আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাঘ সম্মেলন এবং পুতিন

ডিজি টাল (ডিরেক্টর জেনারেল অব টাল)

আহমেদ জুয়েল ভ্লাদিমির পুতিন বাঘপ্রেমী কি-না তা আমরা জানি না। অথবা তিনি পরিবেশবাদী কি-না তাও আমাদের জানা নেই। তবে পোষা প্রাণীর সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো এ কথা আমরা জানি। পুতিন তার পোষা কুকুরকে কীভাবে আদর করেন তা যে কেউ ইচ্ছা করলেই ইউটিউবে দেখতে পাবেন। রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী পুতিন বিশ্বের ক্ষমতাধর নেতাদের একজন।

সম্ভবত তিনিই একমাত্র নেতা যার বন্য এবং নাগরিক পরিবেশে বাঘের সঙ্গে তোলা হাজারো ছবি প্রকাশ হয়েছে গণমাধ্যমে। গহীন জঙ্গলে বন্যবাঘের সঙ্গে আছে তার ভিডিওচিত্র। তার ব্যক্তিগত ওয়েবসাইটে তা দেখা যায়। বাঘের সঙ্গে পুতিনের দুটি স্মরণীয় ঘটনা আছে। একটি হলো- ২০০৮ সালে জন্মদিনে তিনি বাঘের একটি মেয়ে বাচ্চা উপহার পেয়েছিলেন।

মাসেনকা নামের ওই বাচ্চা বাঘটি চিড়িয়াখানায় দেওয়ার আগে তিনি বাড়িতে রেখেছিলেন তিন দিন। বেতের একটি সুন্দর ঝুড়িতে ওটা হাত-পা নেড়ে খেলা করেছিল আর ঘুমিয়েছিল। সে সময় পুতিন ও সেই বাঘের বাচ্চার ছবি ফলাও করে ছাপে রাশিয়ার গণমাধ্যম। ওই একই বছর পুতিন সাইবেরিয়ার সংরক্ষিত বনাঞ্চল পরিদর্শনে যান। তিনি সেখানে স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে বনের মধ্যে ঘুরে বাঘের গলায় ‘ট্র্যাকিং কলার’ পরিয়ে দেওয়ার কাজে সহায়তা করেন।

এই ভিডিওচিত্র তখন রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন থেকে প্রচার করা হয়েচিল। এছাড়া তার ব্যক্তিগত ওয়েবসাইটেও তা সংরক্ষিত আছে। পুতিনের সঙ্গে বাঘের সম্পর্ক বা স্মৃতি নিয়ে এত কথা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে এবারের বাঘ সম্মেলন। বিশ্বের টাইগার জোন বলতে বোঝায় বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, রাশিয়া, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, চীন, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস ও ভুটানকে। এ অঞ্চলে গত শতকে বন্য বাঘের সংখ্যা ছিল এক লাখ।

কিন্তু বর্তমানে সে সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমতে কমতে মাত্র সাড়ে তিন হাজারে ঠেকেছে। আর এ সংখ্যক বাঘের অর্ধেকই আছে সুন্দরবনে। বাঘের সবচেয়ে বড় আবাসস্থলও সুন্দরবন। ভারত-বাংলাদেশের সংস্কৃতির সঙ্গেও বাঘের সম্পর্ক যতটা গভীর, অন্য কোনো দেশে তেমনটি নেই। সে ক্ষেত্রে বাঘের অস্তিত্ব রক্ষায় ভারত বা বাংলাদেশরই সবচেয়ে আগে এগিয়ে আসার কথা ছিল।

কিন্তু এগিয়ে এলেন রাশিয়ার পুতিন। এ ক্ষেত্রে পুতিন অবশ্যই শুধু ধন্যবাদ নয় আরও কিছু পাওয়ার দাবি রাখেন। টাইগার রেঞ্জের ১৩টি দেশ বাঘ নিয়ে আলোচনার জন্য কখনই একত্রে বসতে পারেনি বা বসেনি। সে উদ্যোগও কেউ নেয়নি। শুধু বাঘের অস্তিত্ব নিয়ে ১৩টি দেশের সম্মেলনের ঘটনা এবারই প্রথম।

আর তা ঘটালেন পুতিন নিজেই। তিনি উদ্যোগ না নিলে কবে যে কে এই অসাধ্য সাধন করতেন তা আমরা বলতে পারব না। তবে বাঘকে বিলুপ্তির হাত থকে রক্ষার জন্য ঠিক এই সময়ে এমন একটি সম্মেলনের বিকল্প ছিল না। জয়তু পুতিন। বাঘ সম্মেলনের জন্য আমরা পুতিনের বন্দনা আরও একটি কারণে করতে পারি, তা হলো টাইগার রেঞ্জের ১২টি দেশের বাঘের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমলেও রাশিয়ার বাঘের সংখ্যা কমেনি।

উল্টো গত ৫০ বছরে সেখানে বাঘের সংখ্যা চারগুন বেড়েছে। নিজের দেশের বাঘের সংখ্যা বাড়ছে এমন অবস্থায় তৃপ্তির ঢেকুর তুলে পুতিন বাঘ বিষয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলেও বলার কিছু ছিল না। কিন্তু তিনি তা না করে বিশ্ব ব্যাংক আর ওয়ার্ল্ড ওয়াল্ডলাইফ ফান্ডের সঙ্গে দেন-দরবার করে বাঘ বিষয়ে তার চিন্তার কথা প্রকাশ করেছেন। আর এই সম্মেলন আয়োজনের মধ্য দিয়ে তিনি প্রমাণ করলেন, টাইগার রেঞ্জের দেশগুলোর মধ্যে বাঘের অস্তিত্ব সংকট নিয়ে রাশিয়ার মাথাব্যথা সবচেয়ে বেশি, মাথাব্যাথা বেশি পুতিনের। আর ইতিহাস ঘেঁটে দেখা গেছে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য বাঘের পক্ষে যদি কেউ জোরেশোরে কথা বলে থাকেন তিনি রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ভ্লাদিমির পুতিন।

অন্তত এ সম্মেলনের আয়োজন করে তিনি তা প্রামাণ করলেন। ধন্য ধন্য বাঘবন্ধু পুতিন। সাবেক কেজিবি অফিসার পুতিনের একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক ভাবমূর্তি আছে। কিন্তু সংরক্ষনবাদী সমাজে বাঘ সংরক্ষনের এতবড় উদ্যোগের বিষয়ে পুতিনই প্রথম এবং বিশিষ্ট। এটা তার ব্যক্তিগত সাফল্য বলে অনেকেই উল্লেখ করেছেন।

২১ নভেম্বর রোববার রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে শুরু হয়েছে বিশ্ব বাঘ সম্মেলন বা গ্লোবাল টাইগার সামিট। টাইগার রেঞ্জের ১৩টি দেশের প্রতিনিধিরা ৪ দিন ব্যাপী এই সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সেখানে যোগ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও একটি প্রতিনিধি দল। এই সম্মেলনের প্রধান লক্ষ্য, ২০২২ সালের মধ্যে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করার কৌশলপত্র চূড়ান্ত ও বাঘ রায় অঙ্গীকার করা। সুন্দরবনের বাঘ নিয়ে এ সম্মেলনে একাধিক প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হবে।

সচেতনতার অভাবে কীভাবে প্রতিবছর বাঘের আক্রমণে মারা যায় বন এলাকার ২৫ থেকে ৪০ জন মানুষ। কীভাবে লোকালয়ে এসে মানুষের হাতে বাঘ মারা পড়ে এসব তথ্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সম্মেলনে উপস্থাপন করা হবে। চীন ও ভারতে ওষুধ, মদ ও বিভিন্ন বিলাসবহুল পণ্য তৈরির জন্য প্রতিবছর চোরা শিকারীরা ব্যাপকহারে বাঘ হত্যা করে। নিষিদ্ধ থাকলেও থেমে নেই বাঘ হত্যা এবং বাঘপণ্যের ব্যবসা। এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপের বিষয়ে সম্মেলনে বিশেষভাবে আলোচনা করা হবে।

যুগান্তকারী এই সম্মেলনে বাঘের অস্বিত্ব রক্ষায় নেতারা কী সিদ্ধান্ত নেন তা জানার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন পরিবেশবাদী আর বিশ্বের প্রাণীপ্রেমীরা। বিষয়টি আমাদের জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বাঘ এশিয়ার অভিজাত্যের প্রতীক। রাজকীয় আর ভয়ঙ্কর সুন্দর এই প্রাণীটি আমাদের জাতীয় প্রাণী। সে ক্ষেত্রে বাঘের জন্য যাবতীয় ইতিবাচক সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বেশি ইতিবাচক হবে।

আমরা আশা করব যে উদ্দেশ্যে এই সম্মেলনের আয়োজন তা সফল হবে। আর সফল হলে পুতিনও বেঁচে থাকবেন এক বাঘপ্রেমী হিসেবে সহস্র বাঘের হৃদয়ে। সেই সঙ্গে তার নাম লেখা হয়ে যাবে বাঘ সম্রাজ্যের পুনরুত্থানের নতুন ইতিহাসের পাতায়। উইনস্টন চার্চিল যেমন প্রজাপতি বাগান করে রাজনৈতিক পরিচয়ের বাইরে প্রজাপতিপ্রেমী অন্য এক চার্চিল হিসেবে বেঁচে আছেন, পুতিনও হয়তো বেঁচে থাকবেন তেমনি করেই। ভ্লাদিমির পুতিন, বাঘের জন্য আপনার চিন্তা, উদ্যোগ আর প্রচেষ্টা সফল হোক।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।