~~~কেমন যেন একটা উৎকন্ঠায় আছি.......
৭ই নভেম্বর, বাংলার ইতিহাসের এক অনন্য দিন। কারো মতে ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর ইতিহাসের কালো অধ্যায়ের সূচনা, আবার কারো মতে তা বিপ্লব ও সংহতি দিবস। বিএনপির পক্ষ থেকে উল্লেখ করা হয়, এই দিনে সিপাহি-জনতার উত্থানের মধ্য দিয়ে একটি বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল, ফলে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র ফিরে আসে এবং সার্বভৌমত্ব-স্বাধীনতা রক্ষা পায়। ৭ নভেম্বর বিএনপি জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস হিসেবে পালন করলেও এই বিপ্লব সংঘটনের অপরাধেই মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তম ও তাঁর রাজনৈতিক দল জাসদের নেতৃবৃন্দকে এক প্রহসনের বিচারের মধ্য দিয়ে কর্নেল তাহেরকে বেআইনিভাবে ফাঁসি দেওয়া হয়।
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, ঐ দিনের ঘটনাক্রম ছিল পাকিস্তান আমল বা স্বাধীন বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া বুর্জোয়া রাজনৈতিক টানাপোড়েন থেকে একদমই ভিন্ন।
সেদিন সমাজতন্ত্রের আদর্শে লালিত কমরেড ও মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িত সেনা সদস্যরা একটি ভিন্ন লক্ষ্যে এগিয়ে আসে। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের চরম দুর্ভোগ, চাটুকার ঘেরা তৎকালীন সরকার, রাষ্ট্র দ্রোহীতার দায়ে জাসদের (জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল) নিষিদ্ধকরণ ও দমন নিপীড়ণের স্বার্থে দলের হাজার হাজার নেতা-কর্মী-সমর্থকদের হত্যা এবং মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে কতগুলো অভ্যুত্থান আর রক্তপাতের বিরুদ্ধে ছিল তাদের তীব্র ঘৃণা; আর এরই ফলশ্রুতিতে জাতীয় জীবনে পরিপূর্ণ মুক্তির লক্ষ্যে তাদের এই প্রচেষ্টা।
মূলত ৭ই নভেম্বরের অভ্যুত্থানের মূলে ছিল জাসদের সশস্ত্র শাখা। এই বিদ্রোহের মাধ্যমেই প্রথম বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা এবং বিপ্লবী গণবাহিনী প্রকাশ্যে আত্মপ্রকাশ করে। দু’টি সংগঠনই মুক্তিযুদ্ধে দোর্দণ্ড প্রতাপে নেতৃত্বদানকারী-অংশগ্রহণকারীদের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল।
তৎকালীন সিনিয়র সামরিক অফিসারদের অনেকেই বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত ছিলেন, এবং বিদেশী গোয়েন্দাদের সঙ্গেও যোগসাজশ ছিল তাদের। যারা ৭ নভেম্বরের বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিলেন তাদের মধ্যে অনেকে সাধারণ সৈন্য ছিলেন। তাদের সাহস, বীরত্ব আর আত্মত্যাগের যে গুণাবলী লক্ষ্য করা গেছে তা ঐ বিদ্রোহের এক বিশিষ্ট উত্তরাধিকার হিসেবে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে।
এই বিষয়ে আলোচনার জন্য তৎকালীন বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির মূল্যায়ন অতীব গুরুত্বপূর্ণ। ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি, নীতি নির্ধারণী মহলে অচলাবস্থা, শিক্ষার অভাগ, বেকারত্ব ছিল তখন চরম পর্যায়ে।
দারিদ্র সীমার নিচে বসবাসকারী জনগগোষ্ঠীর সংখ্যা ৭৮ শতাংশ। এই পরিপ্রেক্ষিত থেকে বিচার করলে এরকম হতাশাব্যঞ্জক অর্থনৈতিক দৃষ্টান্তকে চ্যালেঞ্জ করা ছিল খুবই যৌক্তিক। উপরন্তু, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে দেশে প্রথমবারের মতো সেনা ক্যু সংঘটিত হয়। শেখ মুজিবকে হত্যার পর খন্দকার মোশতাকের ক্ষমতা দখলকে কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি তাহের। সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে এ রকম একটি ষড়যন্ত্রের আভাসও দিয়েছিলেন তাহের।
কিন্তু কোনো সতর্কতা কাজে আসেনি, হত্যাকারীরা সফল হয়েছিল। সে সময় সেনাবাহিনীর মধ্যে একের পর এক সেনা ক্যু সংঘটিত হতে থাকে। এমতাবস্থায় দেশকে প্রতিক্রিয়াশীলদের হাত থেকে রক্ষার জন্য এগিয়ে এসেছিলেন কর্নেল তাহের ও তার সহযোদ্ধারা।
৪ নভেম্বর থেকে আবু ইউসুফ এবং এ বি এম মহমুদের বাসায় শুরু হয় জাসদের নেতৃবৃন্দের লাগাতার মিটিং। সেখানে উপস্থিত ছিলেন সিরাজুল আলম খান, ড. আখলাকুর রহমান, হাসানুল হক ইনু, আ ফ ম মাহবুবুল হক, খায়ের এজাজ মাসুদ, কাজী আরেফ প্রমুখ।
আরো ছিলেন বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নেতা হাবিলদার হাই, কর্পোরাল আলতাফ, নায়েব সুবেদার মাহবুব, জালাল, সিদ্দিক প্রমুখ। তৎকালীন অন্যতম প্রধান দল জাসদ, যারা স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে রত ছিল, তাদের যাত্রা প্রথমে বাধাগ্রস্ত হয়েছে শেখ মুজিব সরকারের সময়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক দলের প্রায় ২৬ হাজার নেতা-কর্মী-সমর্থকদের হত্যা, নির্যাতনের কারণে এবং দ্বিতীয়বারের মতো রাজনীতির গতিপথ বদলে দেবার জন্য আবির্ভূত হন খালেদ মোশারফ। সে সময়ে সিপাহীরা স্পষ্টতই বুঝতে পারেন যে, তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে। সৈনিকরা ক্রমেই হতাশাগ্রস্থ হয়ে বিদ্রোহী হয়ে উঠছিল।
আবু ইউসুফের এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় কমরেডদের সাথে মিটিং চলাকালে তাহের জানান, ২ তারিখ রাতে জেনারেল জিয়া তার জীবন রক্ষা করে গৃহবন্দি অবস্থা থেকে মুক্ত করার জন্য ফোনে ও পরে এক সুবেদারের মাধ্যমে এস ও এস ম্যাসেজের মাধ্যমে অনুরোধ করেন।
ন্যাশনালিস্ট, সৎ অফিসার হিসেবে আর্মিতে তার একটা ইমেজ থাকায় তাহের জিয়াকেই সর্বাপেক্ষা উপযোগি বলে মনে করেন। তাহের জানান যে, জাসদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জেনারেল জিয়ার নীরব সমর্থন রয়েছে। তৎকালীন সময়ে জিয়ার পক্ষে জাসদের সিদ্ধান্তের বাইরে কিছু চিন্তা করাও সম্ভব ছিল না। গৃহ বন্দি জিয়াকে যে কোন সময়ে তাকে হত্যা করা হতে পারত, আর তাকে সে অবস্থা থেকে মুক্ত করতে পারত কেবল কর্নেল তাহের। মিটিং-এ সিদ্ধান্ত হয় যে, অভ্যুত্থান সফল হলে বিজয়ী সিপাহি জনতা কার নামে স্লোগান দেবে জিয়ার নামে।
কারণ, তাহের অনেক আগেই আর্মি থেকে রিটায়ার্ড, ক্যান্টনমেন্টে তার নামে স্লোগান হলে একটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হতে পারে। অপরদিকে, জাসদের বড় নেতাদের মধ্যে জলিল, রব, শাজাহান সিরাজ তখন কারাগারে। জিয়া আর্মির লোক, তাকে জাসদ ও বিপ্লবী সৈনিকেরা মুক্ত করেছে, তাছাড়া সাধারণ মানুষের কাছেও তার একটা পরিচিতি ছিল। ঠান্ডা মাথায় পুরো অভ্যুত্থানের ছক তৈরি করেন তাহের। আসলো সেই ৭ই নভেম্বরের রাত।
মধ্য রাতের পর জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করা হয় আর এর দায়িত্বে ছিলেন হাবিলদার হাই। তিনি ২০/৩০ জন সিপাই নিয়ে জিয়ার বাসভবনে যান। তারা স্লোগান দিতে দিতে আসেন ’কর্নেল তাহের লাল সালাম, জেনারেল জিয়া লাল সালাম’।
গভীর রাতে টেলিফোনের মাধ্যমে নিজের জীবন রক্ষার অনুরোধের প্রেক্ষিতে তাহের যে বাস্তবিকই তাকে মুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছেন তা দেখে উৎফুল্ল হয়ে উঠেন জেনারেল জিয়া। হাই জিয়াকে বলেন, কর্নেল তাহের এলিফ্যান্ট রোডে তার ভাইয়ের বাড়ীতে জেনারেল জিয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন।
খানিকটা দ্বিধান্বিত হয়েও উঠে পড়েন সৈনিকদের আনা গাড়িতে। মাঝপথে ফারুক, রশীদের এক সহযোগী মেজর মহিউদ্দীন এসে জিয়াকে বহনকারী গাড়িটিকে থামান। জিয়াকে টু ফিল্ড আর্টিলারীতে নিয়ে যাবার ব্যাপারে মেজর মহিউদ্দীন খুব তৎপর হয়ে উঠেন। সিপাহিরা খানিকটা বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। জিয়া টু ফিল্ড আর্টিলারীতে গিয়ে আত্মবিশ্বাস ফিরে পান।
জিয়া আর ক্যান্টনমেন্টের বাইরের কোন অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে নিজেকে নিয়ে যেতে চাইলেন না। জিয়া বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যদের বলেন কর্নেল তাহেরকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে আসতে। তাহের এই খবর পেয়ে ইনুকে বলেন, “এরা একটা রিয়েল ব্লান্ডার করে ফেলল। আমি চেয়েছিলাম আমাদের বিপ্লবের কেন্দ্রটাকে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে নিয়ে আসতে। ” টু ফিল্ড আর্টিলারীতে পৌঁছালে জিয়া এগিয়ে এসে তাহেরের সঙ্গে কোলাকুলি করেন।
জিয়া তাহেরকে বলেন, “তাহের, ইউ সেভড মাই লাইফ, থ্যাঙ্ক ইউ। থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ। ” তাহের বলেন, “আমি কিছুই করিনি, করেছে এই সিপাহিরা। অল ক্রেডিট গোজ টু দেম। ” এরপর তাহের বসেন জিয়ার সঙ্গে আলাপে।
কিভাবে তারা এই বিপ্লবটি সংগঠিত করেছেন তা জিয়াকে বিস্তারিত জানান। তাহের জিয়াকে পরেরদিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একটা সমাবেশ করা এবং তাতে বক্তৃতা দেবার কথা বলেন। বক্তৃতার কথা শুনতেই জিয়া বেঁকে বসে। রেডিওতেও যেতে অস্বীকৃতি জানালেও পরে ক্যান্টনমেন্টেই রেকর্ড করা জিয়ার একটি বক্তৃতা প্রচার করা হয়েছে রেডিওতে। সেখানে জিয়া নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে ঘোষনা করেছেন।
সিপাইদের অভ্যুত্থানের কথা বললেও বক্তৃতায় জিয়া কোথাও অভ্যুত্থানের পেছনে জাসদ কিম্বা কর্নেল তাহেরের কথা উল্লেখ করেন নি। উপমহাদেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় এই সিপাই অভ্যুত্থান ঘটবার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই সেটিকে বাঞ্চাল করে দেবার জন্য তৎপর হয়ে ওঠে দুটি শক্তি, একদিকে জেনারেল জিয়া, আরেক দিকে খন্দকার মোশতাক। তাহেরকে না জানিয়ে গোপনে ক্যান্টনমেন্টে মিটিং করেন মেজর জেনারেল জিয়া, মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান, এয়ার ভাইস মার্শাল তোয়াব, রিয়ার এডমিরাল এক এইচ খান, জেনারেল ওসমানী, মাহবুবুল আলম চাষী। হঠাৎ মিটিং এ তাহের উপস্থিত হলে মাহবুবুল আলম চাষী বলেন, “উই হ্যাব ডিসাইডেড টু কন্টিনিউ দি গভার্নমেন্ট উইথ মোশতাক এজ দি প্রেসিডেন্ট। ” তাহের বলেন, “উই ক্যান নট এলাউ দিস নুইসেন্স টু গো অন ফর এভার।
” জেনারেল ওসমানী তাহেরের চিন্তাভাবনা জানতে চাইলে তাহের বলেন, “প্রথমত আমাদের একটা বিপ্লবী পরিষদ করতে হবে, গঠন করতে হবে সর্বদলীয় জাতীয় সরকার। সে সরকারের কাজ হবে যত দ্রুত সম্ভব একটা ফ্রি এন্ড ফেয়ার ইলেকশান দেওয়া। জাস্টিজ সায়েম আপাতত হেড অফ দি স্টেট থাকতে পারেন। জেনারেল জিয়া আর্মি চিফ থাকবেন। ”
ঘটনাক্রমে ক্ষমতা হাতে পাওয়া জিয়া নানান টাল বাহানায় বিপ্লবী সৈনিকদের দাবী দাওয়া মানতে অস্বীকৃতি জানায়।
এ ঘটনায় আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠে ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানকারী বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যরা। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্য, গনবাহিনীর সদস্যরা আওয়াজ তোলেন যে জেনারেল জিয়া ১২ দফা মানবার কথা দিয়ে কথা রাখেন নি, ওয়াদা খেলাপ করেছেন, প্রতারণা করেছেন তাদের সঙ্গে। অবশেষে তাহের সব বুঝতে পেরে বলেন, “এটা স্পষ্ট যে মূলত দু’টো কারণে হাতের মুঠোয় সাফল্য পেয়েও আমরা তা ধরে রাখতে পারি নি। প্রথমত জিয়াউর রহমানের বিশ্বাসঘাতকতা, দ্বিতীয়ত আমাদের গণজমায়েত করার ব্যর্থতা। আমাদের বিপ্লবের মিলিটারি ডাইমেনশনটা সাক্সেস্ফুল হলেও সিভিল ডাইমেনশনে আমরা ফেইল করে গেছি।
”
৭ নভেম্বরে ফুঁসে ওঠা ঐ বিদ্রোহ জাগিয়ে দেওয়ার পেছনে জাসদের কিছু মূল লক্ষ্য ছিল। আর তা হল- জাসদ বুঝতে পেরেছিল সাংগঠনিক দিক থেকে তারা ক্ষমতা দখলের উপযোগী অবস্থায় নেই। তাদের অনেক কর্মীই তখন কারাগারে। ৭ নভেম্বরের বিদ্রোহের উদ্দেশ্য ছিল কারাগার থেকে তাদের নেতৃবৃন্দ ও সমর্থকদের মুক্ত করা, তারপর এস্টাবলিশমেণ্টের শরীক হওয়া এবং রাজনৈতিক এবং সামরিক ক্ষমতার সমান্তরাল কেন্দ্র তৈরী করা। জাসদ মনে করছিল যে, আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতার শীর্ষে অবস্থান না করেও ঘটনাপ্রবাহের গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করার মতো যথেষ্ট ওজন তাদের আছে।
এ অবস্থায় জাসদ তার গণসংগঠনগুলোকে সক্রিয় করা এবং সেনানিবাসে অনুগত সামরিক কমিটি গঠন করার মাধ্যমে নিচ থেকে এক ধরনের 'আধিপত্য' তৈরি করতে চেয়েছিল। এ সময় জাসদ আন্দাজ করেছিল সমর্থনের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সামরিক ভিত্তি তারা প্রসারিত করতে পারবে। এদিক দিয়ে দেখলে অন্যান্য প্রগতিশীল রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে মৈত্রীর কৌশল অনুসরণের ব্যাপারে তারা প্রস্তুতই ছিল, যা সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য পূরণের উপযোগী একটি রাষ্ট্র তৈরির ক্ষেত্রে অত্যাবশ্যকীয় শর্ত। আর সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন হতে পারতো ঐ বিদ্রোহের দ্বিতীয় পর্যায়, যার জন্য হয়তো কয়েক মাস সময় লাগতো, আর এ সময়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন অস্থায়ী সরকার ক্ষমতায় থাকতো।
কিন্তু তাহের বুঝতে পারেন এ মুহূর্তে জাসদের পক্ষে এরকম একটা পরিস্থিতিতে নেতৃত্ব দেবার মতো অবস্থা নেই।
ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে আমরা দেখতে পাই, ৭ নভেম্বরের বিদ্রোহের সময় জাসদের সাংগঠনিক প্রস্তুতি বিদ্রোহের ন্যূনতম লক্ষ্য পূরণের উপযোগী ছিল না। লিফশুলৎসের সঙ্গে আলোচনায় তাহের জোর দিয়ে বললেন, ঘটনার গতিধারাই তাদেরকে আগেভাগে এ্যাকশনে যেতে বাধ্য করেছে। তিনি বললেন, তাদের নিজেদের হিসাব-নিকাশ অনুযায়ী একেবারে আঁটঘাট বেঁধে প্রস্তুত হওয়ার মতো অবস্থায় পৌঁছতে, প্রয়োজনীয় সাংগঠনিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে ১৯৭৬ সালের মার্চ বা এপ্রিল পর্যন্ত সময় লেগে যেত। অর্থ্যাৎ, আরো ছয় মাস অপেক্ষা করলে ততোদিনে শহরে এবং গ্রাম এলাকায় তারা তাদের জনসমর্থন নতুন করে সাজাতে পারতেন।
তাহের যুক্তি দেখালেন, একটার পর একটা অভ্যুত্থান আর পাল্টা অভ্যুত্থান সশস্ত্রবাহিনীকে গভীরভাবে অস্থির করে তুলেছিল।
এর কারণ, সামরিক বাহিনীর সবাই বুঝে গেছে যে, সামরিক অভ্যুত্থানের ফলে একপক্ষের উপর আরেক পক্ষের বাড়তি সুযোগ-সুবিধাই কেবল প্রতিষ্ঠিত হয়, দেশের যে হতদরিদ্র সিংহভাগ মানুষ, তাদের ক্ষেত্রে তা কোন মৌলিক পরিবর্তন আনে না। মুক্তিযুদ্ধের সময় কুমিল্লা ব্রিগেডের মাধ্যমে কমরেড তাহের বারবার যে বাণীটি প্রচার করতেন তা হলো-একজন সৈন্যের পক্ষে দেশপ্রেমের প্রকৃত অর্থ হলো সবকিছুর উর্দ্ধে সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত শ্রেণীটিকে তুলে ধরা। বাংলাদেশের মতো বিশ্বের এক দরিদ্রতম দেশে এই বাণী সামরিক বাহিনীর রাজনীতি সচেতন অংশটির মধ্যে বিপুলভাবে জায়গা করে নিয়েছিল। এই রাজনীতি সচেতন শক্তিটিই তাহের এবং জাসদকে বিদ্রোহে নেমে পড়তে চাপ দিয়েছিল। নিঃসন্দেহে, এমনকি তুখোড় পর্যালোচনা সত্ত্বেও, তাড়াহুড়া করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
মনে করা হচ্ছিলো, তারা অংশগ্রহণ করুন আর নাই করুন একটি বিদ্রোহ অত্যাসন্ন। জাসদের সামনে তখন এ বিদ্রোহে ভ্যানগার্ড হিসেবে অবতীর্ণ হওয়ার অথবা না হওয়ার প্রশ্ন। তারা তখন ভ্যানগার্ড হওয়ার মতো উপযোগী অবস্থানে ছিল। ফলে তারা বিদ্রোহের সঙ্গে জড়িত থেকে পথনির্দেশ দিয়েছে। সম্ভবত তারা এমন এক সমাজে বসবাস করতে করতে অধৈর্য হয়ে পড়ছিল যেখানে সমাজতন্ত্রের বুলি আওড়ানো লোকেরা শেষ পর্যন্ত আরাম কেদারায় দোল খায়, না হলে বাজারে চায়ের ষ্টলে বসে আলোচনার ঝড় তোলে।
এগার তারিখ পর্যন্ত জিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ট যোগাযোগ থাকলেও বার তারিখের পর সব যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেই জিয়া তাহেরকে এড়িয়ে যেতেন। একটা সফল বিদ্রোহের জন্য যে সব দুরুহ এবং জটিল দায়িত্ব কাঁধে নেওয়ার মতো যথেষ্ট পরিমাণে প্রস্তুতি ছিল কি না, এপ্রসঙ্গে ১৫ নভেম্বর ১৯৭৫ লিফশুলৎসের সাথে কথোপকথনে তাহের জানান, অভ্যুত্থানের সময় নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নেওয়াটা খুবই জটিল ছিল। প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলোর জোটবদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা ছিল এবং তারা অভ্যুত্থানের সমর্থকদের খতম করার অভিযানে নামতে পারতো। প্রতিশোধ স্পৃহার অভিপ্রকাশ হিসেবে পরবর্তী তিন বছরে সেটাই ঘটেছে।
অপরিণত ও অপর্যাপ্ত প্রস্তুতি এরকম পরিণতিই বয়ে আনে।
এর সপ্তাহখানেক পর এক বৈঠকে তাহের ইঙ্গিত করলেন, ব্যাপক গণ-সমাবেশ, যেটা তিনি আশা করেছিলেন, তাতে জাসদ সাংগঠনিকভাবে ব্যর্থ হয়েছে। বিপুল সংখ্যক মানুষ রাস্তায় নেমে এসে সিপাহীদের স্বতস্ফুর্তভাবে অভিনন্দিত করলেও, অতীতে যেমন ছাত্র-জনতা-রাজনৈতিক কর্মীদের ব্যাপক আলোড়ন দেখা গেছে, এক্ষেত্রে তেমনটি ঘটেনি। ৪ ও ৫ নভেম্বর জাসদের আন্ডারগ্রাউন্ড নেতৃত্বের এক বৈঠকে ঐসব শক্তিগুলোকে সক্রিয় করে তোলার দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়। তবে দায়িত্ব প্রাপ্তরা পরে যথেষ্ট আন্তরিকতা ও তৎপরতা নিয়ে মাঠে নামেনি।
অভ্যুত্থানের বেশ কয়েকটি দিক ছিল। কেবল যে সামরিক শক্তিকেই সংগঠিত করা হয়েছিল তা নয়, ছাত্র-কর্মীদেরও বিষয়টি জানানো হয়েছিল এবং তাদের সংগঠিত ঐক্যের মধ্যে নিয়ে আসা হয়েছিল। লক্ষ্যনির্ভর বিদ্রোহের হাতকে মুষ্টিবদ্ধ করতে হলে সকল আঙ্গুলকে তো একসঙ্গেই গুটাতে হয়।
পূর্বধারণা অনুযায়ী কেন সংগঠিত সমর্থন পাওয়া যায়নি সে ব্যাপারেও যথেষ্ট বির্তক রয়েছে। ১৯৭৩ ও ৭৪ সালে যে সংগঠনটি লাখ লাখ মানুষের সমাবেশ ঘটিয়েছে, তাদের পক্ষে এ ধরনের রাজনৈতিক কর্মকান্ড সামর্থ্যরে বাইরে থাকার কথা ছিল না।
৭ নভেম্বরের সকালে জাসদ পরিস্কারভাবে তাদের কোনো সুস্পষ্ট রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণা করেনি, যা অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তিকে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার এবং বিদ্রোহকে অন্যখাতে প্রবাহিত করার সুযোগ করে দেয়। জনগণের একটি বড়ো অংশ তখন পর্যন্ত ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি, অভ্যুত্থানের নায়ক আসলে কারা এবং তাদের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, নীতিই বা কি, যদি তা আদৌ থেকে থাকে। কয়েকটি স্লোগানই যথেষ্ট ছিল না। এতে কোনো সন্দেহ নেই, সমাজতান্ত্রিক ধারার কোনো সংগঠনের পক্ষে এগুলো খুবই মারাত্মক ব্যর্থতা।
২৩ নভেম্বর পুলিশের একটা বড় দল কর্নেল তাহেরের বড় ভাই ফ্লাইট সার্জেণ্ট আবু ইউসুফ খানের বাড়ী ঘেরাও করে ও তাঁকে গ্রেফতার করে পুলিশ নিয়ন্ত্রণ কক্ষে নিয়ে যায়।
এই ঘটনায় মেজর জেনারেল জিয়াকে টেলিফোন করলে অন্য প্রান্ত থেকে সেনাবাহিনীর উপ.প্রধান মেজর জেনারেল এরশাদ আমার কথা শুনে বলেন যে, আবু ইউসুফ গ্রেফতারের ব্যাপারে সেনাবাহিনী কিছুই জানে না। ওটা হচ্ছে একটা সাধারণ পুলিশী তৎপরতা। তখন একই সময়ে মেজর জলিল ও আ.স.ম. আব্দুর রব সহ অন্যান্য অনেক জাসদ নেতা ও কর্মীকেও গ্রেফতার করা হয়েছিল।
২৪শে নভেম্বর এক বিরাট পুলিশ বাহিনী কর্নেল আবু তাহেরকে ঘিরে ফেলে। তাকে জিয়ার সঙ্গে কথা বলার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে উল্লেখ করে একটা জিপে তুলে সোজা জেলে নিয়ে আসা হয়।
জিয়া শুধু তাহেরের সাথেই নয়, বিপ্লবী সেনাদের সাথে, সাত নভেম্বরের চেতনার সঙ্গে, এক কথায় গোটা জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে পেছন থেকে ছুরি মেরেছে। আর তার এহেন চরিত্র কেবল মাত্র মীর জাফরের সাথেই সঙ্গতিপূর্ণ। এরপর ১৯৭৬ সালের ১৭ জুলাই একটি গোপন সামরিক আদালতে প্রহসনের বিচার করা হলো। বিচারে কর্নেল তাহেরসহ ১৭ জনকে শাস্তি দেওয়া হলো। তাহেরকে দেওয়া হলো মৃত্যুদণ্ড।
আরো বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, তথাকথিত রায়টি ঘোষিত হওয়ার মাত্র ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ২১ জুলাই দণ্ডাদেশ কার্যকর করা হলো। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তাহেরকে ফাঁসি দেওয়া হলো। বাঙালির এই জাতীয় বীর বিন্দুমাত্র শঙ্কাবোধ করেননি ফাঁসির মঞ্চে উঠতে।
এটা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, দেশের স্বাধীনতার জন্য কর্নেল তাহেরের মতো আরো যারা যুদ্ধ করেছেন, তাদের একটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। বাংলাদেশের জনগণকে যেন আর কখনো নিজ দেশে ক্রীতদাসে পরিণত হতে না হয়, সেজন্য ঐ দৃষ্টিভঙ্গিটা ফিরিয়ে আনতে হবে।
বাংলাদেশ বীরের জাতি। যার প্রমাণ এই জাতি রেখেছে যুগে যুগে। দেশ গড়ার ক্ষেত্রে ৭ই নভেম্বরের অভ্যুত্থানের শিক্ষা ও দিক নির্দেশনা পৌছে দিতে হবে আপামর জনসাধারণের মাঝে, যা ছিল প্রকৃত জাতীয় মুক্তির ডাক। কমরেড তাহের হয়ত আমাদের মাঝে স্বশরীরে অনুপস্থিত, কিন্তু তিনি আছেন তাঁর দেখানো আদর্শের মাঝে, প্রতিটা বিদ্রোহের মাঝে, এজাতির প্রাণে মিশে আছেন তাহের। যতদিন রবে মুক্তিকামী মানুষ, ততদিন রবে ৭ই নভেম্বরের চেতনা সমান উজ্জ্বল......
বিপ্লব দীর্ঘজীবী হউক!
দীর্ঘজীবী হউক স্বদেশ!
শাহেরীন আরাফাত
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।