আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্প: স্বপ্নের বহুতল

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ

একটু আগে এসে ফারুকের পাশে সোফায় বসেছে রুমা । টিভির দিকে চোখ । টিভিতে দীপায়ন রিয়েল এস্টেট-এর বিজ্ঞাপন চলছে ।

ওদের নতুন প্রজেক্টটি সেগুনবাগিচায় অবস্থিত। লাল-সাদা রঙের ষোল তলা দীপায়ন টাওয়ার। সুরম্য বহুতল । বিজ্ঞাপনে সেটিই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখাচ্ছে। ফারুক মনোযোগী হয়ে ওঠে।

ওদের ইন্সুরেন্স কোম্পানীর অফিসটা পুরানা পল্টনে। আটতলায় ফারুক-এর রুমের জানালা দিয়ে ঝকঝকে দীপায়ন টাওয়ারটা চোখে পড়ে। এতক্ষণ রান্নাঘরে ছিল রুমা। ওর ফরসা মুখটায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। এপ্রিল মাস।

ফ্যানের নীচে বসে দুর্দান্ত গরমে দরদর করে ঘামছিল ফারুক। রান্নাঘরটা তেতে গনগনে হয়ে আছে। ওপরের দিকে খোলামেলা ফ্ল্যাটবাড়ি হলে হয়তো এ সময় গরম কম লাগত । তিন রুমের এই একতলা বাড়িটির স্যাঁতস্যাঁতে ঘরগুলির দেওয়ালে নোনা ধরে গেছে। দিনের বেলায়ও কেমন অন্ধকার অন্ধকার হয়ে থাকে।

রুমা সব মেনে নিয়েছে, এ নিয়ে তেমন একটা অনুযোগ করে না। অথচ রুমা দেখতে সুন্দরী। ওর আরও স্বচ্ছল পরিবারে বিয়ে হতে পারত। ফারুক দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে। সিগারেট ধরিয়ে অন্যমনস্কভাবে বলল, দীপায়ন রিয়েল এস্টেট-এর এমডির নাম রেজওয়ান করিম।

তাই? হ্যাঁ। জাগন্নাথে পড়ার সময় রেজওয়ান আমার ক্লাসমেট ছিল। সত্যি! রুমা উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। আগে বলনি যে। রুমার কন্ঠে অভিমান।

ফারুক কাঁধ ঝাঁকাল। বলল, বলা হয়নি আর কী। ঝুঁকে সিগারেটের ছাই ঝাড়ল। দীপায়ন টাওয়ার-এর ফ্ল্যাটের কী সুন্দর ইন্টেরিয়র । ড্রইংরুমে কাঠের প্যানেল, ঝকঝকে দেয়াল, চকচকে মেঝে।

বাথরুমে টাইলস, আয়না, বাথটাব। খোলামেলা কিচেনে কিচেন-ক্যাবিনেট, প্রশস্ত বারান্দা পরিচ্ছন্ন গ্রিক। অথচ এই ড্রইংরুমের দেওয়ালে ড্যাম্প, আগে আস্তর ছিল, এখন উঠে গেছে। চারিদিকে তাকিয়ে মন খারাপ হয়ে যেতে থাকে রুমার । ঘরে দিনের বেলায়ও আলো জ্বালিয়ে রাখতে হয়।

জানালার ওপাশে শ্যাওলা-ধরা দেওয়াল। দেওয়ালের ওপাশে সরু গলি, নর্দমার বিচ্ছিরি গন্ধ আসে; দিনরাত রিক্সার টুংটাং, সিএনজির ঘরঘরানি আর ফেরিওয়ালার কর্কস চিৎকার তো আছেই। তা ছাড়া, চোরের ভয়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুমা। বলে, তোমার বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়? কার কথা বলছ? ফারুক অবাক হল যেন।

রুমা বলল, কে আবার - রেজওয়ান করিম। দীপায়ন রিয়েল এস্টেট-এর এমডি। ওহ্। না, আজকাল আর তেমন দেখাটেখা হয় না। যা ব্যস্ত থাকে রেজওয়ান ।

মাঝেমাঝে অবশ্য টেলিফোনে কথা হয় । সে দিনও কথা হল। ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না বলল। সেগুনবাগিচায় দীপায়ন টাওয়ারে নাকি ক’টা ফ্ল্যাট খালি পড়ে আছে। বিক্রি হচ্ছে না।

লোকের হাতে টাকা থাকলেও কেয়ারটেকার সরকারের ভয়ে বার করছে না। রুমার চোখে বহুতল দীপায়ন টাওয়ারের ঘোর লেগেছিল। বলল, ফারুক। বল। আমরা কি সেগুনবাগিচায় একটা ফ্ল্যাট বুকিং দিতে পারি না? ফারুক হাসল।

বলে, ধুরও। আমাদের অত ক্যাশ টাকা কই? তা ছাড়া, আগামী বছর ফারিয়াকে স্কুলে দিতে হবে। তখন খরচ আরও বাড়বে। রুমা মরিয়া হয়ে বলে, সেটা আমি দেখব। দরকার হলে আমি রেজওয়ান ভাইকে রিকোয়েস্ট করব।

রিকোয়েস্ট করব। মানে! মানে ...তোমার বন্ধু যখন। বন্ধু ঠিক না। ক্লাসমেট ছিল রেজওয়ান। বুঝলাম।

একদিন রেজওয়ান ভাইকে আমাদের বাসায় দাওয়াত করলে কেমন হয়? ফারুক ইতস্তত করে বলে, রেজওয়ান খুব ব্যস্ত থাকে। বিয়ের সময় ইনভাইট করেছিলাম। আসতে পারেনি ব্যস্ততার জন্য। ও কি আসতে পারবে? আহা, ব্যস্ত থাকে বলে এক বেলার জন্য বন্ধুর বাড়িও আসতে পারবে না। আশ্চর্য তো! বেশ ক’বার টেলিফোন করে রুমার কথা বলার পর শুক্রবার দুপুরে রেজওয়ান এল ।

একাই এল। রেজওয়ান-এর শ্বশুরবাড়ি টাঙ্গাইল। তিন দিন ধরে বউবাচ্চা নাকি সেখানেই। রেজওয়ান দেখতে বেঁটে, মোটা আর থলথলে; গায়ের রং মিশমিশে কালো, এই বয়েসে মাথায় টাকও পড়েছে ; বেজায় গরমের মধ্যে ধূসর রঙের কোট পরে আছে। রেজওয়ান কে দেখে এমন মিষ্টি করে হাসল রুমা- যেন পৃথিবীর সবচে সুদর্শন পুরুষটিকে দেখছে।

রেজওয়ান-এর মুগ্ধ চোখ রুমার শরীরে একবার ঘুরে যায়। রুমা দেখতে ফরসা, টল, নাকমুখ কাটা-কাটা -এক কথায় ক্ল্যাসিক বিউটি। কালো ব্লাউজের সঙ্গে নীল রঙের কাতান পরেছিল আজ। ফারুক টের না পেলেও রেজওয়ান এর মুগ্ধতা রুমা টের পেল ঠিকই। কিংবা ব্যাপারটা ফারুক টের পেলেও এড়িয়ে গেল।

ফুল আর কেক-মিষ্টি ছাড়াও ফারিয়ার জন্য অনেক গিফট এনেছে রেজওয়ান । খেলনা পেয়ে চার বছরের ফারিয়া ভীষণই খুশি। ‘আঙ্কেল’, ‘আঙ্কেল’ বলে মুখে খই ফুটছে। । ফারিয়াকে কোলে নিয়ে আদর করল রেজওয়ান।

বারবার বলল, কী সুইট! কী সুইট! খেতে বসে চমৎকৃত হল রেজওয়ান । খাবার টেবিলটা ভরে আছে ওর প্রিয় সব খাবারে। ধোঁওয়া-ওঠা সরু চালের ভাত, পটোল ভাজি, কই মাছ ভাজা, পটোল দিয়ে রুই মাছের তরকারী, টাকি মাছের ভর্তা, রুই মাছের ডিম দিয়ে করলা ভাজি, ধনে পাতা দিয়ে ঘন ডাল, গুড়ের সন্দেশ এবং রসমালাই। ইয়া আল্লা! সব যে আমার প্রিয় খাবার। তুমি কি ভাবে জানলে? রুমার দিকে তাকিয়ে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল রেজওয়ান ।

আপনার বন্ধুর কাছে জেনে নিয়েছি। আচ্ছা। আরেকটা মাছ নিন রেজওয়ান ভাই। রুমা আদুরে গলায় বলে। আরে না না, আমি অত খেতে পারব না।

বয়েস হচ্ছে না। কি এমন বয়েস। আচ্ছা নিচ্ছি, নিচ্ছি । এত করে যখন বলছ । বলে রেজওয়ান হাসল।

তৃপ্তি বোধ করছে। তার পয়সা হয়েছে। এখন দরকার প্রচুর আমোদ। মানে, অ্যামুজমেন্ট। আজ সেরকমই একটা আমোদ মাখা দিন ।

রান্না কিন্তু সব আমিই করেছি। বলে রেজওয়ান এর চোখের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকাল রুমা। আচ্ছা। তারপর রুমা সামান্য চেঁচিয়ে বলল, সাবিনা! সাবিনা! বোরহানির জগটা আন তো। রেজওয়ান উচ্ছসিত হয়ে বলে, বাহ! বোরহানিও আছে! আপনি যে বোরহানি খুব পছন্দ করেন সেটাও ওর মুখেই শুনেছি।

হুমম। রান্নাঘর থেকে সাবিনা বোরহানির জগ নিয়ে আসে। রুমা বলল, বোরহানিও আমিই করেছি। তবে টেস্ট কেমন হয়েছে বলতে পারি না। তুমি তো দেখছি খুবই গুণি মেয়ে।

রুমা হাসল। আড়চোখে ফারুকের দিকে তাকাল। ফারুক মাথা নীচু করে খেয়ে যাচ্ছে। ফারুক বলল, আমাদের বিয়ের পর রুমা মায়ের কাছে অনেক রান্না শিখেছে। মাথা নেড়ে রুমা বলল, হ্যাঁ, রেজওয়ান ভাই ।

ফারিয়া হওয়ার আগে মা ঢাকায় এসে কিছুদিন থেকে ছিল। তখনই শিখেছি। বুঝলাম। রেজওয়ান হেসে বলল। তা, রুই মাছের ডিম দিয়ে করলা ভাজি কি চাঁদপুরের লোকে খায়? না।

তাহলে? আমি সিরাজগঞ্জের মেয়ে রেজওয়ান ভাই। ওহ্ । জান তো আমার দেশের বাড়ি সিরাজগঞ্জের শাহাদাতপুরে। হেসে বলল রেজওয়ান। হ্যাঁ, জানি।

ঝকঝকে দাঁত বের করে মিষ্টি হেসে রুমা মাথা নাড়ল। ওর বুকটা ভীষণ কাঁপছে। তা খালাম্মা এখন কই রে ফারুক? চাঁদপুরে। হাইমচরে আমাদের কিছু জমিজমা আছে। ১৯৯৯ সালে আব্বা মারা যাওয়ার পর সেই জমির ওপর স্থানীয় লোকজনের কুনজর পড়েছে।

মা-ই দেখাশোনা করছে। আমি মাঝেমধ্যে যাই। ও। কত জমি? রেজওয়ান -এর চোখ সরু হয়ে ওঠে। ভালোই।

চৌদ্দ-পনেরো কানি তো হবেই। খাওয়ার পর সোফায় এসে বসল ওরা । গিফট পেয়ে ফারিয়া রেজওয়ান এর আশেপাশে ঘুরঘুর করছিল। রুমা সাবিনাকে ইঙ্গিত করল। সাবিনা এসে ফারিয়াকে নিয়ে গেল ।

ফারিয়া চলে যেতেই আয়েস করে সিগারেট ধরাল রেজওয়ান । তার বসার ভঙ্গিটা বেষ আয়েসী। এই বয়েসেই ভূঁড়িটা বেশ উছল হয়ে উঠেছে। রেজওয়ান-এর পাশে ঠিক সোফার ওপর একটা নকিয়া N79; তার বাদামী রঙের নিশান পাথফাইন্ডার এই সরু গলিতে ঢুকেনি। ড্রাইভার বড় রাস্তায় পার্ক করে রেখেছে।

রেজওয়ান বেশ স্বস্তিতেই আছে বোঝা যায়। পরবর্তী ঘটনাক্রম বেশ আঁচ করতে পারছে সে। এ শহরের সে একজন শিকারী মানুষ, জমিজমা শিকার করে, সে জমির বিচিত্র চরিত্রের মালিকের সঙ্গে ডিল করে, সুকৌশলে সাত-পাঁচ বুঝিয়ে তাদের জমি কব্জা করে নেয়, দেরিতে ফ্ল্যাট হস্তান্তর করে, তার আগে ব্যাংক কর্মকর্তাদের যাদুবলে আচ্ছন্ন করে ব্যাঙ্ক থেকে লোন নেয়। রাত্রিতে সুখে ঘুমায়। প্রায়ই বিদেশ ট্রিপ তো আছেই।

রান্নাঘর থেকে ফিরে এসে সোফায় বসল রুমা । তারপর সাহস সঞ্চয় করে বলল, রেজওয়ান ভাই। বল। আমাদের ঘরবাড়ির অবস্থা তো দেখছেনই। রেজওয়ান চুপ করে থাকে।

আপনার বোনের জন্য কিছু করবেন না? কি করতে বল শুনি? মিটমিট করে হাসছে রেজওয়ান । রুমার ফর্সা পেলব শরীরে ঘুরছে চোখ। রুমা বলল, আপনাদের নতুন প্রজেক্টে আমাদের একটু ঠাঁই করে দিন না। নতুন প্রজেক্ট মানে- সেগুনবাগিচার দীপায়ন টাওয়ার-এর কথা বলছ? হ্যাঁ। ওখানেই আমাদের একটা ফ্ল্যাটের ব্যবস্থা করে দিন না।

প্লিজ। টিভিতে দীপায়ন টাওয়ার-এর অ্যাড দেখেছ? হ্যাঁ। কেমন লাগল? ভালো। আমায় আইডিয়া। রেজওয়ান-এর কন্ঠস্বরে গর্বের ভাব ফুটে উঠল।

আপনি না রেজওয়ান ভাই ভীষণ ভীষণ গুণী মানুষ। রেজওয়ান হাসল। তারপর গম্ভীর কন্ঠে বলল, দীপায়ন টাওয়ার-এ তে একটা সমস্যা আছে। কি সমস্যা? রুমার বুকটা ধক করে ওঠে। নীচের দিকে ফ্ল্যাট একটিও খালি নেই।

সব বিক্রি হয়ে গেছে । ভূমিকম্পের ভয়ে ক্রেতারা ওপরের দিকে যেতে চায় না । টপ ফ্লোরে এখনও দু-তিনটি ফ্ল্যাট অবশ্য খালি আছে। তোমরা কি অত ওপরে থাকবে? টপ ফ্লোর-মানে ষোল তলায়? হ্যাঁ। ষোল তলায়।

ওহ্, ফাইন। আমার ওপরের দিকেই ভালো লাগে রেজওয়ান ভাই। অনেক খোলামেলা। বলে রুমা হাততালি দেয়। ওকে, ফাইন।

রেজওয়ান হাসল। ঝুঁকে সিগারেটের ছাই ঝাড়ল। খুশিতে থরথর করে কাঁপছিল রুমা । বলল, তাহলে আমাদের ফ্ল্যাট দেখানোর ব্যবস্থা করে দিন রেজওয়ান ভাই। প্লিজ।

রেজওয়ান মাথা নেড়ে বলল, দেব। আগামী রোববার দীপায়নের প্রজেক্ট অফিসারের সঙ্গে কথা বলে তোমাদের ফ্ল্যাট দেখাবার ব্যবস্থা করে দেব। সেই তোমাদের সেগুনবাগিচায় নিয়ে যাবে। আমার হয়তো সময় হবে না। রেজওয়ান চলে যাওয়ার সময় বড় রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এল ফারুক ।

পুরনো বন্ধুর সঙ্গে ফ্ল্যাট সংক্রান্ত জরুরি কিছু কথাবার্তাও সেরে নিল। ফিরে এসে সিগারেট ধরাল ফারুক । রুমা অধীর হয়ে ছিল। জিজ্ঞেস করে, ফ্ল্যাটের কেমন দাম বললেন রেজওয়ান ভাই? সেগুনবাগিচায় ফ্ল্যাটের দাম অনেক। প্রায় সাড়ে তিন হাজার টাকা স্কয়ার ফিট।

রেজওয়ান অনেক কমিয়ে ধরেছে। কত? তাও গ্যারেজ আর রেজিস্ট্রির খরচ সহ পঞ্চাশ পড়ে যাবে। বলে এক মুখ ধোঁওয়া ছাড়ল ফারুক। পঞ্চাশ লাখ! হ্যাঁ। আর কি বললেন রেজওয়ান ভাই? রুমার বুক কাঁপছে।

বলল যে, ডাউনপেমেন্ট হিসেবে এখনই কিছু ক্যাশ টাকা ম্যানেজ করে দিতে পারলে ভালো হয়। তাহলে সময় মতো কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে সমস্যা হলে রেজওয়ান ম্যানেজ করবে। ডাউনপেমেন্ট হিসেবে কত দিতে হবে? অন্তত ৮/১০ লাখ। অত! হুমম। কি আর করা।

ফারুক এক মুখ ধোঁওয়া ছেড়ে বলল। রুমা হিসহিস করে বলল, আমাদের সিরাজগঞ্জের জায়গাজমি তো বোনদের ঠকিয়ে হারামজাদা ভাইয়েরা লুঠপাঠ করে নিল। ওই কুত্তাগুলার মুখ দেখতে ইচ্ছা করে না আমার! এখন তোমাদের চাঁদপুরের জমাজমি বিক্রি করা ছাড়া উপায় নেই। জমি বিক্রি করতে সহজে রাজী হবে না মা । সেন্টিমেন্ট।

বাবার স্মৃতি। ফারুক দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। মাকে যে ভাবেই হোক বোঝাতে হবে। রুমার অস্থিরতা টের পায় ফারুক। সে অস্থিরতা ওর ভিতরেও সংক্রামিত হয়।

বলল, আগেও তো বুঝিয়েছি। লাভ যে হয়নি তা তুমিও জান। রুমা বলল, কালই তুমি একবার হাইমচর যাও। হাইমচর যাব? কেন? হাইমচর গিয়ে তোমার মাকে বল যে তোমার হাটের্র অসুখ ধরা পড়েছে। ডাক্তার বলেছেন ট্রিটমেন্টের জন্য যত শিগগির সম্ভব বিদেশে যেতে ।

এখন অনেক টাকা লাগবে। পাসপোর্ট ভিসা সব তৈরি। এখন জমি বিক্রি করতে হবে। রুমার প্ল্যানটা শুনে ফারুকে মুখে গভীর চিন্তার ছাপ পড়ে। বলে, মাকে মিথ্যা বলব? হ্যাঁ, বলবে।

কারণ জমির আসল মালিক তুমি! জমি আমার একার না রুমা, মা ছাড়াও জমিতে সালমারও ভাগও আছে। তোমার ছোট বোন খুলনা থাকে। যখন চাইতে আসবে তখন দেখা যাবে। আচ্ছা শোন। ভিটেমাটি, পুকুর তো আর বিক্রি করা যায় না।

তোমার বোনকে বল যে ভিটেমাটি আর পুকুর তোর। কাজটা কি ঠিক হবে? তার মানে তুমি এই থার্ড ক্লাস বাড়িতে থেকে পচে মরতে চাও? অসহ্য! রুমা চিৎকার করে ওঠে। ফারুক চুপ করে থাকে। রোববার। সকাল সাড়ে ন’টার মতো বাজে।

অফিসে বসে কাজ করছিল ফারুক। কাজে অবশ্য মন বসছিল না। বারবার মায়ের মুখটা ভাসছিল। রুমার প্ল্যান অনুযায়ী কাল ভোরের লঞ্চে হাইমচরে রওনা হবে সে - যে মেঘনাপাড়ের হাইমচরে শৈশব কেটেছে তার। সর্ষে ক্ষেতের পাশ দিয়ে দৌড়ে যাওয়ার স্মৃতি আজও স্বপ্নের ভিতরে ভেসে ওঠে।

মা উঠানে রোদে বসে ইলিশ কুটছেন কিংবা বাবা কাঁঠাল কিনে হাট থেকে ফিরেছে কিংবা বাবা চাঁদপুর শহরে গিয়েছেন, এখনও ফিরছেন না, রাত হয়েছে-মার সে কী উদ্বেগ কিংবা চাচতো বোন সহেলী আপার বিয়ের সময় ষাটনল থেকে লঞ্চ করে দুলামিঞা এল ...কিংবা বিকেল বেলা স্কুলের মাঠে নাড়কেলের মালায় শক্ত কালো সুতো পেঁচিয়ে ঘুড়ি ওড়ানো ... সন্ধ্যায় বাড়িতে ফেরা, লোকে বলে মির্দাবাড়ি- সেই মির্দাবাড়ি এখন শূন্য, খাঁ খাঁ করে । জীবনের অজস্র টুকরো টুকরো স্মৃতি আঁকড়ে ধরে আছে মা। সেই মাকে কাল মিথ্যে কথা বলবে ফারুক- হার্টে সমস্যা ধরা পড়েছে, ট্রিটমেন্টের জন্য বিদেশে যেতে হবে ... অনেক টাকা লাগবে। এ কথা বললে মা জমি বেচতে রাজি হবে। তারপর মোটা টাকা নিয়ে শহরে ফিরে আসবে ফারুক।

জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে জমিজমা হারিয়ে কতদিন বেঁচে থাকবে মা কে জানে। নীরব আর্তিতে জীবনের শেষ দিনগুলি পাড়ি দিয়ে হাইমচরে একটি পরিবারের ইতি টানবে মা। ফোন বাজল। সংবিৎ ফিরে পেল ফারুক। রেজওয়ান ।

বলল, হ্যালো, ফারুক? হ্যাঁ, বল। ওর বুকটা কাঁপছে। আমি দীপায়ন টাওয়ার আছি। তুই একটা রিকশা নিয়ে চলে আয়। ফারুক বলল, দোস, আমি এখন যেতে পারছি না রে।

কেন? সাড়ে ১০টায় এমডি স্যারের রুমে মিটিং। ওহ হো। ফারুক বলল, রুমাকে পাঠাচ্ছি। আসলে এসব তো ওর ব্যাপার। ওকে।

কুইক। রেজওয়ান ফোন কেটে দিল। রুমাকে ফোন করে ফারুক । হাত কাঁপছিল তার। হ্যালো, রুমা।

হ্যাঁ, হ্যালো বল। শোন, রুমা। এই মাত্র রেজওয়ান ফোন করেছিল। ও এখন দীপায়ন টাওয়ার আছে। আমাকে যেতে বলল, আমি যেতে পারছি না, খুব ব্যস্ত আছি, তুমি গিয়ে ফ্ল্যাটটা দেখে আস।

জলদি কর। যাচ্ছি। রুমা ফোন কেটে দিল। এর পর আর কাজে মন বসল না। ঘন ঘন জানালার দিকে তাকাচ্ছে ফারুক।

জানালায় এপ্রিলের রোদ। ওখানে দাঁড়ালে সেগুনবাগিচায় ষোল তলা বহুতলটি চোখে পড়ে। এলোমেলো ভাবনায় সময় কেটে গেল। ১১টার মতো বাজে। জানালার কাছে চলে আসে ফারুক।

রোদ ঝলমল করছিল। দূরে ধূসর আকাশের নীচে স্বপ্নের টাওয়ারটি দাঁড়িয়ে। স্বপ্নের বহুতলের দিকে তাকায় ফারুক। রুমার এরই মধ্যে দীপায়ন টাওয়ার -এ পৌঁছে যাওয়ার কথা। কী মনে করে রুমাকে একবার ফোন করল ফারুক।

রুমার ফোন বন্ধ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.