আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ইভ টিজিং

মেঘে মেঘে অলস বেলা ...

আমি পেপার এমনিতেই কম পরি,সম্পাদকীয় তো আরোই না। কারোন এতো এতো খারাপ খবোর পরতে ভালো লাগে না। যাই হোক আজকে সম্পাদকীয় তে দেখলাম ইভ টিজিং নিয়ে দুটি আরটিকেল,কিন্তু বুঝলাম ণা,কোনটা বেশি দরকার? কেও কি একটু বলবেন? দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করুন উত্ত্যক্তকরণ থেকে হত্যা মাত্র দুই সপ্তাহের ব্যবধানে নাটোরের লোকমানপুরে এক কলেজশিক্ষক ও ফরিদপুরের মধুখালীতে এক মায়ের হত্যাকাণ্ড আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, নারী উত্ত্যক্তকারী বখাটে-সন্ত্রাসীদের উপদ্রব কী ভয়ংকর মাত্রায় বেড়ে চলেছে। উত্ত্যক্তকারীরা কী নৃশংস হত্যাকারী হয়ে উঠছে। মধুখালীর চাঁপা রানী ভৌমিক (৪৮) চেয়েছিলেন তাঁর দুটি কিশোরী মেয়ে যেন নির্বিঘ্নে বিদ্যালয়ে যাওয়া-আসা করতে পারে, বিদ্যালয়ের পথে বখাটেরা যেন তাদের উত্ত্যক্ত না করে, হাত ধরে না টানে, অপহরণের হুমকি না দেয়।

অবশ্য তিনি থানা-পুলিশের কাছে যাননি; উপজেলা চেয়ারম্যান, নারী ভাইস চেয়ারম্যান ও মেয়েদের বিদ্যালয়টির ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যদের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। কিন্তু এর ফল হলো উল্টো, অতি ভয়ংকর। বখাটে সন্ত্রাসী চাঁপা রানীকে মোটরসাইকেল চাপা দিয়ে হত্যা করল। নাটোরের কলেজশিক্ষক মিজানুর রহমানের হত্যার ঘটনাও ছিল একই রকম। তিনিও তাঁর ছাত্রীদের উত্ত্যক্তকারীদের সরাসরি কিছুই বলেননি, বলেছিলেন কলেজের অধ্যক্ষকে।

অধ্যক্ষ উত্ত্যক্তকারী দুই বখাটে সন্ত্রাসীকে ভর্ৎসনা করেছিলেন—সেই ক্রোধে তারা মিজানুর রহমানের ওপর প্রথমে মোটরসাইকেল তুলে দিয়ে, পরে মাথায় ও চোখে আঘাত করে হত্যা করেছে। অর্থাৎ উভয় ক্ষেত্রেই নিগ্রহের শিকার মেয়েদের অভিভাবকেরা আইন-আদালত এড়িয়ে সামাজিকভাবে সমস্যাটির সমাধান প্রত্যাশা করেছিলেন। মেয়েদের উত্ত্যক্ত করাকে এখন আর ‘ইভ টিজিং’ বলে হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। ‘ইভ টিজিং একটা সামাজিক সমস্যা, এটা শুধু পুলিশিংয়ের মাধ্যমে নির্মূল করা সম্ভব নয়’—এমন কথা বলাও এখন আর যথেষ্ট নয়, যেমনটি বলেছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক। যদি শুধু সামাজিক সমস্যাই হতো, তাহলে লোকমানপুরে বা মধুখালীতে—কোথাও হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত গড়াত না, কারণ দুটি ক্ষেত্রেই মেয়েদের অভিভাবকেরা সমাধান চেয়েছিলেন সামাজিক পন্থায়।

এখন অত্যন্ত কঠোর হাতে নামতে হবে উত্ত্যক্তকারীদের দমনের অভিযানে। গত এক বছরে ১২৬৯ জন উত্ত্যক্তকারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ নথিভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু শাস্তি হয়েছে কজনের? দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে উত্ত্যক্তকারীদের দৌরাত্ম্য হয়তো এতটা বাড়ত না। এই অপরাধকে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল আইনের আওতায় নিয়ে চাঞ্চল্যকর অপরাধের তালিকাভুক্ত করা উচিত। এর পাশাপাশি পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে মেয়েদের উত্ত্যক্তকরণ বিষয়ে সচেতনতা ও সংবেদনশীলতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন, যেন তাঁরা দ্রুত সাড়া দিয়ে নিগৃহীত মেয়েদের সাহায্যার্থে এগিয়ে যান।

উত্ত্যক্তকারীদের হাতেনাতে ধরতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এলাকাসহ বিভিন্ন সামাজিক স্থানে সাদা পোশাকে পুলিশ সদস্যদের টহলের উদ্যোগ নিলে ভালো হয়। সামাজিকভাবেও উত্ত্যক্তকরণ-বিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, মসজিদ-মন্দিরের ধর্মীয় নেতা, কিশোর-কিশোরীদের মা-বাবা ও পাড়া-মহল্লার গণ্যমান্য নাগরিকেরা—সবাই একজোটে চাইলে উত্ত্যক্তকারীদের দমন করা অসম্ভব কিছু নয়। আমরা দেখেছি, উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়ে অনেক মেয়ে আত্মহত্যা করেছে। এখন দেখা যাচ্ছে, উত্ত্যক্তকারীরা হত্যাকারী হয়ে উঠেছে।

এই নৃশংস দুর্বৃত্তি আর বাড়তে দেওয়া যায় না। এখনই শক্ত হাতে এর রাশ টেনে ধরতে হবে। মিজানুর রহমান ও চাঁপা রানী ভৌমিকের হত্যাকারীদের অতি দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করুন। ইভ টিজিং প্রেমিকা হত্যার উসকানি কোত্থেকে আসে? মোহীত উল আলম চট্টগ্রামে মিদাত নামের বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী তাঁর ঘাতক-প্রেমিকের হাতে নিহত হওয়ার পর পর প্রতিক্রিয়া জানিয়ে যুগান্তর পত্রিকায় একটি কলাম লিখেছিলাম। সেটি পড়ে রুহেলা খান চৌধুরী নামের মিদাতের একজন আত্মীয় আমাকে ফেসবুকে এক ছত্র লেখেন ধন্যবাদ জানিয়ে।

কিন্তু ওই ছোট লেখাটি এত মর্মস্পর্শী যে পাঠকের কাছে এ সংবেদনশীল বর্ণনাটি নিবেদন করতে ইচ্ছা করছে। তিনি লিখেছেন, ‘থ্যাংক ইউ মিদাতকে নিয়ে লেখার জন্য। ও আমার ছোট খালার দেবরের মেয়ে। আমি ওকে ছোটবেলা থেকে দেখেছি, আর যেদিন খুন হলো, তার এক ঘণ্টার মধ্যে আমি হাসপাতালে ওকে দেখতে গেছি। ওহ্! মেয়েটাকে দেখে মনে হচ্ছিল না, ও মারা গেছে।

কপালের ওপর এলানো চুল আর কাজল টানা চোখের পাতা... কী সুন্দর যে লাগছিল! এত ইন্টেলিজেন্ট ভাবতাম যাকে, ও এত বোকা প্রুভড [প্রমাণিত] হলো?’ বস্তুত গতকালও আমি অনেকগুলো পত্রিকা পড়ে দেখলাম যে প্রায় সবগুলোতে নারী নির্যাতনের বীভৎস নানা রকম খবর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। সৌরভ যে মিদাতকে ছুরি মেরে হত্যা করল, সেটা সামাজিকভাবে কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সমাজের কোনো একটা স্তরীভূত ব্যবহার-প্রক্রিয়ার মধ্যে সৌরভদের জন্য উসকানি লুকিয়ে আছে। এ উসকানিটা কীভাবে তৈরি হচ্ছে তা বোঝার জন্য এখন লিখছি। সাহিত্য থেকে একটি প্রসঙ্গ টানি।

ওথেলো কেন তার পরম আরাধ্য প্রেমিকা স্ত্রী ডেসডেমোনাকে হত্যা করল? অধ্যাপক স্টিফেন গ্রিনব্ল্যাট বলছেন, খল চরিত্র ইয়াগো বুঝল যে ওথেলোর মনে যদি ডেসডেমোনার চরিত্র নিয়ে সংশয় তৈরি করানো যায়, তা হলে কাজ হবে। কেন কাজ হবে? কারণ, ইয়াগো ওথেলোর কানে এ কুমন্ত্রণা দিল যে সে ভিনদেশের সংস্কৃতি থেকে এসেছে, তার বয়স বেশি, তার গাত্রবর্ণ কৃষ্ণকায় এবং সে একজন নব্য-খ্রিষ্টান। অন্যদিকে ডেসডেমোনা ভেনিস নগরের একজন সুন্দরী তরুণী শ্বেতাঙ্গ রমণী। ওথেলোকে পছন্দ বা বিয়ে করার পেছনে তার কোনো যৌক্তিক কারণ থাকতে পারে না। এটা তার নিছক মতিভ্রম, সাময়িক একটি আবেগ, যা স্থিত হলে সে আবার কোনো ভেনিসীয় যুবককেই পছন্দ করবে।

সে তার বাবার বিশ্বাস যেখানে ভঙ্গ করেছে, ওথেলোর বিশ্বাস ভঙ্গ করতে সে পিছপা হবে কেন? ওথেলো নতুন ধর্মান্তরিত খ্রিষ্টান। ইয়াগো তাকে শেখাল ওল্ড টেস্টামেন্টের একটি অব্যবহূত বাণী, যাতে বলা হয়েছে যে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেও যদি যৌনক্রিয়ায় সংযম মানা না হয়, তা হলে সেটা ব্যভিচার বলে গণ্য হবে। ব্যস, কাজ হলো। ওথেলো বলছে, ডেসডেমোনা যদি ব্যভিচারিণী হয়ে থাকে, তা হলে আমার জীবনের আর কোনো অর্থ থাকে না। তাকে ভালোবাসি, অথবা তাকে ভালোবাসি না।

আর কোনো বিকল্প নেই। তাকে ভালো না বাসলে সেখানেই নরক এসে পড়ে: ‘আই ডু লাভ দি, অ্যান্ড হোয়েন আই ডু লাভ দি নট,/ ক্যাওজ [নরক] ইজ কাম এগেইন। ’ সে পাপী এবং পাপীকে শেষ করে দেওয়ায় ওথেলো মনে করছে তার ওপর ঈশ্বর প্রদত্ত দায়িত্ব। ডেসডেমোনাকে মেরে ফেলা তাই খুন বলে গণ্য হবে না, দেবতাদের প্রতি বলিদান হিসেবে গণ্য হবে। কাজেই সে আগে ডেসডেমোনাকে মেরে ফেলবে, তারপর তাকে ভালোবাসবে: ‘আই উইল কিল দি/ অ্যান্ড লাভ দি আফটার।

’ ওথেলো যে ডেসডেমোনার ওপর এক শ ভাগ অধিকার প্রয়োগ করতে চেয়েছিল, এটা হচ্ছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের একটি মৌলিক প্রকরণ, যেটা সৌরভের তার প্রেমিকাকে হত্যা করার পেছনে লুক্কায়িত ছিল। পুরুষ মনে করছে যে সে নারীর ওপর—তার মন এবং শরীরের ওপর—সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের অধিকার রাখে। তাকে মেরে ফেললে যেন পাপ হবে না। কারণ, নারীর চেয়ে পুরুষ শ্রেয়। এ শ্রেয়োবোধ এবং সঙ্গে অধিকারবোধ খুব শিশুবেলা থেকে পারিবারিক পরিবেশে ছেলেদের মনে প্রবিষ্ট হয়।

আমার মায়ের সাম্রাজ্যে আমি আর আমার ছোট ভাই ছিলাম যুবরাজ। ষাটের দশকের কথা। মায়ের ছিল মধ্যবিত্ত পরিবারের টানাপোড়েনের সংসার। কিন্তু তাঁর ছোট দুই ছেলের জন্য বরাদ্দ থাকত একটা করে ডিম সকালে, আর রাতে ঘুমোনোর আগে এক কাপ গরম দুধ। আমাদের ওপরে পিঠাপিঠি বড় যে পাঁচ বোন ছিল, তারা পেত অর্ধেক ডিম এবং দুধ কখনো-সখনো।

আমাদের বিছানা থাকত পরিপাটি, আর পায়ের স্পঞ্জ স্যান্ডেল জোড়া থাকত সব সময় বিছানার পাশে মজুদ। বোনগুলোর থাকার নিয়ম ছিল গাদাগাদি করে এক বিছানায়। মা আমার বোনদের কম আদর করতেন তা নয়, কিন্তু খাবার, শোবার বিছানা, পড়ার টেবিল ইত্যাদি পারিবারিক সম্পদ বণ্টনের ব্যাপারে একটা স্বতন্ত্র সুবিধা আমরা ছেলেরা পেতাম, যেটা আমার বোনেরা পেত না। আমি ধরে নিচ্ছি যে সে সময় বা বর্তমান কালেও মায়েরা ছেলেদের প্রতি এক রকমের আচরণ করেন, আর মেয়েদের প্রতি আরেক রকম। এ আনুমানিক তথ্যটা এক শ ভাগ সত্য নয় জানি, কিন্তু মোটামুটিভাবে সত্য।

পারিবারিক ক্ষেত্রে মাতৃভূমিকার (এবং পিতৃভূমিকারও) পুত্রসন্তানের প্রতি সহানুভূতিশীল অবস্থান থাকে বিধায় ছোটবেলা থেকে ছেলেদের মনে একটা গরিমা জন্ম নেয় যে তারা তাদের বোনদের চেয়ে শ্রেয়। এ শ্রেয়োবোধের চেতনা পরিবারের গণ্ডির বাইরে গেলে ছেলেদের মনে আরও পাকাপোক্ত হয়, কারণ সমাজ পুরোটাই চলছে এভাবে যে—ব্যাকরণের ভাষায় বললে—পুরুষ হলো মূল ক্রিয়াপদ আর নারী হলো সহযোগী ক্রিয়াপদ। নারীর অবনমিত অবস্থান পুরুষতান্ত্রিক সমাজে একটা রাজনৈতিক পরিকাঠামোর মধ্যে নিয়ন্ত্রিত হয়। এ নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার নন্দনতাত্ত্বিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক ইত্যাদি স্তর আছে। প্রতিটি স্তর থেকে পরস্পরের সহযোগে এমন একটা বিশ্বাসের জটাজাল তৈরি করা হয়, যার ফলে সেই ৫০-৬০ বছর আগেও আমার মায়ের মতো একজন স্নেহপ্রবণ নারীর কাছে মনে হয়েছিল, তাঁর পুত্রসন্তানেরা যা ভোগ করবে, তা তাঁর কন্যাসন্তানেরা করবে না।

বেগম রোকেয়ার প্রতিবাদের কথা আমরা জানি, আমরা তসলিমা নাসরিনের ক্রোধের কথাও জানি, কিন্তু যে জিনিসটা এখনো কিছুমাত্র বদলায়নি সেটা হচ্ছে, ছেলেদের বরাদ্দে, প্রতীকী অর্থে একটা ডিম পাওয়া, আর মেয়েদের অর্ধেক ডিম পাওয়া। ধর্মের দিক থেকেও মেয়েদের রক্ষাবরণ জোরালো নয়। পিতৃসম্পত্তির অংশ ছেলে পায় এক টাকা, মেয়ে পায় আট আনা। এটার পেছনে অর্থনৈতিক বাস্তবতা হলো, মেয়ের বিয়ে হলে সে পরের ঘরে চলে যাবে এবং সঙ্গে পিতৃসম্পত্তিও জামাইয়ের হাতে চলে যাবে। মেয়েদের বঞ্চনা এখান থেকে শুরু এবং শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে সে আরেক বঞ্চনার শিকার হয়।

সেখানে সম্পত্তি পাওয়ার কোনো নিশ্চয়তা থাকে না, যদি তার পুত্রসন্তান না হয়। নন্দনতাত্ত্বিকতার কথায় আসি। নারীকে পুরুষ পূজা করে গানে, কবিতায়, রংতুলিতে এবং ক্যামেরায়। নারী চাঁদ, নারী ফুল, নারী নদী—এগুলো পুরোনো উপমা, কিন্তু আধুনিক কবিতায়ও নারীর অবস্থান হচ্ছে কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের ভাষায়, ‘আমার আকাশ তুমি, বারো মাস আমার আঙিনা। ’ কিন্তু বাস্তবতা হলো নারীকে গৌরবান্বিত করে সাহিত্যে প্রতিফলন করানোটাও পুরুষতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের একটি তরিকা।

বরং নারীকে পূজার সামগ্রী করাতে নারী আর নারী হয়ে উঠতে পারেনি। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে ইংরেজ রমণী, কবি শেলির শাশুড়ি, মেরি ওলস্টোনক্র্যাফট গর্জন করে উঠেছিলেন মহাকবি মিল্টন এবং ফরাসি দার্শনিক রুশোর বিরুদ্ধে, কারণ তাঁরা তাঁদের সাহিত্যে নারীকে হূদয়ের অধীশ্বর বানাতে গিয়ে প্রকারান্তরে নারীকে চিরস্থায়ীভাবে পুরুষের ওপর নির্ভরশীল করে রূপায়ণ করেছিলেন। এবং দেখুন, ধ্রুপদি সাহিত্যে পর্যন্ত নারীকে নিয়ে সূক্ষ্ম বঞ্চনার একটি বাতাবরণ তৈরি হয়েছে। তিনটি চরিত্র নিই: ফ্লবেয়ারের মাদাম বোভারি, টলস্টয়ের আনা কারেনিনা এবং রবীন্দ্রনাথের চারুলতা—এরা কেউই পুরুষের ওপর অর্থাৎ স্বামীর ওপর থেকে নির্ভরতা তুলে নিয়ে শেষ পর্যন্ত নিজেদের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতায় পৌঁছাতে পারেনি। মাদাম বোভারি আর আনা কারেনিনা তো আত্মহত্যাই করে আর চারু তার প্রেমকে বিকশিত করতে না পেরে সে নিরানন্দ সংসারজীবনে তলিয়ে যায়।

(কেবল ইবসেনের নোরাকে সত্যিকারের স্বাধীন নারী চরিত্র বলে মনে হয়। ) আশ্চর্য যে এখনকার জনপ্রিয় কলকাতার সাহিত্যিক সুচিত্রা ভট্টাচার্য তাঁর সাম্প্রতিকতম উপন্যাস গহীন হূদয়-এ (দেশ শারদীয়, ১৪১৭) দেখালেন যে নায়িকা সোহিনী, যে নাকি স্বামীকে জীবিতকালে পছন্দ করত না এবং স্বামীর বন্ধু অনুপমের সঙ্গে পরকীয়া করে যাচ্ছিল, সেও স্বামীর মৃত্যুর পর অনুপমকে বিয়ে করল না, বরং স্বামীর স্মৃতি আঁকড়ে ধরে জীবন কাটানোর সিদ্ধান্ত নিল। এটা আমরা বলতে পারি যে হ্যাঁ, নিষ্কাম প্রেম। কিন্তু আসলে এটা হচ্ছে সোহিনীর ওপর প্রকারান্তরে সুচিত্রা ভট্টাচার্য স্বামীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করলেন। অর্থাৎ স্বামীর মৃত্যুর পরও সোহিনী স্বামীর অধিকারবোধ থেকে মুক্ত হতে পারেনি।

ঠিক সে অধিকারবোধ যেটা থেকে ওথেলো তার প্রেমিকা-স্ত্রীকে হত্যা করল, কিংবা চট্টগ্রামের চণ্ড ছেলে সৌরভ তার প্রেমিকা মিদাতকে হত্যা করল। সুচিত্রা নারী লেখক হয়েও পুরুষ প্রবর্তিত নারীকে নিয়ন্ত্রণের কৌশলী ফাঁদটা ধরতে পারেননি। আমরা দারিদ্র্যের কথা বলি। এ দারিদ্র্যেরও একটা ছেলে-চেহারা আছে, একটা মেয়ে-চেহারা আছে। গরিব রিকশাওয়ালার বউ গরিব রিকশাওয়ালার চেয়ে গরিব।

বস্তুত আমাদের সমাজে দারিদ্র্য আর নারীর পরাভূত অবস্থান আসলে সমার্থক। নারীর দারিদ্র্য বাড়ে জৈবিকভাবে তাঁর সন্তানপ্রীতি নাড়ির টানের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে। একজন গরিব কিন্তু দুরাচারী স্বামী গর্ভবতী বউয়ের পেটে লাথি মেরে তাকে ঘর থেকে বের করে দিতে পারে। তখন বউটা তার পেটের সন্তানসহ আগের সন্তানগুলো নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ে। পুরুষ এত নিষ্ঠুর হতে পারে যে সে তার সন্তানদের পেছনে ফেলে আরেকটা বিয়ে করে ফেলতে পারে বা অন্যত্র চলে যেতে পারে।

নারী তা পারে না। তার মনোজগৎ এবং শারীরিক বৈশিষ্ট্যগুলো এমন যে সন্তান থেকে বিচ্ছিন্ন সে কখনো হতে পারে না। এর বহু প্রমাণ প্রতিদিন রাস্তার ভিখারিনীদের দেখলে বোঝা যায়। সবগুলো শর্তই আসলে নারীর বিরুদ্ধে যাচ্ছে। মোহীত উল আলম: অধ্যাপক, ইউল্যাব, ঢাকা।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।