বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
এত রাতে কারা যেন পাতা পুড়িয়েছে। পাঙ্খোদের গ্রামটি কাছেই- সম্ভবত তাদেরই কেউ । বুক ভরে পোড়া পাতার গন্ধ নেয় রাশেদ।
এ রকম সময়ে বেঁচে থাকা কি অদ্ভূত মনে হয়। এসব সূক্ষ্ম অনুভূতিই উঠে আসে তার কবিতায় । সাজেকে এসে ভালো লাগছে তার; ছবির মতো সুন্দর সব আদিবাসী গ্রাম, পাহাড়ি রাস্তার দু' পাশে সার সার ঘর, চা খাওয়ার ছোট্ট দোকান । আদিবাসী মেয়েরা হাতে টানা তাঁতের কাপড় বুনছে অথবা কেউবা মোটা বাঁশের পাইপে তামুক খাচ্ছে।
নির্জন পাহাড়ি জীবনযাত্রা দেখতে ভালোই লাগে।
সমতল থেকে ১৮০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত রুইলুই এবং কংলাক-এই দুটি বসতি নিয়েই সাজেক। স্থানীয় আদিবাসীরা বসতিকে বলে ‘পাড়া’। কংলাক পাড়ায় পাঙ্খো আর ত্রিপুরা জনগোষ্ঠির প্রায় ৩০টি পরিবারের বাস। একটি উঠোনে রোদে শুকোতে দেওয়া কফি ফল দেখে মুগ্ধ হয়েছিল রাশেদ। কংলাক পাড়ায় মৃত ব্যক্তিদের স্মৃতি রক্ষার্থে রয়েছে পাথরের এপিটাফ ।
প্রতিটি বাড়ির সামনেই রয়েছে ফুলের বাগান। গ্রামের কারবারী (গ্রাম প্রধান) চংমিং থাং লুসাই ওদের স্বাগত জানিয়ে বললেন... কি খাবেন..... টি, কফি অর অরেঞ্জ জুস?!
কংলাক পাড়ায় ঘুরে বেড়ানোর সময় ভালো লাগছিল। সামিনা অবশ্য বিষন্ন ছিল। কেন যে মেয়েটি সারাক্ষণ মুখ ভার করে থাকে। একটি ফুটফুটে পাঙ্খো শিশুকে কোলে নিয়ে ছবি তুলল শান্তা, রাজীব তামুক ভরা মোটা বাঁশের পাইপে টান দিয়ে খকখক করে কেশে অস্থির, উর্মি তিনশ টাকায় এক পাঙ্খো বুড়ির বোনা নীলসাদা একটা শাল কিনল ।
মাহাতাব ওর রিসার্চের জন্য তুলল অজস্র ছবি । পাহাড়ের ঢালে ছোট্ট একটি চা বাগান, পাহাড়ের বিভিন্ন অংশে বিক্ষিপ্ত বেশ কয়েকটি কফি গাছ... আর পাহাড়ের ঢাল বেয়ে একটু নীচে নামলে রয়েছে কমলা বাগান। দূর্লভ সুগন্ধি 'আগর' গাছও দেখেছে রাশেদ। এসব কিছু মিলিয়ে ভালো লাগছে সাজেক!
রাতে সাজেকের আকাশে যেন ভরা জোছনার বান ডাকল। জোছনার ধবল আলো ঝরে ঝরে পড়ল ঘুমন্ত নির্জন রুইলুই আর কংলাক পাড়ার ওপর- তার পাথরের এপিটাফ, কফি গাছ, আগর গাছ, কমলার বন, চা বাগান আর বিডিআর ক্যাম্প-এর ওপর।
কমলার পাতারা কাঁপল এলোমেলো ঝিরঝিরে হাওয়ায় । বাতাসে ছড়াল কফি ফলের তীব্র গন্ধ, আর সেই তীব্র গন্ধের সঙ্গে মিশল আগরের সুগন্ধ।
সাদা রঙের দোতলা ট্যুরিষ্ট কটেজের সামনের মাঠটিও ধবল আলোয় ভেসে যাচ্ছিল। ওরা ক’জন শিশির ভেজা ঘাসের ওপর এলোমেলো পায়ে হাঁটছিল । ওদের মাথার ওপর তরল রুপার ছড়ানো আকাশ-সমুদ্র।
সেই আকাশের দিকে তাকিয়ে শান্তা বলল, সত্যিই কি সাজেকের আকাশে ফ্লাইং সসার দেখা গেছে?
ওর ঠিক পাশেই সিগারেট টানতে-টানতে হাঁটছিল রাজীব। সে বলল, পেপারে তো তাইই লিখেছে দেখলাম।
কথাটা শুনে সামিনা হাসল। সে হাসিতে ঝরে পড়ে শ্লেষ। কাঁধ ঝাঁকিয়ে সামিনা বলল, ধ্যাত, তা কি হয়! ফ্লাইং সসার হল পুরোপুরি গুজব।
মানুষ কেন যে এসব বিশ্বাস করে। রাবিশ!
মাহাতাব বলল, আমিও পেপারে পড়েছি সাজেকের আকাশে ইউএফও দেখা গেছে; ঘটনাটা সত্যি হলেও হতে পারে সামিনা, একেবারে উড়িয়ে দেওয়া ঠিক না ।
মাহাতাবের বউ উর্মি । সম্ভবত সে কারণেই স্বামীর কথায় সায় দিয়ে উর্মি বলল, হ্যাঁ, ঘটনাটা সত্যি হলেও হতে পারে। একেবারে উড়িয়ে দিস না সামিনা ।
সম্পর্কে উর্মির কাজিন সামিনা । সম্পর্ক অম্ল-মধুর; সামিনা একবার খর চোখে উর্মির দিকে তাকাল। উর্মি অবশ্য দেখতে পেল না।
রাশেদ দূরের অথই জোছনার উপত্যকার দিকে চেয়ে হেসে বলল, হুমম। ঘটনাটা সত্যি হলেও হতে পারে ।
সাজেকের মতো এমন নিরালা পাহাড়ি এলাকা এলিয়েনদের বেছে নেওয়ার কারণ আছে।
কেন রাশেদ ভাই? শান্তা জানতে চাইল। শান্তার কন্ঠস্বর সামান্য কেঁপে উঠল।
রাশেদ বলল, সাজেক উপত্যকা অনেকটাই জনমানবশূন্য। ফ্লাইং সসার ল্যান্ড করার জন্য নিরাপদ স্থান, তাই।
রাশেদের দিকে তাকাল সামিনা । ও, আপনিও তাহলে এলিয়েন-এর অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন?
কিছু না-বলে কাঁধ ঝাঁকাল রাশেদ । ওর পরনের সাদা রঙের ফিনফিনে পাঞ্জাবিটি অশান্ত হাওয়ায় উড়ছে।
রাশেদ এলিয়েন-এর অস্তিত্বে বিশ্বাস করে বলে বিষন্ন বোধ করে সামিনা । অবশ্য সামনের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে যায়।
মাঠটি যেখানে ঢালু হয়ে উপত্যকায় নেমে গেছে, সেখানে সারি-সারি ইউক্যাপ্টিাস গাছ, কমলা গাছ। তারপর গভীর উপত্যকা; অনেক নীচে একটি নদী, রুপালী ফিতের মতো এঁকেবেঁকে বয়ে চলেছে। দূরে মিজোরাম-এর সীমান্ত, নো ম্যানস ল্যান্ড। সত্যিই কি ওখানে ফ্লাইং সসার নেমেছে? কিন্তু তা কি করে হয়?
জোছনার আকাশে কী এক পাখি টী টী শব্দ তুলে উড়ে যায় মিজোরাম সীমান্তের দিকে।
শান্তার হঠাৎই শীত-শীত করে।
ভালো করে চাদর জড়িয়ে নিয়ে বলল, ইস্, আমরা থাকতে-থাকতেই যদি ফ্লাইং সসারটা নামত সাজেকে ।
রাজীব হেসে বলল, আর এলিয়েনরা ছোঁ মেরে আমাদের তুলে নিয়ে যেত শত আলোকবর্ষ দূরের প্ল্যানেট এক্স-এ।
শান্তা হেসে উঠে বলে, না, না, তা কেন হবে-অত সহজ! আজ সাজেক পয়েন্ট বিডিআর বিওপি এবং আর্মি ক্যাম্প দেখলাম না!
রাজীব মাথা নাড়ে। আজই সে দেখেছে-পাহাড়ের উপরিভাগ পরিস্কার করে আর্মি এবং বিডিআর-এর পাশাপাশি দু'টি ক্যাম্প আছে।
শান্তার কথা শুনে সামিনা হাসল।
এসবই হলিউডি ছবি দেখার ফল। বিডিআর ফাইট করবে এলিয়েনদের বিরুদ্ধে!
কিছুটা জোর গলায় সামিনা বলল, ফ্লাইং সসার হল শ্রেফ হ্যালুসিনেশন। চোখের ভুল, আর কিছু না, অথচ সারা পৃথিবীর মানুষ তাই বিশ্বাস করে।
মাহাতাব গম্ভীর কন্ঠে বলল, চোখের ভুল নাও হতে পারে সামিনা । এত লোক যখন দেখেছে।
উর্মি বলল, আমারও তাই মনে হয়।
সামিনা চুপ করে থাকে। এদের সঙ্গে তর্ক করে লাভ নেই। এরা এত কানপাতলা, কোনওকিছু তলিয়ে দেখবে না।
মাহাতাব বলল, সাজেকে ফ্লাইং সসার দেখা গেছে- এ কথা ছড়িয়ে পড়লে আমাদের প্রজেক্ট অবশ্য ভেস্তে যেতে পারে।
মাহাতাবের কন্ঠে উদ্বেগের সুর ফুটে ওঠে।
হ্যাঁ। এলিয়েনের ভয়ে দেশি-বিদেশি ট্যুরিস্টরা সাজেক বেড়াতে আসবে না, তোমাদেরও প্রফিটও কমে যাবে। উর্মি বলল।
মাহাতাব মাথা নাড়ে।
তার মুখে ক্ষীণ উদ্বেগের ছাপ ফুটে উঠেছে। তার কারণ আছে। মাউন্টেন ভিউ লিমিটেড-এর পক্ষ থেকে সাজেকের ট্যুরিস্ট স্পটগুলি সার্ভে করতে এসেছে মাহাতাব । এক হাজার কোটি টাকার মেগা প্রোজেক্ট। পরিকল্পনায় রয়েছে হোটেল-মোটেলসহ অ্যামুজমেন্ট পার্ক, ইকো পার্ক, ক্যাবল কার, টয়ট্রেন, সুইমিংপুল, মুভি কমপ্লেক্স, রেস্টুরেন্ট, জিম, সেলুনসহ আরও অনেক বিনোদন কেন্দ্র ।
সাজেক যদিও রাঙ্গামাটির জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার একটি ইউনিয়ন, তবে ভৌগলিক কারণেই খাগড়াছড়ি - দিঘীনালা - বাঘাইহাট - কাসলং - মাসালং হয়ে সাজেক আসতে হয়। খাগড়াছড়ি থেকে মাসালং পর্যন্ত প্রায় ৫০ কিঃমিঃ রাস্তা ভাল। কিন্তু মাসালং থেকে সাজেক পর্যন্ত ১৭ কিঃমিঃ রাস্তা খুবই খারাপ। রাস্তা পাকা করার কাজ করছে আর্মিদের একটা দল, ইসিবি-১৯। মাউন্টেন ভিউ লিমিটেড এর নিজস্ব বিলাসবহুল বাস খাগড়াছড়ি থেকে ট্যুরিস্টদের তুলে সরাসরি সাজেকে নিয়ে আসবে।
সাজেকে প্রতিদিনই দূরদূরান্ত থেকে লোকজন আসছে, সাজেক সম্বন্ধে মানুষের আগ্রহ দিনদিন বেড়েই চলেছে। সাজেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের একটি রেস্টহাউস থাকলেও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেটি জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে রয়েছে। এই কটেজটি মাউন্টেন ভিউ লিমিটেড-এর প্রথম প্রজেক্ট। সাজেক ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এলথাংগা লুসাই এবং কংলাক পাড়ার কারবারী চংমিং থাং লুসাই-এর সঙ্গে ঘন-ঘন বৈঠক করছে মাহাতাব। সাজেকের মনোরম ট্যুরিষ্ট স্পটগুলি ঘুরে ঘুরে দেখছে; রিপোর্ট লিখছে: ... ৪০ হাজার জনসংখ্যা অধ্যুষিত ৬০৭ বর্গমাইল আয়তন বিশিষ্ট সাজেকই বাংলাদেশের সবচে বড় ইউনিয়ন ।
অদূর ভবিষ্যতে সাজেকেই বাংলাদেশের দার্জিলিং হয়ে ওঠার বিপুল সম্ভাবনা । সুতরাং সাজেকে পর্যটন-অবকাঠামো নির্মাণে ভাস্ট-ইনভেস্টমেন্ট করা যেতে পারে। তবে সমস্যাও আছে। সাজেকে কেবল সরকারি মোবাইল নেটওয়ার্ক থাকে, দেশের অন্যান্য টেলিঅপারেটরদেরও এখানে ইনভলব করার কথাও ভাবতে হবে ... তবে আপাতত সংশয় ওই ফ্লাইং সসার নিয়েই। সাজেকে ফ্লাইং সসার দেখা গেছে- এ কথা ছড়িয়ে পড়লে সম্ভবত ট্যুরিস্ট আসা কমে যেতে পারে।
মাহাতাব ক্ষীন উদ্বেগ বোধ করে।
সামিনা বলল, মাহাতাব ভাই।
বল।
আপনাদের প্রজেক্টে যেন বেশি বেশি করে ট্যুরিষ্ট আসে সে জন্য পত্রিকায় টাকা ঢেলে আপনারাই ফ্লাইং সসারের গুজব ছড়াচ্ছেন না তো?
আরে না, না। কি যে বল।
এলিয়েনের ভয়ে লোকে সাজেক আসবে কেন? এলিয়েনরা বড় বিপদজনক জীব। পৃথিবীর লোকে এলিয়েনদের ভয় করে।
উল্টোটাও তো হতে পারে মাহাতাব ভাই।
আরে না। বললাম না- এলিয়েনরা বড় বিপদজনক জীব।
সামিনার দিকে জ্বলন্ত চোখে তাকায় উর্মি; যেন পুড়িয়ে ছাই করে দেবে। সামিনা কে সাজেকে নিয়ে আসা ঠিক হয়নি। অবশ্য উপায় ছিল - রাজীব ভাই মাহাতাব ঘনিষ্ট বন্ধু, এক সঙ্গে স্কুল-কলেজে পড়েছে । রাশেদ রাজীব ভাইয়ের কাজিন । সামিনার সঙ্গে রাশেদের বিয়ের প্রস্তাব মাহাতাব-ই দিয়েছে।
সামিনা ঢাকায় একটা মহিলা কলেজে পড়ায়। রাশেদ একটা প্রাইভেট ব্যাংকে আছে।
সামিনা শ্লেষের সুরে বলল, মহাকাশের এলিয়েন খুঁজে কী লাভ? এই পৃথিবীতেই তো কত এলিয়েন আছে। এ গ্রহের পুরুষেরা কি সুন্দর ভিন গ্রহের এলিয়েন সন্ধানে মেতে উঠেছে অথচ ... অথচ পৃথিবীতে যে এলিয়েন আছে তার খোঁজ করছে না!
কি বললি তুই!
কিছু না।
উর্মির শরীরে জ্বলে ওঠে ক্রোধ ।
ঘুম পেয়েছে - বলে মাহাতাবকে নিয়ে চলে যায় উর্মি ।
ওদের পিছন পিছন রাজীব আর শান্তাও চলে যায় ।
ওদের এই চলে যাওয়াটা অনেকটাই ইচ্ছাকৃত। ঢাকায় ফিরেই রাশেদ আর সামিনার বিয়ে হওয়ার কথা। দু’জনার পরিচয় অবশ্য আগে থেকেই ছিল, তারপরও বিয়ের আগে নিরিবিলি দু’পক্ষের কথাবার্তা হওয়া দরকার।
রাশেদ জিজ্ঞেস করে, সামিনা, আপনি এলিয়েন-এর অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না কেন?
কেন আবার- এলিয়েন-এর অস্তিত্ব নেই বলেই করিনা।
আপনি সিওর যে এলিয়েন-এর অস্তিত্বে নেই ? এত বিশাল মহাবিশ্ব, আমরা তার কতটুকু জানি।
সামিনা ফিজিক্সের ছাত্রী । কপালের ওপর থেকে এলোমেলো চুল সরিয়ে বলল, বুঝলাম। তবে সমস্যাটা দূরত্বের।
এই ছায়াপথের কথাই ধরুন- এই ছায়াপথের গ্রহগুলোর দূরত্ব এত বেশি যে এক গ্রহ থেকে অন্য গ্রহে পৌঁছতে স্পেসশীপকে আলোর গতিতে ছুটতে হবে। সেটা কি করে সম্ভব বলুন?
রাশেদ অর্থনীতির ছাত্র হলেও পত্রপত্রিকায় পপুলার সায়েন্স নিয়ে লেখাগুলি নিয়মিত পড়ে । সে বলল, বিজ্ঞানীরাও তো বসে নেই সামিনা, তারাও চেস্টা করে চলেছেন। এই পলিমারের কথাই ধরুন -
সামিনা হেসে বলল, আচ্ছা এখন এসব বাদ দিন তো। আজ এখানে আসার সময় দেখলাম গাড়িতে বসে কি যেন লিখছিলেন?
রাশেদ হাসল।
সে যে কবিতা লেখে তা সামিনা জানে। সে বলল, কবিতা।
শুনব।
আসলে কবিতার খসড়া, সবটা এখনও তৈরি হয়নি।
খসড়াই শুনব।
প্লিজ।
রাশেদ স্মৃতি থেকে আবৃত্তি করতে থাকেÑ
একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু পাথরের ওপর বসে ধর্ম ব্যাখ্যা করছিলেন
তাঁর ওপর ঝরে ঝরে পড়ছিল স্বর্গীয় আলো
পিছনের জঙ্গল থেকে ভেসে আসছিল বনমোরগের ডাক
উপত্যকাময় ছড়িয়ে ছিল বিকেলের গাঢ় ছায়া
পড়ন্ত বিকেলের বাতাসে ভাসছিল পাতাবিড়ির গন্ধ
পাহাড়ি জোছনা দেখব বলে আমরা বহুদূর চলে এসেছি
এরপর ফেরার পথটি খুঁজে পেলেই হয় ...
রোহিনী তার স্কার্ফটি হারিয়েছে ডাকবাংলোর পিছনে
ড্রাইভার গুন গুন করে গাইছিল হিন্দি ছবির গান
আবিরও ঢাউস একটা ক্যামেরা নিয়ে মহীয়ান ...
এইসবই মনে আছে। আর-
পাথরের ওপর বসে একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু ধর্ম ব্যাখ্যা করছিলেন
তাঁর ওপর ঝরে ঝরে পড়ছিল স্বর্গীয় আলো
পিছনের জঙ্গল থেকে ভেসে আসছিল ঝিঁঝির ডাক ...
কবিতা শেষ হতেই সামিনা জিজ্ঞেস করল, রোহিনী কে?
রাশেদ থতমত খেল। বলল, কেউ না তো। বলে চশমাটা ঠিক করে নিল।
কাছেই কোথাও হয়তো একটি আগর গাছ রয়েছে। আগরের সুগন্ধ পেল সে ।
তা হলে? সামিনার কন্ঠস্বর কিছুটা তীক্ষ্ম শোনায়।
কি তাহলে?
কবিতায় লিখলেন যে- রোহিনী তার স্কার্ফটি হারিয়েছে ডাকবাংলোর পিছনে ...ওকে কি কেউ রেপ করেছিল?
রাশেদ হাসল। বলল, ধ্যাত, কী যে বলেন।
কবিতা লেখার সময় কত কত শব্দ আসে। যদি কবিতা লিখতেন তা হলেই বুঝতেন।
সত্যি কথা বলবেন না?
সত্যি। আমি রোহিনী নামে কাউকে চিনি না।
রোহিনী হয়তো অন্য কোনও নামের বদলে এসেছে প্রতীক হিসেবে?
হ্যাঁ, সেরকম তো হতেই পারে।
রাশেদ মাথা নাড়ল।
স্বীকার করলেন তাহলে?
আচ্ছা, করলাম।
ধন্যবাদ।
জোছনার আকাশে কী এক পাখি টী টী শব্দ তুলে উড়ে যায় মিজোরাম সীমান্তের দিকে।
সামিনা অভিভূত হয়ে যেতে থাকে।
আজ মাহাতাব ভাই বলছিল-বাংলাদেশের এই অঞ্চলের সীমান্ত প্রহরাবিহীন, ভারতের অংশেও তাই। সাজেক বিডিআর বিওপি থেকে পূর্বদিকে মিজোরাম বর্ডারের দূরত্ব একদিনের হাঁটা পথ, আর উত্তরের ত্রিপুরা সীমান্ত যেতে হাঁটতে হবে পুরো তিন দিন। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন পাহাড় আর গহীন অরণ্যে ঘেরা এই সীমান্ত রেখা প্রাকৃতিকভাবেই সুরক্ষিত । সামিনা শ্বাস টানে। ওখানে একটি ফ্লাইং সসার ল্যান্ড করেছে বলে গুজব ছড়িয়েছে।
গুজব যদি সত্যি হয় তো এতক্ষণে এলিয়েনদের স্পেসশিপ থেকে নেমে ছড়িয়ে পড়ার কথা। কিন্তু, তা কি করে সম্ভব? সামিনা বলে, সাজেক উপত্যকায় ফ্লাইং সসার আছে কী নেই-তা কেবল পাখিরাই জানে, কিন্তু ওরা তো আর সেকথা কাউকেই বলবে না।
সামিনার এই কথাটা রাশেদকে গভীরভাবে স্পর্শ করে । সে বাতাসে 'আগর'-এর সুগন্ধ পেল। এই প্রথম টের পেল ... এক গভীর দুঃখ কালো ছায়ায় সামিনার জীবন ঢেকে আছে, যে দুঃখের কারণ কখনও জানতে পারবে না রাশেদ।
রাশেদ দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে। পাঞ্জাবির পকেটে হাত দেয়, সিগারেটের প্যাকেটের স্পর্শ পায়। অবশ্য সিগারেট ধরালো না। কাছেই কোথাও একটি কফি গাছ আছে মনে হল। তার গন্ধটা ক্রমশ তীব্র হয়ে আগরের গন্ধের সঙ্গে মিশেছে।
এই প্রাকৃতিক গন্ধ বিনষ্ট করার অধিকার তার নেই।
সামিনা বলল, আমি আসলে সাজেক আসতাম না রাশেদ ভাই । মাহাতাব ভাই বলল ... তাই এলাম। ঢাকাতেও অবশ্য দম বন্ধ হয়ে আসছিল। ছাত্রী পড়িয়ে আর পরীক্ষার খাতা দেখে দেখে মাথা ফাঁকা হয়ে ছিল।
... আসলে আপনি যা ভাবছেন তা সত্য না রাশেদ ভাই। এ বিয়েতে আমার আগ্রহ নেই।
রাশেদ চমকে ওঠে। অস্ফুট স্বরে বলে, আমি ... আমি ... কিন্তু অন্যরকম শুনেছিলাম। আগ্রহটা আপনাদের দিক থেকেই, মানে শান্তা ভাবী বলল মাহাতাব ভাই নাকি...
আমি সেসব জানি।
তাহলে?
একজন এলিয়েন-এর সঙ্গে ঘর করবেন কেন?
মানে!
মানে, আমরা, মেয়েরা কি আপনাদের কাছে এলিয়েন নই? পুরুষেরা কি মেয়েদের এলিয়েন মনে করে না? মেয়েদের পুরুষেরা এলিয়েনের মত ট্রিট করে না? পুরুষেরা মেয়েদের মানুষের মত ট্রিট করলে এত ধর্ষন, এত অ্যাসিড ছোড়া, এত ইভটিজিংয়ের মতো নির্মম ঘটনা ঘটে কি করে বলুন? এ দেশে একটি মেয়েও নেই যে জীবনে সেক্সচুয়ালি অ্যাবিউসড হয়নি; মেয়েরা এলিয়েন না-হলে এমন পাশবিক ঘটনা কি করে সম্ভব বলুন? তখন মাহাতাব ভাই বললেন না যে- এলিয়েনরা বড় বিপদজনক জীব। পুরুষেরা আসলে মেয়েদের বিপদজনক জীব মনে করে । নইলে দেশজুড়ে মেয়েদের জীবন ধ্বংসের ভয়ঙ্কর উৎসবে মেতে উঠবে কেন বলুন।
রাশেদ দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে। ওর কাছে অনেক কিছুই যেন পরিস্কার হয়ে যাচ্ছে।
ওরা যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে তার ঠিক পাশেই একটি কমলা গাছ। কমলা পাতায় টুপটাপ শিশির বিন্দু পড়ছে, সেই শিশির বিন্দুতে চাঁদের কিরণ মিশে মোহময় এক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এ গ্রহে মানুষের জীবন এত সুন্দর, এত মোহময় না। কথাটা ভাবতেই অদৃশ্য কফি ফলের গাঢ় গন্ধ পেল রাশেদ। সে শ্বাস টানে, আর শপথ করে- এই পৃথিবীর মেয়েরা এলিয়েন হোক বা না-হোক - সে সামিনার সব দুঃখ ভুলিয়ে দেবে।
চাঁদের আলোয় সামিনার পান পাতার মতো মিষ্টি শ্যামলা মুখের দিকে চেয়ে গভীর আবেগে রাশেদ বলল, সামিনা।
বলুন।
এ ক’বছর আপনাকে আমি যতদূর দেখেছি, আমার ভালো লেগেছে।
বুঝলাম। তো? সামিনা হাসল।
বড় মলিন সে হাসি।
আমার যা বলার ছিল আমি বলেছি।
সামিনা সেই প্রশ্নটিই পুনরাবৃত্তি করে- মিছিমিছি একজন এলিয়েন-এর সঙ্গে ঘর করে কী করবেন? সামিনার প্রশ্নে শ্লেষ স্পস্ট।
রাশেদ কী উত্তর দেবে। সে চুপ করে থাকে।
সামিনা ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল। তারপর দ্রুতপায়ে কটেজের দিকে হাঁটতে থাকে । কে যেন রাশেদ-এর হৃৎপিন্ডটি কেটে দু’টুকরো করে ফেলল। যদিও তখনও সাজেকের জোছনা রাতের বাতাসে ভাসছিল আগরের মিষ্টি সুগন্ধ ...আর ভাসছিল ওর লেখা কবিতার দুটি চরণ-
পাহাড়ি জোছনা দেখব বলে আমরা বহুদূর চলে এসেছি
এরপর ফেরার পথটি খুঁজে পেলেই হয় ...
সাজেক সম্বন্ধে তথ্যসূত্র:
সামহোয়্যারইন ব্লগে প্রকাশিত জেড ইসলাম এর একটি পোস্ট: “জার্নি টু ’সাজেক’-পাহাড়ের এক রানী” এবং
ব্লগার নীল ভোমরার ; “সাজেক ট্যুর! কিছু ছবি, কিছু তথ্য!” এবং শীর্ষ নিউজ ডট কম ৩ নভেম্বর, বুধবার, ২০১০
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।