আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ড. ইউনুসকে নিয়ে আলোচিত তথ্যচিত্র নির্মাতার সাক্ষাৎকার

সাপ-লুডু খেলছি বিধাতার সঙ্গে

বাংলাদেশি সংস্থা গ্রামীণব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের ওপর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র ‘কট ইন মাইক্রো ডেট‘-এর নির্মাতা টম হাইনেমান বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম-কে অনলাইনে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম-এর নিউজরুম এডিটর রানা রায়হান। বাংলানিউজ: আপনার ছবি ‘কট ইন মাইক্রো ডেট’-এর মূল বিষয় নিয়ে বিস্তারিত বলবেন? টম হাইনেমান: ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে জাহানারা নামের একজন নারীর সঙ্গে আমার দেখা হয় ; আর তখনই চলচ্চিত্রটি তৈরির চিন্তা আমার মাথায় আসে। সেসময় তিনি ঢাকা থেকে দু’ঘন্টা দূরত্বের ছোট্ট এক গ্রামে বাস করতেন। ব্র্যাক, প্রশিকা ও গ্রামীণের মতো চার থেকে ছয়টি সংস্থা থেকে ঋণ নিয়েছিলেন জাহানারা।

আমরা তার কাছে যাওয়ার কিছুদিন আগেই তিনি তার ইটের তৈরি বাড়িটি বিক্রি করে দেন। কারণ সাপ্তাহিক কিস্তির টাকা তিনি শোধ দিতে পারছিলেন না। আড়াই বছর পরে আমরা তার কাছে আবারও যাই, দেখা গেল সেই আগের মতোই নিদারুণ অবস্থা তার। আমার দীর্ঘ সময়ের অনুসন্ধানের মূল বিষয়বস্তু ছিলো: দরিদ্র মানুষের প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরা। যে মুহূর্তে বিশ্বজুড়ে ক্ষুদ্র ঋণের জয়জয়কার চলছে।

আমরা বাংলাদেশ, মেক্সিকো ও ভারতে শুট করেছি। বিষয়টা অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও আমি অবশ্যই বলব যে, কেবল বাংলাদেশেই দরিদ্র মানুষ আছে--তা না। গোটা পৃথিবীতেই আমরা একই গল্প শুনেছি। এটাই অবশ্য গল্পের পুরোটা নয়। আমার মনে হয়, অনেক মানুষই ক্ষুদ্রঋণ থেকে সহায়তা পেতে পারেন।

তবে সত্যিই বিশ্বাস করি, সুদের হার পরিশোধ করতে গিয়ে দরিদ্রদের মধ্যেও যারা দরিদ্র তাদের অনেক কঠিন সময় পাড়ি দিতে হচ্ছে। সবসময়ই আমার প্রশ্ন ছিলো: এটা কি ঠিক যে, আমার আপনার চেয়ে দরিদ্র মানুষ দ্বিগুণ সুদ পরিশোধ করবে, আমি নিশ্চিত তাদের ঋণের সুদের হার এরকমই। আমার ছবির দ্বিতীয় অংশ নোবেল পুরস্কারজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তার গ্রামীণব্যাংক নিয়ে। পশ্চিমা বিশ্বের অনেক মানুষের কাছে তিনি ও তার ব্যাংক ুদ্রঋণের আইকন হিসেবে বিবেচিত। একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক হিসেবে আমি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করি-- এখন এটাই আমি করছি।

আমার পরিতাপের বিষয়টা হচ্ছে, ড. মুহাম্মদ ইউনূস আমার অনেক, অনেক মেইলের (বার্তা) উত্তর দেননি। এমনকি স্পেনে সামনাসামনি দেখা হওয়ার পরও তার সময় হয়নি আমার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার। বাংলানিউজ: ড. মুহাম্মদ ইউনূস দারিদ্র্যকে জাদুঘরে পুরে রাখতে চান। গ্রামীণব্যাংকের গত ৩০ বছরের অধিক সময়ের কার্যক্রম অনুযায়ী আপনি তার এ বিশ্বাস কিভাবে দেখছেন? টম হাইনেমান: আমি গ্রামীণ ব্যাংকের বিশেষজ্ঞ কেউ নই। ড. ইউনূস যদি একবার বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র লোকজনকে দেখতে যেতেন, ভালো হতো।

তবে আমার মনে হয়, ‘দারিদ্র্যকে জাদুঘরে’ নেওয়া অত্যন্ত কঠিন। ১৯৯০ সালে ইউএনডিপি জানায়, বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৮৪ শতাংশই দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। ২০০৯ সালে ইউএনডিপি আবারও জানায়, বাংলাদেশের এখনো ৮০ শতাংশ লোকের প্রতিদিনের গড় আয় ২ মার্কিন ডলারের কম। ক্ষুদ্রঋণের ৩৫ বছর ইতিহাসের পর একজন ভাবতেই পারতেন এর জন্মভূমিতে (বাংলাদেশে) এই সংখ্যাটা কমে যাবে। বাংলানিউজ: আপনার ছবির একজন সাক্ষাৎকারদাতার তথ্য অনুযায়ী গ্রামীণব্যাংকের সুদ কখনো ১০০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়।

এর পক্ষে কোনো প্রমাণ হাজির করতে পারবেন? টম হাইনেমান: আমার প্রামাণ্যচিত্রে কেউই তো বলেননি যে, গ্রামীণব্যাংকের সুদ ১০০ শতাংশের বেশি। আমি কাজী খলীকুজ্জামান আহমদের, (এখন পিকেএসএফ-এর চেয়ারম্যান) বক্তব্য নিয়েছি। ২০০৭ সাল থেকে তিনি আড়াই হাজার ঋণগ্রহীতার ওপর পরিচালিত সমীক্ষাকাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। এ সমীক্ষায় দেখা যায়, গ্রামীণব্যাংকে ২৬ থেকে ৩০ দশমিক ৫ শতাংশ সুদ ঋণগ্রহীতাকে দিতে হয়। অন্য কয়েকটি বড় সংস্থার সুদের হার আরও বেশি।

আমার ছবিতে নেওয়া কাজী খলীকুজ্জামানের বক্তব্য ছিলো এ রকম: ‘আমরা দেখেছি যে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে লোকজন তাদের সম্পদ আদৌ বাড়াতে পারেনি। এক তৃতীয়াংশ বা তারও বেশি সংখ্যক লোকের সম্পদ বরং কমে গেছে। আমরা এও দেখেছি যে, স্বাস্থ্য ও পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভালো না। তাদের ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে, তবে কিছুদিনের মধ্যেই ঝরে পড়ছে। তাদের খাদ্যগ্রহণের মানও খুব একটা বাড়েনি।

এর কারণ হচ্ছে, লোকজন আমাদের জানিয়েছে তাদের সাপ্তাহিক কিস্তি শোধ করতে হয়। সুতরাং সাপ্তাহিক কিস্তি পরিশোধ করার জন্যই তারা মূলত টাকা জোগাড় করার চেষ্টার করছে। পরিবারে অন্য প্রয়োজনের কথা মাথায় রাখছে না। কিস্তি পরিশোধ না করলে তার দলের অন্য সদস্যরাই তাকে শাস্তি দেবে। ’ বাংলানিউজ: কেউ একজন কিভাবে নিশ্চিত হবেন যে, ড. মুহাম্মদ ইউনূস গ্রামীণব্যাংকে আসা ৭০০ কোটি টাকা সহায়তা তিনি গ্রামীণকল্যাণে স্থানান্তর করেছেন? টম হাইনেমান: এ বিষয়ে একজন নিশ্চিত হতে পারে যে, কারণ আমরা একগুচ্ছ গোপন নথি পেয়েছি এবং এ নথিগুলো নরওয়ের দাতাসংস্থা নোরাড, ঢাকায় নরওয়ের দূতাবাস ও ড. ইউনূসের লেখা।

এই ওয়েবসাইটে গেলে আপনি সব একযোগে পেয়ে যাবেন: Click This Link ওয়েবাসাইটের ডান দিকে পিডিএফ ফরম্যাটে সব পেয়ে যাবেন। আমরা এগুলো রেখেছি কারণ কখনোই এর আগে এসব প্রকাশ করা হয়নি। (বক্তব্যের এ পর্যায়ে ব্যক্তিগত কিছু অভিমত তুলে ধরেন টম হাইনেমান... তবে তা প্রকাশের জন্য নয়) বাংলানিউজ: গ্রামীণব্যাংকের সাফল্যের কারণে এখন এই মডেল অনেক দেশই অনুসরণ করছে। কিন্তু আপনার প্রামাণ্যচিত্রে বলা হচ্ছে, দরিদ্রদের যে ঋণ দেওয়া হয় তা তাদের আয়-রোজগার বৃদ্ধি করে না বা দারিদ্র্যও কমায় না, কেন? টম হাইনেমান: মেক্সিকো, ভারত ও বাংলাদেশের দরিদ্র লোকজন আমাদের এই কথাই বলেছেন। আর খ্যাতিমান উন্নয়ন-গবেষক ও বিজ্ঞানীদের কথাও একই রকম।

আমরা তাদের উদ্ধৃত করেছি। মজার বিষয়টা হচ্ছে, বাংলাদেশ, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, ক্ষুদ্রঋণ যে দারিদ্র্য কমাচ্ছে এর বিজ্ঞানভিত্তিক কোনো প্রমাণ নেই। ক্ষুদ্রঋণের ৩৫ বছর পর ২০১০ সালেও এটা বলা হচ্ছে। যে কেউ অবাক হয়ে বলতে পারেন, বিশেষজ্ঞদের কথা আগে কেন শোনেননি। বাংলানিউজ: ড. ইউনূস একবার বলেন, ক্ষুদ্রঋণ মানুষের মৌলিক অধিকার।

আপনি কী মনে করেন? বাংলাদেশের লাখ লাখ দরিদ্র মানুষ যারা গ্রামীণব্যাংক ও অন্য ঋণদাতাদের কাছ থেকে ঋণ নিচ্ছে তাদের জন্য এটা কি অপরিহার্য? টম হাইনেমান: আমি আমেরিকার প্রখ্যাত উন্নয়ন গবেষক টমাস ডিখটারের বক্তব্য উদ্ধৃত করছি, তিনি আমার ছবিতেও আছেন: ‘ড. ইউনূস বলেছেন যে, ঋণ (ক্রেডিট) করা মানবাধিকার। তবে তিনি বলেননি যে, দেনার দায়ে পড়াও (ডেট) মানবাধিকার। তবে ঋণের উল্টোপিঠ হচ্ছে দেনার দায়। ’ ঋণ নিলেই আপনি দেনার দায়ে পড়বেন। দরিদ্র মানুষ আমার, আপনার চেয়ে বেশি দেনার দায়ে জড়াতে চায় না।

বাংলানিউজ: কেউ কেউ বলছেন যে, আপনি অন্যের স্বার্থে অপ্রাসঙ্গিকভাবে ড. ইউনূসের নামে কালিমালেপন করছেন। এ নিয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কি? টম হাইনেমান: আমি একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক। নিজের প্রোডাকশন কোম্পানি আছে। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার মৌল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সমালোচনামূলক প্রশ্ন করা। কাকে প্রশ্ন করছি বা বিষয়বস্তুই কী সেটা বিষয় নয়।

আমি কারো দ্বারা প্ররোচিত নই। নরওয়েজিয়ান ন্যাশনাল টেলিভিশনের জন্য আমি প্রামাণ্যচিত্রটি নির্মাণ করেছি। সঙ্গে ড্যানিশ ও সুইডিশ ন্যাশনাল টেলিভশনও রয়েছে। নরওয়েজিয়ান ন্যাশনাল টেলিভিশনের সম্পাদকরা অনেক পরীক্ষা নীরিক্ষার পর স্ক্রিপ্ট অনুমোদন করেছেন। বাংলানিউজ: আপনি কেন ক্ষুদ্রঋণের ওপর কাজ করতে আগ্রহী হলেন? টম হাইনেমান: কারণ ক্ষুদ্রঋণ একটি বৈশ্বিক ইস্যু।

দারিদ্র্য নির্মূল করতে এই উদ্যোগ বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে প্রশংসিত। এটা ভুল না ঠিক সে প্রশ্নটা যে কোনো সাংবাদিকের করা উচিৎ। আমি পাঠক-শ্রোতাদের ওপর এই ভার দিয়ে দিলাম। আমি কেবল প্রতিবেদন তৈরি করে তা সবাইকে জানানোর কাজটা করেছি। বাংলানিউজ: নরওয়ের আন্তর্জাতিক উন্নয়নমন্ত্রী এরিক সোলহেইম বলেন, তারা গ্রামীণব্যাংককে নিয়ে সাম্প্রতিক এ প্রসঙ্গটি পরীক্ষা করে দেখছেন।

আপনি কি মনে করেন, বাংলাদেশের দরিদ্র মানুষের জন্য এটাই সমাধান ? সমাধান যদি আদৌ থেকেই থাকে ,তবে সেটা কোথায় ? আমি বিজ্ঞানী বা রাজনীতিক নই। আমার প্রামাণচিত্রটি থেকে টমাস ডিখটারকে উদ্ধৃত করছি: ‘বিশ্বের বেশিরভাগ লোকই যে উদ্যোক্তা তা নয়। আমাদের মধ্যে সবাই বিল গেটস হতে পারবে না। দরিদ্র মানুষ আমাদের চেয়ে আলাদা হবে এমনটি কেন আমরা আশা করছি? আপনি যদি তাদের জিজ্ঞাসা করেন, দেখবেন তারা সত্যিই একটি সুসংহত অর্থনীতি চায়। তারা একটি চাকরির সুযোগ চায়।

তারা চায় নিরাপত্তা। তারা এক ব্যাগ চাল বিক্রি করার জন্য তপ্ত সূর্যের নিচে গিয়ে অন্য বিশজনের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে চায় না যারা তারই মতো চাল বিক্রির জন্য দাড়িয়ে আছে এবং দিন শেষে পাচ্ছে মাত্র সামান্য কয়টা টাকা। আবার ওভারসিস ডেভলপমেন্ট ইনস্টিটিউটের রিসার্চ ফেলো মিলফোর্ড বেটমান বলছেন, ‘আমরা সেই উন্নয়ন মডেলের আটকে পড়েছি এবং গত ৩০ বছর ধরে যে ভুল করেছি তা মেনে নেওয়া আমাদের জন্য অত্যন্ত কঠিন হয়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে আয়রোজগারের পথ তৈরির জন্য আরেকটি মডেল নিয়ে এগিয়ে যাওয়াও মুশকিল। দারিদ্র্যের চক্র থেকে বেরোবার জন্য সেটা হতে পারে ব্যবসা।

অল্প কিছু টাকা দেওয়ার টাকা পরিবর্তে এটাই ভালো। ঋণ দিয়ে তাদের বরং দেনার দায়ে ফেলা হয়। ’ বাংলানিউজ: আপনাকে ধন্যবাদ টম হাইনেমান: আপনাকেও ধন্যবাদ

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।