আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

I Fought Against Freedom Fighters



বউ এর অনেক বলাবলিতে শেষে রাজী হলাম। বউকে নিয়ে হালকা শপিংএ গেলাম। হাজার হলেও নতুন চাকরি পেয়েছি! সেল্ফে সেল্ফে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ ফোন আসে। প্রায় দেড় মাস আগে এক অফিসে ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম। সেখান থেকেই ফোন আসে।

ওরা ফোনেই জব অফার দিলো। আর এও বলে দিলো যে, আমি যতো বেতন চেয়েছিলাম তাতেই রাজী। কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়। আমিতো মাত্র দুদিন হলো সাইন করেছি আরেক অফিসে। আমি কেন জানি ফোনে বলতে পারলাম না যে আমি জয়েন করতে পারবো না।

ফোনেই জানতে পেরেছিলাম যে পরের দিন সরাসরি এম.ডি-র সাথে সাক্ষাত হবে। ভেবেছিলাম, এম.ডির সাথে সাক্ষাতেই জানিয়ে দেবো জয়েন না করতে পারার অপারগতার কথা। পরের দিন: এই যে শিবলী আসো, বসো। আস্‌সালামু আলাইকুম স্যার। ওয়ালাইকুম সালাম, বসো শিবলী।

স্যার কেমন আছেন? ভালো, বেশ ভালো আছি। শিবলী, তোমার সাথে আমার দেখা হয়নি। সেদিন তুমি আমার ছেলের কাছে ইন্টারভিউ দিয়েছো। আর এ হলো আমার ছোট ভাই আর ও, ওর বউ। আমরা সবাই মিলেই কম্পানীটা চালাচ্ছি।

আমি গত সপ্তাহেই ইউ.এস. থেকে এসেছি আর ওরা এসেছে গতকাল। (পরিচয় পর্ব শেষ হতেই আমি কিছুটা কাচুমাচু করে), কিছু মনে করবেন না স্যার। আমি গতকাল ফোনেই বলতে পারতাম কিন্তু ভাবলাম আপনাকে একটু দেখাও করি আর কথাটাও জানিয়ে দেই। কি কথা শিবলী? (আমি খুব বিনয়ের সাথে) স্যার, আমি জয়েন করতে পারছিনা কারন মাত্র তিন দিন হলো আমি জয়েন করে ফেলেছি আরেক জায়গায়। স্যার, আপনারা একটু বেশীই দেরি করে ফেলেছেন আমাকে জব অফার দিতে।

আর আমি ধরেই নিয়েছি আমাকে আপনারা পছন্দ করেননি। কি বলছো শিবলী! এটা হতেই পারেনা। মাছের বাজারে যখন একজন মাছের দাম বলে, তখন আরেকজন তার দাম বলতে পারেনা। (আমি কয়েক সেকেন্ডের জন্য বুঝতে পারিনা কথাটার মানে। কিন্তু যেই বুঝে আসলো, অমিন মেজাজটা গরম হয়ে যায়! একজন এম.ডি. কেমন করে আমাকে মাছের সাথে তুলনা করে, কথাটা ভাবি মনে মনে! তারপরও বিনয়ী হয়ে হালকা হাসি মুখে বললাম), সরি স্যার, আমি সত্যিই আরেক জায়গায় সাইন করে ফেলেছি আর আমি নন্‌ প্রোফেশনাল হতে চাইনা।

এটা হয়না শিবলী, এটা হতে পারেনা। শিবলী, ওরা তোমাকে কতো বেতন অফার করেছে? আমি ওদের চাইতে ৫ হাজার বেশী দিলাম। বলো শিবলী, কতো বেতন দেবে ওরা তোমাকে? (আমি তখনও বিনয়ী হয়ে) স্যার, ওসব আলোচনা করে আর কি লাভ? শিবলী, ওরা কি তোমাকে একটা ঈদ বোনাস দেবে? আমি দেবো দুইটা ঈদ বোনাস। স্যার, থাকনা এই সব। না শিবলী, এটা হতেই পারেনা।

আচ্ছা বলো, ওরা কি তোমার লাইফ্‌ ইন্স্যুরেন্স দেবে? আমি তোমার লাইফ ইন্স্যুরেন্স করে দেবো। আমার অফিসে তোমার কোন ক্ষতি হলে কয়েক লাখ টাকা পাবে তোমার ফ্যামেলি। (আমার জীবনে এই ধরনের পরিস্থিতি আগে ঘটেনি। বিনয়ী হয়ে বলি,) স্যার প্লীজ্‌ আমাকে ক্ষমা করেন। স্যার আপনারা কি একটু বেশীই দেরি করে ফেলেছেন না আমার সাথে যোগাযোগ করতে? যেদিন মাইকেলের সাথে ফোন ইন্টারভিউ দিলাম সেদিন আপনার ছেলে বললো ম্যাক্সিমাম্‌ দুই সপ্তাহের মধ্যেই রেজাল্ট জানাবে।

কিন্তু দেখেন আপনারা এক মাসেরো বেশি সময় নিয়েছেন। দেখো শিবলী, আসলে আমরা একটু সমস্যায় ছিলাম। আরে তোমার চাকরিতো সেদিনি কনফার্ম, যেদিন ইন্টারভিউ দিয়েছিলে। ফোনে তুমি আর মাইকেল প্রায় ১ ঘন্টা কথা বলেছিলে, তাই না? আমি ইউ.এস. থেকে সব শুনেছি। তুমি জানো শিবলী, আমি শুধু তোমার জয়েন করার জন্য ইউ.এস. থেকে এসেছি এবার।

আসলে মাইকেল আমাকে আগেই বলে দিয়েছিলো কিন্তু আমার ছেলেটা এতো ব্যাস্ত ছিলো... (কিছুক্ষণ নিরবতা, তারপর আবার বলি,) স্যার থাক সেসব কথা। আজ আমি তবে উঠি স্যার। শিবলী, আমি ওদের চাইতে ১০ হাজার বেশী দেবো তোমাকে। তোমার মতো একজন আমার কম্পানীতে অনেক প্রোডাক্টিভ্‌ হতে পারবে। আর তুমিতো সরাসরি সিনিয়র পদে যাচ্ছো।

(অবচেতন মনে আমি তখনকার বর্তমান স্যালারির সাথে ১০ হাজার যোগ দেই, যোগ দেই দুটি ঈদ বোনাস আর জীবন বীমা। যোগ দিতে দিতেই এম.ডি. বলে,) যাও ১৫ হাজার বেশি দেবো। ওরা তোমাকে কতো দেবে? (আমি ভাবি, বাহ্‌, আমি কতোতে সাইন করেছি সেটা না জেনেই ৫ থেকে ১০, ১০ থেকে ১৫ বাড়িয়ে দিলো! কিন্তু ভাবতে ভাবতেই বললাম) সরি স্যার আমি যদি কমিটমেন্ট না দিতাম তবে এই ধরনের আলোচনা হতোনা। কিন্তু স্যার আজকে আমাকে উঠতেই হয়। এভাবেই আমার আর এম.ডি.-র কথা চলছিলো।

ঐ ঘরে যে আরো দুজন ছিলো সেটা এতোক্ষনে বিন্দুমাত্র টের পাওয়া যায়নি। মানে উনারা কথাই বলেনি। তো, আমি যখন উঠে যাবো যাবো, হঠাৎ: শিবলী, তুমি কি জানো আমি তোমাকে আরেকটা কারনে খুব পছন্দ করেছি। (আমি উৎসুক হয়ে,) কি কারন স্যার? তুমি রাজশাহীর ছেলে না? জ্বী স্যার। আমি রাজশাহী ইউনিভার্সিটিতে লেখা পড়া করেছি।

তাই স্যার!? আমার আব্বুও ওখান থেকেই মাষ্টার্স করেছেন। তাই নাকি শিবলী? তাহলে তো আর কোন কথাই থাকেনা। শিবলী, তুমি জয়েন করছো আজি। তোমার আব্বু কোন সাবজেক্টে ছিলেন? স্যার, উনি সোসাল ওয়ার্কের একদম প্রথম ব্যাচ্‌। তাই? আমি মনে হয় তোমার আব্বুকে চিনতে পারবো।

কি নাম উনার? স্যার আমার আব্বুর নাম শাফিউদ্দিন। একদম ঠিক, আমি চিনেছি! শাফিউদ্দিনকে আমি চিনেছি। তোমার আব্বুকে আমি চিনেছি শিবলী। সো, শিবলী, তুমি অবশ্যই আজ জয়েন করছো। (আমি একবার ভাবি আসলেই কি এম.ডি. আমার আব্বুকে চিনতে পেরেছে?) স্যার, আরোতো শাফিউদ্দিন থাকতে পারে।

আমার আব্বু কিন্তু নিয়মিত খেলাধুলা করতেন। (এম.ডি আরো তিনগুন উল্লাসে) ও হ্যা, এখন আমি নিশ্চিত তোমার আব্বুকে চিনেছি! উনি উঁচা লম্বা, সুঠাম দেহ, তাই না? তো, শিবলী, আর কোন কথা নয়। তুমি জয়েন করার জন্য রাজী হয়ে যাও আর তোমার আব্বুকে সুখবরটা দাও যে তারই এক বন্ধুর কম্পানীতে কাজ করতে যাচ্ছো তুমি। (আমি আবারো ভাবি, আসলেই কি আমার আব্বুকে এম.ডি. চিনতে পেরেছে? একটু বেশী শিওর হবার জন্য বললাম,) স্যার আমার আব্বু ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। (সম্ভবত এম.ডি. একটু অন্যমনষ্ক ছিলো,) উম্‌ কি বললে শিবলী, What was he? Sir, my father was a freedom fighter. (আমার কথা শেষ হবার সাথে সাথে এম.ডি. বলে,) Oh! he was a freedom fighter? I FOUGHT AGAINST FREEDOM FIGHTERS. পিনড্রপ সাইলেন্স সম্ভবত একেই বলে।

চারজন রুমে বসা, একটু আগেও কথার পিঠে কথা চলছিলো, মাছের বাজারের দরদাম চলছিলো, নিলামে উঠেছিলো আমার বেতন। সেই রুমে এখন প্রায় ১০-১৫ সেকেন্ড একদম পিনড্রপ সাইলেন্স। কারো মুখে বিন্দুমাত্র কথা নেই। আমার গায়ের রোম খাড়া হয়ে যায়। শরীরটা বন্ধ হয়ে যায়।

শুধু চোখের মনিদুটো নড়াতে পারছিলাম। আস্তে করে এম.ডি-র ভাই ও ভাই বউ এর দিকে তাকাই, মাথা না ঘুরিয়েই। ওদের ফেসিয়্যাল এক্সপ্রেশনে ষ্পষ্ট বুঝে যাই যে কথাটা একদম ১০০ ভাগ সত্য, he fought against freedom fighters. ওদের দুজনের ফেসিয়াল এক্সপ্রেশনে এটা বোঝাই যাচ্ছিল যে ওরা দুজন ভাবছিলো, "ভাইজান এই কথাটা এভাবে বলে দিলো!" আমার বয়স তখনও কম ছিলো। জীবনে কোন রাজাকরকে ওভাবে দেখেনি। কি করা উচিত আর কি উচিত নয় বুঝে আসছিলো না আমার।

আমি যেই বলতে গিয়েছে 'আমি উঠি' অমনি রাজাকারটা বলে, "তো শিবলী, চিন্তা ভাবনার কিছু নাই, তুমি জয়েন করো। আর তোমার আব্বুকে আমার কথা বলবা, উনি নিশ্চই চিনবেন আমাকে। " এতোক্ষন খুব সাবলীল গতিতেই কথা বলছিলো রাজাকারটা কিন্তু এই শেষ কথাগুলির পুরোটাই আমতা আমতা করে বললো। আমি আর কোন কথা না বাড়িয়ে সোজা বের হয়ে আসি লিফ্টের কাছে। লিফ্ট অনেক দুরে আছে দেখে, ৯ তলা থেকে সোজা হেঁটে নেমে যাই দ্রুত গতিতে।

আব্বুর কাছে পুরো ঘটনাটি বলি কিন্তু উনি রাজাকারটাকে চিন্তে পারেনি। শেষে মাইকেলের কাছে একটা মেইল করেছিলাম। মেইলে তুলে ধরেছিলাম পুরো ঘটনাটি আর শেষে তুলে ধরেছিলাম মুক্তিযুদ্ধ আর রাজাকারের ভুমিকা। মাইকেল খুবই অনুতপ্ত হয়েছিলো।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।