ্চলে কাজ করতাম।

গতবছর আমাকে এখানে আনা হয়েছে। ' 'চলো তুন, দেরী না করে আমরা খেতে বসি, খেতে খেতে কথা বলি। ' রিফ তাড়া দিলো। চার সহকমর্ীর মধ্যে একমাত্র তুনই মেয়ে। বাকিরা ছেলে।

এবং বয়সে তুনের চাইতে বেশ বড়। যদিও ওদের কোম্পনীতে এখন মেয়ে কমর্ীর সংখ্যাই বেশি। সহকমর্ীদের স্ত্রীরাও খেতে বসলেন। তাদের সাথেও রিফ পরিচয় করিয়ে দিলো। মিথের মতো ৩১১৯ প্রজাতির একটি রোবট ওদের খাবার সরবরাহ করছে।

চার সহকমর্ীর বাসায়ই একটি করে এ প্রজাতির রোবট পাঠানো হয়েছে। নতুন প্রজাতির রোবটের আচরন নিয়েই কথা হচ্ছে। এ ধরনের রোবট কি ধরনের আচরন করতে পারে তার একটা গাইডলাইন আগে থেকেই তৈরী করে চারজনকে সরবরাহ করা হয়েছে। তুন ছাড়া তিনজনের বাসার রোবট গাইডলাইনে উল্লেখ করা সম্ভাব্য আচরনই করেছে। 'তুনের বাসারটার কি খবর।

' রিফ জিজ্ঞেস করলো। 'আমার বাসারটার ভালোই, তবে ও একটা প্রশ্ন তুলেছে। অবশ্য এ ধরনের রোবট কাজ করার সুবিধার জন্য খুটে খুটে প্রশ্ন করতে পারে। ' 'রোবট প্রশ্ন তুলেছে? কি প্রশ্ন?' মিশেন মির জিজ্ঞেস করলো। 'তেমন কিছু না।

ও বেশ কিছু বই পরিস্কার করছিলো। করার সময় ও বারবার একটি কবিতা পড়ার চেষ্টা করে। কিন্তু ওর মেমোরি এতে অনুমোতি দিচ্ছিলো না। এ কারনে ও মন খারাপ করে । আর প্রশ্ন তোলে.....' তুন পুরো বিষয়টি খুলে বললো।

' আমি বিষয়টি নিয়ে ভাবছি। প্রথমত: যেসব বিষয় অ-অনুমোদিত রাখা হয়েছে এসবের অনেক কিছুরই অনুমতি দিয়ে দেয়া যায়। আর দ্বিতীয়ত: কপোট্রনের বিদ্যুৎ প্রবাহে কিছুটা পরিবর্তন আনা যায়। যাতে এ ধরনের চাহিদা তৈরী না হয়। ' 'এটা তো অন্য প্রশ্নের মতো না।

অত্যনত্দ মৌলিক প্রশ্ন। এ ধরনের প্রশ্ন তোলা তো রোবট আইনের সরাসরি বিরোধীতা। মিথের কপোট্রনে নিশ্চই রোবট আইন সেট করা আছে। সে এ আইনের বিরোধীতা করলো কিভাবে? টেকনিক্যাল সংশোধন তো পরের ব্যাপার, আগে তো তাকে এ প্রশ্ন তোলার জন্য শাসত্দি পেতে হবে। ' রিফ বললো।

'সমস্যার গভীরে না গিয়ে শসত্দির কথা চিনত্দা করলে লাভ হবে না। বরং ও যেহেতু প্রশ্নটা তুলেছে দেখতে হবে আমরা কিভাবে ওকে শানত্দ করতে পারি। শানত্দ করতে পারলে এ অভিজ্ঞতা অন্য সময় কাজে লাগানো যাবে। ' 'রোবট এ ধরনের প্রশ্ন তুলেছে এটা তো আমি ভাবতেই পারছিনা। এ কি করে সম্ভব।

' নিরো ডিল বললো। 'আমিও তাই ভাবছি। ' যোগ করলো মিশেন মির। 'করতেই পারে। এটা সর্বশেষ প্রজাতির মানবিক ক্ষমতা সম্পন্ন রোবট।

এর বুদ্ধিমত্তার সত্দর বেশ উঁচু। হতে পারে সে রোবট। কিন্তু যখন কোন কিছুর বুদ্ধিমত্তার সত্দর উঁচু হবে তখন সে কিছুটা স্বাধীনচেতাও হবে। এটা মানুষের ক্ষেত্রে যেমন সত্য, তেমনি সত্য রোবটের ক্ষেত্রেও। ' 'তোমার তালিকা থেকে ডাইনোসর আর তিমি বাদ গেছে।

এদেরকেও স্বাধীনচেতার তালিকায় নিয়ে নিলে পারতে। ' রিফের খোঁচায় তুনের চেহারা অপমানে লাল হয়ে গেলো। ' কিন্তু আপনি ৩১১৯ প্রজাতির রোবটের ব্যাপারে যে যুক্তি দিচ্ছেন, যে ব্যবস্থা নিতে চাচ্ছেন তা ভুল পথে হাঁটা। আমি আপনার ব্যবস্থা গ্রহনের পক্ষে নই। ' এরপর নিরবতা নেমে এলো খাবার টেবিলে।

তুন আর তেমন কিছু খেলো না। এখান থেকেও মন খারাপ করে বাড়িতে ফিরে এলো। ঘ ভোরে ঘুম থেকে ওঠা তুনের অভ্যাস। বাড়ির পিছনের দিকে একটা ঝুল বাড়ান্দা। বাড়ান্দার নিচে পাহাড়টা ঢালু হয়ে বেলাভূমিতে গিয়ে মিশেছে।

সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ছে বেলাভূমিতে। এখনও সূর্য ওঠেনি। একটু পরে উঠবে। রাতে বোধ হয় বৃষ্টি হয়েছে। গাছগুলি পরিস্কার লাগছে।

কোন কোনটায় পানি জমে আছে। বাতাসটা একটু ঠান্ডা। তুনের একটু শীত শীত লাগছে। এক কাপ চা খেতে পারলে ভালো হতো। বাড়ান্দায় বেশ কয়েকটা সুন্দর চেয়ার পাতা।

তুন একটা চেয়ার টেনে বসলো। সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকতেই ভালো লাগছে। ওর শিশুকেন্দ্রটা ছিলো সমভূমি অঞ্চলে । সেখানে সমুদ্র ছিলো না। তবে ও এ পর্যনত্দ যেসব জায়গায় চাকরি করেছে তার এক জায়গায় সমুদ্র ছিলো।

'মিস, চা। ' 'আরে তুমি কিভাবে বুঝলে আমার চা খেতে ইচ্ছে করছে। ' 'গতকাল রাতে বেশ বৃষ্টি হয়েছে। তাপমাত্রা আগের দিনের তুলনায় পাঁচ ডিগ্রী কমে গেছে। আপনার শীত শীত লাগতে পারে।

শীতের সকালে মানুষের অনেক সময় চা খেতে ভালো লাগে। ' তুন মিথের হাত থেকে চায়ের কাপ নিলো। মাঝারি লিকারের চা। সাথে তেজপাতা লেবু দেয়া। তুন আসত্দে আসত্দে চায়ের কাপে চুমুক দিতে লাগলো।

আসলেই বেশ ভালো লাগছে। চা-ও দারুন হয়েছে। সমুদ্রের ওপাশে আসত্দে আসত্দে সূর্য উঠছে। আলো ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে। তুন সাড়াদিনের কাজের প্ল্যান করতে লাগলো।

আগের রাতেই ওর যোগাযোগ মডিউলে আজকের কাজের এসাইনমেন্ট দেয়া হয়েছে। দুপুরের মধ্যে মিথের প্রাথমিক পর্যবেক্ষনের উপর একটি রিপোর্ট। আর এরপর থেকে মানবিক রোবটের উপর নতুন একটি পরিকল্পনা তৈরী। যে রোবট হবে ৩১১৯ এর চাইতেও উন্নত। যারা ভবিষ্যতে কি হবে, তার সমীকরন সমাধান করবে।

নেতীবাচক কিছু হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে বর্তমানের কোন্ সূচক পরিবর্তন করলে ফলাফল ইতিবাচক হতে পারে তা বের করবে। আর সে সূচকটি পরিবর্তনও করবে। সকাল দশটা থেকে ওর কাজ শুরু। ওর হাউজ কম্পিউটারের মাধ্যমেই কাজ করতে হবে। সকাল দশটায় তুনসহ আরো কয়েক লাখ কমর্ী কাজ করবে বাড়িতে বসেই।

কেউ কাজ শুরু করলো কি না তা উঠবে কেন্দ্রীয় কম্পিউটারে। আগে নোটিশ না দিয়ে কেউ নির্ধারিত সময়ের পরে কাজ শুরু করলে বা অনুপস্থিত থাকলে সাথে সাথেই শো-কজ নোটিশ চলে যাবে কমর্ীর কম্পিউটারে। আর নোটিশের সনত্দোষজনক উত্তর পাওয়া না গেলে সেদিনই ঘোষিত হবে শাসত্দি। শাসত্দি কার্যকর হবে কয়েক ঘন্টার মধ্যেই। অফিসে গিয়ে অফিস করার বিষয়টি এখন অনেকটাই কমে গেছে।

তবে গুরুত্বপূর্ন কমর্ীদের নিজেদের মধ্যে ধারনা বিনিময়ের সূযোগ তৈরী করে দেয়ার জন্য কাছাকাছি রাখার চেষ্টা করা হয়। মিথ-৩১১৯ এর উপর রিপোর্টটা তৈরী হয়ে গেলো যথাসময়েই। এটি কেন্দ্রীয় কম্পিউটারে পাঠিয়ে দিয়েই তুন কাজ শুরু করলো নতুন পরিকল্পনা নিয়ে। কোনো ঘটনা ভবিষ্যতে কি ফল আনতে পারে এটি নির্ভর করে বেশ কিছু সূচকের উপর। সবগুলি সূচককে প্রথমে দুই ভাগে ভাগ করা যায়।

একটি মূল ঘটনার সূচক। দ্বিতীয়টি মূল ঘটনার বাইরের অন্যান্য ঘটনার সূচক। বাইরের অন্যন্য ঘটনার সূচক গুলি মূল ঘটনাকে সমানভাবে প্রভাবিত করে। মোট ঘটনার ভবিষ্যত সূচকটির সংখ্যামান যদি প্লাস , মাইনাস একশ ধরা হয় তবে মূল ঘটনার সূচক পঞ্চাশ আর বাইরের অন্যান্য ঘটনার সূচক পঞ্চাশ। এখন উদাহরন হিসেবে একটি ঘটনাকে নেয়া হলো।

এর বাইরের অন্যান্য ঘটনার সূচক কি কি হতে পারে। বাইরের অন্যান্য ঘটনার সংখ্যা কম হোক বা বেশি হোক একে পঞ্চাশ সংখ্যা মানের মধ্যেই হিসাব করতে হবে। ধরা যাক কোন ঘটনার বাইরের ঘটনার সংখ্যা পাঁচটি....... তুন তার কাজে ডুবে গেলো। একটানা কাজ করতে লাগলো। মিথ এসে বেশ কয়েকবার তাকে ডেকে গেলো খাওয়ার জন্য।

পরে খাবে বলে মিথকে বললো তুন। কিন্তু কাজে এতটাই ডুবে গেছে যে এটা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করলো না। বিকেলের দিকে মিথ খাবার সাজিয়ে ট্রে'র ট্রলি এনে রাখলো তুনের সামনে। তুন ভাবলো একটু পরে খেয়ে নেবে। কিন্তু সে খাবারও পড়ে রইলো।

তবে ঠান্ডা হলো না। ট্রলিতে সোলার প্যানেল ব্যবহার করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে খাবার নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় রাখার ব্যবস্থা আছে। বিকেল পাঁচটা পর্যনত্দ অফিসের নির্ধারিত সময়। কিন্তু তুন কাজ করে যেতেই লাগলো। মনে হচ্ছে এ অংশটার সমাধান এখন না করলে পরে মনে থাকবে না।

একটা অংশ সমাধান করলে মনে হচ্ছে পাশের অন্য অংশটা একটু এগিয়ে দেই। রাত আটটার দিকে চরম উৎপাত শুরু করে দিলো মিথ। ' এভাবে কাজ করলে শরির খারাপ হবে। না খেয়ে কাজ করা কোনভাবেই ঠিক না। ঠিক আছে একটু খেয়ে আবার না হয় কাজ করেন।

' -ওর উৎপাত চলতেই লাগলো। খেতে আকৃষ্ট করতে খাবারের পাত্রের ঠাকনা খুলে দিলো। মিথের এ কৌশল কাজে লাগলো। খাবারের গন্ধে তুন আর বসে থাকতে পারলো না। কাজ রেখে খেতে বসলো।

'কি কাজ করছিলেন?' 'নতুন রোবট তৈরীর কাজ। ' 'আমার মতো রোবট?' 'না , তোমার চেয়েও ভালো রোবট। ' 'কি রকম?' 'এ রোবট বর্তমানের কোন কাজের ফলাফল ভবিষ্যতে কি হতে পারে তা বলতে পারবে। ' 'জ্যোতিষি রোবট?' 'না জ্যোতিষি না। জ্যোতিষিদের বলা আর এ বলার মধ্যে অনেক পার্থক্য থাকবে।

জ্যোতিষিরা হিসাব কষেন আকাশে গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান মানুষের উপর কেমন প্রভাব ফেলতে পারে সে হিসেবে। কোন শিশুর জন্মের সময় আকাশের কোন তারা শিশুটির উপর যতটা প্রভাব ফেলে, তার চাইতে অনেক বেশি প্রভাব ফেলে শিশুটির পাশে দাড়ানো ডাক্তার। কারন বস্তু হিসেবে ঐ তারার চাইতে ডাক্তারটি শিশুটির অনেক কাছে। মহাকর্ষ সূত্র অনুযায়ী শিশুটির উপর ডাক্তারের আকর্ষন বেশি। তাই জ্যোতিষিদের হিসাব বাসত্দবসম্মত নয়।

এখানে রোবট ভবিষ্যতের কথা বলবে অনেক অনেক হিসেব কষে। অনেক বাসত্দব ঘটনা এ হিসেবের মধ্যে থাকবে। ভবিষ্যৎবানী হবে পুরোপুরি সত্য বা প্রায় সত্য। কোনো ঘটনা যদি ভবিষ্যতে নেতিবাচক মানে খারাপ কিছু হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তবে বর্তমানের কোন্ সূচকের কারনে তা খারাপ হবে তা রোবট বের করবে। তখন সে সূচকটি এমনভাবে পরিবর্তন করতে হবে যাতে ভবিষ্যতের ঘটনাটি ভালো হয়।

এভাবে রোবট মানুষের কল্যানে কাজ করবে। ' 'ভুল হবে না?' 'হতে পারে। মানুষেরও তো ভুল হয়। তবে মানুষ আবেগে অনেক সময় অনেক সিদ্ধানত্দ নেয়। এমন একটা ব্যবস্থা থাকলে প্রতিটি সিদ্ধানত্দ নেয়ার ক্ষেত্রে মানুষ এ রোবটের সাহায্য নেবে।

সিদ্ধানত্দ হবে অংক কষে। আবেগের ব্যাপার থাকবে না। ভুল হওয়ার সম্ভাবনাও যাবে কমে। আর একবার সিস্টেমটা চালু করা গেলে ধীরে ধীরে ভুল কমিয়ে আনার জন্য গবেষনা হবে। এভাবে চ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।