আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিদায় হজ ও রাসুল (সঃ)-এর ভাষণ

Mahmood Khan

মদিনায় হিজরতের সময় থেকে হিজরি সাল গণনা করা হয়। সে হিসাবে দশম হিজরির জিলকদ মাসে রাসুলে পাক (সঃ) হজ পালন করেছিলেন। তিনি হজে যাওয়ার এরাদা পেশ করার পর সংবাদটি পলকের মধ্যে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। সারা আরবের সব সাহাবায় কেরাম (রাঃ) হজে অংশগ্রহণের জন্য উদ্বেলিত হয়ে উঠলেন। জিলকদের ২৬ তারিখ রোজ শনিবার রাসুলে পাক (সঃ) গোসল করলেন।

তারপর তিনি লুঙ্গি ও চাদর পরিধান করলেন। জোহর নামাজ আদায় করার পর মদিনা থেকে দুই মাইল দূরে জুলহুলাইফা নামক একটি স্থান আছে। মদিনাবাসীদের হজের এহরাম বাঁধার মিকাত এটাই। এখানে পৌঁছে রাত কাটালেন। পরদিন আবার গোসল করলেন।

হজরত আয়েশা (রাঃ) নিজ হাতে রাসুলে পাক (সঃ)-এর দেহ মুবারকে আতর মেখে দিলেন। তারপর রাসুলে পাক (সঃ) দুই রাকাত নামাজ আদায় করলেন। অতঃপর ‘কাসওয়া’ নামক উটনীর পিঠে আরোহণ করে হজের এহরাম বাঁধলেন। তারপর বুলন্দ আওয়াজে পাঠ করতে লাগলেন, ‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইকা, লাব্বাইকা-লা শারিকালাকা লাব্বাইকা ইন্নাল হামদা অননি মাতালাকা অল মুলকা লা শারিকালাকা’। অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমি হাজির হয়েছি, হে আল্লাহ! আমি হাজির হয়েছি, হে আল্লাহ! আমি হাজির হয়েছি এবং ঘোষণা করছি, তোমার কোনো অংশীদার বা শরিক নেই।

হে আল্লাহ! আমি হাজির হয়েছি নিশ্চয়ই সমুদয় প্রশংসা ও নিয়ামত তোমারই জন্য নিবেদিত এবং আধিপত্য ও সার্বভৌমত্ব কেবল তোমারই জন্য। তোমার কোনো অংশীদার নেই। হজরত জাবের (রাঃ) এই হাদিসটি বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, আমি তাকিয়ে দেখলাম ডানদিকে এমনকি সর্বত্র জনতার ঢল নেমে এসেছে। বস্তুত রাসুলে পাক (সাঃ) যখন লাব্বাইকা শব্দটি উচ্চারণ করতেন, তখন সঙ্গে সঙ্গে সহস্রকণ্ঠে একই শব্দ ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে পাহাড়-পর্বত ও প্রান্তর প্রকম্পিত করে তুলতো। মক্কা বিজয়ের প্রাক্কালে রাসুলে পাক (সঃ) যেসব স্থানে অবস্থান করে নামাজ আদায় করেছিলেন, সেসব স্থানে প্রাণপ্রিয় লোকজন বরকতের নিয়তে বহু মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন।

হজের যাত্রাপথে রাসুলে পাক (সঃ) সেসব স্থানে যাত্রাবিরতি করে নামাজ পড়েছেন। তারপর ‘সরফ’ নামক স্থানে পৌঁছে রাসুলে পাক (সঃ) গোসল করলেন। পরদিন রোববার জিলহজ মাসের ৪ তারিখ সুবহে সাদেকের সময় তিনি পবিত্র মক্কায় প্রবেশ করলেন। মদিনা থেকে মক্কা পর্যন্ত এই সফর ৯ দিনে অতিক্রম করেছিলেন। বনু হাশেমের শিশু-কিশোররা রাসুলে পাক (সাঃ)-এর আগমনের সংবাদ শুনে খুশিতে মাতোয়ারা হয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছিল।

রাসুলে পাক (সঃ) স্নেহ বাৎসল্যে কাউকে উটের পিঠে-সামনে এবং কাউকে পেছনে বসিয়ে নিয়েছিলেন। তারপর যখন কাবা শরিফ নজরে পড়লো তখন তিনি দোয়া করলেন, হে আল্লাহ! আপনি এই গৃহের ইজ্জত, সম্মান ও মর্যাদা বাড়িয়ে দিন। অতঃপর কাবা শরিফ তাওয়াফ করলেন এবং মাকামে ইব্রাহীমে দুই রাকাত নামাজ আদায় করলেন। তারপর এই আয়াত পাঠ করলেন- ‘আত্তাখিজু মিম্মাক্বামি ইব্রাহীমা মুছাল্লা’ অর্থাৎ মাকামে ইব্রাহীমকে তোমরা নামাজের স্থান হিসেবে গ্রহণ করো। তারপর ৮ জিলহজ বৃহস্পতিবার সব মুসলমানকে সঙ্গে নিয়ে রাসুলে পাক (সঃ) মিনায় চলে গেলেন।

তারপর ৯ জিলহজ শুক্রবার দিন ভোরে নামাজ পড়ে আরাফাতের দিকে রওনা হলেন। ওই দিনটিই ছিল ইসলামের গৌরব এবং মর্যাদা বিকাশের দিন। যার ফলে অন্ধকার যুগের যাবতীয় অহেতুক ও বাতিল কাজকর্ম বিলুপ্ত হয়ে গেল। রাসুলে পাক (সঃ) ইরশাদ করলেন, জেনে রেখো, অন্ধকার যুগের সব প্রথা ও কুসংস্কার আজ আমার পদতলে সংস্থাপিত হলো। রাসুলে পাক (সঃ) ইরশাদ করলেন, হে লোকগণ! অবশ্যই তোমাদের প্রতিপালক এক এবং তোমাদের পিতাও এক; সুতরাং আরবের কোনো আজমের ওপর প্রাধান্য নেই।

শ্বেত বর্ণের লোকের কালো বর্ণের লোকের ওপর এবং কালো বর্ণের লোকের শ্বেত বর্ণের লোকের ওপর কোনোই প্রাধান্য নেই; কিন্তু তাকওয়া ও পরহেজগারি হলো মর্যাদার একমাত্র মানদন্ড। তারপর রাসুলে পাক (সঃ) বললেন, প্রত্যেক মুসলমান একে অন্যের ভাই এবং সব মুসলমান ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ। অতঃপর রাসুলে পাক (সঃ) বললেন, ‘হে লোকগণ! তোমরা নিজেরা খাবে তা তোমাদের গোলামদেরও খেতে দেবে। যা তোমরা পরিধান করবে তা তাদেরও পরিধান করাবে। আরবে কোনো বংশের কেউ যদি কারো হাতে নিহত হতো তবে এ হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ করা বংশের ওপর অপরিহার্য হয়ে দাঁড়াতো।

এমনকি হাজার বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও এই ফরজ অবশিষ্ট থাকতো। এতে করে যুদ্ধ ও রক্তপাতের এক অনন্তকালীন অধ্যায়ের সূচনা হতো। এ কারণে আরবের জমিন সর্বদাই রক্তে রঞ্জিত থাকতো। তাই এসব আরবের পুরনো পদ্ধতি ও লোকাচার, আভিজাত্যবোধ, বংশের গৌরব গাথার রেশ সর্বাংশে খতম করা হলো। এর জন্য নবুয়তের এই ঘোষণা বিশ্ববাসীর সামনে সত্যিকার আদর্শের নমুনা পেশ করলো।

এ পরিপ্রেক্ষিতে ঘোষণা করা হলো, অন্ধকার যুগের সব রক্তপাত বাতিল করে দেয়া হলো এবং সর্বপ্রথম আমি আমার বংশের রক্ত অর্থাৎ রাবিআ বিন হারেছের রক্তশোধ বাতিল ঘোষণা করলাম। অন্ধকার যুগের সর্ব প্রকার সুদের কারবার বাতিল করা হলো এবং সর্বপ্রথম আমার নিজের বংশের সুদ অর্থাৎ আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিবের সুদি কারবার বাতিল ঘোষণা করা হলো। স্মরণ রাখা দরকার যে, রাসুলে পাক (সঃ)-এর চাচা আব্বাস (রাঃ) ইসলাম গ্রহণের আগে সুদের কারবারে জড়িত ছিলেন। সে সময় সব লোকের কাছেই তিনি সুদের টাকা পাওনাদার ছিলেন। রাসুলে পাক (সঃ) তা বাতিল করে দিলেন।

ঘোষণা করলেন, তোমরা নারীদের বিষয়ে আল্লাহকে ভয় করো। অবশ্যই তাদের হক তোমাদের ওপর আছে এবং তোমাদের হকও তাদের ওপর আছে। আরবের জানমালের কোনো মূল্য ছিল না। তারা ইচ্ছানুযায়ী যাকে ইচ্ছা তাকেই হত্যা করতো এবং মানুষের কাছ থেকে জোরপূর্বক ধন-সম্পদ ছিনিয়ে নিতো। তাই শান্তি ও নিরাপত্তা প্রদানকারী সম্র্রাট রাসুলে পাক (সঃ) সারা দুনিয়ার সামনে সন্ধি, স্বস্তি ও নিরাপত্তার আশ্বাস প্রদান করলেন এবং ঘোষণা করলেন, তোমাদের ধন-সম্পদ, তোমাদের রক্ত কিয়ামত পর্যন্ত এমনি হারাম যেমন- এই মাসে, এই দিনে, এই স্থানে এসব বস্তু হারাম।

এই নির্দেশ তোমাদের আল্লাহপাকের সামনে হাজির হওয়া পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। আমি তোমাদের কাছে একটি জিনিস রেখে যাচ্ছি। তোমরা তা দৃঢ়ভাবে ধরে রাখলে কখনো পথভ্রষ্ট হবে না। ওই বস্তুটি হলো আল্লাহর কিতাব। এরপর রাসুলে পাক (সঃ) কিছু বিধান জারি করলেন।

হুকুম করা হলো- আল্লাহপাক সব হকদারকে তাদের ন্যায্য হক প্রদান করেছেন; সুতরাং এখন কোনো উত্তরাধিকারীর জন্য অছিয়ত করার দরকার নেই। জেনে রেখো, ছেলে ওই ব্যক্তির বলেই সাব্যস্ত হবে- যার শয্যায় সে জন্মলাভ করেছে। আর ব্যভিচারের শাস্তি হলো প্রস্তরাঘাতে হত্যা করা এবং তার হিসাব আল্লাহপাকই গ্রহণ করবেন। আর যে ছেলে নিজের পিতার বদলে অন্য কারো ঔরসে জন্ম নিয়েছে বলে দাবি করে এবং গোলাম স্বীয় মনিব ছাড়া অন্য কারো মালিকানায় নিজেকে সংযুক্ত করে তার ওপর আল্লাহর অভিসম্পাত অবধারিত। ধার করা বস্তু অবশ্যই ফেরত দিতে হবে।

কিছু ভুল হলে সঠিকটা বলে দেবেন। সাধারন মানুষেরই ভুল হয়। আমি বিচ্ছিন্ন কেউ না।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.