আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সেই মসলিন শাড়িটা

পথের প্রান্তে আমার তীর্থ নয় ,,,,,পথের পাশেই আছে মোর দেবালয়
আলমারী খুলে কাপড় ভাজ করছে নীলা । অনেক দিন হয় গোছানো হয়নি। কাপড়গুলো শুধু বের করে পড়েছে আবার খুলে ভাজ করে গুজে রেখেছে। এক্কেবারে যা তা অবস্থা। আজ বাসায় কেউ নেই, রান্না বান্নার ঝামেলা কম, তাই ভাবলো এটাই সুযোগ আলমারীটাকে মানুষ করার।

গুন গুন করে গাইছে লতার গাওয়া একটি প্রিয় গান... 'যা...রে যারে উড়ে যারে পাখী... ফুরালো গানের মেলা শেষ হয়ে এল বেলা....' এক সময় গান শোনা আর অল্প সল্প গাওয়ার অভ্যাস ছিল। সংসারের যাঁতাকলে অনেক কিছুর সাথে এরও সমাপ্তি ঘটেছে। কত হাবিজাবি শাড়ী যে জমেছে, কাউকে দিয়ে দিলেই হয় ভাবছে নীলা। কিন্ত প্রত্যেকটাই মনে হয় কোনো না কোনো স্মৃতি জড়ানো। এটা বিয়ের বেনারসী শাড়ী, এটাতো সারা জীবনের স্মৃতি।

এ শাড়ী কি কাউকে দেয়া যায় ! এই পার্পল বালুচরীটা প্রথম বিবাহ বার্ষিকীতে দেয়া, এটাও দেয়া যাবেনা। এই শাড়িটা ছেলে তার আট বছরের জন্মদিনে টাকা পেয়ে জোর করে নীলার হাতে দিয়ে বলেছিল 'আম্মু এটা দিয়ে তুমি একটা শাড়ী কিনো',একটা কোটা শাড়ি কিনেছিল সে। এমন নানান স্মৃতির চিন্হগুলো ভাজ করে করে রাখছে নীলা.... 'আকাশে আকাশে উড়ে, যা ফিরে আপন নীড়ে, শ্যামল মাটির বনছায়...। হঠাৎ চোখে পড়লো র‌্যাপিং পেপারে মোড়ানো একটা শাড়ির বক্স ! কি ব্যাপার এটা দেখছি খোলাই হয়নি! তাড়াতাড়ি করে বক্সটার সুতো খুলে ঢাকনাটা তুলতেই ভুত দেখার মত চমকে উঠলো নীলা! বাক্সের ভেতর তুঁত রঙের এক অপরূপ কারুকাজ করা মসলিন শাড়ি। হাতটা আস্তে করে রাখলো অপুর্ব সুন্দর এই শাড়িটার উপর।

নরম মসলিন এখনও তেমনি নরম আছে প্রথম দিনের মতই । কত বছর আগের কথা ,কেমন আছে সে! নীলার কথা কি মনে আছে তার ! নাকি নীলাও তার মন থেকে স্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছে । হাত বুলিয়ে শাড়ি থেকে ধুলা ঝাড়ার মত মন থেকেও ধুলার পর্দা সরিয়ে বের করছে সেই কত বছর আগের কথা। কি জেদ তাঁর, জন্মদিনে একটা শাড়ী সে কিনে দেবেই। নীলার কোনো বাঁধাই সে মানবেনা।

তাও আবার নীলাকেও সাথে যেতে হবে। শাড়ির দোকানে এসে ফোন 'কি ব্যাপার এখনও আসলে না! আমি কখন থেকে বসে আছি'। নীলা দৌড়ে গিয়ে লিফ্ট দিয়ে নেমে গাড়ীতে উঠে ড্রাইভারকে বল্লো 'জোরে চালাও'। শাড়ির দোকানটা বাসার কাছে, হেটেই যাওয়া যায়। এতটুকু ধৈর্য্য যেন দুজনের কারোই নেই।

এক মিনিটে গন্তব্যে পৌছে দোকানের দরজাটা টেনে খুলেই দেখতে পেল, সে বসে আছে। তাকে দেখেই এক মুখ হাসি নিয়ে চেয়ার থেকে উঠে আসলো। কাছে এসে সবার চোখ এড়িয়ে একটু আলতো করে জড়িয়ে ধরে বল্লো,'এত দেরী কেন শুনি ! কখন থেকে বসে আছি! 'কই দেরী হলো! তোমার ফোন পাওয়ার সাথে সাথেই তো দৌড়ে আসলাম'। নীলার ভীষন লজ্জা লাগছে আবার খুব ভালোও লাগছে। সে কোনোদিকে চাইতে পারছেনা, মনে হচ্ছে সবাই তার খুশী ঝলমল মুখ দেখেই বুঝি বুঝে ফেলবে ওকে সে কত ভালোবাসে।

ডিসপ্লে করা শাড়িগুলো একটার পর একটা সে তুলে ধরছে আর বলছে ' এখন বলো কোনটা তোমার পছন্দ'? নীলার একটাই কথা, 'বাদ দাও আমার শাড়ির দরকার নেই, আমি শুধু তোমাকে দেখবো বলে এসেছি'। তার একটাই কথা 'তোমাকে নিতেই হবে' । অনেক দেখার পর নীলা যখন এই মসলিন শাড়িটায় হাত দিয়েছে তখন সে বল্লো 'এটা তোমার পছন্দ হয়েছে ঠিক আছে এটাই নেবো' নীলা লজ্জা পেয়ে বল্লো 'না না আমি এমনি দেখছিলাম'। কে শোনে কার কথা। নিজেই শাড়িটা হ্যাঙ্গার থেকে নামিয়ে প্যাকেট করে দিতে বল্লো সেলসম্যানকে ।

কিন্ত বেশ দামী দেখে নীলার খারাপ লাগছিল। । শাড়িটা প্যাকেট করে দিতেই সে তার হাতে দিয়ে বল্লো 'এই নাও তোমার জন্মদিনের উপহার'। নীলা রেখে দিয়েছে শাড়িটা আলমারীতে। ওর সাথে যেদিন বাইরে যাবে সেদিন পড়বে।

'নীলা চলোনা আজ দুজনে মিলে বাইরে কোথাও খেতে যাই'। কিন্ত সেখানে কি এমন পার্টি শাড়ি পড়ে যাওয়া যায় , পড়া হলোনা। 'নীলা নিউ মার্কেটে আসো না, তোমার সাথে দেখা হবে, কতদিন তোমাকে দেখিনা!' মার্কেটে কি এমন শাড়ী পড়ে যাওয়া যায় ! কত ছোটোখাটো জায়গায় ঘোরাঘুরি হলো, লেকের পাড়ে হেটে যাওয়া । চন্দ্রিমায় বাদাম খাওয়া , কোনো জায়গাই যেন এই দামী শাড়ি পড়ার উপযুক্ত না। শাড়িটা যত্নের সাথে আলমারীর তাকে রাখা আছে আর এই রঙের সাথে মিলিয়ে পড়ার জন্য নানা রকম চুড়ি, কানের দুল, মালা।

কত দোকান ঘুরে ঘুরে কিনে এনেছে সে এগুলো। এর মধ্যে কি হলো ! সামান্য একটু ভুল বোঝাবুঝি, একটু কথা কাটাকাটি , সব কিছু ভেঙে গেল যেন তাসের ঘরের মত। ঘন্টার পর ঘন্টা ফোনে আলাপ মনে হয় স্বপ্ন। কত হাজার এস এম এস, এখন ভাবলে মনে হয় কল্পনা। ।

তারপর স্মৃতির চোরাবালির নীচে সব কিছু আস্তে আস্তে ঢেকে যাওয়া। শাড়িটাও যেন হারিয়ে গেল কত শত শাড়ির ভাজে। আজ এত বছর পরে সেই শাড়িটা কোথা থেকে এসে সবকিছু উলট পালট করে দিয়ে গেল নীলার জীবনে। শাড়িটা বুকে জড়িয়ে ধরে একাকী বাসায় হাহাকার করে কেঁদে উঠলো নীলা, যার সাক্ষী হয়ে রইলো শুধু অফ হোয়াইট কালারের দেয়ালগুলো আর চোখের পানিতে ভিজে যাওয়া সেই মসলিন শাড়িটা। *** লেখকঃ মাহজাবীন জুন।


 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।