আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মেসি না রোনালদো?

কি যে লিখি ছাই মাথা ও মুন্ডু আমিই কি বুঝি তার কিছু

গোল করার প্রতিযোগিতা চলছে লিওনেল মেসি ও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর। কে সেরা—আবার জমে উঠেছে এই তর্কও। ‘এল ক্লাসিকো’তে দুজন মুখোমুখি হওয়ার আগে এই দ্বৈরথ নিয়ে লিখেছেন আবিদুল ইসলাম কে বেশি ক্লান্ত, কবি না কবিতা? এই তর্ক কি হয়, নাকি হতে পারে? কবি আর কবিতা কি এক ব্যাপার! এখন কিছুটা থেমেছে, তবে আগে এমন আরও একটা বেমানান তর্ক খুব হতো—কে শ্রেষ্ঠ, রবীন্দ্রনাথ নাকি নজরুল? দুই যুগশ্রেষ্ঠর মধ্যে কি তুলনা করা যায়! নাকি করা উচিত? আসলে তর্কটা একটু সেকেলেও হয়ে গেছে। লেখার শুরুর অংশটাকে ভণিতা বলতে পারেন। পেলে, না ম্যারাডোনা? এ তর্কটাকে সেকেলে বললে কেউ আবার কিছু মনে করে বসেন কি না, এ কারণেই খেলার জগতের বাইরে গিয়ে তুলনা খুঁজে সইয়ে নেওয়া আর কি! তবে বাস্তবতা এটাই, পেলে-ম্যারাডোনার শ্রেষ্ঠত্বের তর্কও এখন সত্যিই সেকেলে।

কবির সুমনের গানে ‘ভোর হলো কী করে’ নিয়ে সূর্য আর মানুষের বাগ্যুদ্ধ থামাতে বাতাস দুই পক্ষকেই ধমক দিয়ে বলেছে, উটকো তর্ক রাখো! ধমক-টমক দেওয়া নয়, বিনম্রভাবেই বলতে হয়, ‘পেলে না ম্যারাডোনা সেরা’ তর্কটা আলমারিতে তুলে রাখার সময় এসে গেছে। লিওনেল মেসি না ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো সেরা? সময় এখন এর সমাধান খোঁজা নিয়ে রোমাঞ্চিত হওয়ার। পেলে বা ডিয়েগো ম্যারাডোনা দুজন দুই যুগের সেরা। ফুটবলের এই দুই মহান নায়কের মুখোমুখি সাক্ষাৎ কখনোই হয়নি। এর আগে বা পরেও ফুটবলে এমন কোনো বড় দ্বৈরথের কথা শোনা যায়নি।

রোমারিও-রোনালদোর মধ্যে একটা দ্বৈরথ হয়তো হতে পারত, কিন্তু দুজনের গায়েই ছিল ব্রাজিলের হলুদ জার্সি। মধ্যমাঠে ফরাসি মহানায়ক জিনেদিন জিদানের সঙ্গে দ্বৈরথে আসতে পারেন, এমন কেউ ছিলেন না বললেই চলে! জিদানপরবর্তী সময় রোনালদিনহো এসেছেন বার্সেলোনার মধ্যমাঠ আলো করে। মেসি কিংবা রোনালদো তখনো কুঁড়ি। রোনালদিনহো এখন আঁধারের বুকে জোনাকের মতো। এই জ্বলছেন তো পরক্ষণেই নিভু।

আর এখন সেদিনকার সেই দুটি কুঁড়ি ফুটেছেন ফুল হয়ে। রঙিন পাপড়ি মেলে দুজনই বহু বর্ণে বর্ণিল করে তুলছেন ফুটবলের সবুজ মাঠ। কাল আর কীর্তি তাঁদের ফুটবল মহাকালের পাতায় ঠাঁই পাইয়ে দেবে কি না, এর সমাধানের ভার কালের কাছেই তোলা রইল। তবে কোন হেঁয়ালিতে কে জানে, ফুটবল দেবতা এ দুজনকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন মুখোমুখি। ফুটবলপিয়াসীদের উপলক্ষ এনে দিয়েছেন ফুটবল বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম দ্বৈরথের অমিয় সুধা পান করার।

বার্সেলোনার মেসি, রিয়ালের রোনালদো কোনো এক অজানা কারণে ২০০৬ বিশ্বকাপের পর নিজেকে হারিয়ে খুঁজতে শুরু করেছেন রোনালদিনহো। রোনালদিনহোর ম্লান হয়ে আসার সুযোগে নিজেকে মেলে ধরতে শুরু করেন মেসি। পুরো ফুল হয়ে ফুটতে আরও দুই মৌসুম সময় নেন আর্জেন্টিনার ছোট্ট জাদুকর। ২০০৮ সালে রোনালদিনহো মিলানে পাড়ি জমালে পরেই মেসির আলো বাঁধ ভাঙে। ২০০৮-০৯ মৌসুমে বার্সেলোনার হয়ে ৫১টি ম্যাচ খেলে ৩৮ গোল করেন, সতীর্থদের দিয়ে করান ১৮ গোল।

রোনালদো তখন ‘লাল দুর্গে’ রীতিমতো সূর্যালোক নিয়ে উদ্ভাসিত। আগের মৌসুমেই (২০০৭-০৮) ৪৯ ম্যাচে ৪২ গোল করে গড়ে ফেলেন ম্যানইউর হয়ে উইঙ্গার হিসেবে এক মৌসুমে সবচেয়ে বেশি গোল করার রেকর্ড। পরের মৌসুমে অবশ্য মেসির সঙ্গে পেরে ওঠা হয়নি। ৫৩ ম্যাচ খেলে করেছেন ২৬ গোল, অবদান রেখেছেন সতীর্থদের করা ৯টি গোলে। মেসি-রোনালদোর শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ের সেই শুরু।

সংবাদমাধ্যম থেকে শুরু করে ফুটবলবোদ্ধা, পাঁড় ফুটবল অনুসারী থেকে সাধারণ ফুটবল দর্শক—রচিত হতে শুরু করে ফুটবল বিশ্বের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর ফুটবল দ্বৈরথের পাণ্ডুলিপি—মেসি-রোনালদো দ্বৈরথ। তুলনা শুরু হয় মেসির ধ্রুপদি সংগীতের মতো রেশমি পরশের ফুটবলের সঙ্গে রোনালদোর হার্ডরক ফুটবলের আলাদা সৌন্দর্যের। আহা, এমন একটা দ্বৈরথ এত দূর থেকেই চলবে! তা কী করে হয়? তাতে কি আর মনের আশ মেটে? ফুটবল দেবতার হয়তো খেয়াল চাপল দুজনকে মুখোমুখি করে দিলে কী হয়, সেটা দেখার। সে জন্যই হয়তো রিয়ালে নাম লেখাতে মরিয়া হয়ে উঠলেন রোনালদো। ম্যানইউ-সমর্থকদের আকুতি, কোচ অ্যালেক্স ফার্গুসনের পিতৃসুলভ ভালোবাসা; কিছুই বেঁধে রাখতে পারল না তাঁকে।

ম্যানইউর রোনালদো গত মৌসুমে হয়ে গেলেন রিয়ালের রোনালদো। সেই থেকে রিয়াল-বার্সার দ্বৈরথ এখন রোনালদো-মেসিরও। চলছে, চলবে সময়ের হিসাবে মেসি-রোনালদোর দ্বৈরথ এখনো ‘শিশু’ই। তবে এটা যে শিশুকাল পেরিয়ে যৌবনে পা রাখবে, তা বলাই যায়। দুজনের বয়স তা-ই বলে।

মেসির বয়স কেবল ২৩ বছর। রোনালদো তাঁর দুই বছরের বড়। দুজনই ক্যারিয়ারের মধ্যগগনে পা রেখেছেন মাত্রই। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে তাঁদের এই আঁচ তাপ হারাতে হারাতে আরও প্রায় আধা যুগ নয়নজুড়ানো দ্বৈরথ উপভোগ করতে পারবে ফুটবল রোমান্টিকরা। বয়স ছাড়াও তাঁরা দুজন এমন দুটি ক্লাবে খেলেন, যে দুটি ক্লাব নিঃসন্দেহে বিশ্বের অন্যতম সেরা।

আর ঘরোয়া কিংবা ইউরোপ প্রতিযোগিতায় যে দুটি দলের উপস্থিতি নিয়তি-নির্ধারিতই বলা চলে। লড়াই পুরস্কার-মঞ্চে একটা আক্ষেপ মেসিকে সততই পোড়ায়—শোকেস ভরা এত এত ট্রফি, কিন্তু আর্জেন্টিনার হয়ে কিছু জেতা হলো না। অদ্ভুত এক মিল রেখে পর্তুগালের হয়ে কিছু জিততে না পারার আক্ষেপে পুড়ছেন রোনালদোও। তবে দুই ক্লাবের হয়ে অনেক পুরস্কার জিতেছেন দুজনই। দুজনেরই আছে লিগ, কাপ আর চ্যাম্পিয়নস লিগের ট্রফি।

আর ব্যক্তিগত অর্জন বা স্বীকৃতি? সেখানেও কেহ কারে নাহি জিনে সমানে সমান! ২০০৭-০৮ মৌসুমটাকে জ্যোতির্ময় করে পুরস্কারে ভেসেছেন রোনালদো। দলকে লিগ আর চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতানোর পুরস্কার পেয়েছেন অর্জন আর স্বীকৃতির স্মারক জিতে। ২০০৮-এর ফিফা আর ইউরোপের বর্ষসেরা ফুটবলার হওয়ার আনন্দে তো ভেসেছেনই, ট্রফি-কেসটা ভরে গেছে ছোট-বড় আরও অনেক স্বীকৃতি-স্মারকে। গত বছরটা আবার ছিল শুধুই মেসির। বার্সেলোনার এক বছরে ৬ শিরোপা জেতায় বড় ভূমিকাই ছিল আর্জেন্টিনার ফরোয়ার্ডের।

আর রিয়ালে রোনালদোর প্রথম মৌসুমটা ছিল খুবই সাদামাটা। এই পার্থক্য প্রতিভাত হয়েছে পুরস্কারের মঞ্চেও। ফিফা আর ইউরোপ সেরা পুরস্কারের সঙ্গে ছোট-বড় বছরের প্রায় সব ফুটবল পুরস্কারেরই ঠাঁই হয়েছে মেসির ট্রফি-কেসে। আর এবার? লড়াই সেই সমানে সমান। ক্লাব মৌসুমের এ পর্যায়ে এসে অবশ্য সামান্য এগিয়েই আছেন মেসি।

১৮ ম্যাচ খেলে ২৩ গোল করেছেন, করিয়েছেন ৯ গোল। আর রোনালদো এক ম্যাচ বেশি খেলে নিজে করেছেন ১৮ গোল। সতীর্থদের দিয়ে করিয়েছেন ৬ গোল। মৌসুম শেষ হতে এখনো অনেক পথই পাড়ি দিতে হবে। দেখা যাক, শেষ পর্যন্ত কী হয়? দ্বৈরথ মাঠের বাইরেও মেসি-রোনালদোর মাঠের দ্বৈরথই ফুটবল বিশ্বে অভূতপূর্ব।

পুরস্কারের মঞ্চেও এমন লড়াই নতুন। সময়ের দুই সেরা খেলোয়াড়ের এই লড়াইটা নতুন মাত্রা পেয়েছে মাঠ আর পুরস্কারের মঞ্চের বাইরের একটি দ্বৈরথের জন্যও। আর এ লড়াই বাণিজ্যিক। রিয়াল-বার্সার মতো এখানেও তাঁরা দুই শত্রুপক্ষের প্রতিভূ। মেসি-রোনালদো চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই বিশ্বসেরা ক্রীড়াসামগ্রী প্রতিষ্ঠান অ্যাডিডাস আর নাইকি—দুই দলের।

মেসি অ্যাডিডাসের বুট পরে খেলেন, রোনালদোর পায়ে নাইকির বুট। আর এ দুটি প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন, নিজেদের ভাবমূর্তি বিক্রি এবং বেতন-ভাতা মিলিয়ে দুজনের যে আয়, তাতে মেসি শুধু রোনালদোরই ওপরে নন, ছাড়িয়ে গেছেন ইংল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক ডেভিড বেকহামকেও। ফ্রান্স ফুটবল ম্যাগাজিনের ২০০৯-১০ মৌসুমের হিসাব অনুযায়ী মেসির বার্ষিক আয় তিন কোটি ৪৬ লাখ ইউরো। আর রোনালদোর তিন কোটি ১৪ লাখ। তিন কোটি ১৯ লাখ আয় নিয়ে দুজনের মাঝে আছেন বেকহাম।

পরিশেষে মেসি-রোনালদোর মাঠ আর মাঠের বাইরের এই দ্বৈরথ কবে কোথায় থামবে, তাতে শ্রেষ্ঠত্বের মুকুটই বা কার মাথায় উঠবে, তা দেখতে অপেক্ষা করতেই হচ্ছে। তবে স্থান ও কাল ফুটবল বিশ্বকে যে রোমাঞ্চের উপলক্ষ এনে দিয়েছে, তা উপভোগ করার সময় তো এখনই। কাল আবার একটা ‘এল ক্লাসিকো’, মানে মেসি-রোনালদোর আরেকটা ধ্রুপদি লড়াই। তবে তাই হোক, আর কিছু না ভেবে বার্সা-রিয়াল আর মেসি-রোনালদোর সেই ধ্রুপদি লড়াই-ই আপাতত চেটেপুটে উপভোগ করা যাক। সরাসরি খেলার দেখার জন্য ক্লিক করুন


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।