আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ডা. ইয়েসমীনের একটি সন্ধা

নিঃস্বার্থ মন্তব্যকে ধন্যবাদ, সাময়িক ভাবে আমি মন্তব্যে নেই

১ অনেকদিন থেকেই বাড়ির সঙ্গের চেম্বারটাকে উত্তরাতে সরিয়ে নেব ভাবছি। মিন্টুর সঙ্গে কথা হয়েছে। ও আমার হাজব্যান্ড। শুনে বললো, মোহাম্মদপুরে এই জায়গাটা ইনফার্টিলিটি ক্লিনিকের জন্য সবচেয়ে ভাল জায়গা। মধ্যবিত্তেরা উত্তরা যাবে না।

বন্ধের পর নাইমার নার্সারী স্কুল খুলছে। নতুন জায়গায় গেলে স্কুল পাল্টানো, নিরাপত্তাসহ - নানান সমস্যা। আরেকটা সমস্যা এসে জুড়েছে। কাজের মেয়ে করিমন নাইমাকে দেখাশোনা করে। করিমনের বাপ হঠাৎ এসে হাজির।

মেয়ের বিবাহের প্রস্তাব এসেছে। নিয়ে যেতে হবে। করিমন চলে গেলে চলবো কি করে ভাবছিলাম। যখন আমেরিকার বাল্টিমোরে ছিলাম তখন তো বাড়ির সব কাজ একাই সামলাতে পারতাম। এখানে এসে পুরো বদলে গেলাম।

জনসংখ্যার চাপ, মানুষ বাড়ছে। এই করিমনেরই তো ৬ ভাইবোন। এই উর্বর দেশে যে টেস্টটিউব বেবীর চাহিদা এত তা জানা ছিল না। মাত্র ৬ মাসের মাথায় রোগীর বেড়েছে ১০ গুণ। মিন্টুর বুদ্ধি হলো, কয়েকজন ডাক্তার একসঙ্গে যৌথভাবে ক্লিনিক দেয়া উচিৎ।

এতে সবারই লাভ হয়। চাপও কমে। বাচ্চাটাকে সময় দেয়ার কথা ভাবছিলাম। অবশেষে বাড়ির ভিতরে চেম্বার করে সুবিধা হয়েছে। নাইমার খিদে পেয়েছে।

ওকে আমি নিজের হাতে গোসল দেই। আঠার মতো আমার সঙ্গে লেগে আছে। মা, মা করে প্যান প্যান করছে। এমন সময় বিপ বিপ করে ইন্টারকম বাজলো। নাইমাকে বললাম, একটু দাঁড়াও মামনি।

কেউ বোধ হয় এসেছে । ইন্টারকমে নিচ থেকে গেটকিপারের কণ্ঠ ভেসে আসে -আপা একজন লোক নাম বলছেন জহির। এই যে কথা বলেন -হ্যালো ( ভারী পুরুষ কণ্ঠ) -জ্বি, বলুন -ইয়েসমীন বলছো? আমি জহির, জার্নালিজমের জহির। তখনো পুরো নিশ্চিত হতে পারিনি। কারণ জহির নামে দু'তিন জনকে চিনতাম।

ইউনিভার্সিটির ডিপার্টমেন্ট কারো মনে নেই। -কোন জহির? একটু বলবেন? -আরে আমি বৃন্দবৃত্তের মুস্তাকিম জহির। মনে নাই, লম্বু জহির ডাকতো সবাই। আমি চিনতে পেরে বললাম, ও-- জহির ভাই! সন্ধার পর রোগী দেখা মানা। যদি পরিচিত কেউ আসে বাড়িতে আসতে বলি।

কিন্তু হঠাৎ কি মনে দারোয়ানকে বললাম, ঠিক আছে উনাকে চেম্বারে পাঠিয়ে দাও ২ চেম্বার আর বাসা লাগালাগি। নাইমাকে নিয়ে মুশকিল। সেও যাবে চেম্বারে। দিনের বেলা তাকে চেম্বারে যেতে দেই না। এখন ইয়ো ইয়োর মতো লাফাচ্ছে।

কী একটা হিন্দি গান শুনেছে টিভিতে, ওটা গাইছে। আমি বোঝালাম, মারে আমি এক্ষুণি চলে আসবো। না ও সঙ্গেই যাবে। মায়ের রাগটাই পেয়েছে। বেশী বললে জীদ করে ঘো ঘো করবে।

বলতে বলতে নিজেই একটা বেগুনী জামা খুঁজে এনেছে। চুল আঁচড়ে, মুখটা মুছে কপালে চুমু খেলাম। বেচারার দোষটা কি - সারা দিন পর মাকে পেলে এখন তো একটু এমন হবেই। এখন মনে হচ্ছে জহির ভাইকে পরদিন আসতে বললেই হতো। জহির ভাই এতদিন পর কেন এসেছে ভাবছিলাম।

হয়তো ডাক্তারী কোন কাজে। লোকটা কি আগের মতোই আছে? গোঁফ আছে? এখনো তেলহীন উস্কুখুস্কু চুলে ঘুরে বেড়ায়, সেই ট্রেড মার্ক ব্লু প্যান্ট আর ফতুয়া পড়ে ঘুরে বেড়ায়? আর কথায় কথায় কবিতা জুড়ে দেয়। আমি টিএসসিতে ছিলাম ৯২ এর দিকে। ঢাকা মেডিক্যালে পড়ার সময় সখ করে কবিতা আবৃত্তির নেশা চাপে। ওটা উড়ে গেছে বছর খানের পরেই।

জহির ভাই তার পরেও অনেক বছর ছিল। দু'বার পথ চলতে দেখা। তখনও সেই বাউন্ডুলে পোষাক। ঠোঁটে রহস্যময় হাসি। এর পর আর উনার কথা শুনিনি।

৩ চেম্বারে ঢুকে টেবিলের ওপাশে বসে থাকা মানুষটাকে বললাম -স্লা মালেকুম, ভাইয়া, কেমন আছেন? -ভাল, ভাল। তুমি যে বেঁচে আছ সেটা জানলাম সুতপার কাছে পরশুদিন। কথা বলতে বলতে দেখলাম তার জামাটা বেশ বদলে গেছে। ইস্ত্রি করা, প্যান্টটাও দামী । চোখের চশমাটা আধুনিক ফ্রেমের।

তবে কথা বার্তায় তেমন একটা বদলাননি। সুতপা আমার বন্ধু, সেও ছিল আবৃত্তির দলের অন্যতম ফাঁকিবাজ মেয়ে। আমি কথার শুরুটা বেশ উপভোগ করি। বলি -সুতপার সঙ্গেই মাস ছয়েক আগে দেখা হয়েছিল। জাপান গিয়ে ফুজিয়ামার জ্বালা মুখে ডুবে গেছে।

আপনার সঙ্গে যে যোগাযোগ আছে জানতাম না। -আমি মিশুক মানুষ। তুমি ঢাকায় আছো আর আমি জানিনি এটাই বরং বিস্ময়কর। রিকশায় আসতে আসতে একটা কথা ভাবছিলাম। একটু পুরনো কথা.. আমি তার বিষন্নতার কারণ আন্দাজ করে থামালাম।

বললাম, রাত হতে চলছে, চা চলবে? শিল্পরসিকেরা চায়ের নাম শুনলে কখনো মানা করেনা। উনিও মাথা নাড়লেন। পিছনে চীনা ব্যাণ্ডের টিমেকারে এককাপ চা বসিয়ে দিয়ে দেখে এলাম নাইমা কি করছে। ছোট টিভিতে কার্টুন দিয়ে বলেছি বসে থাকতে। ও বাধ্য মেয়ের মতো সোফায় বসে আছে।

ফিরে এসে দেখি উনি দেয়ালে আমার মেডিকেলের পুরনো ছবিটা এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে। তার মাথায় সাদা চুল উঁকি দিলেও পেছন থেকে তাকে আগের মতোই লাগছিল। এবার আমিই কথা শুরু করলাম -ভাইয়া, এবার বলুন, আপনার সংসারের কথা -তোমার কথা বলো আগে! -আমি কি বলবো, নিজের চোখেই তো দেখতে পারছেন। আগের ইয়েসমীন আর নেই। চলছে আর কি।

তখন জহির ভাই দার্শনিকের মতো করে বললেন, -তুমি কি সত্যি সুখী আছো? হঠাৎ আবৃত্তির দলে এলে। আমাদের দারুন দিন কাটছিলো। তারপর এরকম ডুবই দিলে যে কিছুই হলো না। আমি অনেকদিন থেকে ভাল নেই। কবি আর আবৃত্তিকার দুটো দলই বোধ হয় কথায় কথায় গলা ভার করে ফেলে।

তিনি তারপর থেমে বললেন, তোমার হাজব্যান্ড কিন্তু দেখতে হ্যান্ডসাম। মেয়েটাও খুব সুইট। -দেখেন নি নাইমাকে? আমি নাইমা কে ডাকি, নাইমা, মামনি। নাইমা ছুটে এসে দরজায় উঁকি দেয়। তারপর আমার কাছে এসে আমার শাড়ীতে লজ্জায় কবুতরের মতো মিশে দাঁড়িয়ে থাকে ।

দেখলে কে বলবে আজকেও ডাক্তারী বইতে রঙ দিয়ে হাতি আঁকার জন্য বকা খেয়েছে। নাইমাকে বললাম, মামনি, এ তোমার জহির মামা। সালাম দাও। মেয়েটা খুব মিহি গলায় কিছু একটা কিছু বলে। ঠিক বোঝা যায় না।

-জহির ভাই,হাত ধরে নাইমাকে কাছে নেয়। পকেট থেকে চকলেট বের করে দেয়। আমি মানা করি। জহির ভাই বলতে থাকে,ওকে ছবিতে দেখছিলাম। এত ভদ্র মেয়ে।

মায়ের মতোই চেহারা স্বভাব পেয়েছে। নাইমা দ্রুত তার সঙ্গে মিশে যায়। জহির ভাইয়ের মিশতে পারা জাদুটা তাকেও ঘিরে ফেলে। আমি দ্রুত ভিতরে যাই। দু চামচ চিনি ঘেঁটে চায়ের সরবত নিয়ে ফিরে এসে বসি।

নাইমার শরীরটা কেন যেন দুর্বল লাগছে। সে ফিরে গিয়ে ডিভিডিতে নতুন কার্টুনে মগ্ন হয়। -তুমি এখানে এলে যে? বাইরে একবার গেলে সবাই তো চিরদিনের জন্য বিদেশে থেকে যায় -সে অনেক ঘটনা। জহির ভাই আসল কথায় আসে, -ইয়েসমীন, আমাদের বিয়েটা মনে হয় টিকবে না। যদিও ৮ বছর হয়ে গেল।

অনেক সময়। -না টিকার কী কারণ? বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে? -হ্যা ডাক্তারী টোনে প্রশ্ন করি, -কোন ডাক্তার দেখান নি? -হ্যা, অনেককে দেখালাম। তাও ৪/৫ বছর তো হবেই। সর্বশেষ ডা. আনোয়ারা আজাদ কে দেখিয়েছি হলি ফ্যামিলির। -তারপর? -ডাক্তার বলেছেন স্বাভাবিক ভাবে আমাদের কিছু হবে না।

আমি কাজ করি একটা ইন্ডেন্টিং ফার্মে। যা পাই চলে যায়। লুৎফার সঙ্গে বিবাহটা পারিবারিক ভাবে। ওকে হয়তো ভালবাসিনি। কিন্তু দীর্ঘদিনে আমি লুৎফার উপর নির্ভরশীল হয়ে গেছি।

কিছু মেয়ে থাকে না বাচ্চা মানুষ করতে পছন্দ করে। লুৎফা ঐ রকম। নিজের হাতে ভাইয়ের বোনের বাচ্চাদের মানুষ করেছে। এমন অবস্থায় সন্তানহীন থাকা কতটা কষ্টকর বুঝতেই পারো। আমি লুৎফাকে সবসময় বলেছি, পৃথিবীটা কত বড়।

৫০০ শ কোটি মানুষ। একটা মানুষ না হলে কী হয়? লুৎফা অত চালাক না, সে অপরাধ বোধে ভোগে। আর কাঁদে। আমি শুনছিলাম। বললাম, -বলেন, শুনছি -ইয়েসমীন -জ্বী -তুমি তো একটা নামকরা ক্লিনিক চালাও।

তুমি কি জানো নিজের শিশুর জন্য তৃষ্ণাটা কেন এত প্রবল হয়? -আপনারা কি টেস্টটিউব বেবী নেয়ার কথা ভেবেছেন। ভাবী কে নিয়ে আসেন আমি কিছু পরীক্ষা করে দেখি। এখন ১৫% ক্ষেত্রে সফলতা আসছে। জহির ভাই একটু থেমে দম নেয়। বলে, -কাউকে বলো না, সমস্যাটা তোমার ভাবীর না! লুৎফাকে বলিনি।

তুমি ডাক্তার। তাই বলি, রিপোর্টে এসেছে আমার স্পার্মকাউন্ট জিরো। আমার পক্ষে কখনোই বাবা হওয়া সম্ভব হবে না। ৪ বেশ অনেকক্ষণ হয়ে গেছে। পাশের রুমের সোফায় মেয়েটা কার্টুন দেখে ঘুমিয়ে গেছে।

আমি ফিরে দেখি জহির ভাই চলে যাবে বলে দাঁড়িয়ে গেছে। ফিস ফিস করে বললো, -একটা লজ্জার কথা বলি। তুমি তো আমার বোনেরই মতো, কিন্তু ডাক্তার। এ দেশে কোন স্পার্ম ডোনার পাওয়া যাবে? এরকম কি হয় যে লুৎফা জানবেনা কিন্তু তার গর্ভে.... শুনে মুহুর্তে মাথায় রক্ত চড়ে যায়। খুব বিব্রত হয়ে বলি -জহির ভাই! আপনি কি বলছেন! আপনি ভাবী কে ঠকাতে চান? -কিসের ঠকানো? -তা হলে কেন মিথ্যে বলবেন? কেন ভাবীর সঙ্গে শেয়ার করবেন না।

পৌরুষ বাঁচাতে এ কী করতে চান? দোষটা যে আপনার তা তাকে জানতে দেয়া আপনার উচিত না? এতই ভীতু আপনি? -না, আমার ভয় নেই -তা হলে কেন এমন করেন। মিথ্যে দিয়ে হলেও অন্যের স্পার্মের সন্তান চান। শত শত দরিদ্র শিশু মারা যাচ্ছে, চাইলে তাদের একজন কে এডপ্ট তো করতে পারেন। পারেন না? জহির ভাইয়ের গলাও কষা হয়। ভয়ঙ্কর রাগে গড় গড় করে সে জবাব দেয় -তুমি কি করে বুঝবে আমার কী কষ্ট? তুমি তো ডাক্তার ।

রাতের পর রাত জেগে থাকি, যখনই কারো কোলে শিশু হয় চেয়ে দেখি। প্রায়ই মনে হয় বাড়িতে একটা শিশু খেলে বেড়াবে টুকটুক করে। দেশে এত লোকের বাচ্চা হয়, আমি কেন এমন? তুমি ডাক্তার, সুখী ফ্যামিলী। উপদেশ দিতে চাও দাও। কিন্তু দেখছ তো কেন মানুষ টেস্টটিউব বেবীর জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে? গর্ভ থেকে না বের হলে নিজের বাচ্চা ভাববে লুৎফা? সুখে থাকবে? আর শোনো, এডপ্ট করা বাচ্চা কি কোনদিন আপন হয়? কাকের বাসায় কোকিলের বাচ্চা কি কোন দিন আপন হয়? জহির ভাইয়ের প্রতিক্রিয়ায় ডাক্তার হয়েও ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলি।

বলি, ভাইয়া! এভাবে বললেন? আমি শুধু ডাক্তার। মানুষ না? আমাদের নাইমাকে দেখে কি তাই মনে হয়েছে? ওর সঙ্গে আমার মিল কি পাননি? কোথা থেকে এল এই মিল? শত শত মাইল দুরের মানুষের ভিতর রক্তের মিল ছাড়া কি মিল হয় না? লোকটা কিছুক্ষণ যেন কিছু বুঝতে পারেনি। তারপর ক্রমাগত বলে চলেছে, আই এম স্যরি! আই নেভার মীন দেট। বিদায় নেবার আগে আমার কাছে এতিমখানার এড্রেসটা চাইতে থাকলো। একবার মনে হলো আমাকে খুশী করতে চাইছে, আবার মনে হলো হয়তো নাইমাকে দেখে সেও দত্তক নিতে কনভিন্স হয়েছে।

আমি বিরক্তি চেপে বললাম, আজ থাক, ভাইয়া। আমি পরে আপনার কার্ডের এড্রেসে ইমেইল করে দেব। ----- ড্রাফট ১.০

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।