ব্লগে আসার বা থাকার কোন কারন খুজে পাই না,তবু পুরনো টানে বার বার আসি সামুতে
এক
-খোকন ভাই,এক কাপ চা দেন।
-কি চা খাইবেন ভাইজান?
-লাল চা দেন।
-খোকন ভাই,মনটা কি খারাপ?
-‘হ’ ভাইজান আর তো চলে না। সিগারেট আর চা বেচে পুরোটা সংসার। বউ,দুই পুলা,বুড়া মা।
ক্যামনে চালাই।
চা বানাতে বানাতে কথা বলে খোকন ভাই। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি এখনও কিছুক্ষণ সময় আছে। দশ/পনের মিনিটের ভিতর বাস আসার সম্ভাবনা নাই। খোকন ভাইয়ের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে সময় কাটালে খারাপ হয় না।
বলেই চলেছে খোকন ভাই।
-সিগারেটে তো লাভ কম। যা একটু লাভ তা চা বেচেই। তাও চিনির দাম আবার বাড়ছে।
চা’র গ্লাসটা আমার হাতে দিয়ে বলতেই থাকে।
-ভাইজান,এই আপনারা এইহানে আছেন ম্যালা দিন,পাশ কইরা বড় ইঞ্জিনিয়ার অইবেন,জীবনে ম্যালা ট্যাহা কামাইবেন। আমি চা’ই বেচুম,তা তো ঠিকি আছে কিন্তু হেইডাও তো বব্ধ ওইয়া যাইতাছে।
খোকন ভাইয়ের দশ বার বছরের ছেলে দৌড়ে এসে দোকানে ঢোকে।
-বাজান বাজান,মায় কইছে দাদির উপুরটান খুব বাড়ছে। শ্বাস নিবার পারতেছে না।
-আচ্ছা বাজান,তুমি যাও। আমি ওষুধ নিয়া আমুনে। তুমি ইশকুলে গেছ্যিলা?
-হ বাজান গ্যাছিলাম।
খোকন ভাইয়ের ছেলেটি যেভাবেই এসেছিল সেভাবেই ছলে যায়। খোকন ভাই দোকানে থাকা আর একজনের জন্য চা বানাতে বানাতে বলে,
-পুলাডারে দোকানে লাগাইয়্যা দিলে,ছোডা কামলা দিয়া কিছু বাড়তি কামাই করন যাইত।
কিন্তু আপনেরা লেহাপরা করেন এইডা দেইখা খুব ভালা লাগে।
খোকন ভাইয়ের চোখে যেন একটু আলোর নাচন।
দোকানের সামনে থাকা লোকটিকে চা দিয়ে এসে,চায়ের চুলাটার সামনে দাঁড়িয়ে একমনে বলতে থাকে,
-আমারত লেহাপরা হইল না। বাপ দাদায় কাম করত পাটকলে,আমিও ছোটবেলায় ধুকে গেছলাম পাটকলে। ভালই চলছিল।
হঠাৎ সব বন্ধ করে দিল।
একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলে জিজ্ঞাসা করলো,
-’কালত আপনাদের এখানে অনুষ্ঠান হবে?
-হাঁ। ১৬ ডিসেম্বর উপলক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
-অ,এই কারণেই সব রং করতাছে বুজি?
-হা রাষ্ট্রপতি আসবে কাল।
দুই
অনুষ্ঠানের পরের দিন খোকন ভাইয়ের দোকানে যাই।
দোকানে বিষণ্ণ মুখে বসে আছে খোকন ভাই। চা বন্ধ,চায়ের চুলাটা ভেঙে ফেলেছে সিটি কর্পোরেশনের বুলডোজার,ছাউনিটাও নেই। রাষ্ট্রপতি আগমনে রাস্তার দুই পাশের সৌন্দর্য(!!!) বৃদ্ধি করা হয়েছে। দোকানের ভিতর গিয়ে চুপচাপ বসি কিছুক্ষণ। কোন প্রশ্ন করি না।
একটা অপরাধ বোধ তাড়া করে আমাকে।
- খোকন ভাই,একটা সিগারেট দেন।
খোকন ভাই সিগারেট দিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। কিছুক্ষণ পর বলে,
আসলে ভাইজান আমাগোরই দশ। আমরাই তো প্রত্যেক নির্বাচনে একেকবার একেকজনকে ভোট দেই এম পিঁ,মন্ত্রী,প্রধানমন্ত্রী বানাই।
আর হ্যাঁরা আমাগোর পেটে পাছায় লাথি মারে দুচোখ বন্ধ কইরা।
খোকন ভাইকে টাকা দিয়ে চুপচাপ বেরিয়ে আসি দোকান থেকে। একটু তাড়াতাড়ি করেই যেন। হইত আমি এড়াতে চাইছি খোকন ভাই কে। কারণ আমি এতদিনে জেনে গেছি সচেতন হওয়া অপরাধ,সচেতনতা জন্ম দেই দায়বদ্ধতার।
তাই সমাজ,প্রশাসন রাষ্ট্র,রাষ্ট্রকাঠামো চায়না আমি সচেতন হই। চায়না আমি জেনে যাই গরিব দুঃখী,অসহায় মেহনতি সর্বহারা মানুষের কথা। যেমন জানতে দেয়া হয় না উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে ভেসে ভাসমান মানুষ বৃদ্ধির কথা,বৃদ্ধি পাওয়া ভাসমান পতিতাদের হার,অব্যাহত বৃদ্ধি পাওয়া ধনী গরীবের বিভেদের কথা।
আমি আর কি করবো। হইত কিছু করতে হবে তাদের জন্য যারা অগণিত,যারা অসহায়,যারা নিষ্পেষিত।
অথবা আত্মসমর্পণ করবো সমাজ,প্রশাসন,রাষ্ট্র,রাষ্ট্রকাঠামোর কাছে। হইত খোকন ভাইয়ের দোকানে বসে চুপচাপ মাথা নিচু করে থাকবো। বড় জোর এক কাপ চা খাবো। আর দোকানে কর্মরত তার ছোট ছেলেটির হাতে একশত টাঁকার নোট দিয়ে নিজেকে মহৎ ভাববো। আর আমাদের জন্য ভাঙা হবে আরও অনেক খোকন ভাইয়ের চায়ের চুলা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।