আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভারত বিরোধীতার মন্ত্র যেনো আত্মঘাতী না হয়, সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশ বিরোধী জাতীয়তাবাদী অবস্থান পরিস্কার থাকা জরুরি

হিন্দু না ওরা মুসলিম ঐ জিজ্ঞাসে কোনজন, কান্ডারি বলো ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা'র

ছোটকালে শুনছি, এখনো প্রায়ই শুনি, এবং নিয়মিত পড়িও বটে, যে ৪৭এ নাকি ভারত বিভাগ হইছে। প্রথম প্রথম পড়ছি এবং শুনছি, ভাবাভাবি বা প্রশ্ন করি নাই। বড় হওয়ার পর যেই প্রশ্নটা মাথায় বারবার আইছে তা হইলো, ভারতীয় নামে যেইখানে কোন কালে এই দুনিয়ায় কোন জাতি ছিল না, ছিল না ভারত নামে কোন কালে কোন দেশ, সেইখানে সেই দেশের আবার বিভাগ হয় কেমনে? দক্ষিন এশিয়া নামের এই ভুখন্ডের সাইজ খানা রিতীমত বিশাল, রুশ দেশ বাদ দিলে ইউরোপের সমান সমান বলা যায়। এইখানে বাঙালি, পাঞ্জাবি, তামিল এহেন নানান জাতির বাস ছিল দীর্ঘকাল আগে থেইকাই। হঠাৎ কইরা এই ভারতীয় জাতি আর ভারত নামক্ দেশ কই থেইকা আইলো? ভাগ হইলে হইছে বাঙলা ভাগ, পাঞ্জাব ভাগ, ভারত ভাগ কিরুপে হুয় ইহা আমার বোধগম্য হয় না।

খোজ তালাস লইয়া দেখা যায় এহেন ভারত নামক রাষ্ট্র বঙ্কিম চন্দ্র নামক সাহিত্যিক এবং গান্ধিজী নামক রাজনীতিবিদ ও ওনাদের গোষ্ঠির লোকজন স্বপ্নে প্রাপ্ত হইছেন। আসমুদ্র হিমাচল এহেন ভারত বর্ষের ধারণা যেই স্বপ্নে পাওয়া সেই স্বপ্নে অবশ্য মুক্তির পয়গাম যতটা ছিল তার চেয়ে বেশি ছিল সাম্প্রদায়িকতা আর উপনিবেশী শোষনের বিষ। আমার এহেন বক্তব্য আপাতত সুধিজনের কাছে সরল সিধা ভাষায় এবং যথাসম্ভব কম কথায় বয়ান করার চেষ্টা করবো মাত্র। ভারত অথবা ইন্ডিয়া এই দুই নামের ভেতরই এই রাষ্ট্রের প্রকৌশল এবং স্বপ্নের উৎস তালাস কইরা দেখা দরকার। মহাভারত নামক মহাকাব্যে ভরত নামক একজন আর্য রাজার নাম পাওয়া যায় যিনি এই ভুখন্ডের তাবৎ আর্য ভুখন্ডের রাজা হইয়া ছিলেন।

ভরত রাজার এই রাজ্য ছিল উপনিবেশিক যুগে হিন্দু ঐতিহাসিকদের স্বপ্নবিলাস, আর্যবর্ত, আর্য নামক সভ্য জাতির রাজ্য। উচ্চ বর্ণের ব্রাক্ষ্মন্যবাদী হিন্দু ধর্মাবলম্বিরা ফিরিঙ্গি ঔপনিবেশিক শাসনের সাথে সহাবস্থান, দালালি এবং চামচামি এই তিনটাই শুরু করছিল মুসলমানদের আগে। ফলস্বরূপ এই ভুখন্ডের শুরুর দিকের শিক্ষিত বিদ্বত সমাজ এবং রাজনীতিবিদগণ এই ভুখন্ডের ইতিহাস, নৃতত্ব এবং জাতীয়তার ধারণা যেই স্বপ্ন থেইকা প্রাপ্ত সেই স্বপ্ন বড় বেশি হিন্দু জাতিয়তাবাদী সাম্প্রদায়িকতা প্রসুত। আর তাই মহাভারতের আর্য রাজার নামে তারা এই ভুখন্ডের সকল জাতি রাষ্ট্ররে নিশ্চিহ্ন কইরা প্রতিষ্ঠিত করতে চাইল ভরত রাজার আর্যবর্ত। এই এক রাষ্ট্রের ধারণা অবশ্য তাদের মাথায় প্রথম ঢুকাইছে ফিরিঙ্গি প্রাচ্যবাদীরা।

ফিরিঙ্গি সভ্যতা ইউনানি সভ্যতামূখী, এইটা সবাই জানে। সেই কবে আজ থেইকা হাজার দুয়েক বছর আগে ইউনানের ঐতিহাসিক হেরেডোটাস লিখছিলেন “এনসাইক্লোপিডিয়া ইন্ডিকা”। ইন্দু অববাহিকার অপর পাশের পুরা ভুখন্ডই ইউনানিগো কাছে ছিল ইন্ডিয়া, যেই ভুখন্ডের মানুষ গুলা আজিব, যেই ভুখন্ডের মাটি খুড়লে স্বর্ণ বাইর হয়, যেই ভুখন্ডে সেক্স হইলো ফিরি সেক্স, যেই ভুখন্ডরে জয় করার বাসনা যাগে, লুট করার মোহ হয়। ইউনানিগো কাছ থেইকা ইন্ডিয়া শব্দটা গ্রিকগো ভাষায় গেছে শুধু শব্দ হিসাবে না, পুরা একটা ধারণা হিসাবে। এই কারণে ইউনানি হেরেডোটাসের ‘ইন্ডিয়া’ নামক বয়ান আর দুই হাজার বছর পরের ডেমোক্রেসির পিতৃতূল্য দার্শনিক এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী জেমস মিল এর ‘ইন্ডিয়া’ নামক ধারণায় মিল অনেক বেশি।

ফিরিঙ্গি মিল ইংল্যান্ডে শুনাইলেন গণতন্ত্রের বাণী আর আমাগো শোনাইলেন শোষনের, কারণ ওনার মতে ইন্ডিয়া একখান রাষ্ট্র, এই রাষ্ট্রের সবাই এক জাতি এবং এক স্বভাব বিশিষ্ট, এই রাষ্ট্র সম্পদশালী এবং এই রাষ্ট্রের মানুষের কোন মেরুদন্ড বা জ্ঞান বুদ্ধি নাই, এদের গণতন্ত্রের কোন অধিকার নাই। এই ভুখন্ড আছেই দখল আর শোষন করার লাইগা। এর অর্থনৈতিক গুরুত্বও অপরিসিম, কে না জানে বহু রাষ্ট্র শাসন করার চেয়ে এক রাষ্ট্র শাসন করা অনেক সহজ। ফিরিঙ্গি শিক্ষায় শিক্ষিত এবং তাদের চাকড় সমাজ এই ভুখন্ডের শুরুর দিকের বিদ্বত সমাজ এবং রাজনীতিবিদরাও চাইছে তাই। উপনিবেশের পা চাইটা তথাকথিত স্বাধীন ভুখন্ডে যেন নিজেদের প্রভুদের শোষন অব্যাহত থাকে এবং লুটের ভাগ যেন তারা ঠিকঠাক পায় এই কারণে আসমুদ্র হিমাচল পুরা ভুখন্ডটা তারা প্রভুগো মতন একটা রাষ্ট্র হিসাবেই চাইছে।

ইন্ডিয়া বা ভারত নামক রাষ্ট্রের উৎপত্তি এবং চরিত্র তাই সাম্প্রদায়িক এবং ঔপনিবেশিক শোষনের বিষযুক্ত। পাকিস্তান্ নামক রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও তাই। এক জাতি তত্ত্ব যেমন মিথ্যা বয়ান, দ্বিজাতী তত্ত্বও তাই। দিল্লি আর লাহরের ফিরিঙ্গিগো পা চাটা বনিক সমাজ আর তাগো ভাই বেরাদাররা নিজেগো স্বার্থে এই ভুখন্ডে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগাইছে, বাঙলা ভাগ করছে। গান্ধি যেমন দক্ষিন ভারত হিন্দি প্রচার সভা গঠন কইরা তামিল ভাষার শ্বাসরোধ করতে চাইছে, জিন্নাও তেমন ঘোষনা দিছে “উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা”।

একটা জাতির ভাষা আর সংস্কৃতিরে ধ্বংশ করতে পারলেই সেই জাতিরে শাসন করা যায়, শোষন করা যায়, কারণ সেই জাতির তখন আর কোন আত্মপরিচয় থাকে না। সে তখন প্রভুরে নকল করতে গিয়া প্রভুর পণ্য খরিদ করে, আর কে না জানে, আধুনিক সভ্যতার শাসক সমাজ পণ্য বিক্রেতারা, আর আমাদের মতো তৃতিয় বিশ্বের দেশে এই পণ্য বিক্রেতারা নিজ দেশী না, ভিন দেশী, ফিরিঙ্গিগো হাত ঘুইড়া আম্রিকান এবং ভারতিয়। উপনিবেশের থাবা নিয়া এরা আমাগো গ্রাস করতে চায়। বাঙলার মুক্তি সংগ্রামের শুরু ৫২ শালে, ২১ ফেব্রুয়ারী আমাগো উপনিবেশ এবং সাম্প্রদায়িক জাতীয়তা বিরোধীতার পবিত্র দিবস। এই দিনে শুরু হওয়া মুক্তি সংগ্রামের সামরিক উলম্ফন আমরা পাইছি একাত্তরে, পাইছি এই ভুখন্ডই শুধু না, গোটা দুনিয়ার উপনিবেশী মানচিত্রের সবচেয়ে বড় বিষ্ম, বাংলাদেশ।

এই দেশ আমার পরম পবিত্র দেশ, এই দেশ উপনিবেশী দুনিয়ায় সাম্রাজ্যবাদি আগ্রাসনের বিপরীতে জ্বলজ্যান্ত আদর্শ। সাম্রাজ্যবাদী নিল নকশার বিরুদ্ধে এই দেশের জন্ম, সাম্প্রদায়িক ভেদ বুদ্ধির বিপিরীতে এই দেশের জন্ম, দক্ষিন এশিয়ার তাবৎ শোষিত এবং নিগৃহিত জাতি সত্ত্বারে জাগায়া তুলতে এই পবিত্র রাষ্ট্রের জন্ম। আমরা পাকিস্তানের বিরোধীতা করছি ধর্মের নামে না, স্থানিয় ভাষা এবং সাংস্কৃতিক সত্ত্বার পরিচয় উর্ধ্বে তুলে ধরে। ইসলামের নাম ধইরা সেইদিন উপনিবেশের মুসলমান প্রতিভু আশরাফ শ্রেণী পাকিস্তান রাষ্ট্র টিকানের জারপরনাই চেষ্টা কইরা পারে নাই। আমরা ভারতীয় সাংস্কৃতিক এবং সামরিক আগ্রাসনের বিরোধীতা করবো, সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশ এবং সাম্প্রদায়িকতার বিরোধীতার মন্ত্রে, কোনরকম ইসলামী জাতীয়তাবাদ অথবা সাম্প্রদায়িকতার মন্ত্রে না।

বিগত চার দলীয় জোট সরকারের শাসনামলের শেষ দিকে এই দেশের মানুষ জেগে উঠছিল কানসাট, শনির আখড়া আর ফুলবাড়িয়ায়, সেই জাইগা ওঠার ফল ভোগ করতাছে আওয়ামীলীগ। বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভারতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসন আর সিমান্তে সামরিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এখন আমরা একজোট হচ্ছি, প্রতিবাদ করছি। এই প্রতিবাদের আগুন ছড়িয়ে পরুক পুরো বাংলাদেশে, সেই আগুনে পুরে খাক হোক বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে দিল্লীর মসনদ পর্যন্ত। কিন্তু আওয়ামীলীগের মতো এবার বিএনপি আর জামাত যেনো এই আন্দোলনের ফল নিজের ঘরে না তুলতে পারে লক্ষ্য রাখুন। তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতা আর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রতিজ্ঞা করে আমাদের মুলা দেখাইছে আওয়ামীলীগ।

সাম্প্রদায়িক মন্ত্রে আমাদের ভারত বিরোধীতাকে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগাতে চায় বিএনপি জামাত জোট। হিন্দু এবং মুসলমানের উর্ধে উঠে বাঙালি না হলে মুক্তি নাই। বাঙলা মা, মাটি আর এই ভুখন্ডের তাবৎ সন্তানের অধিকার আদায়ে সংগ্রাম অব্যাহত রাখুন। শুধু একটাই সতর্ক বার্তা, ছাগুরা যেনো বেল না পায়। হিন্দু না ওরা মুসলিম ঐ জিজ্ঞাসে কোনজন, কান্ডারি বলো ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা'র।

ফেলানি আমার মায়ের সন্তান। হিন্দু মুসলিম পরিচয় নিয়া যারা রাজনীতি করে, আমার মায়ের সন্তান, আমার বোনের জন্য চোখের পানি ফেলার, রাজনীতি করার অধিকার তাদের নাই। সবাইকে লাল সবুজের সালাম।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.