আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আজব গুজবে কুপকাত



অপরাজিত বন্দ্যোপাধ্যায় যৌনাঙ্গ ছোট হওয়ার গুজব উত্তরবঙ্গ ছড়িয়ে দক্ষিণবঙ্গ পৌঁছালো। একটি সামান্য গুজব ইদানিং সময়ে কার্যত গণ হিস্টেরিয়ার রূপ পাচ্ছে। শুক্রবার থেকে পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চসহ বিভিন্ন যুক্তিবাদী সংগঠন এই গুজবের প্রতিরোধে ব্যপক সচেতনা অভিযানে নামছে। পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক সত্যজিৎ চক্রবর্তী জানিয়েছেন, আক্রান্ত জেলাগুলোকে চিহ্নিত করা হয়েছে। সেইসব জেলার বিভিন্ন এলাকার জনমানসে বিভ্রান্তি কাটানোর প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

এদিকে যৌনাঙ্গ সংকোচনের গুজব কীভাবে ছড়িয়ে পড়ছে তার ওপর নজর রাখতে শুরু করেছে সি আই ডি’র গোয়েন্দারা। এই অপপ্রচারের পিছনে কোন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বা সমীক্ষক গোষ্ঠী স্বার্থ জড়িত আছে কিনা তা একযোগে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা জানতে চেষ্টা করছে। সংখ্যালঘু এলাকায় বেশি করে এই সংকোচনের ভয় কাজ করাতে এর পিছনে অভিসন্ধি কাজ করছে বলে ধারণা গোয়েন্দাদের। বিজ্ঞান কর্মীদের সূত্রে জানা যাচ্ছে, বয়ঃসন্ধিকাল থেকে শুরু করে পরিণত বয়সের মানুষ এই গুজবে দারুন আতঙ্কিত। জননাঙ্গ সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে তা ক্রমেই দেহের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে বলেই তারা একটা অজানা আশঙ্কায় ভুগছে।

দারুন মানসিক অবসাদ এমনকি মৃত্যুভয়ে ভুগছেন অনেকে। উত্তর ২৪পরগণার বাগদা, কাজিপাড়া, রাজারহাট, দক্ষিণ ২৪পরগণার গড়িয়া, ভাঙড়, ক্যানিং, মন্দিরবাজার, কুলপি, সল্টলেক নয়াপট্টি, হুগলীর বৈদ্যবাটী, হাওড়ার উলুবেড়িয়া, সাঁকরাইল, আমতা, উদয়নারায়ণপুরে বেশি দেখা যাচ্ছে। কাছ থেকে বিষয়টি পর্যালোচনা করে সমাজতত্ত্ববিদ সুদর্শনা সেন জানাচ্ছেন, পলায়নী মনোবৃত্তি থেকে এই গুজব আদপে রোগের চেহারা নিচ্ছে। অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষই যেকোন গণ হিস্টিরিয়ার বেশি শিকার হন। এর কারণ তাদের মধ্যে আর্থিক সুরক্ষা কম থাকে।

বাজার এখন অগ্নিমূল্য, প্রতিদিন লড়াই করতে হচ্ছে প্রতিকূলতার সঙ্গে। জটিল পরিবেশ, পরিস্থিতির মধ্যে নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষ তাই এই গুজবের মধ্যে নিজেদের একটু মানসিক প্রশান্তি খূঁজে পান। সকলে গুজবে তাঁর ব্যক্তিগত পরিণতির কথা না ভেবে একটা খেলায় মেতে উঠে। অন্যদিকে মহিলার ক্ষেত্রেও এই গুজবের একটা চাপা প্রচার থাকলেও পুরুষতান্ত্রিক সমাজ সেঅর্থে মেনে না নেওয়ায় তারা অন্তত জ্বর-জারির প্রকোপ থেকে বেঁচে যাচ্ছেন। টানা চার-পাঁচ নিম্নাঙ্গ জলে ডুবিয়ে রাখলে শারীরিক পরিস্থিতি খারাপ হবে এটাই স্বাভাবিক।

বিশিষ্ট মনোচিকিৎসক ডাঃ হিরন্ময় সাহা জানাচ্ছেন, বেশি সময় ধরে জলে ডুবে থাকলে চামড়া কুঁচকে যাওয়ারই কথা। হাত, পায়ের মধ্যে তা যৌনাঙ্কের ক্ষেত্রেও একইভাবে প্রযোজ্য। একটি ভয় নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আতঙ্কে ভুগতে থাকলেও একইভাবে যৌনাঙ্ক সংকোচনের সম্ভাবনা তৈরি হয়। শীতকাল শুরু হয়েছে। হঠাৎ ঠান্ডার প্রকোপে পুরুষ ও মহিলা সকলেরই চামড়ায় টানা ধরা প্রবণতা থাকে।

শীতের শুরুতে তাই সকলকে একটু রোগা রোগা লাগে। আতঙ্ক মাথায় চড়ে থাকায় দেহের সামান্য পরিবর্তনকেই বেশি বেশি করে মনে হচ্ছে। এটা পরিষ্কার ‘ফোবিয়া’ বা চেতন মনের ভয়। রোগের সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক নেই। প্রায় একই কথা বলেছেন বিশিষ্ট গ্রন্থি বিশেষজ্ঞ সলিল কুমার পাল।

তিনি জানাচ্ছেন, গুজব থেকে যে শারীরিক সমস্যা দেখা দেয় তার প্রমাণ রয়েছে ভূঁড়ি ভূঁড়ি। চিকিৎসা বিজ্ঞানে একে কোরো সিন্ড্রোম বলে। এটি পুরোপুরি মানসিক রোগ। গুজবের মাধ্যমে আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে উদ্বেগ ও ভীতিতে আক্রান্ত হয়। পরে মানুষ থেকে মানুষে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে তা গণ হিস্টিরিয়া হতেও দেখা গেছে।

এই উপসর্গে ঘুম বেজায় কমে যায়। তাই ব্যক্তির স্বাভাবিক কাজকর্ম লাটে ওঠে। ক্ষিদে যায় কমে। মানসিক উদ্বেগ, অনিদ্রার জেরে গায়ে একটা জ্বালা জ্বালা বোধ হয়। আক্রান্ত ব্যক্তিকে কোনভাবে ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারলেই সমস্যা অধিকাংশ ক্ষেত্রে কমে যায়।

এলাকায় কারো মধ্যে এই সমস্যা হলেই জেলা হাসপাতাল বা স্থানীয় চিকিৎসকের কাছেই নিয়ে যাওয়াই ঠিক। তিনি ঐ মানসিক আতঙ্কিতকে মনের সংস্কারকে কমানোর সঙ্গে স্নানবিয় উত্তেজনা কমানোর ওষুধ দিয়ে তাকে একদিনেই সুস্থ করে দিতে পারেন। পুরোনো ধ্যান ধারণা থেকে মন্ত্র পড়া, কানে-মুখে চুন লাগানো, ঘন ঘন নিম্নাঙ্গে জল ঢালা বা জলে ডুবে থাকায় অপকার ভিন্ন উপকারের কোন সম্ভাবনা নেই। বিশিষ্ট স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ শঙ্খশুভ্র চৌধুরী জানাচ্ছেন, রোগটির সংক্রমণের একটি স্নায়বীয় ব্যাখাও থেকে যাচ্ছে। মস্তিষ্কের বিশেষ ধরণের স্নায়ুকোষের (মিরর নিউরন) সাময়িক সমস্যার জন্যও যৌনাঙ্ক সংকোচন ঘটে থাকে।

এটি ক্ষণস্থায়ী। আমাদের প্রত্যক্ষ উপলব্ধী থেকে শিক্ষা নেওয়ার প্রবণতা পরিচালিত করে ঐ মিরর নিউরন। অতি উদ্বেগ অথবা আতঙ্কে নানা ধরণের স্নায়বিক পদার্থের অকাল নিঃস্বরণ শুরু হয়। এর জন্য ঐ মিরর নিউরনের কোন কিছু ঠিক-বেঠিক ভেবে নেওয়ার শক্তিটা কমে যায়। এই থেকেই গণ হিস্টিরিয়ার জন্ম।

ডা. চৌধুরী আরো জানান, আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান পত্রিকা ডায়াগোন্যাস্টিক অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিক্যাল অব মেন্টাল ডিসঅর্ডারস্‌-এ ‘কোরো সিন্ড্রোম’ নিয়ে গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে। এটি পড়েই হয়ত কোন সচেতন বিজ্ঞান মনস্ক মানুষ তা চাউর করে চলেছেন। এই ধরণের গুজব ছড়ানোটা একটা অপরাধ। অহেতুক ভয় পাবেন না। গুজবে কান দেবেন না।

মাথা ঠান্ডা রেখে সঠিক ব্যবস্থা নিলেই সহজেই নিরাময় হওয়ার যায়। ইন্টারনেট ঘাটলে দেখা যাচ্ছে বিশ্বের প্রায় সব দেশে কোন না কোন সময়ে লিঙ্গ সংকোচনের ঘটনার গুজব দেখা গেছে। বিশ্বের উন্নত দেশেও এই যৌনাঙ্ক ছোট হয়ে যাওয়ার গুজব গণ হিস্টেরিয়ার রূপ নিয়েছিলো। ইউরোপ ও আমেরিকায় একে জেনিট্যাল রিট্রাকশন সিন্ড্রোম বা জি আর এস নামে ডাকা হয়। এটি ব্যবহারজনিত সমস্যা।

আফ্রিকা এবং এশিয়ায় এই সমস্যা অনেকবার এসেছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যৌনাঙ্ক সংকোচনের গুজব কয়েকবার হিস্টিরিয়ার রূপ পেয়েছে। চিনে এই ধরণের মানসিক বিকারের নাম ‘সুক ইয়াঙ’। চিনে প্রথম দেখা গেছিল ১৯৪৮সালে। এরপর ১৯৫৫, ১৯৬৬, ১৯৭৪, ১৯৮৪, ১৯৮৫ ধারাবাহিকভাবে এই সমস্যা দেখা গেছে।

সাম্প্রতিক অতীতে আর চিনে আসেনি শুধু জনসচেতনার কারণে। সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনামে এই সমস্যা দুই দুইবার হয়েছে। এশিয়ায় এই সমস্যার চিকিৎসকরা নাম দিয়েছে ‘কোরো সিন্ড্রোম’। এতে মেয়েদের থেকে ছেলেরা বেশি সংক্রামিত হয়। ভারতে প্রথম ১৯৯৩সালে এই সমস্যা প্রথম আসে।

সেবারে এর উৎপত্তিস্থল ছিল অসম। এবারেও ‘কোরো সিন্ড্রোম’ গুয়াহাটি থেকে ধুবড়ি হয়ে পশ্চিমবঙ্গে এসেছে। প্রথমে নিউ আলিপুর দুয়ার, কোচবিহার হয়ে এসেছে দক্ষিণবঙ্গে। এবারেই অসমে নতুন নাম পেয়েছে ‘কোরো সিন্ড্রোম’। নাম হয়েছে ‘ঝিনঝিনিয়া’।

আমাদের রাজ্যে অধিকাংশ মানুষই এটাকে না মানায় ‘ঝিনঝিনিয়া’ বদলে হয়েছে ‘ডিস্কো’।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।