আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

লং এর কথা (চঞ্ছল আক্তার-এর আত্মার আত্মকাহিনী অবলম্বনে)



লং এর আর মেঘাপুঞ্জিতে মন বসে না। সেই পুরানো কয় ঘর খাসিয়া, চেনা মানুষজন। আর শুধুই পান পাতা গোনা সকাল বিকাল! পলি দূর শহরে পড়তে গেছে। আর ছুটিতে যখন সে ঘরে ফিরে, সে সময়টা লং এর বড় আনন্দের। আর যে সময়টা সে থাকে না, লং শুধুই ভেবে যায়।

পলি আবার কবে আসবে ? তার কবে আবার ছুটি হবে ? নাকি অন্য কোন বাঙালি ছেলের মোহে ডুবে যাচ্ছে তার পলির মন ? বার বার তার অবুঝ মন কুরে কুরে খায় পলির কথা, গান, হাসি। তাদের উল্টোদিকের ঘরে পলির বেড়ে ওঠা, সেই সাথে তারও বড় হওয়া, ঠিক যেন পান গাছের বেড়ে ওঠা - এমনি শতেক স্মৃতি ভাসে লং এর চোখে, আর মেঘাপুঞ্জির পাশের বিশাল পাহাড়টা ঝাপসা হয়ে আসে। অল্পই পড়াশোনা করা হয় তার। মাঝে মাঝে ভাবে সে, পড়তে পারলে হয়তো জীবনটা অন্যরকম হতে পারতো তারও। বাঙালীদের জীঘাংসা অনেক কাছ থেকে দেখেছে সে।

তার মন জেনেছে, মানুষের হেয় দৃষ্টির মাঝে থাকার চেয়ে তার পাহাড়-গ্রামের জীবন অনেক ভালো। এখানকার সব গাছ, পাখি, জন্ত্ত তাকে ভালোবাসে, কাছে টানে। তাই লং পড়াশোনা ছেড়ে, অজাচিত সব ভাবনা ছেড়ে তার গ্রামে ফিরে কাজে মন দেয়। পানের বরজ তাদের লক্ষ্মী, আর এ পান বেচেই তাদের আয়। পাশাপাশি জুম চাষেও সমান দক্ষ সে।

তারপরও পাহাড়ি মানুষের কি হবে, তাই তার অবচেতন মনে খেলা করে। প্রকৃতির অবারিত সম্পদে ভরা তাদের পাহাড়, বনানী। আর তঞ্চকেরও তেমনি আনাগোনা। কিন্ত্ত এ সম্পদ বিক্রীর কাজে লং সব সময় বাঙালীর প্রলোভন এড়িয়ে চলেছে। বাঙালীরা প্রয়োজনে নিজের মাকেও বিক্রী করতে পিছ পা হয় না।

খাসিয়ারা শত অভাবের মাঝেও তাদের মাকে বিক্রী করতে শেখেনি। পাহাড়ে কাজ করে বেড়ায় লং, আর মাকে বলে তার স্বপ্নের কথা। পুরানো পানবাগান থেকে কম পান পাতা পাওয়া যাচ্ছে। তাই সে নতুন বাগান করবে পাহাড়ের কোলে। সেই সাথে জুম চাষ।

পাশেই নতুন কুঁড়ে ঘর উঠাবে। তারপর বিয়ে করে স্বপ্নের সংসার পাতবে পলির সাথে। যদিও মাঝে মাঝে পলির অনুপস্থিতি তার কাছে অসহনীয় হয়ে ওঠে, মনে হয় এক দৌড়ে সে চলে যাবে শহরে, তার পলির কাছে। কোন অচিন এক বাঙালী ছেলের কাছে পলিকে হারানোর ভয় তাকে প্রায়ই বিচলিত করে। এভাবেই পাহাড়ের নীরালায় নাম-না-জানা ছড়ার মত লং-এর জীবন বয়ে চলে।

আগে লং ফুটবল খেলতে শহরে যেত। খুব নাম করেছিল সে ভালো খেলার জন্য। পুঞ্জির উঠানে বিকেল বেলা ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের নিয়ে খেলাধুলায় মেতে ওঠে সে। তার শুধু অপেক্ষা কবে পলি আসবে, আর তাদের সুখের জীবন শুরু হবে। দিন যেন আর ফুরায় না।

অবশেষে পুঞ্জিতে পলি আসার আগে পুলিশ এলো। তাদের সাথে সাংবাদিক, আরো কত লোকজন! পলির লাঞ্চিত হওয়া মৃতদেহ পাওয়া গেছে শহরে, এ খবর পৌঁছে দিতে আর লাশ বুঝিয়ে দেবার দায় শেষ করতে সেখানে যায় তারা। ক’দিন পত্র-পত্রিকায় খুব লেখালেখি হয়। সেই সাথে হারিয়ে যায় পলির কাহিনী। পাহাড়ি লং যেন পাথর হয়ে যায়।

তার কেবলই মনে হয়, একদিন যেন পলি ফিরে আসবে, ছুটি হবে তার, আর বেণী দুলিয়ে ব্যাগ নিয়ে নেচে নেচে সে ঢুকবে পুঞ্জির উঠোনে। পাহাড়ে বসে তার জন্য অপেক্ষা করে লং, আর প্রায়ই মাঝরাতে পলির সাথে তার দেখা হয়। তার সাথে পলি কথা বলে, হাসে, খুনসুটি করে, ইশারায় কাছে ডাকে। কিন্ত্ত কাছে যেতে যেতেই পলি যেন হাওয়ায় মিশে কোথায় হারিয়ে যায়। লং পলির পছন্দের গান গুলো গেয়ে যায়, তার বাঁশিতে পলির প্রিয় সুরগুলো তোলার চেষ্টায় বুঁদ হয়।

কিছুতেই ভোলে না সে তার পলির কথা, যেন সে আসবে ফিরে শহর থেকে কোন একদিন।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।