আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পথে ওত পেতে আছে বিপদ!

এবার ঈদে বাড়ি যাওয়া হয়নি এমিলিয়ার। তা না হোক, বেঁচে থাকলে আরও অনেক ঈদের দিন আসবে। মা-বাবা-পরিবারের সঙ্গে আনন্দের সময়ও কাটানো যাবে অনেক। আগে তো বেঁচে থাকা। এই বেঁচে থাকার আনন্দে বাকি সব আফসোস তুচ্ছ হয়ে গেছে।

কিন্তু ঈদে বাড়ি যেতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হলো, বাকি জীবনে কখনো কি তা ভুলতে পারবেন এমিলিয়া? এখনো ঘুমের ঘোরে সেই দৃশ্য ভেসে ওঠে চোখে। ভয়ে শিউরে ওঠে সারা শরীর, ঘুম ভেঙে যায়।
এমিলিয়া খানম সাংবাদিক। একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার চট্টগ্রাম অফিসে কর্মরত। নেত্রকোনা বাড়ি।

ঈদের ছুটিতে বাড়িতে যাচ্ছিলেন ৭ আগস্ট। একা বলেই পাশাপাশি দুটো আসনের টিকিট কিনেছিলেন বিড়ম্বনা এড়াতে। যাত্রা শুরু হয়েছিল রাত আটটায়। আধঘণ্টা বা পৌনে এক ঘণ্টায় চট্টগ্রাম শহর ছেড়ে বাড়বকুণ্ডের কাছাকাছি পৌঁছে বাস। এখানে এসে দেখেন বিশাল যানজট।

শুনতে পান, শিবিরের এক নেতা খুন হয়েছেন সীতাকুণ্ডে। তার জের ধরে সড়ক অবরোধ, যানবাহন ভাঙচুর চলছে সীতাকুণ্ডের দিকে। এ অবস্থায় গাড়ির চালক সামনে না এগোনোর সিদ্ধান্ত নিলে যাত্রীরাও সবাই তাতে সায় দেন। রাত পৌনে নয়টা থেকে একটা পর্যন্ত সেখানেই ঠায় বসে থাকা। দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর উল্টো দিক থেকে পুলিশের গাড়ি ও অ্যাম্বুলেন্স আসতে দেখে ভরসা পেলেন চালক।

গাড়ির দীর্ঘ সারি চলতে শুরু করল ধীরে। দেরি হোক, তবু বাড়ি তো পৌঁছানো যাবে—এই ভেবে উৎফুল্ল যাত্রীরা।
কিন্তু তখনো তাঁরা জানেন না কী বিপদ অপেক্ষা করছে সামনে। রাত আড়াইটার দিকে সীতাকুণ্ডের আগে বাড়বকুণ্ড-সীতাকুণ্ডের মাঝামাঝি একটি অন্ধকার জায়গায় হঠাৎ শুরু হলো আক্রমণ। রাস্তার দুই পাশে মাঠ।

মাঠ থেকে কিরিচ, লাঠি হাতে কিছু লোক এসে এলোপাতাড়ি ভাঙতে শুরু করল সারিবদ্ধ গাড়ি। একসময় বৃষ্টির মতো ইটের টুকরা এসে পড়ছিল বাসের জানালায়। টুকরা কাচ আর পাথর থেকে নিজেকে বাঁচাতে যাত্রীরা সবাই শুয়ে পড়েছে বাসের মেঝেতে। বাসের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। হঠাৎ এমিলিয়া দেখলেন তাঁদের গাড়ির চালককে গাড়ি থেকে বের করে নিয়ে গায়ে পেট্রল ঢেলে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা।

আতঙ্কে আর্তনাদ করছেন চালক। এ সময় কীভাবে বাসের বন্ধ দরজা খুলে রাস্তায় নেমে এসেছেন মনে করতে পারেন না এমিলিয়া। শুধু মনে আছে, পেছন ফিরে দেখেছিলেন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছে তাঁদের বাসটি। তাঁর মতোই শত শত যাত্রী তখন প্রাণ ভয়ে ছুটছেন এদিক-সেদিক। কিন্তু বাইরে বেরিয়ে এসে বোঝা গেল এখানে ডাঙায় বাঘ জলে কুমিরের অবস্থা।

ভীত-আতঙ্কিত যাত্রীদের যাঁর কাছে যা আছে তা-ই ছিনিয়ে নিচ্ছে একদল মানুষ। মেয়েদের ব্যাগ, গলার সোনার হার, কানের দুল কেড়ে নিচ্ছে তারা। এমনকি মেয়েদের গায়ে হাত দিতেও দ্বিধা করছে না।
ভয়ার্ত মানুষের চিৎকার, অসহায় মেয়েদের হাহাকার আর কিছু লোকের জান্তব উল্লাস মিলিয়ে সে এক বীভৎস দৃশ্য! একাত্তর দেখেননি এমিলিয়া। রাজাকার-আলবদররা পাকিস্তানি বাহিনীর সহায়তায় লুটপাট করেছে, এ কথা শুনেছেন।

সেই ভয়াবহতার একটি খণ্ডচিত্র যেন পুনরাবৃত্ত হচ্ছে তাঁর চোখের সামনে, স্বাধীন দেশে! কারা করছে এসব? শিবির? কেন? তাদের কর্মী খুন হয়েছে প্রতিপক্ষের হাতে। সেই প্রতিপক্ষ নিশ্চয়ই তাদের এলাকারই বাসিন্দা। তাহলে ঈদে ঘরমুখী এই বাসযাত্রীদের ওপর প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা কেন? একপর্যায়ে পুলিশ এসেছে। দুর্বৃত্তরা গা ঢাকা দিয়েছে আশপাশে। পুলিশ সরে গেলেই তারা যে আবার ফিরে আসবে, এ ব্যাপারে নিশ্চিত ভুক্তভোগীরা।

কারণ, এ রকম চোর-পুলিশ খেলা দেখছেন তাঁরা অনেকক্ষণ ধরে। চালক ও যাত্রীদের মধ্যে তাই ফিরে আসেনি স্বস্তি।
কোন বাস থেকে নেমেছিলেন, কোন বাসে উঠেছেন এসব আর মনে ছিল না এমিলিয়ার। কোনোমতে ফেনী পর্যন্ত গিয়ে একটা ফিরতি বাসে চেপে চট্টগ্রামের দিকে রওনা দিয়েছেন তিনি। ওই যে শুরুতে বলেছিলাম, বেঁচে থাকলে ঈদ আরও আসবে...।


ফিরে আসার পথে ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কের দৃশ্য দেখে মনে হয় যেন যুদ্ধবিধ্বস্ত কোনো দেশ। রাস্তার দুই পাশে পড়ে আছে মালপত্রসহ ভস্মীভূত ট্রাক ও কনটেইনার বোঝাই লরি। চারদিকে পোড়া গন্ধ, ভাঙা কাচ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে যত্রতত্র।
এমিলিয়ার ধারণা, শুধু রাজনীতিসংশ্লিষ্ট লোকজনই এসব করেনি। এতে যোগ দিয়েছে আশপাশের গ্রামের সুযোগসন্ধানী কিছু মানুষও, যারা মানুষকে ভয় দেখিয়ে মূল্যবান সম্পদের ক্ষতি করে বিকৃত আনন্দ লাভ করেছে।

আর লুট-ছিনতাইয়ের নগদ লাভ তো আছেই।
‘বিকৃত আনন্দের’ কথা যখন এলই, তখন প্রীতি নামের তরুণ প্রকৌশলীর মর্মান্তিক মৃত্যুর প্রসঙ্গটি উল্লেখ করতে হয়। ট্রেনে চেপে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা যাচ্ছিলেন প্রীতি দাশ (২৪)। পাশে ছিলেন তাঁর স্বামী মিন্টু দাশ ও তাঁর বন্ধুরা। হাসিখুশি আনন্দময় পরিবেশে যাত্রা।

কে জানত মুহূর্তেই মুছে যাবে এ ছবি। বেদনায় ভরে যাবে চারপাশ। অজ্ঞাত কেউ একজন ঢিল ছুড়ে মেরেছিল ট্রেনের জানালা লক্ষ্য করে। সোজা এসে লেগেছিল প্রীতির মাথায়। রোগবালাই, ঝগড়া-ফ্যাসাদ-শত্রুতা, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা এমনকি বড় কোনো দুর্ঘটনাও নয়, বলা চলে অকারণে, কোনো যুক্তিসংগত কারণ ছাড়াই মৃত্যুবরণ করতে হলো মায়ের আদরের মেয়ে, চার ভাইয়ের একমাত্র বোন, সুদর্শন তরুণের সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী প্রীতিকে।

হয়তো শুধুই খেলাচ্ছলে ঢিল ছুড়েছিল কেউ, শুধুই তামাশা। এই বিকৃত আনন্দের মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা কী?
এ ঘটনা দুঃখজনক, কিন্তু নতুন কিছু তো নয়। সংবাদপত্রের প্রতিবেদন বলছে, এক বছরে চলন্ত ট্রেনে পাথর ছোড়ার ঘটনা ঘটেছে অন্তত ৫৪ বার। আমরা জানি, প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি। রেলওয়ে সূত্র জানিয়েছে, বেশির ভাগ ঘটনা রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের নজরে আসে না।

বড় ঘটনাগুলো কেবল নথিভুক্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয় (প্রথম আলো, ১৩ আগস্ট)। সুপারিশ করা হয় বটে, ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অপরাধী শনাক্ত করবে কে? রেললাইনের পাশে দাঁড়িয়ে কে কখন এই বিকৃত খেলায় মেতে উঠল, খেলা শেষ করে সরে পড়ল নীরবে, কে তার খোঁজ রাখবে?
প্রীতি দাশ মারা গেছেন, এর আগে ১৯৯৭ সালে ট্রেনে ছোড়া ঢিলে মারা গেছেন একজন জেলা নিবন্ধন কর্মকর্তা। এসব খবর আমরা জানি। কিন্তু জানি না কত মানুষ এই নিষ্ঠুর তামাশার শিকার হয়ে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে, পঙ্গু হয়ে কাটাচ্ছে দুঃসহ জীবন।
আইন-আদালত দিয়ে এ সমস্যার সমাধান হওয়ার কথা নয়।

প্রয়োজন জনসচেতনতা। রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মো. তফাজ্জল হোসেন বলেছেন, ‘আমরা প্রতিবছর গণসচেতনতা সৃষ্টির জন্য রেললাইনের আশপাশের বাসিন্দাদের মধ্যে প্রচারপত্র বিলি এবং ট্রলিযোগে মাইকিং করে আসছি। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে লোকজনকে সচেতন করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ’
এসব উদ্যোগ যে খুব একটা সফলতা পায়নি, প্রীতি দাশের মৃত্যুই তো তার বড় প্রমাণ। ঘরে-পরিবারে, স্কুল-কলেজে, মসজিদ-মন্দিরে এমনকি চায়ের দোকানের আড্ডাতেও যদি শিশু-কিশোর-তরুণদের মানুষের দায়িত্বের কথা, অন্যের ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকার প্রকৃত শিক্ষা দেওয়া না যায়, তাহলে এই প্রবণতা কি বন্ধ হবে?
জাতি হিসেবে অনেক অর্জন আমাদের আছে।

সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অনেকগুলো আমরা অর্জন করেছি নির্দিষ্ট সময়ের আগেই। শিশুমৃত্যুর হার, মাতৃমৃত্যুর হার কমেছে, বেড়েছে শিক্ষার হার, মাথাপিছু আয়। উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে সমীহ আদায় করার কথা ভাবতেই পারি আমরা। কিন্তু এমিলিয়াদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা আর প্রীতিদের মৃত্যু কি আমাদের সভ্য জাতি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াতে দেবে?
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwabd@yahoo.com।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।