আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সেই কাটতে না চাওয়া দু:স্বপ্নের দিনগুলি

আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই..পাই যদিবা.ক্ষণেক্ষণে হারাই

জানালার বাইরে দিয়ে তাকিয়ে আছে পলা!!জানালাটা খুব বেশি খোলা সম্ভব না!!তাই যতটুকু পারে তাই দিয়েই দেখছে বাইরের আকাশ টা,,,আশেপাশের সব কিছু কতদিন প্রাণ ভরে দেখা হয়না! বাসার পাশের সেই গাছটাতে যেই ঘুড়িটা আটকে আছে!!গোলাপি রং এর একটা ঘুড়ি,,লেজটা নীল রং এর!!কতদিন ধরে আটকে আছে কে জানে!!খুব ইচ্ছা করছে যেয়ে ঘুড়িটাকে উড়িয়ে দিয়ে আসতে!!যার যেভাবে থাকার কথা ,,,যেভাবে যাকে মানায় তাকে সেভাবেই থাকতে দেয়া উচিত!! হঠাৎ মনে পরল- আসলেই তো,,,,যাকে যেভাবে মানায়..। কিন্তু সেটা কি হয় সবসময়?? এইযে ,,,,ওরা আজ বাসার ভিতরে বন্দি সেভাবে কি থাকার কথা ছিল ওদের? এইভাবে আর কতদিন!! নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে!! নিজেকে অনেক বড় বড় লাগে ইদানিং!! এই তো কদিন আগেও ,,,সারা বাড়িময় দুষ্টামি করে বেড়াত,,বাবা আর মা কে পাগল করে ফেলত!!বাবা অফিস থেকে আসার সময় ই চেয়ে বসত "আামার জন্য কি এনেছ বাবা?" --"ওরে পাগলী,এত বড় হয়ে প্রতি দিন ই কিছু না কিছু লাগবে?" -ওমা বাচ্চারা না বাবা মার কাছে বড় হয়না,তোমরাই না বল??" --বাব্বাহ,,,আমার পলামাতো অনেক কথা শিখেছে!!আজ তোর জন্য আমের আচাড় নিয়ে এসেছি,,,এবার খুশি?? -অনেক খুশি বাবা,,,,তুমি পৃথিবীর সবচেয়ে ভাল বাবা!! বলে বাবাকে জড়িয়ে ধরা!!বাবার ওর কপালে চুমু খেয়ে মাথায় হাত রেখে আদর করে দেয়া!!কি সুন্দর ছিল দিনগুলো!! যখন তখন বৃষ্টি হলেই ছাদে যাবার বায়না!!মার বকুনি,,,,সে কে শোনে কার কথা ,,,ছোট ভাই তপু কে এক হেচকা টানে তুলে ছাদে যেয়ে ভিজতে যাওয়া,,,বৃষ্টির কণার সাথে যেন এক আজব সখ্যতা পলার,,, পানিতে লাথি দেয়া,হাত দিয়ে পানি তে জলকেলি করা!!কখনও ,,,,প্রিয় গান গুলো গেয়ে নাচতে থাকা!! সদ্য তারুণ্য যখন বৃষ্টির ফোঁটার মত টুপটাপ করে উঁকি দিয়ে পরতে যাচ্ছে!!যখন দিনের প্রথম রোদের মত গায়ে এসে তারুণ্য তার পবিত্র আলো দিয়ে কুমারী কন্যার চারপাশ আলোকিত করে ফেলে তখন সেই মেয়ের মধ্যে উচ্ছাস আর ভালবাসা টা যেন অকারণেই সবকিছু ভাল লাগিয়ে দেয়!! সেই রকমই সময় কাটছিল পলার!! উচ্ছাস আনন্দ আর ভালবাসা!! নিজেকে নতুন করে উপলব্ধি করা!!আর এক রঙিন ভবিষ্যতের স্বপ্ন আঁকার মধ্যেই কেটে যাওয়ার মত সময় ছিল তখন!!১৭ বছরের একটা মেয়ের তখন জীবন নিয়ে আর কিইবা চাওয়ার থাকতে পারে!! হঠাৎ কি করে জানি সব উলট পালট হয়ে যেতে লাগল বুঝতে পারছিল ,,,সব কিছু বদলে যাচ্ছে,,,,সবার মধ্যে কেমন যেন অস্হিরতা,,,কেউ কিছু বলছে না,,,কিন্তু কেমন যেন এক দুস্বপ্নের ভয় সবার মাঝে,,,কলেজেও মেয়েদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে!!এদিন ,,,সোমা নেই,,তো পরের দিন মিলি আসছেনা,,,, কলেজ মিস এর জন্য কোন শিক্ষকরাও যেন কিছু বলছেনা,,, আগে যেখানে একদিন মিস হলেই তুলকালাম হতো,,, স্যার ম্যাডামরাও রেগুলার না!! অস্হিরতা কাজ করতে লাগল!! কিন্তু সেটা ভয়ে রূপ নিল,,,যেদিন বাবা বলল '--"মাগো,,,দেশের পরিস্হিতি তো শুনছিস,,,চারদিকের অবস্হা ভাল না!!তোর মা বলছিল- (পলার মায়ের দিকে তাকিয়ে)আর হ্যাঁ আমিও বলি আর কি কলেজ টা আপাতত বন্ধ থাক এখন!! দেশ স্বাধীন হলে আবার কলেজ যাবি.। -বাবা তুমি যে সব কিছু মা র কথা শুনে বলছ,,,আমি বুঝতে পারছি!!কিন্তু আমার অবাক লাগছে,,,তুমি কলেজ যেতে আমায় বন্ধ করতে বলছ বাবা?আমি ভাবিনাই তুমি এমন বলবে!! --মারে আমি বা তোর মা সব বুঝে শুনেই বলছি!! এটা বলার আগে অনেক সংকোচ হচ্ছিল রে মা,,,যেই আমি তোকে তুই হাজার মানা করলেও কলেজ যেতে বলতাম,,,মিস দিতে দিতাম না,,,সেই আমি বলছি রে মা,,,দেশের অবস্হা দিন দিন আরও খারাপ হচ্ছে,,,,আমাদের যে তোকে নিয়ে অনেক ভয় হয়!! -বাবা,আমি তোমাদের অবস্হা বুঝছি,,,আমি তাই করব,যা তোমরা চাইবে,,,কিন্তু কাল শেষক্লাসটা করে আসি বাবা,,সবার থেকে একটু বিদায় নি্য়ে আসি???প্লিস বাবা?? পলার বাবা,বদরুল আলম সম্মতি দিলেন,, পরদিন কলেজ যাওয়ার সময় ই বুঝতে পারল পলা,,,আসলেই আর সম্ভব না!!পাড়ার নুরুদ্দিন আগেথেকেই ওকে ফলো করত,,,এখন তো ক্ষমতা হাতে,,, নুরুদ্দিনের মামা-বাসার মোল্লা স্হানীয় ক্লাবের শান্তি কমিটির উচ্চপদস্হ লোক!!বেশ প্রভাব আছে তার,,,পাকিস্হানি আর্মিদের বাড়িতে দাওয়াত করে খাওয়ান...তাই নুরুদ্দিন ও নিজেকে ক্ষমতাবান ভাবা শুরু করেছে.। কতবড় সাহস,,,সেদিন আসার সময় পলার সামনে দাড়িয়ে রাস্তা আটকে দাড়ালো,,,পলা বিব্রত বোধ করছে বুঝে যেন আরও মজা পাচ্ছিল সে,,,,কলেজের স্যার চলে আসায় সে যাত্রায় চলে এসেছিল পলা!! কিন্তু আবারও যদি আসে,,,কি করবে পলা!! তারপর থেকে ঘরেই,,,বের হয়না একদমই,,, এখন ডিসেম্বর মাস,,,মাঝে কতদিন বৃষ্টি হয়ে গেল..পলা আর ছাদে উঠে নাচানাচি করে ভিজতে পারেনাই!!জানালা খুলে কয়েকটা আঙুল বাড়িয়ে দিয়ে বৃষ্টির পানি ছুঁয়েছে,,,চটপটে অস্হির চপলা মেয়েটা যেন এই কয়েকদিনে এক ধাক্কায় বড় হয়ে গেল!! কেমন যেন এক গম্ভীর স্হিরতা চলে এসেছে,,, বাবা অফিস থেকে ফিরলেই কিছু চাওয়ার জন্য সে দরজার কাছে দাড়িয়ে থাকেনা,,, মাকেও আর জালায় না পলা আগের মত!! এখন তো শীতও এসে পরেছে ডিসেম্বরের!! মনে পরছে গত শীতের ছুটিতে নানাবাড়ি গিয়েছিল ওরা,,,সকাল বেলায় পিঠা খাওয়া,,,আর তপুকে নিয়ে বের হয়ে যাওয়া গ্রামদেখতে.এখন এসব খুব দূরের স্মৃতি মনে হয়,,, নিজেকেই প্রশ্ন করে ,,,সত্যিই কি এমন ছিল?? মন খারাপের সময় গুলোতে যে শুধু ভবিষ্যত নিয়ে শংকা কাজ করে এটা সত্য না,,,অতীত ও তখন প্রশ্নের সম্মুখীন হয়! কলিং বেলের শব্দে ভাবনা ভাঙে পলার!!বাবা এসেছে বোধহয়!! দরজা খুলতে সামনে এগিয়ে দেখে,,,তপু খুলে দিয়েছে,,,হুম বাবাই তো,,,কিন্তু সাথে কে এটা? মামাতো ভাই বিপুল না? এ অবস্হা কেন ? ওরা প্রায় সমবয়সী,,,কিন্তু খুব বেশি কথা হয়না ওরসাথে!!এসে বসল ড্রইংরুমটায়,,, মামামামী আর ছোট বোনটাকে ভারতে পাঠিয়ে দিয়েছে বিপুল,, পাশের বাড়ির হিন্দু কাকা কাকীদের সাথে বাবামাকেও পাঠিয়ে দিয়েছে.সুযোগ বুঝে!! আর নিজে যায়নি,,,কারণ সে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছে,,,ফুপুর বাড়ি এসেছে খবরটা জানাতে,,,আর কিছু টাকা লাগবে,,,এর জন্য!!এখানের দলে যোগ দেবার কথা পরশু দিন থেকে,,, পলার নিজেকে অনেক বেশি অপরিণত লাগতে থাকে,,,তার বয়সী এক ছেলে এখন মুক্তিবাহিনীতে যাচ্ছে আর সে কিনা কলেজ যাওয়াটাও ভয় পায়,,,,হায়রে সমাজ!!হায়রে মেয়ে মানুষের অক্ষমতা!! সেই জটিলতা থেকেই কথা বলল না বিপুলের সাথে প্রথম দিন!! আস্তে আস্তে বিপুল ই কথা শুরু করল -কি খবর পলা?কথা বল না যে? --কি বলব!!মামামামী আর দীপাকে যে দিয়ে দিলে ,,,খারাপ লাগে নাই? -নাহ,,একটু লেগেছে তা সত্য ,,কিন্তু এটা ছাড়া কি উপায় ছিল বল?? --হুম,,,তা যুদ্ধ করবে?ভয় করে না? -নাহ,,ভয় করবে কেন? --মেয়েরা যুদ্ধ করতে পারেনা? -পারে তো,,করেও,,,কিন্তু সবসময় সেটা সম্ভব হয়ে উঠে না,,,তারা মানসিকভাবে যুদ্ধ করছে!!এবং আমাদের থেকেও অনেক বেশি করেই করে!! --ইস ,,,আমি যদি পারতাম!! এভাবে কথা চলতে থাকে পলা আর বিপুলের আরও অনেকক্ষণ!! মা এসে কথার রেশ কাটিয়ে খেতে যেতে বলে!! পলার মা আতিয়া একটু বেশিই রক্ষনশীল মনোভাবের,খুব একটা পছন্দ করছেন না তিনি পলা আর বিপুলের এরকম ঘন্টার পর ঘন্টা কথা হওয়া!!সেটা উনি সরাসরি না বললেও পলা ঠিকই বুঝতে পারছিল!! সেরাত টাও থাকে বিপুল,,এরই মধ্যে বোধহয় জানাজানি হয়ে গেছে নতুন কেউ এসেছে,,নুরুদ্দিন তো ওদের উপর সবসময় খেয়াল রাখে,,,পলার কারণেই!! শুধু শুধু পাড়ার এক ছোটছেলেকে দিয়ে বাসার দরজায় ধাক্কা দিয়ে গেল!! আবার তার কিছুক্ষণ পর আরেক ছেলেকে দিয়ে বাবা আছে কিনা জিজ্ঞেস করল পলার মা আতিয়া, সেটায় খুব ই বিচলিত হয়ে আছেন.নিজের ভাতিজা,,,কিন্তু তার জন্য নিজের পরিবারের বিপদ মানতে পারছেননা তিনি,,আজ আর রান্না করেন নি,,,মন বসছেনা!!ভাবছেন যা আছে তা দিয়েই চালিয়ে দিবেন!!আর খাওয়ার পরই বিপুল কে বলবেন চলে যেতে,,,এসব ভয় আর সহ্য হচ্ছেনা তাঁর!! কিন্তু বলতে পারলেন না আতিয়া, ভাবলেন পলার বাবা আসলে তাঁকে দিয়েই বলাবেন!! অপেক্ষা করতে লাগলেন,,, বেলা ৬টার সময় বেল বাজল,,, দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলল তপু,,,আর দরজা খুলেই চিৎকার,,, একি!!!বাবার গায়ে এত রক্ত কেন?? পলা বের হয়ে এল রুম থেকে,,,আতিয়ার ভিতরে একটা বারি খেল!!কি হল এটা? অফিস থেকে আসার সময় বাসার মোল্লা আর নুরুদ্দিন সহ বেশ কিছু পাকিস্হানী আর্মি অনেক পিটিয়েছে!!বারবার বিপুলের কথা জিজ্ঞেস করছিল,,,বাসায় এসেছে এক জন মুক্তিবাহিনীর লোক তারা এর খোঁজ পেয়ে গেছে!!আর পলার দিকেও নজর এই নুরুদ্দিনের,,,পলাকে নিয়ে আজেবাজে কথা বলার সময় আর বদরুল আলম চুপ থাকতে পারেননি,,,তাই গালি দিয়ে উঠেছিলেন,,,,প্রতিবাদ করে উঠেছিলেন,,,তার পরপরই এরকম প্রহার!!কোনমতে বেঁচে এসেছেন স্হানীয় আরও মানুষজন চলে আসায়,,, কিন্তু তিনি জানেন আবারও আসবে ওরা,,,এবার বাড়িতে!!পালানোর ক্ষমতা নাই এখন আর তার,,,বাড়ির সবাইকে জানাতেই চলে এসেছেন তিনি,,, আতিয়া চুপ করে থাকে,,,তাকেই এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে,,,স্বামীর এই অবস্হায় তাকে ফেলে যেতে পারবেননা তিনি!! হঠাৎ করে বিপুলের হাতটা চেপে ধরেন আতিয়া,,,বিপুল অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে,,,ফুপুর সাথে কথা বার্তা হলেও কখনও,,এভাবে স্পর্শ পায়নি সে,,,আর ফুপু কিছুনা বলেও যেন কি বলে দিচ্ছিলেন,,,কি যেন ছিল সেই চোঁখের মধ্যে,,, বিপুল ও হাতটা চেপে ধরে মাথা আলতো করে নোয়াল!! বাড়ির পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে পলা,,,সাথে তপু আর বিপুল পিছন ফিরে তাকালো,,,দেখল মা এক নিবিস্ট মনে বাবার মাথাটা কোলে ধরে ওজিফাটা পড়ে যাচ্ছেন!!কি মনে করে যেন একবার ওদের দিকে তাকালেন,,,, মাকে কখনও এভাবে দেখেনি পলা,,সেই চোঁখে যেন জেনে শুনেই সব কিছু মেনেনেয়ার একটা ব্যাপার ছিল,,,আর যেন নীরব চাহনি দিয়েই বলে দিচ্ছেন"আমার দোয়া তোদের সাথে আছে" অনেক দিন পর বের হল বাড়ি থেকে, সেই বাতাস,সেই গাছে এখনও সেই ঘুড়িটা বাঁধা!!সেই প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে চাওয়ার সেই বাতাস!!কিন্তু কেমন যেন শুন্যতা পলার মনটা জুড়ে,,,, আর কি কখনও বাবা মাকে দেখতে পাবে পলা??? আর কখনও ছুঁতে পারবে বাবার কপাল টা?আর কখনও মাকে জড়িয়ে ধরতে পারবে? চোঁখের কোণ থেকে টপ করে পানি ঝরল গাল বেয়ে,,, নয়মাসের মধ্যে এই প্রথম কাঁদলো পলা............।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।