আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

সব কিছুর মধ্যেই সুন্দর খুঁজে পেতে চেষ্টা করি............

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় একটি পাঠশালার বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠা শুধু দুঃসাধ্যই নয়, অবিশ্বাস্যও বটে। ঠিক এমনই অত্যাশ্চার্য ঘটনাটি ঘটেছে আজকের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলাতে। বুড়িগঙ্গার ধারের জগা বাবুর পাঠশালা যে একদিন দেশের অন্যতম সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে পরিণত হবে তা হয়তো কেউ কল্পনাও করেনি। একটি পাঠশালার এই বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠা নিয়েই আজকের পোস্ট। পাঠক, আপনারা হয়ত অনেকেই জানেন-আঠারশ’ আটষট্টি সালে মানিকগঞ্জের বালিয়াটি প্রকারন্তরে বলিয়াদী জমিদার জগন্নাথ রায় চৌধুরী পুরান ঢাকয় কলেজিয়েট স্কুল ও পোগেজ স্কুলের পাশেই স্বল্প পরিসরে শিশুদের জন্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন “জগন্নাথ পাঠশালা" যা দুই বছরের মাথায় "জগন্নাথ স্কুল" নামে পরিণত হয়”।

অনেক বিশিষ্ট বাঙ্গালি লেখাপড়া শিখেছেন এই প্রতিষ্ঠানে। বিখ্যাত সাহিত্যিক ড. দিনেশ চন্দ্র সেন এই স্কুলের ছাত্র ছিলেন। ১৮৮২ সালে তিনি এ স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাস করেন। ১৮৮৪ সালে জমিদার জগন্নাথ বাবুর মেঝ পুত্র কিশোরী লাল রায় চৌধুরী ও এলাকার প্রভাবশালীদের সহযোগিতায় স্কুলটির স্কুল শাখারা সাথেই উচ্চ মাধ্যমিক তথা কেলেজে উন্নীত হয়। তখন কলেজ শাখার ছাত্র ছিল মাত্র ৪৮ জন।

১৮৮৭ সালে স্কুল শাখা কলেজ থেকে আলাদা করা হয়। স্কুল শাখার নাম দেয়া হয় "কিশোরী লাল জুবিলী স্কুল"। যা বর্তমানে কে এল জুবিলী স্কুল নামে নিবন্ধিত এবং পরিচিত। কিশোরী লাল রায় চৌধুরী কলেজ পরিচালনায় তীক্ষ্ম দৃষ্টি রাখতেন। তার দূরদৃষ্টির ফলে ১৯০৭ সালে "কলেজ ট্রাষ্টি বোর্ড" গঠিত হয়।

১৯০৯ সালে তার মৃত্যুর পর ট্রাস্টি বোর্ড পুনর্গঠিত হয়। অনেক খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ছিলেন। তাদের প্রচেষ্টায় এলাকার বিত্তবান ও দেশী-বিদেশী বিদ্যানুরাগী প্রতিষ্ঠানটি সম্প্রসারণের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। সন্তোষের জমিদার রাজা মন্মথ রায় চৌধুরী ১৯১০ সালে টাঙ্গাইলের প্রথম মন্মথ কলেজটিকে জগন্নাথ কলেজের সঙ্গে যুক্ত করেন। এ সময় কলেজের ছাত্র সংখ্যা ছিল পাঁচ শত।

সে বছরই ঢাকার কমিশনার স্যার রবার্ট নাথন কলেজটিকে নগদ ৮০ হাজার টাকা অর্থ সাহায্য দেন। জগন্নাথ কলেজের মূল প্রশাসনিক ভবনটি এই টাকায় নির্মিত। তখন কলেজটিতে আইএ; আইএসসি; বিএ (পাস) শ্রেণী ছাড়াও ইংরেজি, দর্শন ও সংস্কৃতে অনার্স এবং ইংরেজিতে এমএ পড়ানো হত। ১৯২০ সালে ভারতীয় লেজিসলেটিভ কাউন্সিল আইন পাসের মাধ্যমে জগন্নাথ কলেজ অ্যাক্ট নথিভুক্ত করে। ১৯৪২ সালে অধ্যক্ষ শৈলেন্দ্র ঘোষ নিজের মেয়েকে ভর্তি করার মাধ্যমে কলেজে সহশিক্ষা চালু করেন।

এই কলেজে ১৯৬৭ সালের প্রথম মহিলা শিক্ষিকা হিসেবে যোগ দেন হামিদা রহমান। ১৯৬৮ সালে জগন্নাথ কলেজকে সরকারি করা হয়। দিনে দিনে কলেজে ছাত্র সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে আবাসন সংকট দেখা দেয়। কর্তৃপক্ষ আবাসন সমস্যা সমাধানে পুরনো ভবন ক্রয় এবং ততকালীন ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেটের কাছ থেকে বিভিন্ন স্থানে জমি লিজ নিয়ে ভবন তৈরি করে। ১৯৮৩ সালের মধ্যে মোট ১৫টি হল তৈরি করে মোটামুটি আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়।

১৯৯৫ সালে জগন্নাথ কলেজের ছাত্র সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৮ হাজার। জাতীয় সংসদে “জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০০৫” পাস করার মাধ্যমে জগন্নাথ কলেজকে পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা হয় ২০০৫-২০০৬ অর্থ বছরে। সেই "জগা বাবুর পাঠশালা" থেকে বার বার নাম বদল হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। ১৮৬৮ সালে প্রতিষ্ঠাকালে নাম রাখা হয় জগন্নাথ পাঠশালা, তারপর জগন্নাথ স্কুল। মাঝে কিছুদিনের জন্য রাখা হয়েছিল ব্রাহ্ম স্কুল।

পুনরায় ১৮৭৮ সালে জগন্নাথ স্কুল, ১৮৮৪ সালে জগন্নাথ কলেজ, ১৯২১ সালে জগন্নাথ ইন্টারমিডিয়েট কলেজ, ১৯৬৮ সালে সরকারি জগন্নাথ কলেজ, সর্বশেষ ২০০৫ সালে নতুন নাম হয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। তবে প্রতিষ্ঠানটি শুরু থেকে বার বার কুচক্রীদের ষড়যন্ত্রের কবলে পড়েছে। জগন্নাথ কলেজে আই,এ, আই,এসসি, বি,এ (পাস) শ্রেণী ছাড়াও ইংরেজি, দর্শন ও সংস্কৃতি অনার্স এবং ইংরেজিতে মাস্টার্স চালু করা হলেও ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর তা বন্ধ করে দেয়া হয় এবং ইন্টারমিডিয়েট কলেজে অবনমিত করা হয় জগন্নাথকে। নিউমার্কেট এলাকায় জগন্নাথের সম্পত্তির ওপর নির্মিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার সাজাতে জগন্নাথ কলেজ গ্রন্থাগারের ৫০ ভাগ বই দান করা হয়।

পুরানো ঢাকার নারী শিক্ষায় বাধা দূর করতে ১৯৪২ সালে সহশিক্ষা চালু করা হয়। ১৯৪৮ সালে তা বন্ধ করে দেয়া হয়। ১৯৬৩ সালে অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান(শফিক রেহমান সাহেবের পিতা) পুনরায় কো-এডুকেশন চালু করেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ জগন্নাথ কলেজে পাকিস্তানী হানাদাররা হামলা চালায়। ছাত্ররা অনেকে পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করেন।

ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে এবং মুক্তির সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে। জগন্নাথ কলেজে হানাদারদের ক্যাম্প করা হয়। যুদ্ধ শেষে এখানে গণকবরের সন্ধান মেলে উদ্ধার করা হয় কয়েক ট্রাক ভর্তি মানুষের কঙ্কাল। ১৯৮২ সাল থেকে শুরু হয় এলাকার প্রভাবশালীদের জগন্নাথ কলেজের হল দখলের পাঁয়তারা। ছাত্রদের সাথে এলাকাবাসীর সংঘর্ষ বাধে বারবার।

বর্তমানে দখল প্রক্রিয়ায় সব থেকে এগিয়ে আছেন হাজী সেলিম। ১৯৮৪ সালে পুরানো ঢাকার মহল্লায় মহল্লায় ভিসিআর-এ সিনেমা দেখানো হতো। ভিসিআর দেখানোর নামে অনৈতিক কাজও চলত। একপর্যায়ে ছাত্ররা আন্দোলন করে পুরানো ঢাকার সর্বত্র ভিসিআর প্রদর্শনী বন্ধ করে দেয়। ভিসিআর প্রদর্শনার্থীদের আয়ের পথও বন্ধ হয়ে যায়।

হল দখলের লোভে এককভাবে ছাত্রদের উপর দোষ চাপিয়ে ছাত্রাবাসগুলোতে হামলা চালানো হয়। প্রথমে বেদখল হয়ে যায় কুমারটুলি ছাত্রাবাস। এরপর একের পর এক বেদখল হয় ৮৪ জিএল পার্থ লেন, কুমারটুলিতে (ওয়াইজঘাট ষ্টার সিনেমা হলের পিছনে) অবস্থিত হলগুলো। ১৯৯২ সালে ১৪টি হলের মাত্র ৩টি কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে থাকে। বাকিগুলো পুলিশ ও এলাকাবাসীরা দখল করে নেয়।

৩টি হলের দুটি (মাহমুদা স্মৃতি ভবন ও এরশাদ হল) বর্তমানে ভেঙ্গে মসজিদ ও কলা অনুষদ করা হয়েছে। বর্তমানে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকের পদ আছে-৩৫০টি, শিক্ষক আছেন- ৩০৩ জন, শিক্ষক ডিপুটেশন হয়েছেন- ২৮২ জন, ছাত্র সংখ্যা- ২৮ হাজার, অনুষদ ৪টি (কলা, বাণিজ্য, সামাজিক বিজ্ঞান ও বিজ্ঞান), অনার্স ও মাস্টার্স পড়ানো হয় ২৪টি বিষয়ে, গ্রন্থাগার ১টি, ব্যবহৃত হল ১টি, নাম বানী ভবন। বেদখল হয়ে যাওয়া হলের সংখ্যা ১১টি, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভিসি ড. সিরাজুল ইসলাম। বর্তমান ভিসি ডঃ মেজবাউদ্দিন আহমেদ দায়িত্ব পালন করেছেন(এই তথ্যে সামান্য পরিসংখ্যানগত ভূল থাকতে পারে-যেহেতু বেশীর ভাগ তথ্য গত মার্চ মাসে নেয়া)। বর্তমান সমস্যাঃ অন্যান্য সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় অনাবাসিক এ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের উচ্চহারে বেতন ও ভর্তি ফ্রি গরীব মেধাবী ছাত্রদের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পরিবহনের জন্য আছে মাত্র ৬ টি বাস। এর মধ্যে ২টি মিনিবাস শিক্ষক আনা-নেয়ার জন্য। ১০ টি বি আর টি সি বাস ও ২টি মিনিবাস শিক্ষার্থীদের আনা-নেয়া করে। বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার পর প্রশাসন শিক্ষার্থীদের পরিবহনের জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করার কথা বলা হলেও এ পর্যন্ত কিছুই হয়নি। প্রায় সময়ই ছাওত্র ছাত্রীদের লক্কর ঝক্কর লোকাল বাসে বাদুরঝোলা হয়ে আসা-যাওয়া করতে হয়।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. মেজবা উদ্দিন স্যার বলেন, নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেককিছুর অভাব আছে। এগুলো পূরণ হতে সময় লাগবে। বর্তমান ছাত্রদের ক্লাস সংকট পূরণ ও প্রশাসনিক কাজের সুবিধার জন্য ২০ তলা বিশিষ্ট ভবন করা হবে। তিনি বলেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় অতিপ্রাচীন ও একটি ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানের মান-মর্যাদা, সুনাম-সুখ্যাতি বজায় রাখা প্রতিটি ছাত্র ও শিক্ষকের নৈতিক দায়িত্ব।

(লেখার মূল তথ্য সূত্রঃ অধ্যক্ষ সাইদুর রহমানের লেখা "শতাব্দীর স্মতি", জগন্নাথ কলেজের ইতিহাস(লেখক অধ্যাপক আবুল বাসার, ঐ কলেজের প্রাক্তন এবং প্রয়াত প্রিন্সিপাল) এবং ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ভিসি ডঃ মেজবাউদ্দিন স্যারের সাথে ব্যাক্তিগত পরিচয়)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।