আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্প : শ্রীহীন কাহন

♠ ব্লগার ইমন জুবায়ের ♠ মেঘের আড়ালে থাকা একটি নক্ষত্রের নাম

তরীটা শেষ বারের মতো ডুবলো যখন....... আলো ফুটাবার আগেই সারা গাঁয়ের কাকগুলো আজ তীব্র স্বরে ডাকতে শুরু করে দিয়েছে। কাকের স্বরেও একটা করুন সুরের আবেশ রয়েছে;যেন ঘটে গেছে অবাঞ্চিত কোন কিছু। ঘটনা থেকে দুর্ঘটনার আরম্ভ যেখানে; আজ সেখানে এই ভোরবেলাতেই আকাশটা গোমট ভাব ধরে আছে। প্রভাত আলোর সাথে সাথেই অচিনপুরের গ্রামবাসী জেনে গেল রাতের শেষ প্রহরে নিপেন রায়ের কন্যা শ্রীলক্ষী ইহধাম ত্যাগ করেছে। গাঁয়ের একটা শ্রীলক্ষী মরে গেছে তাতে যেমন দেশের এক কোনা ক্ষয়ে যায়নি, তেমনি শ্রী লক্ষীর জন্য এপাড়ার চক্রবর্তী বাড়ির কারোর মাথাব্যাথা বা হাহাকার জাগেনি বিন্দু মাত্র।

প্রতিটা দিনের মতো তাদের সকালের শুরুটা হয়েছে বরাবরের মতই। রোজ যেমন করে দাশ পাড়ার ছেলেরা ফুটবল নিয়ে মাঠে নেমে যায় আজ হয়তো ওরা নেমে যেত মাঠে কিন্তু নিপেন রায়ের বাড়ি থেকে ভেসে আসা কান্নার করুন সুরের কাছে ওদের ইচ্ছেটা থমকে গেছে। রঘুনাথের চায়ের চুলো আজ জ্বলেনি; ঝাঁপি খোলেনি দ্বীপশিখার বাবাও। বোবা মেয়েকে নিয়ে রোজ সকালে পুজো দিতে যেত অবিনাশ সেও আজ মাঝ পথে থ” মেরে গেছে; এ-সবই ব্যতিক্রমের মাঝে গড়াগড়ি খেলেও; শুধু বদলে যায়নি চক্রবর্তী বাড়ির দৃশ্যপট। সেই সকালে আরেক দৃশ্যের সুত্রপাত ঘটতে চলেছে তখন কাঙ্খিত চক্রবর্তী বাড়িতে।

পাশের গাঁয়ের খালেক পাঠান চক্রবর্তী বাড়ির আঙ্গিনার মাঝ বরাবর দাড়িয়ে চেচাচ্ছিল। হরিপদ’র তখনও খাওয়া হয়ে উঠেনি। অফিস যাবার তাড়াহুড়োতেই শ্যামল চক্রবর্তী গলায় টাই বাধছে, আর ওদিকে পরমা দেবী ঠাকুর ঘরে ঘন্টা বাজাতে শুরু করে দিয়েছে। চক্রবর্তী বাড়ির প্রতিদিনকার সকালটা এভাবেই শুরু হয় তার ব্যতিক্রম ঘটানো মুশকিল। এ-গাঁয়ে চক্রবর্তীদের কে সবাই যথেষ্ঠ সমীহ করে চলে।

একেতে গাঁয়ে পুরোহিত বলতে একমাত্র ওরাই তার উপর ঠকুর দেবতার পায়ে পরম পূজনীয় হিসেবেই গাঁয়ের লোক ওদের মানে। শ্যামল চক্রবর্তি বিয়ে করেননি তাতে কি ! কিপটেমিতে এ গাঁয়ের সেরা। হরিপদ’র বউ পরমাদেবী যাকে গায়ের লোক দেবী বলেই মনে করে; তার কিন্তু গ্রামের কায়স্থদের প্রতি ভারী রাগ। কোন কম্মিনকালে যে তিনি ঠকে ছিলেন এক কায়স্থের হাতে সেই,থেকেই শুরু। কুয়াশা মেশানো শীতের সকালে খালেক পাঠানের কাটা স্বরের গলা ফাটানোটা আড়ালে পড়ে যেত, যদি কিনা পরমার ঘন্টা বাজানোটা ক্ষানিকটা সময় আরো চলতো।

কিন্তু হঠাৎ ঘন্টা থেমে গেল !! বোধহয় কাটাকাটা স্বরটা কানে গিয়ে লেগেছে ততক্ষনে। পরমা বাইরে বেড়িয়ে শাসিয়ে বলে উঠল, সে কি পাঠান সাহেব অত জোড়ে চেচাচ্ছেন কেন ? বলি হয়েছেটা কি? -কি আর হবে, এই বলে এতক্ষণ চেচানোর চোটে তেষ্টা লেগে বারান্দায় একপাশে বসে গেলেন তিনি ওনার একটু হাপানিও আছে আবার, তাই একটু দম নিয়ে বলল, হরিপদর দাদার ছেলে সুকান্ত আমার মেয়েকে নিয়ে পালিয়েছে। -চক্ষু চরকগাছ হয়ে গেল পরমার মুখ থেকে বেড়িয়ে এল হায় ! পালিয়েছে বললেই হলো আমার কান্ত গাঁয়ের ছোট জাতের হিন্দু মেয়েদেরকেই পাত্তা দেয়না সে তোমার মেয়েকে নিয়ে যাবে কোন দুঃখে। পাঠান বলল আপনাদের কান্ত কি আর সাধে গেছে আমার মেয়ে সফুরাই তো ওকে জালে আটকে দিয়েছে। হাত থেকে ঘন্টা পড়ে গেল পরমার।

শ্যামলের পায়ে আর জুতা পড়া হলোনা, হরিপদ বোধকরি ততক্ষনে ফ্রিজ হয়ে গেছে। পরিবেশে খানিকটা গুমোট ভাব চাপলো এবার। খালেক পাঠান দাড়িয়ে উঠে বললো, আমার মেয়েকে আজ দিনের মধ্যে ফেরত দিতে হবে না হলে ঠাকুর,কর্তা,পুরোহিত কিন্তু মানবো না আমি বলে দিলাম। সব কটাকে জেলে পুড়ে দেব। হরিপদ এসে বললো আমার ছেলে যে তোমার মেয়েকে নিয়ে ভেগেছে তার কি প্রমাণ আছে তোমার কাছে ? ভাজ করা একটা ছোট চিঠি দিল পাঠান।

এই সে দেখুন লেখা আছে। শ্যমলের চোখ বড় হয়ে গেছে ততক্ষনে পাড়লে হরিপদকে ধরে ফেলে;কিন্তু দাদা বলে কথা; দাদার তো আক্কেল কোন কালেই ছিলোনা তার ঘরেরই তো ছেলে তার কি আর আক্কেল হবে। চিঠির মর্মার্থ যদি বা বোঝা গেল। কিন্তু ঘটে যাওয়া ঘটনা যে কোন পর্যন্ত গিয়ে দাড়াবে তা,কে জানে তাই সেটার আন্দাজ আপাতত কেউ ভাবলো না। চিঠির সারাংশ হরিপদর সামনে আয়নার মতো ভাসতে লাগলো বংশের মুখে চুনকালি লেপন করে ছোট কর্তা শ্রী মান সুকান্ত চক্রবর্তী সফুরা বেগমকে নিয়ে ভেগেছেন।

পরমা এই মর্মার্থ বুঝতে গিয়েই জ্ঞান শূন্য হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। সবাই ধরা-ধরি করে ভেতরের বাড়িতে নিয়ে গেল। সারা গাঁয়ে ছিঃ ছিঃ পড়ে গেল। কর্তা ভেগেছে মুসলমানের মেয়েকে নিয়ে;পারলে পাড়া শুদ্ধু লোক চক্রবর্তীদের বাড়িতে ছিঃ ছিঃ কোরাস তুলে আর কি? আর এই ছিঃ ছিঃ উপলক্ষ্যে চক্রবর্তী বাড়ির লোকজন শ্রীলক্ষীর অন্তর্ধান নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় আর পেলনা। তটিনীর এপাড় গঙ্গার ধারে দুর্বাঘাসে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে সুকান্ত।

প্রেমের খেলা খেলতে গিয়ে শ্রীলক্ষীর জন্য মনটা আজকাল একটু আকুপাকু করে; এত খেলা সে চায়নি কিন্তু হয়েগেছে। এবার ভাবছে অভিনয় করতে গিয়ে কি শেষে ভালবাসার জালে আটকে যাবে। ওর ভাবনায় আছে কদিন প্রেম-প্রেম খেলে তারপর একদিন ফুরুত করে পালাবে। ও ভেবেছিলো শ্রীলক্ষী নিশ্চই কষ্ট পাবেনা। কিন্তু গত দুপুরের বাধ ভাঙ্গা ঢেউ কান্না দেখে খানিকটা অবাকই হয়েছে সুকান্ত।

নারীরা বড্ড বোকা হয়; ভালবাসলেই কি সব কিছু দিতে হবে। সুকান্ত’র চতুর অভিনয় ঘুনাক্ষরেও শ্রীলক্ষী বুঝতে পারলোনা। সাত সমুদ্র ভেবে নিয়ে আর সামনে এগোনো যায়না; যাই হোক সুকান্ত’র এবার পল্টি নিতে হবে। এ-যুগে এক প্রেমে কি তুষ্ট থাকে মন। কেষ্ট’র যদি অষ্ট সখি থাকতে পারে সেই ক্ষেত্রে সুকান্ত কোন ছাড় যে, তার মাত্র একটা সখি থাকবে।

কমপক্ষে পাচঁটা প্রেম না করতে পারলে কি নারীকে চেনা যায় ? আকাশের রঙ বদলায়, বদলায় সব কিছু; হাওয়ার টানে পাল উড়ায়ে উজান যায় নৌকা। তাহলে ওইবা কেন বদলাবে না। সুকান্ত জানে হরিপদ কখনো মেনে নেবেনা শ্রীলক্ষীকে। যদি বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে কখনো আসে তাহলে একবার মুখ ফুটে বলে দিলেই হবে। কায়স্থ হয়ে বামুনের সাথে একটা গোল পাকাতে এসেছ নীপেন বাবু।

শ্রীলক্ষী’র জন্য ভালোবাসার বাগানে অনেক ফুল ফুটানো হয়েছে এবার নতুন আরেকটা বাগান তৈরি করা দরকার। এ গাঁয়ের মেয়েদের সৌন্দর্যের ছটাটা বোধকরি একটু কমই। তা,না হলে সবকটা শ্যামলা বরণ কেন; সে,যাই হোক সুকান্তর নতুন প্রেম একটা চাই। মাঝে-মাঝে ক্ষ্যাপা হয়ে বলতে ইচ্ছে করে প্রেমে নেই জাত-পাত স্বার্থ উদ্ধারের পর ভালোবাসা রসাতলে যাক। সুকান্তর ভাবে শ্রীলক্ষীকে ভালোবাসা একটু বেশিই দেয়া হয়েছে; নয়তো সকালসন্ধ্যে তারই নাম কি আর এমনিতে জপে।

ক্যালেন্ডারে রাধাকৃষ্ণকে দেখিয়ে লক্ষী একদিন বলেছিলো,কেষ্ট ঠাকুরের মতো তুমি আমি সারাজীবন এভাবে একসাথে থাকবো তো !! সুকান্ত মুখের সাইজ হ্যাবা করে বলল, বোকা নাকি কেষ্ট ঠাকুরের কি বিয়ে হয়েছিলো কখনো !! ওটা তো প্রেমলীলা ছিল। আদুরে গলায় বটবৃক্ষের তলায় গাছের নিবিড় ছায়ায় বসে শ্রী বলে গেল আমি সারাজীবন তোমাকে নিয়েই থাকতে চাই ! তুমি তো আমার নিশ্বাস; আর জান,তো নিশ্বাস ছাড়া বাঁচা যায় না। কথা শুনে সুকান্তর ভেতর থেকে হাসি হাসছিল ঠোট চেপে বলে; ও তাই !! সুকান্তর মনের পর্দা বলে সিনেমার ডায়লগ বলা হচ্ছে;যেন একবারে মুখস্থ; হায়রে ব’এর বোকারানী শ্রীলক্ষী। লায়লা -মজনুকা জামানা আভি নেহি !! এ যুগে অত ভালোবাসা থাকতে নেই। গত ক’দিন ধরে সুকান্ত নতুন ডানায় ভর করে ভাবনার জল গায়ে ঢেলে মজে আছে; এবার প্রেমটা একটু ব্যাতিক্রমী হবে।

সর্ষে ক্ষেতে ফুল দেখতেই সুন্দর কিন্তু তার সুভাষ ভালো হয়না। গোলাপের কাটা না থাকলে সুন্দরের কমতি হতো তাই কাটায় ভরা গোলাপই সুন্দর। ব্যাতিক্রমী প্রেম না করলে জীবনের রস আস্বাদনে পাচঁফোড়ঁনের ঝাজ পাওয়া যাবেনা। ব্যাতিক্রমী অনুভূতির আশায় সুকান্ত’র ইচ্ছেরা পাশের গাঁয়ে পাঠানের সুশ্রী মেয়ে সফুরাবানুর পাশে গিয়ে দাড়ালো; নতুন আর একটা প্রেমের পটে চিত্রাঙ্কন শুরু হলো। আর ওদিকে শ্রীলক্ষী যার প্রেমাতুর মন সুকান্তকে ভালোবেসে প্রেমের নদীর মাঝ পথে সাম্পান নিয়ে বসে আছে সে।

আজকাল নববধু হবার স্বপ্নে মাতোয়ারা হয়ে যায় সে; যার রস আস্বাদন হয়ে গেছে সুকান্তর প্রেমের ষড়যন্ত্রের ছাকনিতে; শ্রীলক্ষী বিশ্বাসের পাহাড় হাতের মুঠোয় নিয়ে সব দিয়েছে উজার করে। শ্রীলক্ষী’র মতো এই মেয়েরা সারল্যের সেতু খুলে দিয়ে বসে থাকে সর্বনাশের নাটের গুরুর হাতে। নিজের সর্বনাশের কথা যদিওবা টের পায় সেথায় পাইন বনের নিরবতা এনে সয়ে যাওয়া পাথর মনে করে নিজেকে তুলে ধরে। তটিনীর ওপাড় সাধন দা’র মিষ্টান্ন ভান্ডার কেবিনে বসে শেষ বারের মতো শ্রীলক্ষী বলে উঠলো সুকান্ত তুমি যদি ঘরনী করে আমাকে না তুলে নাও, তাহলে কিন্তু আমাকে বিসর্জন হতে হবে। মৃদু হেসে সুকান্ত বললো, ধুর বলে কি পাগলী !! তোমার জন্য গাঁ ছাড়া হবো নাকি, আমাকে এবার ছাড়ো তোমাকে মুক্তি দিয়ে দেই।

শ্রী এবার তুমি ডানা মেলে উড়ো; ভালবাসলে বিয়ে করতে হবে এমনটা আছে নাকি আজকাল। চমকে যাওয়া শ্রী আকাশ হতে যেন পড়ে গেছে এমনটাই মনে হয় ওর চোখ ছাপানো কাঁন্নাকে থমকে দিয়ে কাপা কন্ঠে বলে উঠে তুমি কি তাহলে আমাকে সত্যি ভালোবাসনি? এতকাল অভিনয় করেছো; সুকান্ত তুমি কি বলছো তা,কি জানো !! সুকান্ত চোখ সাজিয়ে বলে সত্যিকারের ভালোবাসা আজকাল সিনেমায় হয় বাস্তবে নয়; অনেকদিন প্রতিমা বিসর্জন দেখিনি,তোমার বিসর্জন দেখতে ভালোই লাগবে। শ্রী এই জনারন্যে কাঁদবে কি করে; তবুও চোখ যে ফেটে বেড়িয়ে আসছে; ওর সবকিছু নাই হয়ে গেছে তাই হয়তো চিরসত্যি আজ ওর ভালোবাসা গভীর গহীনে পড়ে গেছে যেখানে অথৈ আঁধার। চোখ মুছে শ্রীলক্ষী বলে উঠলো, আমার ভালোবাসার কোন মূল্য নেই তোমার কাছে ? -সুকান্ত হা-দুখানা প্রসারিত করে বললো শ্রী তুমি দেখনি; সদ্য ফোটা ফুল কেমন শোভা পায় ফুলদানীতে কিন্তু সে ফুল যদি চুপসে যায় তাহলে ফেলে দিতে হয় আবার কেউবা ভালো লেগে গেলে রেখে দেয় বইয়ের ভাজে কিন্তু কেউ কি সেটা আবার ঘরের শোভা বাড়াতে ঘরে তুলে; সেটা তুলে না কেননা সেটা পুরোনো হয়ে যায়; তুমিও আমার কাছে এখন পুরোনো হয়ে গেছ। আমি ছায়া মাড়াতে পারি;কিন্তু ছায়া কি আমাকে মাড়াতে পারে কখনো।

সত্যি বলতে আমার ইচ্ছে ছিলো সব লুটে নেব কিন্তু তার বিনিময়ে অনেকদিন ভালোবসবো। আর তাছাড়া শ্রী তোমার তো এমন কোন ক্ষতি হয়ে যায়নি;তোমার দেহ আছে,মন আছে নতুন করে কাউকে ভালোবেসে কাছে ডাকো;শান্তি পাবে। শ্রীলক্ষীর ইচ্ছে করছিলো চরিত্রহীনটার মুখে একদলা থু-থু ফেলতে; কিন্তু করতে গিয়েও বিবেকে বাঁধলো; ভালবাসতো কি,না ভালবাসাটা তো নষ্ট হয়ে যায়না,তার মাঝে শুধু ঘৃণাটা এসে যোগ হয়। সেই ঘৃণাটা আজ ভীষন ভাবে এসে জাপটে ধরেছে শ্রীলক্ষীকে। শ্রীলক্ষী উঠে দাড়িয়ে সোজা হয়ে সুকান্তর গালে একটা চপেটাঘাত করে বলল,তুমি পায়ের নিচে চাপা পড়ে যাওয়া কীটের চেয়েও জগন্য; যদি আগে জানতাম তুমি এমন প্রানী তাহলে রাস্তার সারমেয়কে ভালোবাসতাম তবুও তোমাকে না।

সুকান্ত আর কি যেন বলতে চাইছিলো; শ্রীলক্ষী কান্নাচাপা দিতে দ্রুত বেড়িয়ে এল। বাড়ি ফিরবার আগ পর্যন্ত ওর মনে হলো পথের নুড়ি পাথর থেকে শুরু করে গাছের নুয়ে পড়া ডাল গুলো পর্যন্ত ওকে ব্যাঙ্গ করছে; ভীষন বোকা !! ও ভীষণ রকমের বোকা !! তরীটার পথচলার শুরু যেখানে মাঝ রাতে বিছানায় গা এলিয়ে শ্রী লক্ষীর মনে ভাসে যদি জীবন না’য়ে সারা জীবনের সঙ্গীই না করতে পারলি হতভাগা তাহলে ভালবাসলিই বা কেন? আজ চোখে শুধু জ্বালা ধরে যায়। বারবার হৃদপিন্ডটা কম্পন করে উঠে। দেয়ালের পুরোনো ক্যালেন্ডারটা বলে উঠে, শ্রী তুমি তলিয়ে গেছে ডুবন্ত জাহাজের মতো; তুমি কতবার আকঁ কষেছ আমার গায়;শুধু অপেক্ষার দাগ। একদিন তুমি বধু হবে সেই ভাবনায় ক্যালেন্ডারের পাতায় গুনেছ তুমি দিন-মাস-বছর।

চোখ বন্ধ করে শ্রীলক্ষী ভাবতেই পারেনা অন্য কোন পুরুষ ওর হাত ধরবে ওকে কাছে টানবে;কিছুতেই না !! যে অধরে সুকান্তর স্পর্শ লেগে আছে এখনও তাতে অন্য দশটা মেয়ের মতো প্রেমটাকে ফ্রেমে বন্দি সিনেমার অংশ বিশষ ভাবতে পারেনা ও। স্বর্গীয় বস্তু এটা। কোন কবি লিখেছেন স্বর্গ হতে আসে প্রেম, সেই বিশ্বাসটা ওক দারুন ভাবে কাপিয়েছে। আর এই অষ্টাদশ বয়সে বাধভাঙ্গা প্রেম ওকে আলোড়িত করে তুলেছে বারংবার। কেষ্ট ঠাকুর থেকে শুরু করে চন্ডিবাবুর প্রেম কোনটাই বাদ যায়নি।

দীর্ঘ তিনটি বছর জুড়ে এই প্রেমলীলা চলেছে সুকান্তর সাথে। প্রেম ও করতে চায়নি করতে হয়েছে। কেষ্টর বাঁশির সুরে রাধা না এসে, থাকতে পারেনি; আর ও, তো শ্রীলক্ষী সে কি করে ফেরাবে। তাই প্রেমের জালে নাও ভাসিয়েছে। ক্যালেন্ডরে আকঁ কষা আছে প্রথম দিনকার কথা।

সুকান্ত হ্যাংলাটে টাইপের প্রতিদিনকার কলেজ ছুটির পর পিছু থাকতোই; প্রথম ক’দিন সামনে এসে নিবেদন করেছিলো শ্রী’র মনটা পাবার জন্য; তারপর আড়ালে-আবডালে মরিয়া। শেষে রোদ জ্বলা এক দুপুরে সুকান্ত কাছে এসে বলেছিল যদি ভালোবাসা না দাও তো একশিশি বিষ তো দিতে পারবে। না হয় তাই দাও সেটা খেয়েই না হয় এ-ভুবন ছাড়ি। শ্রী,সুকান্তকে ভালোবাসার সাহস কিছুতেই করতো না; কিন্তু সত্যিই যদি;কোন অঘটনের জন্ম দিয়ে দেয় সুকান্ত এই ভেবে ভালবাসলো; তখন কে জানতো হৃদয় না পোড়ালো কষ্টের তাপমাত্রাটা সঠিক বোঝা যায়না। এসব কথার ভীড়ে মাথা চারা দিয়ে উঠলো শেষ বিকেলে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা।

শ্রীলক্ষী যখন সুকান্তকে শেষবারের মতো বুঝাতে ব্যার্থ হচ্ছিল ঠিক সেই মুহুর্তটাতেই নীপেন রায়,শ্রীলক্ষী’র বাবা হরিপদ চক্রবর্তীর দ্বারে গিয়ে হাজির। বিষয়টা তো হেস্তনেস্ত করতে হবে। কিন্তু চিরকালের রগত্যাড়া হরিপদ কি আর ভালোবাসা বুঝে; হম্বিতম্বি করে নিপেন বাবুকে তিরস্কার করলেন। ছোট জাতের কায়স্থ হয়ে কিনা বামুনের ঘরের বউ হতে চায়। নিপেন বাবুর প্রায় কেঁদে ফেলবার উপক্রম।

দৈন্যতা কখনো অনুভব করতে দেননি সন্তানদের নিজের সাধ্যের সবটুকু তিনি করেছেন। শ্রীলক্ষীকে ভালবাসেন আর তাই মেয়ের সুখের জন্য চক্রবর্তীর সামনে আজকের এই হাতজোড় করা। একে তো বাবার তিরস্কারের ধাক্কা তার উপর সুকান্তর মুখোশ উন্মোচন; সব মিলিয়ে তীরে ভীড়বার আগেই বুনোঝড়ে তরীর অগস্ত্য যাত্রার সংকেত। বাবার তিরস্কারটা ভুলে যেতে পারতো শ্রী, যদি কি,না সুকান্ত এমনটা না করতো। হরিপদ বলেছে ছেলেকে ঘরে তুলবে না এমন কর্ম সাধন করলে এ গাঁ ছাড়া করবে তাকে।

তার চেয়ে বড় কথা নিপেন বাবুকে শাসানো হয়েছে মেয়েকে জলদি পাত্রস্থ করতে হবে। যদি দূর্ঘটনা কিছু ঘটে গায়ের লোক রায় বাড়ির সকলকে গাঁ ছাড়া করবে। রাতের আঁধারটা কষ্ট লুকাবার বিশেষ একটা স্থান। আর তাইতো শ্রী কষ্ট লুকাতে এই রাতে শেষ বারের মতো বসে আছে সমস্থ স্মৃতিকে নিয়ে একপাশে। বাবা কখনো কোনদিন এমন ভাবে লাঞ্চিত হয়নি।

নিজের এই অস্পৃর্শা শরীরটাকে কারো ঘরের লক্ষী হিসেবে দেয়া যায়না; শুধু এ ধরনী ছেড়ে দেয়া যায়; কিন্তু খুব কষ্ট যে হবে;সুকান্ত তুমি কেন এমন করলে !! আমি শ্রী আজ সম্পুর্ন শ্রীহীন হয়ে গেলাম। বিষাক্ত তরলের শেষবিন্দু টুকু কন্ঠে ধারণ কনে নিলো শ্রীলক্ষী। তারপর একটানা তানপুরার সুরের মতো করুন স্বরে আর্তবিলাপ করে চলা হলো তার। শ্রীলক্ষী রাতের শেষ প্রহরে ভালোবাসার দেয়ালে যখন একে দিল কষ্টের করুন চিহ্ন তখন ভোর হতে চলেছে। সমাপ্ত ************************************************* শুভেচ্ছা চক্রবর্তীদ্বয় কে................. অমিত চক্রবর্তী দিপেন চক্রবর্তী


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.