আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সীমান্ত-হত্যাঃ সীমান্ত আদালত সংক্রান্ত বিষয়ে একটি প্রস্তাবনা



আমার বাড়ি সীমান্তে বাংলাদেশ –ভারতের সীমান্ত এলাকায় অর্থাৎ সীমান্তের পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে বসবাসরত মানুষকে যে নানারকম হেনস্থা ও দুর্ভোগের মুখোমুখি হতে হয় তার উপর কোন গবেষণা নাই। তবে আমার বাড়ি সীমান্তে। সীমান্ত নিয়ে শৈশব থেকেই নানা বিক্ষিপ্ত –বিচ্ছিন্ন চিন্তা ছিলো। আজ বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কের বিচার করব। আমার সীমান্তের জীবনের অনেক ঘটনা এই বিশ্লেষণে চলে আসবে।

বিশ্লেষণের পেছনে ঐ ঘটনাগুলোর ছায়া আপনারা দেখতে পাবেন। আমার এলাকায় আবার ফরেস্ট বিট আছে। তাই আমাকে বাড়তি একটা আইনের প্রতিও অনুগত থাকতে হয়। সেটা বন আইন। আমার সীমান্তে অনেকগুলো ক্যাম্প ও চৌকি আছে।

শিবের বাজার ও মথুরাপুরে দু’টি বড়ো ক্যাম্প আছে। সীমান্ত এঁকে বেঁকে চলে গেছে বিলুনিয়া –ফেনী নদী হয়ে রামগড়ের দিকে। এখানে অনেক গ্রামের তিনদিকে ভারত। সীমানা একটি বড়ো অজগরের মত। যেন সবাইকে গ্রাস করতে চাইছে।

এ পাড়ের সাথে ওপাড়ের একটা সীমান্ত অর্থনীতি আছে,থাকবে। চোরাকারবারি ও সীমান্ত অর্থনীতির মধ্যে, নানা বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে, ফারাক আছে। ভারতীয় সীমান্ত এলাকার এক বিপুল সংখ্যক মানুষ বাংলাদেশে হাটবারে মাছ, তরি-তরকারি কিনে। কারণ, ত্রিপুরায় মাছের আকাল। ত্রিপুরার দিক থেকে দেখলে যারা ভারতীয় সীমানায় আছেন, তারা খুবই একটা পশ্চাৎপদ এলাকায় থাকেন।

বাজার-ঘাট বেশ দূরে। পুঁজা মন্ডপ তৈরি করবার জন্যও ভারত থেকে কারিগর আসেন। এরক্ম কিছু কারিগর একবার আমাদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা খেয়েছিল। সীমান্ত অর্থনীতির শাখা-প্রশাখা অনেক বিস্তৃত ও নানা দিক থেকে আলোকপাত করা যায়। একবার আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে ভারতে পালিয়ে গিয়েছিলাম।

বিকাল বেলা অবশ্য আরেকজনের নজরে পড়ে যাই। বাংলাদেশ থেকে ওখানে তারা কাঠ কাটতে গিয়েছিল। সে কোন না কোনভাবে আমার পরিবারকে চিনত। জেরার মুখে আমি সব স্বীকার করি। ভারতের উত্তর-বদরপুরে যুদ্ধের সময় আমারা ছিলাম।

ছোটবেলার অনেক স্মৃতি অই বাড়ির সাথে জড়িয়ে আছে। তারা আমাকে একবার দেখার বাসনা করল। আমি ঢাকা থেকে ফিরে খুবই সহজ ভংগিতে অই বাড়িতে যাই। ঐতিহাসিকভাবে গড়ে ওঠা অনেক সম্পর্কই আইন দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না, আইনের বেড়ি পরানো যায় না। আমাদের সীমান্তে গরু চুরি হত।

চোরেরা ভারতে ঢুকে নিশি রাইতে গরু চুরি করত। বাংলাদেশের মানুষ চোরদেরকে চরম শাস্তি দিয়েছিলো। সীমান্তের অনেক সমস্যা, আমি দেখেছি, দুই পাড়ের জনগণ সালিশ- দরবার করে নিজেরাই সমাধান করত। এরকম ঘটনা আশির দশক পর্যন্ত আমি প্রত্যক্ষ করেছি। আমার মনে হয় একেকটা সীমান্ত এলাকার একেকটা বৈশিষ্ট্য।

কোথাও পাহাড় এসে বাংলাদেশ উপর হামলে পড়েছে, কয়েকটা টিলা টংকর বাংলাদেশের উপর উপুড় হয়ে আছে। কোথাও জঙ্গলের মাঝখানে সীমান্ত পিলার। সীমান্তের পাখিরা এপাড়ে আসে। পশু পাখিদের কোন সীমান্ত নাই। মনে পড়ে একবার ভারতীয় হাতি আমাদের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের কোন একটি জেলায় ঢুকে পড়েছিল।

ভারতীয় মাহুত ও হস্তি বিশেষজ্ঞরা এসে সে-ই হাতি নিয়ে গিয়েছিলো। সীমান্তে অনেক ছোট ছোট ঝোপ-ঝাড় আছে। দু’দেশের পাখি একসাথে ঘুমায় সেখানে। নদি যখন ভাঙে জানে না কোন সীমান্ত। মাঝে মাঝে সীমানা নদীর মাঝখানে।

মাছেরা সারাক্ষণই আইন লঙ্ঘন করছে। অতএব, সীমান্ত একটি জটিল ব্যাপার। সীমান্তের অর্থনীতি, সংস্কৃতি, বিনিময়, নির্ভরশীলতা অনেক বিষয় আমাদের ভাবনা –চিন্তায় আসা দরকার। আমার বন্ধু সেলিম তাহের বলেছেন: সীমান্ত আদালত বসানো একটা বাস্তব জরুরী প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। এই রাষ্ট্রযন্ত্রের ভঙ্গুর পররাষ্ট্রনীতি, ‘সুজন’ টাইপ সুশীলিয় ভাঁড় বা বিভ্রান্ত বাম রাজনীতিকদের দিয়ে এই প্রস্তাবনা আশা করা সময়ের অপচয়।

একটা রাজনৈতিক প্লাটফর্মের সত্যি প্রয়োজন ছিল হে! যেখানে খামোশ আর নিষেধের তর্জনী তুলে আগ্রাসী দাদাগিড়ির দাঁতভাঙ্গা জবাব দেবার জন্য জনজোয়ার তৈরী করা যায়। তার কথার প্রেক্ষাপটে ও আমার ক্ষুদ্র অবতরণিকার আলোকে এই বিষয়ে কিছু ভাবনা তুলে ধরতে চাই। ১। এই আদালত হবে ভারত-বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধি ও প্রথাগতভাবে যারা সীমান্তে সন্মানিত মানুষ তাদেরকে নিয়ে গঠিত হবে। ২।

সীমান্তের জিরো পয়েন্টে এই আদালতের জন্য একটি ভবন তৈরি করা হবে। এই আদালতে একটি প্রসিকিউশন ও ডিফেন্স কাউন্সিল থাকবে। সীমান্তের দুপাড়ের আইন বিশেষজ্ঞদের নিয়ে এই কাউন্সিল তৈরি করা যেতে পারে। ৩। এই আদালত সকল প্রকারের অপরাধ আমলে নেবে কিন্তু সব ধরনের অপরাধের বিচারের এক্তিয়ার এই আদালতের থাকবে না।

৪। এই আদালতের কর্ম-পরিধি ও এক্তিয়ার আন্তর্জাতিক আইনের আলোকে নির্ধারণ করা হবে। এই আদালত যে আইনের বলে হবে সে-ই আইন সকল সকল ধরনের হত্যার জন্য দায়ি সীমান্ত রক্ষিদের সাময়িক বরখাস্ত, বা ক্লোজারের জন্য ব্যবস্থা করতে পারবে। ৫। এই আদালতের জুরি বোর্ডে সীমান্ত রক্ষি বাহিনীর কমপক্ষে তিনজন প্রতিনিধি থাকবেন।

৬। আদালত উভয় দেশের ও আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের ভিত্তিতে মানুষের প্রাণ রক্ষা ও মানবাধিকার নিশ্চিত করবে। ৭। জীবন ও জীবিকার জন্য কিংবা স্বাভাবিক কারণে সীমান্ত অতিক্রমণের বিষয়গুলোকে গুরুতর অপরাধ হিসেবে গণ্য করবে না। ৮।

এই আদালতকে কেন্দ্র করে সীমান্ত –মৈত্রী শহর গড়ে উঠতে পারে। আসুন আমরা এই প্রস্তাবকে সমৃদ্ধ করি। আপনাদের মতামত দিন। আমি দীর্ঘদিন ধরে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথাও ভাবছি। তার আগে তিনটি ইন্সটিটিঊট গড়ে তোলা দরকার।

সেগুলো হলোঃ • Center for Indo-Bangla Studies • Center for American Studies • Center for Sino-Bangladesh Studies • Center for the Studies of Border Relations and Human Security আমি এইসব বিষয় নিয়েও গভীরভাবে সবাইকে ভাবতে বলছি। কারণ আমাদের চিন্তার ফ্রন্টিয়ার ঠিক করতে না পারলে কোন কিছুই আগাবে না। শুধু ভারত-বিরোধী রাজনীতি, যা অনেক ক্ষেত্রেই অন্তঃসারশূন্য, দিয়ে কোন কাজ হবে না। সম্প্রদায়ের স্বার্থের জন্য লড়াই করা আর সাম্প্রদায়িক হয়ে ওঠা আলাদা ব্যাপার। মুসলিম লীগের নেতাদের মধ্যে এক বড়ো অংশই মননে –মগজে সাম্প্রদায়িক ছিলেন না।

তারা শ্রমিক –কৃষক মেহনতী মানুষের প্রতিনিধিত্ব করতেন। বাংলাদেশে ভারত-বিরোধী রাজনীতির একটা অংশ ফ্যাসিবাদি রাজনীতি। এই রাজনীতির ভয়াবহ দিক আমরা দেখেছি। অন্যদিকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী নামে যে রাজনীতি , একটা বিশেষ ধরনের রাজনীতি, কিছু বিশেষ মনোভাবের যে রাজনীতি, যা ইসলাম বিরোধী হয়ে উঠবার কারণে অনেকেই প্রত্যাখান করেছে, সেটাও বাঙ্গালিদের স্বার্থ রক্ষায় অপারগ, গভীরভাবে সাম্প্রদায়িক। আমরা বাংলাদেশীরা দুই ধরনের সাম্প্রদায়িকতার শিকার।

সে-কারণে নতুন রাজনীতি বিনির্মাণের জন্য আবারো কাগমারী সন্মেলনের একটা নয়া মূল্যায়ন দরকার। সেখান থেকে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের মূল সূত্রগুলো তৈরি করা যেতে পারে। আমরা সকল ধরনের সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কিন্তু সম্প্রদায়ের বিশেষ স্বার্থ দেখার বিরুদ্ধে নই। সীমান্তের ওপাড়ে হিন্দু আর এপাড়ে মুসলমান – এই যদি হয় ভারতীয় সীমান্ত রক্ষি বাহিনীর মনোভাব, তা হলে এই মনোভাবের উৎস খুঁজতে হবে দিল্লীতে। সে-কারণে আমরা মানুষ রক্ষার জন্য (দুই পাড়ের সীমান্তের মানুষ) সীমান্ত আদালতের মত প্রস্তাব দিয়ে যাবো।

তারা শুনবে কী না জানি না। তবে এটা জানিঃ • অন্তত আমরা বলতে পারব, লাশের মিছিলের উপর দাঁড়িয়েও আমরা ‘ আইনী’ প্রস্তাব দিয়েছি; • সীমান্তের লোকদের সীমানা আলাদা করতে পারে না। সীমান্তের লেন-দেন ঐতিহাসিকভাবে আছে,থাকবে; • সীমান্তের এ পাড়ের ( বাংলাদেশের) জনগণকে অনুপ্রবেশকারী, চোরাকারবারি , জঙ্গি –এই সব অভিধায় অভিহিত করা থেকে বিরত থাকতে হবে। • চোরাকারবার আর সীমান্তে চিরায়ত অর্থনীতি, সীমান্ত অর্থনীতি, দু’টো সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার, এটা বোঝা দরকার। পেটের দায়ে বাংলাদেশের বহু শ্রমজীবি দিল্লী, বোম্বে, কোলকাতায় কাজ করে।

এতে আমি দোষের কিছু দেখি না। সীমান্ত আদালত স্থাপিত হলে তারা ফেলানীর মত তিরিশ ঘন্টা “শ্রমজীবিদের নিয়তির’ ঐতিহাসিক স্মারক হয়ে অনন্তপুর সীমানার কাটাতারের উপর প্রাণহীন পড়ে ছিল। হায়! তার দম যেতে কতক্ষণ লেগেছিলো। তার বাবা মায়ের মুখ তার মনে পড়েছিলো কী। সে পানি চেয়েছিল।

কে তাকে দেবে মরণ জল! হায় নিয়তি! তাই প্রস্তাবনাঃ - নিয়মিত সীমান্ত বৈঠকের পাশাপাশি বিজিবি- বিএসএফের যৌথ মহড়ার আয়োজন করা; - বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় সীমান্ত ম্যাজিস্ট্রসি চালু করা। - এ পর্যন্ত সকল হত্যাকান্ডের উপর একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করা। - সীমান্ত এলাকার গ্রামগুলোকে ‘ কৌশল্গত ম্যাপিং করা”; - দু’পাশের প্রায় ব্যবহারের দিক থেকে “ যৌথ সম্পদ” যেমন, গরু চরানোর মাঠ, নদী, হাওর ইত্যাদি চিহ্নিত করা; - এগুলোর ব্যবহার নীতিমালা ঠিক করা। ডিজিটাল বাংলাদেশে গরুর রাখালের কাছে তো আর জিপিএস নাই যে বুঝবে সে এই সীমান্তের এপাড়ে না ওপাড়ে। তা’ ছাড়া গরুকে তো সীমান্ত চেনানো মুশকিল।

তবে গরুর গলায় জিপিএস ট্র্যাকার লাগান যেতে পারে। এগুলো সবই কতগুলো ব্যবহারিক উদ্যোগ। কেউ কেউ হাসবেন। বলতে পারেন এগুলো ভালো ভালো কথা। কথায় চিড়া ভিজবে কী না, সে-ই প্রশ্নও অনেকে তুলতে পারেন।

বিডিআর-বিএসএফের মহাপরিচালক পর্যায়ের বৈঠকে কত কথাই তো হয়। বেশির ভাগ কথা আনুষ্ঠানিকতার পর্যায়ে থেকে যায়। কাজের কাজ কিছুই হয় না।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।