আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমান কাহিনী - গোয়েবলসরা দিকে দিকে ফেলিছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস।

* আমি খুজে বেড়াই নিজেকে *

আমানউল্লাহ আমান। ১৯৯০ থেকে ২০০৬। ১৬টি বছর। রাজনৈতিক উত্থানের পাশাপাশি পরিণত হয়েছেন দেশের শীর্ষ স্থানীয় বিত্তশালীতে। সাধারণ এক বয়াতীপুত্র থেকে বর্তমানে রাজধানীর অভিজাত এলাকায় নামে বেনামে অন্তত ৭টি বাড়ি, ৩টি মার্কেট ও ২ হাজার শতাংশের বেশি জমির মালিক।

স্পিনিং মিল, পেট্রল পাম্প, হাসপাতাল কি নেই তার! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিনের শীর্ষ দেনাদার নয়, তিনি এখন শীর্ষস্থানীয় পুঁজিপতি। রূপকথাকেও হার মানায় তার উত্থান। অথচ তিনি পাননি সমৃদ্ধ উত্তরাধিকার, ছিল না ব্যবসা-বাণিজ্য। পরিচিত জনের কাছে তার দাবি, স্ত্রীর সূত্রেই পেয়েছেন বেশির ভাগ এপার্টমেন্ট। তবে দুদকের সম্পদ বিবরণীতে উল্লেখ করেছেন, স্ত্রীর কাছে ধার নিয়েই কিনেছেন জমি, নির্মাণ করেছেন বাড়ি।

তবে তার স্ত্রী মাঝারি সারির সাবেক এক ব্যাংক কর্মকর্তার মেয়ে। নিজে কোন চাকরি বা ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত নন। ফলে সবার প্রশ্ন, ধার দেয়ার মতো এত টাকা তিনি পান কোথায়? তবে নেতাকর্মীদের কাছে তার অর্থের সব উৎসই ওপেন সিক্রেট। চাঁদাবাজি, সরকারি কাজে অনিয়ম, দখল, প্রতারণা ও দলীয় পদ এবং নমিনেশন বাণিজ্যই তাকে উন্নীত করেছে বৈভবের শীর্ষে। একদা স্বৈরশাসকের সঙ্গে আঁতাতের সন্দেহ বিদ্ধ আমান ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের পর পরিণত হন নায়কে।

বর্তমানে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব। দলের মধ্যে তাকে নিয়ে নানা মত। কেউ বলেন বহুরূপী, কেউ বলেন ছদ্মবেশী। তিনি নিজেই তার এ চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। দিনে থাকেন রাজপথের আন্দোলনে মুখর, রাতে গোপন বৈঠকে মশগুল।

দলের রাজনীতিতে কখনও তিনি চাচার, কখনও তিনি ভাইয়ের। আর এ প্রভাবে যাচিতভাবে তিনি নিয়ন্ত্রণ করেন বিএনপির প্রতিটি অঙ্গসংগঠন। বিএনপি থেকে ছাত্রদল কোথায় নেই তার গ্রুপ। পদবিতে যুগ্ম মহাসচিব হলেও মহাসচিবকে ডিঙিয়ে যান দাপটে। প্রভাব টিকিয়ে রাখতে ভবিষ্যৎ নেতার নাম ভাঙিয়ে গ্রুপ সৃষ্টির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করছেন দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও চেয়ারপারসনের কার্যালয়।

বাড়ি ও জমির সাম্রাজ্য: দুদকের তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, নিজ ও স্ত্রীর নামে ঢাকা ও কেরানীগঞ্জে পাঁচটি বাড়ি ও ২০০০ শতাংশেরও বেশি জমি রয়েছে আমানের। দুদকের তদন্ত মতে, গুলশান মডেল টাউনের ২১ নম্বর রোডে ৬ কাঠা জমিতে ৬লা বিশিষ্ট ২ নম্বর বাড়িটি তার। এর আনুমানিক মূল্য ৩ কোটি ১৮ লাখ টাকা। কেরানীগঞ্জের পৈতৃক ভিটায় ২০০০ হাজার বর্গফুটের ওপর তৈরি করেছেন একটি দোতলা বাড়ি। জমির দাম ছাড়াও ভবনের দাম আনুমানিক ৩৪ লাখ টাকা।

কেরানীগঞ্জে রয়েছে তার ক্রয়কৃত ১০৭ শতাংশ জমি। এর ক্রয় মূল্য ৫ লাখ টাকা। প্রতিবেদনে বলা হয়, আমান ১৯৯১ সালের আগে একজন সাধারণ ছাত্রনেতা ছিলেন এবং তার উল্লেখযোগ্য কোন আয় ছিল না। এমনকি তিনি উত্তরাধিকার সূত্রেও কোন উল্লেখযোগ্য সম্পদের মালিকানা পাননি। ২০০৬ সাল পর্যন্ত ১৬ বছরে তিনি তার আয়করের নথিপত্রে আয়ের পরিমাণ দেখিয়েছেন ৬৪ লাখ ৫৩ হাজার টাকা।

বাস্তবে সংখ্যাটি তিন কোটির বেশি। একইভাবে তার স্ত্রী সাবেরা আমানের নামে মিরপুরের ৯৮১/১ মণিপুরে ১০ কাঠা জমির ওপর রয়েছে একটি ছ’তলা বাড়ি। ব্যাংকের ঋণ বাদ দিলে সেখানে তার সম্পদের মূল্য প্রায় ২ কোটি টাকা। কেরানীগঞ্জ মৌজার হযরতপুরে রয়েছে সোয়া দুই কোটি টাকা দামের একটি ছ’তলা বাড়ি। ক্রয়সূত্রে বনানীর এফ ব্লকের ৭ নম্বর সড়কের ৪৪ নম্বর বাড়িটির মালিকও সাবেরা আমান।

এর দালিলিক মূল্য ৫০ লাখ টাকা। এছাড়া সাবেরা আমানের নামে রয়েছে- মৌজা চর আলগীতে ৫২ লাখ টাকা ক্রয় মূল্যে ৬৬০ শতাংশ নাল জমি, সাভার উপজেলার মৌজা বৈলারপুরে ৬৮ লাখ টাকা ক্রয় মূল্যের দুই ভাগে (১১০১.২৫ ও ১৬১) ১২৬২.২৫ শতাংশ জমি ও কেরানীগঞ্জ বিসিক শিল্প নগরীতে দু’টি (১২০০০ ও ৬০০০) ১৮ হাজার বর্গফুটের দু’টি প্লট। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রকৃতপক্ষে আমানের অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়টি গোপন করার জন্য তার স্ত্রী সাবেরা আমানের নামে ওই অবৈধ সম্পদ অর্জন দেখানো হয়েছে। কারণ, সাবেরা আমান একজন সাধারণ গৃহিণী এবং তিনি কোন প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবসা বাণিজ্য বা অন্য কোন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত নন। প্রতিবেদনে এটাও বলা হয় যে, আমান সম্পদের উৎস গোপন করার জন্য মিথ্যা ঘোষণা ও শঠতার আশ্রয় নিয়েছেন।

কারণ তার ঘোষিত ধারদাতা অর্থাৎ তার স্ত্রী লিখিতভাবে জানিয়েছেন যে, তার নামে অর্জিত সম্পত্তি তার স্বামীর অর্থে কেনা। তিনি একজন গৃহিণী ফলে তার নিজস্ব উপার্জন নেই। তবে দলের নেতাকর্মীসহ একদা ঘনিষ্ঠজনদের মতে, দুদকের তদন্ত টিম খুঁজে পায়নি আমানের সম্পদের এক-দশমাংশও। বিশেষ করে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর কোন হদিসই পায়নি তদন্ত টিম। তাদের মতে, ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর এমপি হিসেবে গুলশান মডেল টাউনে বরাদ্দ নেন দু’টি প্লট।

সেখানে ২১ নম্বর রোডের ২ নম্বর প্লটে তৈরি করেন একটি ৬তলা বাড়ি। অভিযোগ আছে, সেখানেই একটি প্লট যৌথ মালিকানায় নেয়ার কথা বলে জনৈক খোকনসহ দুই জনের কাছ থেকে নেন ১ কোটি ২০ লাখ টাকা। তবে শেষ পর্যন্ত প্লটটি নিজের নামে লিখে নিয়ে দুই জনের পুরো টাকাই আত্মসাৎ করেন আমান। সূত্র জানায়, এ জন্য বর্তমানে মামলা চলছে। এদিকে ডিওএইচএস-এর ১৯ নম্বর রোডের ২৬০ বাড়িটি আমানের।

যেখানে তিনি মাঝে মধ্যে অবস্থান করেন। আইনি জটিলতা এড়াতেই বাড়িটি তৈরি করেছেন স্ত্রী সাবেরা আমান, সম্বন্ধী আসকারসহ শ্বশুরপক্ষীয় স্বজনদের নামে। সূত্র জানায়, বর্তমান বাড়ির উল্টো পাশেই রয়েছে তার আরও একটি বাড়ি। আমানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ একাধিক নেতা জানান, স্ত্রীর নামে বনানীর বাড়িটি তিনি নামকাওয়াস্তে কিনেছেন মুন্সীগঞ্জের শেখ আবদুল্লাহ’র কাছ থেকে। ২০০৬ সালের বাতিল হওয়া নির্বাচনে মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর থেকে নমিনেশন দেয়ার কথা বলে তার কাছ থেকে প্রথমে নিয়েছিলেন ৫ কোটি টাকা।

পরে ওই টাকা দিয়ে নামকাওয়াস্তে বাড়িটি কেনেন। এছাড়া কাওরান বাজারে ১৩ কাঠা জমিতে নির্মাণ করেছেন আধাপাকা টিনশেড ঘর। আমানের একাধিক ঘনিষ্ঠ সহযোগী জানান, গাজীপুরের চৌরাস্তার কাছেই বেনামে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন মাইডাস স্পিনিং মিল। কাগজে কলমে তা তানাকা গ্রুপের এবং এর মালিক হিসেবে দেখানো হয়েছে আমানের সম্বন্ধী আসকার ও জনৈক নাজিমউদ্দিনকে। কিন্তু তারা যথাক্রমে ৫ এবং ৮% শেয়ারের মালিক মাত্র।

কেরানীগঞ্জের তানাকা পেট্রোল পাম্প ও তানাকা শপিং কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠান দু’টিরও বেনামে মালিক আমান। পাশাপাশি সাভারের পাকিজার পাশেই স্ত্রী সাবেরা আমানের পাঁচতলা বাড়িতে অনিক জেনারেল হাসপাতাল নামে একটি হাসপাতাল। প্রতারণা ও চাঁদাবাজিতেই জমিদার আমানের একাধিক সাবেক রাজনৈতিক সহযোগী জানান, ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এলে এক সময় জাপান যান আমান। সেখানে গিয়ে তার পূর্বপরিচিত কেরানীগঞ্জের জনৈক মাহিনের মাধ্যমে বাংলাদেশে বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করেন তানাকা নামে জাপানি এক বিত্তশালী মহিলাকে। জাপানি ওই মহিলার টাকায় স্পিনিং মিলের জন্যই কেনা হয়েছিল সাভার ও কেরানীগঞ্জের জমিগুলো।

তবে পদে পদে প্রতারণার মাধ্যমে টাকা আদায় করতে থাকলে এক পর্যায়ে বাংলাদেশ ছাড়েন ওই জাপানি মহিলা। ফলে তানাকা স্পিনিং মিল আর কখনও আলোর মুখ দেখেনি। কিন্তু নামমাত্র মূল্যে মাহিনের সঙ্গে বোঝাপড়া করে ওই জমি লিখে নেন স্ত্রীর নামে। সে জমি ক্রয়ের অর্থের উৎস জানাতে না পারায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে জেল খেটেছেন সাবেরা আমান। তবে তার এক ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়, দুদকের তদন্ত প্রতিবেদনের চেয়ে শতগুণ বেশি জমি রয়েছে আমান দম্পতির।

খোদ হেমায়তপুরের তেতুলঝোড়ায় রয়েছে ৮০ বিঘা জমি। এর মধ্যে ৬৫ বিঘা রেজিস্ট্রেশন হলেও বাকিগুলো সরকারি খাসজমি ও এলাকাবাসী থেকে দখল করা। এর অনেকটাই দেয়াল দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। সে জমির মূল মালিক জাপানি মহিলা তানাকা আর বাংলাদেশে না ফিরলেও কেরানীগঞ্জের রুহিতপুরের ছেলে মাহিন বর্তমানে গুলশানে বসবাস করেন। নিজেকে পরিচয় দেন আমানের খালাতো ভাই হিসেবে।

অভিযোগ রয়েছে, প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে চাকরি দেয়ার কথা বলে বয়াতিকান্দির একজনের কাছ থেকে দখল করেন ১০ কাঠা জমি। সেখানে নির্মাণ করেন একটি আট তলা মার্কেট। তবে বিনিময়ে চাকরি বা টাকা কোনটিই পাননি ওই ব্যক্তি। একই ভাবে ইন্ডাস্ট্রি প্রতিষ্ঠার কথা বলে কেরানীগঞ্জের হযরতপুরের ইটাপাড়ার জনৈক কামালউদ্দিনের কাছ থেকে দখল করেন ১৮ বিঘা জমি। সেখানে আজ পর্যন্ত কোন স্থাপনা হয়নি।

এছাড়া ১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানের সময় মোহাম্মদপুরের শ্যামলীতে দখল করেন একটি ৬ তলা বাড়ি। সরকারি রিলিফের টিন দিয়ে কেরানীগঞ্জের হযরতপুর বাজারে করেছেন একটি মার্কেট। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, একটি হাউজিং কোম্পানি কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদ, ইকুরিয়া, আইন্তা ও পানগাঁও মৌজায় প্রকল্প হাতে নিলে টাকার মেশিন হাতে পান আমান। প্রকল্পের প্রতি বিঘা জমির চাঁদা হিসেবে আমানকে দিতে হয়েছে দেড় লাখ টাকা। এ টাকা তিনি তৎকালীন সাব-রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে আদায় করতেন।

আমানের ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়, কেরানীগঞ্জের নাজিমউদ্দিন চেয়ারম্যানের মাধ্যমে ওই হাউজিং কোম্পানির কাছ থেকে এককালীন টাকাও নিয়েছেন তিনি। এছাড়া মন্ত্রী থাকাকালে কেরানীগঞ্জে জিয়া কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য এলাকাবাসীর কাছ থেকে দখল করেন প্রায় ২৫০ বিঘা জমি। এর বেশির ভাগই বর্তমানে তার ভোগ দখলে রয়েছে। নব্বইয়ের আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রঐক্যের একাধিক নেতা জানান, এরশাদ সরকারের পতনের পর তার সময়ে বিত্তশালীদের একটি কালো তালিকা প্রকাশ করা হয় ছাত্রঐক্যের পক্ষ থেকে। এ তালিকার বিত্তশালীদের গোপনে হুমকি ধমকি দিয়ে আদায় করেছেন প্রচুর অর্থ ও কয়েকটি বাড়ি।

সে সময় যাদের কাছ থেকে আমান অর্থ আদায় করেছেন তাদের মধ্যে আছেন বর্তমান মহাজোট সরকার ও সাবেক চারদলীয় জোট সরকারের মন্ত্রী থেকে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ও সরকারি চাকরিজীবী অনেকেই। এ সময় বিএনপি’র তৎকালীন মহাসচিব মির্জা গোলাম হাফিজ তাকে উপাধি দিয়েছিলেন অর্থশিকারি। তিনি বলতেন, টাকা মানে আমান, আমান মানে টাকা। এছাড়া ১৯৯১ সালে নির্বাচনী ফান্ডের নামে আমান আদায় করেন প্রচুর অর্থ। সরকারি কাজে অনিয়ম জানা যায়, স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে সিএমইও’র কাজের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ড. খন্দকার মোশাররফের সঙ্গে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় আমানের।

ফলে তাকে সেখান থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। ওই সময় বিদেশী সাহায্যের একটি বড় অঙ্কের একটি টাকা এনজিওগুলোকে বরাদ্দের নামে আত্মসাৎ করেন। অভিযোগ রয়েছে কেরানীগঞ্জের রোড অ্যান্ড হাইওয়ের ঠিকাদার মহিউদ্দিন ও স্বপনের মাধ্যমে অনেক কাজ না করে টাকা তুলে নিয়েছেন সরকারি কোষাগার থেকে। এছাড়া, ১৯ কোটি টাকায় টেন্ডার হওয়া হযরতপুর ব্রিজের ঠিকাদার ‘রূপায়ণে’র কর্ণধার ফরিদের কাছ থেকে নিয়েছেন ৩ কোটি টাকা। এছাড়া শ্রম ও জনশক্তি প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে ৫-৭ লাখ টাকার বিনিময়ে জনৈক জামানের মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন দিয়েছেন একাধিক এনজিও প্রতিষ্ঠানকে।

এছাড়াও গত ১৫ বছরে কেরানীগঞ্জে যে সব উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে তার সবগুলোই নিয়ন্ত্রণ করতো তার অনুগতরা। সেখান থেকে আমান পেতেন ১০%। নিজস্ব লোক জিয়াউদ্দিন পিন্টু, রেজাউল করিম পল ও নিকটতম বন্ধু কিশোরগঞ্জের স্বপনের মাধ্যমে পরিচালনা করতেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো। তাদের মাধ্যমেই কেরানীগঞ্জের বিসিক প্রকল্প, কন্টেইনার পোর্ট ও সাভারের ট্যানারি প্রকল্পের পুরো কাজ নিয়ন্ত্রণ করেছেন। বিএনপি সরকারের সময়ে তাকে মাসোহারা দেয়ার বিনিময়ে বুড়িগঙ্গা দ্বিতীয় সেতু ও ধলেশ্বরী ১ ও ২ সেতুর টোল আদায় করতো তার অনুসারীরা।

ওদিকে চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে তার বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা ইউনিয়নের কালিগঞ্জ বাজারের আলম মার্কেটের মালিক আলম। চেকের মাধ্যমে টাকা নেয়ার সে মামলায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ৭ বছরের সাজাও হয়েছিল আমানের। একাধিক সিনিয়র আইনজীবী বলেন, আমান দম্পতির দুর্নীতির আকার-প্রকার দু’টোই বৃহৎ। স্বাভাবিক আইনে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হলে তারা শাস্তি এড়াতে পারবেন না। তবে ওয়ান ইলেভেন পরবর্তী সময়ে তাড়াহুড়ার আইন ও বিচারের কারণে এ ধরনের দুর্নীতিবাজরা রেহাই পেয়ে যাচ্ছেন।

উচ্চতর আদালত এসব মামলার মেরিট দেখে নয়, আইন প্রয়োগের পদ্ধতিগত ভুলের জন্য তাদের বিরুদ্ধে দেয়া সাজা বাতিল করছে। এখানে জাস্টিস হারিড, জাস্টিস বারিড (বিচার দ্রুত বিচার মৃত) হয়েছে। তবে প্রচলিত আইনে নতুন করে তদন্ত ও বিচারিক উদ্যোগ নেয়া হলে তারা কোনভাবেই দায় থেকে রেহাই পাবেন না। রাজনীতিতে উত্থান আশির দশকের শেষ দিকে ছাত্রদলের তৎকালীন দুই গ্রুপের বিরোধকে কেন্দ্র করে এবং যুবদলের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের এলাকার ছেলে হওয়ার সুবাদে ছাত্রদলের আহ্বায়ক হন আমান। তবে আহ্বায়ক হয়েই গোপনে এরশাদের সঙ্গে সমঝোতা রক্ষা করে চলেন তিনি।

এরশাদের পতনের আগের সপ্তাহে তিনি ছিলেন রহস্যময় নিখোঁজ। ফলে খালেদা জিয়ার সন্দেহের মুখেও পড়েন। কিন্তু কৌশলী আমান সবকিছুই ম্যানেজ করে নেন দ্রুত। তবে পরবর্তীতে আমানের হিংসাত্মক মনোভাবের কারণে বাতিল করা হয় ছাত্রদলের ইতিহাসে একমাত্র নির্বাচিত রিজভী-ইলিয়াস কমিটি। ইলিয়াস আলীকে পাঠানো হয় কারাগারে।

এছাড়া নব্বইয়ের গণ অভ্যুত্থানের শতাধিক ছাত্রদল নেতা আমানের কারণে বিএনপির রাজনীতি থেকে নির্বাচিত ও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। তাদের মধ্যে আছেন মালেক, কামারুজ্জামান রতন, নির্মল দাস, খোরশেদ আলম, আমজাদ, সেলিম চৌধুরীর মতো সম্ভাবনাময় নেতা। তাদের কেউ কেউ যুবদলসহ অন্যান্য সংগঠনে ঠাঁই পেলেও বেশির ভাগই রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়েছেন। বিএনপি’র একাধিক সিনিয়র নেতা জানান, দলের আমানের পরিচয় একজন দক্ষ বহুরূপী। যিনি সকালে মির্জা আব্বাসের বাসায় গিয়ে বলেন, সংস্কারপন্থিদের রুখতে হবে, দুপুরে সাদেক হোসেন খোকার বাসায় গিয়ে বলেন, আপনি ছাড়া ঢাকাতে বিএনপি অচল, বিকালে ড. খন্দকার মোশাররফকে গিয়ে বলেন, মহাসচিব দল চালাতে পারছেন না আর রাতে খোন্দকার দেলোয়ারের কাছে গিয়ে বলেন, আপনি ছাড়া কেউ দল চালাতে পারবে না।

শেষে সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের সঙ্গে বসে করেন রাজনৈতিক পর্যালোচনা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দলের কতিপয় নেতা ছাড়া কেউ তাকে বিশ্বাস করতে পারেন না। দলের ইমেজ সঙ্কট সৃষ্টির অন্যতম হোতা এ নেতাকে মন থেকে মানতে পারেন না কেউই। এমন কি সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর দুই নেতা মির্জা আব্বাস এবং সাদেক হোসেন খোকাও আমান বিরোধিতায় একাট্টা। ছাত্রদলের একাধিক নেতা জানান, আমান যাকে কাছে ডেকে হেসে কথা বলেন, আদর স্নেহ করেন, তার জন্যই রাজনীতির মাঠ করে তোলেন ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ।

আমান সম্পর্কে দলের নেতাকর্মীদের অভিযোগের বহর বিশাল। কমিটি গঠন থেকে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় আমানের অবৈধ হস্তক্ষেপের বিষয়টি ছাত্রদলের একটি ঐতিহ্য। অনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ও কোন্দল সৃষ্টির মাধ্যমে কেন্দ্রীয় কমিটিকে দুর্বল করে ছড়ি ঘোরান তিনি। বিক্রি করেন পদ। পছন্দের অযোগ্য এবং অর্থশালীদের পদায়ন করেন গুরুত্বপূর্ণ পদে।

ছাত্রদলের বর্তমান কমিটিতে তার অপছন্দের কারণে বাদ পড়েছেন অনেক যোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ ছাত্রনেতা। যুবদলেও অবৈধ হস্তক্ষেপের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করেছেন তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীকে। আমানের শক্তি ও ধমকের কাছে অসহায় এসব সংগঠনের নেতারা। সংগঠনগুলোতে কর্তৃত্ব ফলাতে হেন কর্মকাণ্ড নেই যা তিনি করেন না। একইভাবে দেশের বিভিন্ন জেলা বিএনপি’র কমিটি পুনর্গঠনেও জটিলতা জিইয়ে রেখেছেন তিনি।

তৃণমূল নেতাদের নির্বাচিত কমিটিতে এড়িয়ে ভাইয়া (তারেক রহমান)-র পছন্দের প্রার্থী বলে অর্থের বিনিময়ে সেখানে চাপিয়ে দেন দু’-একজন শীর্ষ নেতা। অন্যথায় বিক্ষুব্ধ কাউকে দিয়ে গঠন করান পাল্টা কমিটি। তারা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নির্দেশনার ধার ধারেন না। কথায় কথায় দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নাম ভাঙান। এ কাজে সহায়তা করেন তার নেতৃত্বাধীন ভাইয়া গ্রুপ।

ফলে দেশের অন্তত ২০টি জেলায় এখনও কমিটি জটিলতা কাটছে না। সব মিলিয়ে সারাদেশের তৃণমূল নেতাদের কাছে ভাইয়া গ্রুপ বর্তমানে একটি আতঙ্কের নাম। মন্ত্রী থাকাকালে কেরানীগঞ্জে সংঘটিত ১৫টি নৃশংস রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের কারণে এলাকাতেও বীতশ্রদ্ধ আমান। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন আওয়ামী লীগের ৪ জন ও বিএনপি’র ১১ নেতাকর্মী ও সমর্থক। এলাকার জনগণ এসব হত্যাকাণ্ডের জন্য পরোক্ষভাবে আমানকেই দায়ী করেন।

স্থানীয় নেতাকর্মীদের মতে, মতের বিরুদ্ধে গেলেই আমান মুছে ফেলেন দল আর ব্যক্তি সম্পর্ক। কিলার গ্রুপ ভাড়া করে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি চালিয়েছেন নিজের এককালের প্রধান সহযোগীকেও। তার এ অনুসারী ও অনুগতদের নিয়ে নেতাকর্মীদের কাছে প্রচারণা চালান তিনিই তারেক রহমানের আগামী দিনের মুখ্য সহচর। দলের পরবর্তী মহাসচিব। তাকেই সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস ও গুরুত্ব দেন তারেক রহমান।

সমপ্রতি অনুষ্ঠিত দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটির বৈঠকে এ ব্যাপারে অনেক নেতাই প্রকাশ্যে অভিযোগ করেছেন বেগম খালেদা জিয়ার কাছে। আমানের ঔদ্ধত্ব ও সাংগঠনিক হস্তক্ষেপের কারণেই সমপ্রতি দলের স্থায়ী কমিটির পদ থেকে অব্যাহতি চেয়ে খালেদা জিয়ার কাছে চিঠি লেখেন গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। কিছুদিন আগে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তার উদ্ধুত আচরণের শিকার হয়েছেন ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ও বিএনপি’র আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপন। এদিকে সমপ্রতি এক জরুরি প্রয়োজনে খালেদা জিয়া তাকে তলব করেন। তবে বার্তাবাহককে তার স্ত্রী বলেন, খালেদা জিয়া বললেই নাচতে হবে নাকি! বিষয়টি খালেদা জিয়ার কানে যায়।

পরের সপ্তাহে খালেদা জিয়ার সামনে গিয়েই সহানূভূতি পেতে আমান দ্রুত প্রস্তাব দেন- ম্যাডাম আরেকটি হরতাল দেন। এ সময় খালেদা জিয়া তাকে কয়েকজন সিনিয়র নেতার সামনে ধমক দেন। নেতাকর্মীদের অভিযোগ তিনি সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে নিজেকে রক্ষা করছেন। কপিপেষ্টে মাইনাস সুত্রঃ মানব জমিন

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.