আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বানোপো .... পৃথিবীর প্রাচীনতম এক মাত্রিতান্ত্রিক সভ্যতা

পথের প্রান্তে আমার তীর্থ নয় ,,,,,পথের পাশেই আছে মোর দেবালয়
মিউজিয়ামের সামনে বানপো রমনীর ভাস্কর্য ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি যে আমাদের এই পৃথিবীতে প্রাচীন কাল থেকেই বিভিন্নস্থানে বিভিন্ন সভ্যতার উন্মেষ ঘটেছিল। এর মধ্যে চৈনিক সভ্যতা, সিন্ধু সভ্যতা, পারস্য সভ্যতা, মিশরীয় সভ্যতা গ্রেইকো-রোমান সভ্যতা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। চীনের যে সভ্যতার কথা আমরা সচরাচর জেনে থাকি তাহলো পাচঁ হাজার বছর আগের। কিন্ত তার চেয়েও প্রাচীন সেই নতুন প্রস্তর যুগ অর্থাৎ নিওলিথিক পিরিয়ডেও চীনের শিয়ান প্রদেশে উন্মেষ ঘটেছিল বানপো নামে এক সভ্যতার। মানচিত্রে চীনের প্রাচীনতম সভ্যতার সুতিকাগার শিয়ান প্রদেশ বেশ কয়েকবছর আগে আমরা যখন বেইজিং থেকে ১২০০ কিলোমিটার দুরত্বে প্রাচীনতম ঐতিহাসিক শহর শিয়ান ভ্রমনে গিয়েছিলাম তখন বেইজিং এর ট্যুর কোম্পানী ভ্রমন তালিকায় বানপোর নামও উচ্চারন করেনি।

আর এ সম্পর্কে আমরা জেনেছিলাম তখন যখন সারি সারি দাঁড়িয়ে থাকা টেরাকোটা সোলজারের মিউজিয়াম দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। যার জন্য বানপো সভ্যতার ইতিহাস সম্পর্কে আগে থেকে আমাদের কোন তথ্য জেনে নেয়া সম্ভব হয়নি। বানপোদের গৃহের আদলে তৈরী মিউজিয়ামের দৃষ্টিনন্দন গেট। পৃথিবীর প্রাচীনতম এই প্রত্নতাত্বিক যাদুঘরে প্রবেশ করলাম যার উদ্ভোদন হয়েছিল ১৯৫৮ খৃষ্টাব্দে। নাম লিখালাম সেই তালিকায় যেখানে প্রতিমাসে ছেচল্লিশ হাজার দর্শকের প্রবেশ ঘটে।

পর্যটকদের সুবিধার জন্য যাদুঘরের চারিদিকে ইংরাজীতে এর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস লেখা রয়েছে। এমন ধাতু ফলকে লেখা বানপো ইতিহাস শিয়ান শহরের বাইরে চারিদিকে পরিখাবেষ্টিত এই ওভাল আকৃতির এই গ্রামটি ৫০,০০০ হাজার স্কয়ার মিটার জায়গা জুড়ে অবস্থিত। সেই গ্রামে বড় মাঝারী এবং ছোট এধরনের নানা আকারের ৫০০ ঘরের সন্ধান পাওয়া গেছে যা কিনা পাচটি ভাগে ভাগ করা। এছাড়াও ছিল দুশটি খাবার মজুদ করার জন্য ভান্ডার, ছটি মৃত শিল্প কারখানা এবং আড়াইশোটি কবর। প্রত্নতাত্বিকদের ধারনা সেই গ্রামে বিভিন্ন ধরনের গোত্রের বসবাস ছিল।

বানপোদের সমাজ মাতৃতান্ত্রিক ছিল বলেই প্রত্নতাত্বিকদের ধারনা। তাদের সমাধিক্ষেত্র থেকে এ ধারনা করেছেন তারা। তাদের কবরস্থানটি বর্তমানে মিউজিয়াম। বানপো সমাধিস্থল প্লেনের হ্যাঙ্গারের মত আচ্ছাদিত বানপো প্রত্নতাত্বিক মিউজিয়াম মাতৃতান্ত্রিক সমাজে পুরুষরা ছিল মায়ের পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। পুরুষ সদস্যরা মারা গেলে তাদের অন্য কোন পুরুষের সমাধিতে সমাহিত করা হতো।

এর প্রমান রয়েছে বানপোদের সমাধিক্ষেত্রে। বেশ বড় একটি জায়গাজুড়ে প্রতিষ্ঠিত বানপোদের সমাধিক্ষেত্রে রয়েছে ১৭৪ টি কবর যা কিনা প্রাপ্তবয়স্কদের। এর একটিতে রয়েছে একাধিক মৃতদেহ, আরেকটি কবরে চারটি একই বয়সী যুবতীর মৃতদেহ। একটি কবরে চারজন নারীর শবদেহ আরেকটিতে দুটো প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের । এছাড়া বাকিসবগুলোতে একটি করে মৃতদেহ।

একক কবর এবং এক কবরে একই লিঙ্গের একাধিক শবদেহ মাত্রতান্ত্রিক পরিবারের চিনহ বুঝিয়ে থাকে। কোন কবরেই নারী পুরুষের যৌথ মৃতদেহ পাওয়া যায়নি। একক নারী সমাধিক্ষেত্র গাইড আধ ভাঙ্গা ইংরেজীতে সেই প্রাচীনতম সভ্যতার বিভিন্ন দিকগুলো নিয়ে বিস্তৃত বর্ননা দেয়ার পন্ডশ্রম করে যাচ্ছিল। আমাদের সাথে পাশ্চাত্যের অনেক পর্যটক ছিল যারা গাইডের জ্ঞ্যানের উপর ভরসা না করে যার যার হাতের বইটিতে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিল। চীনারা নিজেদের সীমাবদ্ধতার কথা মেনে নিয়ে মিউজিয়ামের কোনায় বিশাল মনিটরে বানপো সভ্যতা সম্পর্কে ইংরাজীতে ধারাবাহিক বর্ননা আর তাদের জীবনযাত্রার কাল্পনিক ছবি দেখিয়ে যাচ্ছিল।

বিশাল প্লেনের হ্যাঙ্গারের মত আচ্ছাদিত সেই সমাধিক্ষেত্রের মনিটরের ধারা বর্ননায় জানলাম তাদের সমাজে বিয়ে প্রথার আদৌ কোন প্রচলন ছিল কি না ? বিশাল প্লেনের হ্যাঙ্গারের মত আচ্ছাদিত সেই সমাধিক্ষেত্র না ছ হাজার বছর আগে বানপোদের সেই মাতৃতান্ত্রিক সমাজে আজকের মত এক নারী এক পুরুষের মধ্যে কোন বিয়ের প্রচলন ছিলনা। উপযুক্ত মেয়েরা একাকী এক ঘরে বাস করতো। রাতে তাদের ঘরে যে কোন পুরুষের অবাধ প্রবেশাধিকার ছিল। সকালে তাদের সেই সম্পর্কের ইতি ঘটতো। ছেলেরা ফিরে যেত মায়ের কাছে, থাকতো নানা রকম সাংসারিক কাজে ব্যাপৃত।

এযুগের মত তাদের সমাজে কোন স্থায়ী সম্পর্কের স্থান ছিলনা। প্রত্যেক নারী পুরুষই একাধিক নারী পুরুষের সাথে সম্পর্কিত ছিল। তবে তাদের মধ্যে যদি ভালোবাসা তৈরী হতো তাহলে সম্পর্কটা হয়তো কিছুদিন দীর্ঘস্থায়ী হতো। এ নিয়মের ফলে এদের সন্তাদের কাছে পিতৃ পরিচয় চিরদিনই অজানা থেকে যেত। তারা মাকেই চিনতো এবং মায়ের দ্বারাই সমাজে পরিচিত হতো।

নদী থেকে পানি আনার পাত্র কবর দেয়ার সময় মৃতদেহের সাথে জিনিসপত্র দেয়ার প্রথা বা রীতি প্রাচীনকালের অনেক দেশেই লক্ষ্য করা যায়, যেমন মিশরের ফারাওদের কবরে। এই রীতিটি আমরা বানপো সমাধিগুলোতেও লক্ষ্য করে থাকি। তবে তাদের যে মাত্রিতান্ত্রিক সমাজ ব্যাবস্থা ছিল তার আরেকটি প্রমান নারীদের কবরে পাওয়া বিভিন্ন জিনিসপত্রের পরিমান। নারী বানপোর সমাধিতে দান করা তৈজসপত্র বানপো সমাধিক্ষেত্রে একট তিন চার বছরের শিশু কন্যার সমাধিতেও ৭৯টি বিভিন্ন জিনিস দেখা যায় যা কিনা একজন পুর্নবয়স্ক পুরুষের সমাধিতে রয়েছে দুটো কি তিনটি জিনিস। এসবের মাধ্যমে বোঝা যায় সেই হাজার বছর আগে বানপো সমাজে নারীদের উচ্চ মর্যাদা আর পরিবার এবং গোত্রের মধ্যে তাদের ছিল সর্বোচ্চ আসন।

কৃষিকাজ আর মাছধরায় ব্যাস্ত বানপো। শিল্পীর কল্পনায় আকাঁ বানপোদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা আবর্তিত ছিল অন্যান্য প্রাচীন মানুষদের মতই শিকার, কৃষিকাজ আর মাছধরাকে কেন্দ্র করে। পাথর দিয়ে তাদের তৈরী কুড়াল, ফসল কাটার কাঁচি থেকে শুরু করে প্রায় ৫,২৭৫ টি কৃষি যন্ত্রপাতি মাটির গর্ভ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। মাছ ধরা যে তাদের অন্যতম জীবিকা ছিল তার প্রমান পাওয়া যায় ছিপ বড়শীর প্রাপ্তি থেকে। রান্নার বিভিন্ন তৈজসপত্র থেকে অনুমান করা যায় যে তারা আগুনের ব্যাবহার জানতো অর্থাৎ তারা কাঁচা খাবার খেতোনা।

রঙ্গিন হাড়িকুরি বানপোদের তৈরী তাদের সেই গৃহস্থালী জিনিসপত্র গুলো ছিল বিভিন্ন আকৃতির। যা সে সময়ের জন্য ছিল বিস্ময়কর। যেমন এই পানির পাত্রটি। এখানে পদার্থ বিজ্ঞানে তাদের ধারনা লক্ষ্য করা যায় বলে বিশেষজ্ঞদের মতামত। এই পাত্রটি পানিতে ছেড়ে দিলে কাত হয়ে পানি ভরতে পারতো।

যখন ভরে যেত তখন নিজে নিজেই সোজা হয়ে যেত। এ থেকে পানি কখনো উপচে পড়তোনা কারন এর মুখটা ছিল সরু। দুদিকে আঙ্গটা লাগানো এই জগটা বহন করাও সুবিধাজনক। বহন করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেলে এর সুচালো গোড়াটা মাটিতে গেথে রাখা যেত সহজেই। কি অসম্ভব বুদ্ধিমান ছিল এই জাতি।

অপরূপ ডিজাইনের পানির পাত্র এছাড়াও বিভিন্ন বানপোদের সেই গ্রামে বিভিন্ন শিল্প কর্মের প্রচুর নিদর্শনও ছড়িয়ে রয়েছে। দৈনন্দিন জীবনে ব্যাবহারের জন্য মাটির দিয়ে বিভিন্ন আকৃতির তৈজসপত্র তৈরীতে তারা ছিল দক্ষ। এমনকি সেই সব ঘর গৃহস্থালীর কাজে ব্যাবহৃত প্রতিটি জিনিসে তাদের শিল্পী মনের পরিচয় আকাঁ লক্ষ্য করা যায়। যেমন এগুলোতে তারা রঙ দিয়ে বিভিন্ন নকশা একেছে, এছাড়াও আকাঁ আছে বিভিন্ন পশু, পাখি বা মানুষের মুখ। তারা হাড়, দাত বা ঝিনুক দিয়ে তৈরি করতে পারতো অসাধারন ডিজাইনের গলার হার, হাতের বালা, কানের দুল প্রভৃতি।

এসবের নমুনা পাওয়া গিয়েছিল বানপো নারীদের সমাধিগুলোতে। সেই প্রস্তর যুগে শিল্পমনা বানপোদের নির্মিত নকশী করা মাটির গামলা বানপোরা তাদের নিজস্ব হরফে লিখতে পারতো বলেও প্রত্নতাত্বিকদের দৃঢ বিশ্বাস। তবে তা ছিল চীনের প্রাচীনতম সভ্যতা স্যাং রাজত্বের আমলে লেখা হরফের চেয়েও পুরোনো ধারায়। আমাদের সম্পুর্ন অজানা এই বানপো সভ্যতা সম্পর্কে জানতে পারা এবং তাদের সম্পর্কে সমাজ এবং রীতিনীতি সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য আমাদের চমকে দিয়েছিল । ধীরে ধীরে বের হয়ে আসলাম সেই ছ হাজার বছর আগের এক সমাধিক্ষেত্র থেকে।

মিউজিয়াম থেকে বের হয়ে এসে তুলে নিলাম স্মৃতির মনি কোঠায় তাকে সেই হাজার হাজার বছর আগে নিওলিথিক আমলে চীনের আদি একটি গোত্র বানপোদের সভ্যতার নিদর্শন তুলে ধরা প্রাচীনতম এই যাদুঘরটি না দেখলে আমাদের শিয়ান ভ্রমন হয়তো অসমাপ্তই থেকে যেত। ধন্যবাদ জানাই শিয়ানের ট্যুর কোম্পানীকে আর সেই গাইডকে যে অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে তুতলিয়ে আমাদের বোঝানোর আপ্রান চেষ্টা করে যাচ্ছিল।
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.