আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এমন তীর্যক তর্কের অবতারণার জন্য আমাকে ক্ষমা করবেন...

সুবোধের কথামালা

২১ সেপ্টেম্বর চলমান সম্প্রচার যন্ত্র (আমার চাকরীদাতা প্রতিষ্ঠান) থেকে খবর এলো ২৩ সেপ্টেম্বর আমাদের সাথে দয়াময় চৌধুরী বসবার সদয় সম্মতি (আসলে মফস্বলের সংবাদ শ্রমিক মারার কল বসিয়েছেন) দিয়েছেন। তিনি প্রায় ৫ বছর আগে আমাদের দেয়া নিয়োগপত্র বাতিল করে নতুন চুক্তি/নিয়োগপত্র দেবেন। সাথে সংবাদ প্রেরণ সংক্রান্ত অসিহতনামা। দেশের সব প্রতিনিধিরা অংশ নিলেও আমার স্বজনের আকস্মিক মৃত্যুর কারণে আমার পক্ষে সে পতন সভায় উপস্থিত হওয়া সম্ভব হয়নি। তবে সহকর্মীদের কাছ থেকে সভার বিশদ বিবরণ অবগত হয়ে লজ্জা এবং অপমানে মাথাটা ন্যুজ হয়ে গেছে।

প্রায় ৫টি বছর এতটা দু:খ-দৈন’র ভেতরেও নিরবচ্ছিন্ন কাজ করে যেখানে সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির কথা সেখানে নতুন নিয়োগ পাওয়া দয়াময় চৌধুরী প্রতিষ্ঠানকে লাভের মুখ দেখাতে মফস্বল শ্রমিকদের সাফ জানিয়ে দিলেন এখন থেকে আর কোনো বেতন ভাতা দেয়া হবেনা শুধুমাত্র সংবাদ ফুটেজ প্রেরণ সাপেক্ষে খরচ দেয়া হবে। তাও আবার উভ কিংবা প্যাকেজ সংবাদের জন্য ২ শ টাকা মাত্র। যথেষ্ঠ আরামপ্রদ এমন পুরস্কারের (আসলে তিরস্কার পড়তে হবে) ঘোষণাটি সে সভায় উপস্থিত হয়ে শুনতে হয়নি বলে সৃস্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া আদায় না করলে অকৃতজ্ঞতা হবে বৈকি! কিন্তু দয়াময় চৌধুরী বাবু আপনার কি জানা আছে প্রত্যেক জেলা প্রতিনিধি কত বছরের টাকা পাওনা আছে? কত বছরের উভ এবং প্যাকেজের বিল বকেয়া? সারা দেশের পরিক্ষিত সংবাদ প্রতিনিধিদের এ প্রতিষ্ঠানের প্রতি যে মমত্ববোধ আছে সে সম্পর্কেও কি আপনার কাছে পরীক্ষা দিতে হবে? তাও আবার সুবিধাজনক সময়ে যিনি প্রতিষ্ঠানের অনেক বড় অধিকর্তা হয়ে গেড়ে বসেছেন। পদ এবং অর্থের মোহে এসে যদি, যারা সব সময় শোষণের শিকার তাদেরকেই নিস্পেষিত করার পরিকল্পনা তৈরি করেন তাহলে নৈতিকভাবে কি আপনার পরাজয় হলো না? এটুকু ভাববার শক্তিও কি আপনার নেই? অবশ্য থাকবার কথাও নয় বোধকরি। কারণ; অন্য নৈতিকতালয়ের মার্কেটিং বোঝা মানুষ সাংবাদিকদের/ বিশেষ করে মফস্বল সংবাদ শ্রমিকদের বেদনা কি বুঝবেন! এ প্রতিষ্ঠানের দুর্দিনে আপনি কোথায় ছিলেন? যখন আমরা ভবিষ্যত অনিশ্চিত যেনেও অন্য কোথাও যাইনি, সুবিধা বুঝে অন্যকোনো ছায়াতলের আশ্রয় খুজিনি।

এখন নাকি আপনি প্রতিষ্ঠানের লাভের চ্যালেঞ্জ বাজি ধরেছেন। বাহ্ বেশ! ধরুন তাতে কোনো আপত্তি নেই কিন্তু আমাদের ওপর থেকে চাপিয়ে দেয়া এ অনৈতিক সিদ্ধান্ত বাতিল করুন। মহাশয় নাকি প্রচারিত প্যাকেজ সংবাদের জন্য বরাদ্দ করেছেন ২০০ টাকা। লজ্জায় মাথা নত হয়ে আসে। এই বুঝি আপনাদের বিবেক?? মহোদয়ের অবগতির জন্য বলছি; আমি যখন চলমান সম্প্রচার যন্ত্রে কাজ শুরু করি তখন (এখন থেকে প্রায় ৫ বছর আগে) আমার জেলায় ভিএইচএস ক্যামেরা পাওয়া যেতো; যা দিয়ে বিটিভি ছাড়া প্রাইভেট চ্যানেলগুলোতে সম্প্রচারযোগ্য ফুটেজ হতোনা।

তখন ফেনীতে মিনি ডিভি প্রযুক্তির ক্যামেরা পাওয়া যেতো যা ভাড়া লাগতো ১৫’শ থেকে ২ হাজার টাকায়। তখনো আমাকে সংবাদ পাঠাতে হয়েছে। আর এখন মফস্বলে ১ টি উভ কিংবা প্যাকেজের জন্য ক্যামেরা ভাড়া পাওয়া যায় ৫’শ টাকায়, ডিভি ক্যাসেট ১৬০-২০০টাকা মাঝখানে যাতায়াত খরচ, ব্যাক্তিগত ব্যায়, কখনো কখনো সংবাদের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তির কাছে একাধিকবার যাওয়া আসা, কুরিয়ারে সংবাদ ও ফুটেজ পাঠানো সব মিলিয়ে স্থান কাল ভেদে ১ হাজার থেকে ২ হাজার টাকা খরচ হয়। সংশ্লিষ্ট কর্তা ভ্যাক্তিগণের অবগতির জন্য এ লেখায় একটি ফিরিস্তি দিতে চাই। সারাদেশে যদি একটি চলমান সম্প্রচার যন্ত্রের ৬০ জন মফস্বল সংবাদ শ্রমিক থাকেন, তাদের বেতন গড়ে ৩ হাজার টাকা হলে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা মাসে বেতন বাবত লাগে।

একজন মফস্বল সংবাদ শ্রমিক প্রতিমাসে গড়ে ১৫ টি সংবাদ পাঠালে ৬০ জনের ৯’শ টি সংবাদ পান সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। তাহলে ৯’শ সংবাদের জন্য ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা মাসে খরচ করতে না পারলে এ যন্ত্র (আসলে যন্ত্রণা) বন্ধ করে দেয়াই বোধ হয় সমীচিন হবে। আমার বিবেচনায় নিরপেক্ষ সংবাদ হচ্ছে চলমান সম্প্রচার যন্ত্রের প্রাণ। সেক্ষেত্রে মফস্বল প্রতিনিধিদের উপেক্ষা করে কিংবা ঠকিয়ে চ্যানেল চালানো হয়তো সম্ভব তবে মানুষের হৃদয়ে সে নৈতিকতার ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু হবে, সেটা অনেক বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন মেলে ধরে আছে। বরঞ্চ অপেক্ষাকৃত কম জনপ্রিয় দুটি অনুষ্ঠান বাদ দিয়ে হলেও সংবাদ পরিবেশনের স্বার্থে সাংবাদিকদের স্বার্থ বিবেচনা জরুরি।

আমাদের প্রায় ৫ বছর আগে দেয়া নিয়োগপত্রে পারিশ্রমিক ৩ হাজার টাকা, প্যাকেজ সংবাদ ৮’শ টাকা, উভ সংবাদ-৩ থেকে ৫’শ টাকা এবং সেই সাথে ফোন-ফ্যাক্স-কুরিয়ার, যাতায়াত খরচ প্রদানের কথা উল্লেখ ছিলো। কিন্তু উল্লেখ থাকলেও কার্যত এ সকল সুযোগ সুবিধা কখনো মফস্বল সংবাদ শ্রমিকদের দেয়া হয়েছে বলে আমার জানা নেই। হালে শুধুমাত্র পারিশ্রমিক দেয়ার রেওয়াজ চালু হয়েছিলো- তাও হটকারি সিদ্ধান্তে বন্ধ হয়ে গেলো। অথচ যেখানে এতভাবে পরীক্ষিত সংবাদ শ্রমিকদের বেতন ও সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির কথা সেখানে এমন সিদ্ধান্ত কেনো নিতে গেলেন কতৃপক্ষ? কার প্ররোচনায়? তাহলে কি কতৃপক্ষই চান আপনার কর্মীরা মিডিয়ার লোগো আর প্রভাব বিক্রি করে খাক? চাঁদাবাজি আর বাটপারি করুক? চুক্তি অনুযায়ী সারাদেশের মফস্বল সংবাদ শ্রমিকদের মাসিক পারিশ্রমিক ৬০ জনের গড়ে ৩ হাজার টাকা হলে ৫ বছরে ১ কোটি ৮ লাখ টাকা অন্যদিকে সংবাদ ও ফুটেজ প্রচার, টিএ-ডিএ, ফোন-ফ্যাক্স-কুরিয়ার বাবত গড়ে ন্যুন্যতম ৪ হাজার টাকা (আমাদের অভিজ্ঞতা বলছে মাসে ৪ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত হতো) ধরা হলেও ৫ বছরে ১ কোটি ৪৪ লাখ টাকা আমাদের ঠকানো হয়েছে। অবশ্য বর্তমান মালিকানায় আসার পর মফস্বল শ্রমিকদের শুধুমাত্র বেতন দেয়া হয়েছে কয়েক মাসের আর পূর্ব মালিকানার বকেয়া ৫ হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।

ঢাকায় কর্মরত একজন রিপোর্টারের পেছনে একটি সংবাদ সংগ্রহের ব্যায় ট্রান্সপোর্ট- ক্যামেরাপার্সন, সবার ডিএ এলাউন্স-সহ কমপক্ষে ২ থেকে ৪ হাজার টাকা। সেখানে মাসে গড়ে ১৫টি সংবাদের জন্য একজন জেলা প্রতিনিধি কোনো ধরনের লোকবল, প্রযুক্তি সাপোর্ট ছাড়াই সংবাদ সংগ্রহ থেকে প্রেরণ পর্যন্ত ৩ হাজার টাকাও পাবেন না? এটা কি ধরনের ন্যয্যতা? এ প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ কর্তাব্যাক্তি আপনার কি সদয় দৃষ্টি হবে বিষয়গুলো বিবেচনার? আপনি এ দেশের একটি বৃহৎ শিল্প গ্র“পের সর্বোচ্চ কর্তাব্যাক্তি। এ প্রতিষ্ঠানের আওতায় ১৮ টি শিল্প উইং পরিচালিত হচ্ছে। যেখানে হাজার হাজার শ্রমিক, কর্তকর্তা, কর্মচারি কাজ করে তাদের জীবন জীবিকা চালাচ্ছেন। যদি তাদের বেতন ভাতা দিতে পারেন তাহলে শুধুমাত্র ৬০ জন জেলা প্রতিনিধিকে আপনি পারিশ্রমিক দিতে পারবেন না! এটাও কি আমাদের বিশ্বাস করতে হবে? আদতেই কি আপনি জানেন মিডিয়া হাউসটিতে কখন কি হচ্ছে? নাকি আপনাকে আড়ালে রেখে কিংবা ভুল বুঝিয়ে বিষয়গুলোর এমন প্রশাখা তৈরি করেছে? আপনার যত শিল্প উইং আছে, তাতে আপনার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি হয়তো হয়েছে কিন্তু মিডিয়া আপনাকে যে উচ্চতায় উঠিয়েছে সেটা কি অর্থনৈতিক বিবেচনার বাটখারা দিয়ে পরিমাপ করা যাবে? আজ যদি দেশের কেবল একজন প্রতিনিধি গত ৫ বছরের বকেয়া পরিশোধ ও সামাজিক সম্মানহানী এবং অর্থনৈতিক ক্ষতিপূরণ চেয়ে আইন আদালতের দ্বারস্থ হয় তাহলে অবস্থাটা কি দাড়াবে? তখন আপনার এমন হটকারী সিদ্ধান্ত নেয়ার মদদদাতারা কোথায় থাকবেন? আপনার নাকি লোকসান হচ্ছে।

আর লোকসানের ওজন কমাতে মিডিয়ার ওই হাউসের সবার বেতন হবে কিন্তু কোরবান হতে হবে পরীক্ষিত শ্রমিকদেরই যারা নাকি দুর্দিনেও হাল ছাড়েনি। এ হাউসে সারাদেশের যে ক’জন শ্রমিক আমরা আছি কেবল আমাদের ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা বন্ধ করে দিলেই আপনার লাভ হবে? ১৮ টি প্রতিষ্ঠানের লাভতো পাচ্ছেন, যে প্রতিষ্ঠান আপনাকে খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে গেলো সে প্রতিষ্ঠানের লাভটাও আপনার জরুরি? তাও আবার শ্রমিকদের ঘাম নিংড়ানো কষ্টের ফসল মহাজনের গোলায় ভর্তি করার সে চিরাচরিত প্রথার মত? মফস্বল শ্রমিকরাতো অনেক ছাড় দিয়েছি। তার অনেক নজিরও আছে কিন্তু তথাকথিত মদদদাতারা ৬ মাস,বেতন ভাতা ছাড় দিয়ে প্রতিষ্ঠানে টিকে থাকুন। আমরাও দেখি সত্যিকারের ভালোবাসাটার ওজন কত? আমাকে ক্ষমা করবেন পাঠক ও সতীর্থগণ। এমন তীর্যক তর্কের অবতারণার জন্য।

লজ্জা নেই ভেবে যদি লজ্জা নিবারণের চেষ্টাটুকু সংশ্লিষ্ট কর্তাগণ গ্রহণ করেন তাহলে হয়তো আরো উলঙ্গ হবোনা। লেখক : একজন মফস্বল সংবাদ শ্রমিক

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।