আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এক সাধারন রমনীর এক সাধারন দুপুর

নিশীথ রাতের বাদল ধারা

আমার রাজা, শুধু কি বললাম, কেন বললাম সেটাই বড় হল? আমার বুক ভরা অভিমান তুমি দেখলে না? তোমার জন্য ডুকরে ডুকরে কাঁদলাম, সেই আকূলতা তোমায় ছুঁল না একটুকুও? এই তোমার শর্তহীন, দ্বিধাহীন ভালবাসার প্রকাশ? এটকু লিখেই কলম থামিয়ে নাহিদা তাকিয়ে থাকল নোট প্যাডের দিকে। চোখের কোলে ঈষদুষ্ণ জলের বাষ্পে ঝাপসা হয়ে যেতে লাগল গুটি গুটি অক্ষরগুলি—জীবন্ত হয়ে উঠল, যেন চলন্ত পিপড়ের লাইন। চোখ মুছে একটানে সড়সড় করে ছিড়ে ফেলল চিঠিটা। কুটি কুটি করে কাগজের টুকরোগুলো ফেলে দিল টেবিলের পাশে রাখা বিনে। অনির্মেষ তাকিয়ে থাকল সাদা প্যাডের দিকে।

কেমন এক শ্লেষের হাসির কনামাত্র ফুটে উঠলো ঠোঁটের কোনে। কি আয়রনি! অনিকের প্রিয় গান হচ্ছে “মেরা জীবন কোড়া কাগজ”! সারাদিন গুন গুন করে গাইতো। হিন্দি বুঝে না কিছু কিন্তু গানের ভাব নাকি তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে! আঁতেল কোথাকার! কিন্তু সত্যি কি এগুলো তার মনের কথা? সে নিজেইকি অনিককে আগের মতন ভালবাসে? তাদের বিবাহিত জীবনটা কি নেহাতই স্বস্তিকর অভ্যাসে পরিনত হয়ে যায় নি? আটপৌড়ে হয়ে পড়েনি? তার খানিক আগের ক্ষণস্থায়ী মনস্তাপ কি আদতে অনিকের জন্য নাকি এই সমাজের কায়দাকানুনের ফাঁদে বন্দী আছে বলে তার সচেতন ভন্ডামির অপরাধবোধ? তার নিজেকে করুণার আত্মগ্লানি? কেন এই মিথ্যাচার নিজের সাথে? অনেক ভালবেসে সাজানো ঘরটা খাঁ খাঁ তেমন করছে না। যতটা একা একা লাগার কথা, লাগছে না দেখে নিজেই অবাক হচ্ছে খানিকটা। অনিক বাড়ি ছেড়ে গেছে আজ সপ্তাহখানেক।

ও কিভাবে থাকবে তা নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তাও করেনি। প্রথমটায় নাহিদা ভেবেছিল, দিন দুয়েক পরে রাগ পরলে আপনিই সুড় সুড় করে চলে আসবে, অভিমানী মুখ করে চারপাশে ঘুর ঘুর করবে, বিড়ালের মতন গা ঘেষে আদর চাইবে। কিন্তু ফিরে এল তো নাই-ই, বেমালুম লাপাত্তা হয়ে রইল। মোবাইলও অফ করে রেখেছে, অফিসেও যায়নি, মায়ের বাড়িতেও না। এখন একটু একটু করে দুঃশ্চিন্তা হচ্ছে না তা নয়।

হ্যাঁ, মাঝে মাঝেই অনিক রাগ করে সিলেট কিম্বা কাপ্তাই ঘুরতে বেড়িয়ে পড়ে কিন্তু গিয়েই জানান দেয় কোথায় আছে। কারণ ফিরে আসবার জন্য নাহিদার বেদনার্দ্র অনুরোধ তার আহত পুরুষ ইগোতে মনে হয় জলপট্টির মত আরাম দেয়! হায়রে ঠুনকো পৌরুষ! কিন্ত গেলটা কোথায়? বোকার মতন কেন যে চিঠি লিখতে বসে গেল ও, কোথায় পাঠাবে লিখে? যে হারিয়ে থাকতে চায়, তাকে কি করে খুঁজবে ও? কেনইবা খুঁজবে? সেদিন কি কুক্ষনেই না রায়হানের গল্প করেছিল ওর কাছে। সবকিছুর শুরু সেদিন থেকেই। কিছুই না। কাজের সূত্রে ঊনার সাথে আলাপ, ব্যাংকে কাজ করেন বলে গাড়ি কেনার লোন সম্পর্কে জানতে চেয়েছিল, আর অতিরিক্ত উৎসাহের সাথে অনিকের কাছে বলেছিল যে উনি সব ব্যবস্থা করে দেবেন! সেটাই হয়েছে কাল।

সেদিন থেকেই খালি সন্দেহ আর সন্দেহ! এত বিরক্ত লাগতো বলার মতন না। পৃথিবীর সব ছেলেই মেয়ে দেখলে হামলে পরে না—এই সাধারণ জিনিষটাই ওর মাথায় ঢুকল না। অফিসে সান্তুনু জয়েন করেছে, দিন রাত সবার সাথে মজা করে বেড়ায়। একদিন জোড় করে যেচেপরে চা খেতে এসেছিল অফিসের পরে, তা নিয়ে কি তুলকালামটাই না সে করল। তারপর থেকে বার বার একই খোঁচা, কারনে অকারণে একই অসহ্য ইঙ্গিত--মনকে বিষিয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট।

তবে এবারের ঘটনাটা আরো রঙচঙে, অভিযোগ আরো তলাহীন। অনিকের দুই খ্যাতিমান কলিগ আসবেন, সারা বাড়িতে সাজ সাজ রব, শ্বাশুড়ি ঠাকুরুন স্বয়ং নাস্তাপানি নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছেন। সে খালি বেড়ে খাইয়েছে, তাদের ঠাট্টার ঠোঁটকাটা প্রত্যুত্তর দিয়েছে। তারাও সবার সামনে তার ভূয়সী প্রশংসা করেছে। অন্যলোকে স্ত্রীর সুনাম করলে কেউ যে এত রেগে যেতে পারে, অনিককে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারতো না ও।

কারো সাথে হেসে ভদ্রতা রক্ষা করা দোষের হতে পারে, এটা মানতে পারেনি বলেই তর্কাতর্কি, কটু কথার বর্ষন। প্রতিবাদ করে নাহিদা শুধু বলেছিল, তুমি এত ক্ষুদ্র কেন, হীন কেন, হীনমন্যতায় কেন ভোগ? মনটা এত ছোট কেন? এরই ফলশ্রুতিতে অনিকের গৃহত্যাগ! মজার ব্যাপার হচ্ছে, “ও না ফিরে যদি আর?” এই চিন্তা খুব একটা উদ্বেগ আনছে না মনে! না ফিরলে খুব যে খারাপ লাগবে সেটাও মনে হচ্ছে না। এই ভাবনাটাই কেমন গোপন সুখের মত মনের কোনে উঁকি দিয়ে পালাচ্ছে, আবার ফিরে আসছে। অনিক নিজে যখন অফিসের মহিলা কলিগদের সাথে দেশের বাইরে যায় সেমিনারে, কিম্বা তারা যখন রাত ১২টা ১ মিনিটে ওকে জন্মদিনে উইশ করে, সেটা নিয়ে প্রশ্ন করা কিন্তু অভব্যতার পরিচয়। প্রশ্ন তুললেই বিদ্রুপের হাসি হেসে বলবে তুমি যে দিনভর হিন্দি সিরিয়াল দেখা অন্তঃসার শূন্য মহিলাদের মতন কথা বলছ নাহিদা! মনটাকে এতটু উদার কর বুঝলে! হায়রে! কিন্তু ও কি কখনো নিজের অন্তঃসারশূন্যতা টের পায়—আয়নার সামনে নিজেকে বিচার করে? মন উঠে যাওয়া বোধকরি একেই বলে।

কেমন করে সময়ের রেলগাড়িতে চড়ে খুব আপন কেউ এত দূরে চলে যায় যে তাকে মনেই পড়ে না, তার চলে যাওয়ার শূন্যতা স্পর্শ করে না মনকে আর। ভালবাসাহীন এই বিয়ের শিকল পড়ে থাকতে হবে কতকাল কে জানে। বাঙালী মেয়েদের “শেষ গতি তার পতি” এই ভাবনাকে কবে কাঁচকলা দেখাবে সে? কাউকে ভাল না বাসলে তার সাথে একই ছাঁদের নিচে অবিরাম থাকা কি ভন্ডামি নয়? সামনের সেল ফোনটা টুংটাং করে বেজে উঠতেই সম্বিত ফিরে বাস্তবে ফিরে এল নাহিদা। অনিকের এস-এম-এস! তড়িঘড়ি খুলে দেখেঃ “সরি বউ। তুমি অন্য লোকের সাথে আর মাখামাখি কোরো না, তাইলেই আর কোন দিন ঝগড়া হবে না।

আর রাগ করে থেক না বউ। রাগের মাথায় যা বলেছি ভুলে যাও। একটু পরে বাড়ি আসছি। মা খেতে বলেছে। তুমি তৈরি থেক।

এক সাথে যাব। আমার প্রিয় নীল সার্টটা বের করে রেখ। লাভ ইউ। “ হতবাক হয়ে বার দুয়েক পড়ল ও। হিপোক্রেসির চূড়ান্ত নমুনা দেখে বিস্মিত হবার ক্ষমতাও লোপ পেল যেন! মিনিট দুয়েক পরে বুকচেড়া দীর্ঘ শ্বাস ফেলে উঠে পড়ল।

রেডি হতে হবে, সময় নেই বেশী, অনিক বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে পারে না, তার ধৈর্য বড় কম। নীল সার্টটা কি লন্ড্রি থেকে আনা হয়েছে? না হলে নীলসাদা স্ট্রাইপটা কি বের করে রাখবে? কোন শাড়িটা পড়বে আজ? সিল্ক না সুতি? হঠাতই শ্লেষের হাসি ফুটল নাহিদার ঠোঁটের কোনে। কোন মুখে নিজে সে অনিকের হিপোক্রেসির কথা ভাবে? আজ সাজার সময় নিজের মুখটা আয়নায় ভাল করে দেখে নিতে হবে তো! ---------------------------------------------------------- অনেক পুরানো একটা গল্প। এতই বোকা বোকা লেগেছিল নিজের কাছে, তাই পোস্ট করিনি। আজ এক বন্ধুর সাথে কথা বলে দেখলাম গল্পটা ভাল না হলেও কারো কারো জীবন গল্পের খুব কাছাকাছি! এমন না হলেই ভাল লাগত আমার।

কিন্তু সত্যি বড়ই নিদারুন!

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।