আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

১০৮ ঘরের মাটির বাড়ি (বিষ্ময়কর)

নিরপেক্ষ আমি

ঘর নেই, গাছতলায় ঘুমায়, এমন মানুষের সংখ্যা দেশে একেবারে কম নয়। আবার কারও বাড়ির গণ্ডা গণ্ডা ঘর খালি পড়ে থাকে। শোয়ার মানুষ নেই, সারি সারি খালি ঘর দাঁড়িয়ে আছে বিশাল বাড়িতে; এমন একটা বাড়ির গল্প বলব। স্কুলের মতো একটানা বিশাল বাড়ি, দূর থেকে দেখলে মনে হয় বুঝি দুর্গ। এক লহমায় হিসাব করে ওঠা যায় না, ঠিক কয়টা ঘর এই বাড়িতে।

কেউ একজন এসে জানিয়ে দেন, ঘরের সংখ্যা ১০৮! সব শুনে মনে হয়, বিরাট কোনো রাজবাড়িতে ঢুকে পড়েছি। আসলে রাজা তো নয়ই, জমিদারও নয়; ১০৮ ঘরের এই বাড়িটির মালিক দুই কৃষক সহোদর। আর বাড়ি মোটেও ইট-কাঠ-পাথরের সুরম্য পুরী নয়। ১০৮ ঘরের এই বাড়ি নিতান্ত মাটি দিয়ে বানানো। মনের খেয়ালে শুধু কাদামাটি দিয়ে বিশাল এই দ্বিতল ভবন বানিয়েছেন সমশের আলী মণ্ডল ও তাহের উদ্দিন মণ্ডল।

এত বড় বাড়িতে লোকসংখ্যা মাত্র ৩১! আজ থেকে ২৫ বছর আগের কথা। নওগাঁ জেলার মাহাদেবপুর উপজেলার আলীপুর গ্রামের দুই ভাই সমশের আলী মণ্ডল ও তাহের উদ্দিন মণ্ডল নতুন বাড়ি তৈরি করার উদ্যোগ নিলেন। সঙ্গে তাঁদের একমাত্র বোন মাজেদা খাতুনও ছিলেন। সে সময় এ এলাকায় বেশির ভাগ বাড়িই ছিল মাটির। এলাকার এঁটেল মাটির দেয়াল বেশ টেকসই।

মাটি দিয়ে দোতলা বাড়িও তৈরি করা হয়। কিন্তু মণ্ডলদের বাড়ি তৈরির ব্যাপারটা একটা মহাযজ্ঞে পরিণত হলো। কাজ শেষ করতে তাদের সময় লগেছে পুরো এক বছর। ছাউনিতে টিন লেগেছে ২০০ বান্ডিল। ১৫০ হাত লম্বা এ ভবনের জন্য মাটি তুলতে গিয়ে বাড়ির পাশেই তৈরি হলো বিরাট এক পুকুর।

বাড়িটি মাটির হলেও পুকুরে পাকা শান বেঁধে দেওয়া হয়েছে। নওগাঁ জেলা সদরের ২৫ কিলোমিটার দূরে মহাদেবপুর উপজেলা। জেলা সদর থেকে বাসে করে অনায়াসে যাওয়া যায়। উপজেলা সদর থেকে ১৩ কিলোমিটার পুব দিকে আলীপুর গ্রাম। যাওয়ার ব্যবস্থা রিকশা-ভ্যান।

গ্রামে সুনসান নীরবতা। মানুষের হাঁকডাক নেই। গাড়িঘোড়ার শব্দ তো নেই-ই। পাতলা বসতি। এমন নিভৃত গ্রামের ভেতর এমন বাহারি বাড়ি কল্পনাও করা যায় না! গ্রামের ভেতর ঢুকতেই এমন বিরাটকায় বাড়ি দেখে যে-কেউ চমকে উঠবে।

প্রথমে এর চেহারা দেখে একে বাড়ি বলে ঠাহর করাই কঠিন। বাড়ি দেখেতে লোক এসেছে শুনে সমশের মণ্ডলের বড় নাতি রাজু আহাম্মেদ বের হয়ে এলেন। হেসে বললেন, ‘কোন দিক দিয়ে ঢুকবেন? এ বাড়িতে ১১টি দরজা!’ পুব দিকের একটা দরজা দিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকতেই দেখা গেল, মাথার ওপর ঝোলানো রয়েছে গরুর গাড়ির ছই। বাড়িটি মাটির তৈরি হলেও বারান্দার খুঁটিগুলো ইটের। দোতলার পাটাতন তৈরি করা হয়েছে তালগাছ চিরে ও বাঁশ দিয়ে।

এর ওপর মাটি দিয়ে এমন করে লেপে দেওয়া হয়েছে, যেন প্লাস্টার করা। ২৫ বছর আগে লেপে দেওয়া পাটাতন প্রায় অবিকৃতই আছে। দোতলার বারান্দায় সুন্দর নকশি করা রেলিং। দোতলার একটি ঘরে ঢুকে বিস্মিত হতে হলো পাঁচটি দরজা দেখে। এমন অনেক ঘরেরই চার-পাঁচটি করে দরজা আছে।

রাজু আহাম্মেদের কাছে বাড়ির দরজার সংখ্যা জানতে চাইলে তিনি প্রমাদ গুনলেন। বললেন, ‘কোনো দিনই হিসাব করা হয়নি। এমন জড়ানো-পেঁচানো ঘর আছে যে সারা দিন ধরে গুনবেন আর সারা দিন ধরে ভুল করবেন। গোনা শেষ হবে না। আমরা কখনো গোনার চেষ্টাও করে দেখিনি।

’ দোতলায় ওঠার সিঁড়ি ১৩টি। যেকোনো এক সিঁড়ি দিয়ে উঠে সব ঘরে যাওয়া যাবে। ঘুরতে ঘুরতে বেশ টের পাওয়া গেল, ফাঁকা পড়ে আছে অনেক ঘর। মজার ব্যাপার, ফাঁকা পড়ে থাকলেও প্রতিটি ঘরই সুন্দর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। সমশের মণ্ডলের ছোট ছেলের স্ত্রী বিউটি খাতুন বলেন, ‘সব ঘরে বসবাস না করলেও আমরা নিয়মিত ঘরগুলো পরিষ্কার করি।

কিছু ঘরে ধান-চৈতালি রাখি। বাকি ঘরগুলো পড়েই থাকে। ’ বর্তমানে সমশের মণ্ডল, তাহের মণ্ডল ও তাঁদের একমাত্র বোন মাজেদা খাতুনের ছেলেমেয়ে, নাতিপুতিই এই বিশাল বাড়ির বাসিন্দা। এখন তাঁদের সদস্যসংখ্যা ৩১। কয়েক বছর আগে সমশের মণ্ডল মারা গেছেন।

ছোট ভাই তাহের মণ্ডল এখনো বেঁচে আছেন। তিনি বাড়িতে ছিলেন না। তাঁকে পাওয়া গেল বাড়ির পাশে একটি মরিচক্ষেতে। জমি পরিচর্যার কাজ করছেন। গুটিকয় সদস্যের জন্য এই মহাযজ্ঞ কেন, এর জবাবে তাহের মণ্ডল কথা ঠিক খুঁজে পান না।

শেষ পর্যন্ত একটা কথাই বোঝাতে পারলেন—শখ! এ জন্যই বোধহয় বলা হয়, শখের তোলা আশি টাকা!

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।