আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

'জয় বাংলা' "জিন্দাবাদ'" ও "জঙ্গিবাদ"

আল্লাহ মহান, যাহা বলিব সত্য বলিব। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ থেকে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি মুহূর্তে জয় বাংলা স্লোগানটি ছিল সবচেয়ে বড় প্রেরণাদায়ী শক্তি। মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক। 'পাকিস্তান জিন্দাবাদে'র বিপরীতে জয় বাংলা ছিল বাঙালিত্বের উদ্বোধন। সে অর্থে জয় বাংলা নিছক স্লোগান নয়, একটি ইতিহাস।

১৯৭১ সালের নভেম্বর থেকে মুক্তিযোদ্ধারা চাপ বাড়াতে থাকেন ঢাকার দিকে। এ সময় নারায়ণগঞ্জের শহরতলিতে আমরা পাকিস্তানি ঘাঁটিতে মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণ প্রায়ই টের পেতাম। রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে যখন দুই পক্ষে গোলাগুলি হতো- আমরা বাঙ্কারে বসে কান পেতে থাকতাম। গোলাগুলির শেষে যখন সমস্বরে 'জয় বাংলা' স্লোগান ধ্বনিত হতো, তখন আনন্দে উদ্ভাসিত হতো আমাদের মুখ। বুঝতাম, জয় হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের।

১৯৭৫ সালের পর বিএনপি হঠাৎ 'জয় বাংলা'র মতো একটি ঐতিহাসিক স্লোগানকে আওয়ামী লীগের স্লোগান হিসেবে বিবেচনা করতে লাগল। আর পাকিস্তানি ভাবাদর্শে আশ্রিত বলে নতুন স্লোগান প্রতিষ্ঠিত করার মানসে জুড়ে দিল 'বাংলাদেশ জিন্দাবাদ'। কিন্তু ইতিহাস তো বন্দিত্ব মানে না। এতকাল আওয়ামী লীগের স্লোগানে জয় বাংলা কোনোক্রমে টিকে ছিল। জয় বাংলার শক্তিকে ভয় পেয়েছিল বিএনপি-জামায়াত।

ভেবেছিল, 'বাংলাদেশ জিন্দাবাদে'র মধ্য দিয়ে প্রজন্মকে সরিয়ে আনতে পেরেছে জয় বাংলার শক্তি থেকে। কারণ এসব দলের নেতৃত্বের ভীতি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় প্রত্যাবর্তন। তারা যথার্থই বুঝেছিল, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জড়িয়ে আছে 'জয় বাংলা' স্লোগানের ভেতর। তাই তারা হয়তো এই ভেবে স্বস্তিতে ছিল যে প্রজন্মকে জয় বাংলা ভুলিয়ে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিচ্ছিন্ন করা গেছে। কিন্তু নষ্ট রাজনীতির চর্চা করতে গিয়ে ইতিহাসের সত্য বিস্মৃত হয়েছেন ক্ষমতাবিলাসীরা।

ঐতিহ্যের একটি সাংস্কৃতিক শক্তি থাকে। সংস্কৃতি বহতা নদীর মতো। স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করতে চাইলে তা ফল্গুধারায় প্রবাহিত হয়। পরবর্তী প্রজন্মের রক্তধারায়, অর্থাৎ চেতনায় তা হয় অনুরণিত। ফলে জয় বাংলার মতো গৌরবের স্লোগান ঐতিহ্যসচেতন, দেশপ্রেমিক, আধুনিক প্রজন্মের চেতনা থেকে সরিয়ে দেওয়া কঠিন।

এই চিরন্তন সত্যটিই প্রতিষ্ঠিত হলো এ বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে। প্রথমে শাহবাগের গণজাগরণে, পরে এর ধারাবাহিকতায় সারা দেশে ও প্রবাসে। বাঁধভাঙা জোয়ারের তীব্রতা বেশি থাকে। বাঙালির সর্বজনীন গৌরবের জয় বাংলা স্লোগানকে নষ্ট রাজনীতি আওয়ামী লীগের স্লোগান বলে বালির বাঁধে আটকে রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু সময়ের দাবিতে জয় বাংলা তার স্বমহিমায় ঠিকই নতুন প্রজন্মের কণ্ঠে পুনঃ স্থাপিত হলো।

ইতিহাসভ্রষ্ট কিছুসংখ্যক মানুষ ছাড়া সবার কণ্ঠে এখন অসংকোচে এবং দারুণ গৌরব ও উত্তেজনায় ধ্বনিত হচ্ছে 'জয় বাংলা'। এভাবেই গণজাগরণ ইতিহাসকে স্বমর্যাদায় প্রতিস্থাপন করল। ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে এ কারণে এই সময়ের নাবিকদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। ভেবে পাই না, বিএনপি কোন অন্ধত্বে এতটা বুদ্ধিভ্রষ্ট হচ্ছে! জঙ্গিবাদ লালন করা জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে অতটা আধুনিক হওয়া সম্ভব নয় বুঝি। তাই এই দলের সেয়ানা কুশীলবরা সরলমতি মাদ্রাসার ছাত্রদের বদ্ধবুদ্ধিতে আটকে রাখা কওমি মাদ্রাসার হুজুরদের বিভ্রান্ত করে মাঠে নামাতে পেরেছে সহজেই।

১২টি ইসলামী দলের ব্যানারে ২২ ফেব্রুয়ারি তাণ্ডব চালাতে যাদের মাঠে নামানো হয়েছিল, তাদের অনেকেই ছিল আধুনিক শিক্ষা ও সংস্কৃতিবঞ্চিত মাদ্রাসাছাত্র। টেলিভিশন ক্যামেরায় বায়তুল মোকাররম মসজিদে এমন কয়েকজন উত্তেজিত জঙ্গি ভাবধারার কর্মীর বডি-ল্যাঙ্গুয়েজ ও প্রকাশভঙ্গি অনেকেরই হয়তো নজর কেড়েছে। তারা যেভাবে বলছিল- শাহবাগের আন্দোলনকারীরা ইসলাম উৎখাত করতে মাঠে নেমেছে, তাই তাদের কর্তব্য জীবন দিয়ে হলেও ওদের বিতাড়িত করে ইসলাম রক্ষা করা। এভাবে যুক্তি-বুদ্ধিহীন তরুণদের তাদের গুরুরাই মনগড়া বক্তব্যে উত্তেজিত করে মাঠে নামিয়েছে। বোঝা গেল, এসব সরলমতিকে ধার্মিক না বানিয়ে ধর্মান্ধ করা হয়েছে।

তারা মসজিদের পবিত্রতা নষ্ট করে মসজিদের ভেতর হামলা করার অস্ত্র জমা রাখছে। মসজিদের জায়নামাজ আর ধর্মীয় গ্রন্থ পুড়িয়ে দিচ্ছে। জাতীয় মসজিদের খতিবকে লাঞ্ছিত করছে। বোঝা গেল, ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা ওদের সামনে অনুপস্থিত। ৬০০-৭০০ বছর আগে এ দেশে সুফিসাধকদের চরিত্র-মহিমা, মানুষের প্রতি ভালোবাসা, অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করার মহত্ত্ব দেখে হিন্দু-বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল।

আর আজ এসব ইসলাম না-জানা অথবা রাজনৈতিক সুবিধা লাভের জন্য মোনাফিকের মতো কেউ কেউ ইসলামকে মনগড়া ব্যাখ্যা করে সরলমতি তাল্বে ইলমদের মাঠে নামিয়ে দিচ্ছে ধর্মের সৌন্দর্যে কালিমা লেপন করতে। ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে একটি টেলিভিশন চ্যানেল তাণ্ডব চালানো ১২টি ইসলামী দলের দুজন নেতার সাক্ষাৎকার প্রচার করে। একটি ব্লগের লেখায় মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য রাখা হয়েছে, তাই তাঁরা ক্ষুব্ধ হয়ে মাঠে নেমেছেন, এমন দাবি ইসলামী নেতাদের। এই সূত্রে তাঁদের সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, ব্লগে তাঁরা লেখাটি পড়েছেন কি না। সলজ্জ হাসিতে জানালেন, ব্লগ তাঁরা পড়েননি।

তবে একটি পত্রিকায় (আমার দেশ) এ বিষয়ে রিপোর্ট পড়ে তাঁরা দেশজুড়ে প্রতিবাদ-বিক্ষোভে নেমেছেন। আমি জানি না, এই সম্মানিত হুজুরদের সাংবাদিকরা পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন কি না? আমি হলে বিনীতভাবে জানতে চাইতাম, পত্রিকায় পরিবেশিত রিপোর্টটিই যে সত্য, তাতে আপনারা নিশ্চিত হলেন কেমন করে? এ ধরনের তৃতীয় সূত্র থেকে তথ্য পেয়ে যাচাই-বাছাই না করে দেশজুড়ে অমন অরাজকতা তৈরি করা কি ইসলাম সমর্থন করে? আর কোনো একজন ব্লগার কী বক্তব্য রাখল, তার দায় সবার ওপর চাপিয়ে দেওয়া কি ন্যায়সংগত? বিশ্বজুড়ে নানা অঞ্চলে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুবিধালোভী ইসলামের লেবাসধারী নেতারা সরলমতি অনুসারীদের যেভাবে মানবতাবিরোধী কাজে উস্কে দিচ্ছে, তাতে বিশ্বব্যাপী মানুষের চোখে ইসলাম ধর্ম একটি জঙ্গিবাদী-মানবতাবিরোধী ধর্ম বলে চিহ্নিত হচ্ছে। মহানবী (সা.) কর্তৃক প্রবর্তিত ও বিশ্বব্যাপী সুফি-সাধকদের দ্বারা প্রচারিত মানবিক ও শান্তির ধর্ম ইসলামের সঙ্গে যা মেলানো যায় না। ১২টি ইসলামী দলের নেতাদের কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকলে ভিন্ন কথা। না হলে বলব, জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের চালে পড়ে আপনারা এ ধারার জেহাদি তৎপরতা চালিয়ে ইসলামের ক্ষতি করছেন।

ইসলামকে রক্ষা নয়, জামায়াতে ইসলামীর যুদ্ধাপরাধী নেতাদের রক্ষা করার জন্য আপনারা তাদের হাতিয়ার হয়েছেন। যে মানুষগুলো এ দেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, গণহত্যা, সাধারণ মানুষের সম্পদ ধ্বংস আর নারী ধর্ষণে অংশ নিয়েছিল ও পাকিস্তানি বাহিনীকে এসব দুষ্কর্মে সহযোগিতা করেছিল, তাদের রক্ষার দায়িত্ব কি মহানবীর প্রবর্তিত ইসলাম গ্রহণ করবে? তা হলে কোন স্বার্থে আপনারা এমন সব অনাচারে যুক্ত হচ্ছেন? ইসলামকে গভীরভাবে জানা ও বিশ্লেষণ করতে না পারা সরলমতি ছাত্র ও অনুসারীদের মধ্যে ভুল ব্যাখ্যায় উত্তেজনা ছড়িয়ে দিয়ে পথভ্রষ্ট করছেন? ইসলাম ধর্ম গোঁড়ানীতিতে বিশ্বাস করে না। এ ধর্মে স্থিতিস্থাপকতা আছে বলেই প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে সগৌরবে টিকে আছে। সময় ও যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও অর্থনৈতিক ভাবনায় সংস্কারের অনুমোদন রয়েছে এ ধর্মে। মহানবী (সা.)-এর বিদায় হজের ভাষণেই তো রয়েছে পথনির্দেশনা।

ইসলাম ধর্মই তো দেশপ্রেমকে সর্বোচ্চে স্থান দিয়েছে। দেশপ্রেমের প্রতীক তার পতাকার মর্যাদা। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত এ দেশের বিপ্লবী ঐতিহ্যের প্রতীক শহীদ মিনার। তাই গভীরভাবে ইসলামী দর্শন অনুভব করতে পারলে ২২ ফেব্রুয়ারি পতাকা লাঞ্ছিত করা ও শহীদ মিনার ভাঙা কি ধর্মসম্মত হয়েছে? যদি তা না হয়, তাহলে আপনারা কী ভূমিকা রেখেছেন? কার্যকারণ সূত্রে আমরা বিশ্বাস করি, জামায়াতে ইসলামী কোনো ইসলামী ধর্মাদর্শের দল নয়। রাজনৈতিক অভিলাষ পূরণে ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে।

কিন্তু ১২টি ইসলামী দল তো ইসলামী আদর্শে পরিচালিত দল। জামায়াতে ইসলামীর কলঙ্কিত মানুষদের রক্ষা তো আপনাদের কর্তব্য নয়। আমরা আশা করব, কোনো আবেগ নয়, বাস্তবতার বিচারে আপনারা পুরো বিষয়টির মূল্যায়ন করবেন। ধর্ম, সমাজ ও দেশ রক্ষার গুরুদায়িত্ব আপনাদের ওপর। ইসলামের মানবিক আবেদন ছড়িয়ে সবার অন্তর জয় করার চেয়ে বড় বিজয় আর কী সে হতে পারে?  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।