আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শাহরুখের আগমন, আমাদের সাংস্কৃতিক শুন্যতা, দর্শকদের উচ্ছ্বাস আর আমাদের ভুলুণ্ঠিত রাষ্ট্রীয় সম্মান...



শাহরুখ খান, বিভিন্ন মাধ্যমে গত কয়েকদিনের উম্মাদনার নাম। সংস্কৃতি-অপসংস্কৃতি, সম্মান-অসম্মান নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বহু প্যাঁচাল দেখলাম, সহ্য করলাম-আসলে করতে বাধ্য হলাম। বাঙালির সাংস্কৃতিক শুন্যতায় শাহরুখের সদয় আগমণজনিত প্লবধারা আরো অনেকদিন বাঙালি সংস্কৃতিকে উজ্জীবিত রাখবে সে বিষয়ে অনেকেরই কোন সন্দেহ নেই। যদিও এর পেছনে বাণিজ্য আর নিজেদের অন্তঃসারশুন্যতা কতখানি প্রকট হয়ে ওঠে তার হিসেব করার দরকার বোধ করে না কেউ, তাপরও একজন মহাতারকার উপস্থিতির উজ্জ্বল আলোধারা আমাদেরকে হয়তো অনেকখানি আলোকিত করেছে। আমার মত খটমট টাইপের মানুষের এসব মহান মানুষের মাহাত্য বুঝে আসে না, শাহরুখ কিংবা তার বঙ্গদেশীয় সাংস্কৃতিক অগ্রপথিকদের ওসব কারবার।

তাই এর ভাল-খারাপ দিকে নিয়ে আমার মাথা না ঘামালেও চলবে হয়তো। নিজে আলট্রা-মডার্ণ হতে পারিনি বলে অন্যের এগিয়ে থাকাকে হিংসে করেই বা লাভ কি! এত বাজনা-বাদ্য, ঢাক-ঢোলের এত আড়ম্বর, ঢাকার রাস্তা ছেয়ে থাকা পোস্টার দেখে কি হবে-না হবে, সেই কৌতুহল ওঠাটা বোধহয় দোষের কিছু নয়। শাহরুখভক্তদের কাছে মাফ চেয়ে নিচ্ছি, আপনাদের দলে না থেকেও অনধিকার কৌতুহল প্রদর্শন ক্ষমাসুন্দর মনোভাব নিয়ে বিবেচনা করবেন আশা করি। তো শুক্রবার সন্ধা থেকে কাজের ফাঁকে মাঝেমধ্যেই চোখ রাখছিলাম, আধুনিক বৈশাখী টিভিতে। আমার বুঝে আসেনি, শাহরুখ সম্পর্কে একেকজনের জ্ঞানের বাহার দেখে।

একজন মানুষ আরেকজন মানুষের কতখানি অনুসারী হলে তার মোজা-আন্ডাওয়্যারের মাপ পর্যন্ত জানে(আসলে এই বিষয়গুলোই সম্ভবত বাকি ছিল, শাহরুখ বিষয়ে প্রায় সব তথ্যই বৈশাখী-র অনুষ্ঠানে উঠে আসার খবর দিলেন আমার কাজের মেয়ে। ওঠা-বসা, চালচলন, পোশাক-আশাক থেকে সবকিচু মুখস্থ করে ফেলেছে সে-ও)। মূল অনুষ্ঠান শুরু হবার আগে কয়েকদিন ধরে একটি মিডিয়ার প্রায় কয়েক হাজার মিনিট খরচ করা নিশ্চয়ই বড় কিছুর ইঙ্গিত দেয়, আমার মত বাস্তব-জ্ঞানহীনের তা মাথায় না আসলেও অন্যরা ঠিকই আন্দাজ করেছিলেন। আমি তো একবার সংবাদ দেকার জন্য বৈশাখী চ্যানেল-এ ঢুকে ভিমড়িও খেলাম। যা বাব্বা, হিন্দী কোন চ্যানেল-এ ঢুকলাম না-কি! পরে লোগো দেখে ভুল ভাঙলেও ঝিম মেরে থাকলাম খানিকক্ষণ।

এরপর আছে রেডিও থেকে শুরু করে পত্র-পত্রিকার ক্রমাগত শাহরুখকেন্দ্রীক আকাশমুখী উল্লম্ফন। তাই, একটু কৌতুহল মনে জাগলেও খুব দোষের কিছু হবে না বলেই ধারণা করি। আটটায় অনুষ্ঠান শুরু হবার পর অন-স্টেজ-প্রোমোশনালের নতুন ধরণ দেখলাম এবার। ভালই লাগল। মহান এসব মানুষের অতীত কীর্তি ভক্তকূলের জানা থাকলেও আবার মনে করিযে দেয়া নিশ্চয়ই দোষের কিছু নয়।

মূল অনুষ্ঠানের অনেক মৌজ-মাস্তির (আজকের প্রথম আলোর শাহরুখ বিষয়ক সংবাদের শিরোনাম এরকম, হা হা হা..জাতীয় দৈনিকের ভাষার অবস্থা! অবশ্য রুপক বলে চালিয়ে দেবার অবকাশটুকু তারা নেবেন) কথা না বলে শাহরুখের অংশতেই আসা ভাল। বাংলাদেশের তারুণ্যে কতটুকু গভীরতা, তাদের মনোজাগতিক গঠন কেমন-এসব তত্ত্বীয় কচকচানিতে না গিয়ে বলা যায়, ছ্যাবলামিরও একটা শেষ থাকে। ছি, আত্মসম্মান কোন তলানিতে গিয়ে ঠেকলে নিজেদের এতখানি হাস্যকর করে তোলা সম্ভব! শাহরুখ স্মার্ট মানুষ, তাই বলে আমাদের তরুণরা নিজেদের বলে কিছুই রাখেনি? কথায় কথায় শাহরুখের পায়ে পড়া-ক্ষমা চেয়ে নেয়া দেখে মনে হচ্ছিল, এই না হলে স্বার্থক শাহরুখের এদেশে আসা! একজন রাশান কুৎসিতদর্শন স্বল্প-বসনা মেয়ের শরীর ছোঁবার নির্লজ্জ অপচেষ্টা আমার মাথা হেট করে দিয়েছে, একজন বাঙালি তরুণ হিসেবে আমি লজ্জিত। তবে তারপরও মনে হয়েছে, শাহরুখ তোমরা সত্যিই অনেক শক্তিশালী, না হলে আমার দেশের তারুণ্য তোমার তারকাদীপ্তির কাছে এমন আনুভূমিক আত্মসমর্পণ কেন করবে! আর অনুষ্ঠানের একজন শো-গার্ল হবার পরও শাহরুখকে জড়িয়ে ধরে চুমু দেবার বাড়াবাড়ি ভক্তি মনে করিয়ে দেয়, তুমি ধন্য শাহরুখ! আমাদের মেয়েদের কাছে তোমার আসন দেবতারও অনেক ওপরে। তুমি চাইলে তোমার ভোগে সবকিছু দিতে প্রস্তুত তারা-জোড় দিয়ে বলছি, সবকিছু....।

ধন্য তোমার মানবজন্ম। মেয়েদের দিকে তাকালেও যেখানে ইভটিজিং নামক জুজু তাড়ায় এদেশের ছেলেদের, তখন তুমি চাইলেই সবকিছু পেতে পার এই মেয়েদের কাছ থেকেই। পুরুষত্বের স্বভাবজাত হিংসা করলে মাফ কর ভাই, আপনারাও মাফ করবেন -হে শাহরুখ অনুরাগীরা। আয়োজক হবার সুবাদে চৌধুরী (স্বপন চৌধুরী, অন্তর শোবিজের মালিক) সাহেবের মেয়ে খানদের রাজার সাথে নাচার সুযোগ পায় ঠিকই, নাচের 'ন' টুকুও জানে না তাতে কি? শাহরুখের বুকে একটু মাথা রাখার, আধুনিক স্মার্টনেসের প্রধান রূপক গালে চুমু পাবার-দেবার শখটুকু তো পূরণ হল! যদিও ঢাকাইয়া আনস্মার্ট নম্বর ওয়ান প্রদীপ অনুমতিই পান না উপমহাদেশের উজ্জ্বলতম নক্ষত্রের সাথে স্টেজে ওঠার। অপমানের কি আছে, লেভেল তো মেইনটেইন করতে হবে তাই না!! টাকা, টাকা আর টাকা....শুধুই টাকা।

শাহরুখদের আসার কারণও যেমন টাকা, অন্তর শোবিজের তাকে আনার কারণও তেমনি টাকা, বৈশাখী নামের একটি বাঙালি টিভি চ্যানেলের হঠাৎ হিন্দি চ্যানেলে রূপ নেবার কারণও সেই টাকাই (অবশ্য খান সাহেব বলতে পারেন, 'টাকা নয় আমি কনভার্ট করে রূপি নিয়েছি!')। এর মধ্যে ঢাকা পড়ে যায় দেশের প্রধান নায়ক হয়েও স্থান না পাবার অপমান, আমাদের তারুণ্যের শুন্যতা, আকাশসংস্কৃতির টানের প্রাবল্য কিংবা অন্য সবকিছু। যেন সাংস্কৃতিক মুক্তির নতুন পথের সন্ধান পেয়ে গেছি আমরা। শাহরুখরা তার কান্ডারী, আর আমাদের তরুণরা সেই তরীর মাঝিমাল্লা...জয় হোক নব্য-সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের!! আমরা পশ্চাতপদতার অতলেই রয়ে গেলাম। শুধু একটা ব্যাপারে আক্ষেপ থেকে গেল।

জানতাম না যে, আমাদের প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত শাহরুখ সাহেবের বড় ভক্ত। তিনি আমন্ত্রণও জানিয়েছিলেন সেই মহাতারকাকে। কিন্তু সময় হয়নি শাহরুখের, প্রধানমন্ত্রী টিকেট না কেটে তাকে দেখার আশা করেও তাই নিরাশই হলেন। আয়োজকদের কাছে জিজ্ঞাসা, আর কত টাকা দিলে আপনাদের এই মহাতারকা আমাদের প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণটুকু রক্ষা করতেন?

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।