আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

(ওরে ও মিয়া ভাই, গল্প পড়াতে ধৈর্য্য চাই): জন্মান্ধ প্রেমাঞ্জলি ( ০৫-০৮ আউট অফ ২৭)

বা

জন্মান্ধ প্রেমাঞ্জলি ( ০১-০৪ আউট অফ ২৭) Click This Link ৫. যখন বৈরাগীর ‘আমি শহরের অন্দর মহলে ঢুকে পড়ি’ কবিতাটি প্রকাশিত হলো তখন মোটামোটি আলোচনায় চলে আসে কবিতাটি। প্রচলিত ধারায় রচিত নয় কবিতাটি। ছন্দ মানা হয়নি, এমনকি কিছুটা যৌনতাকে উপমা হিসাবে নিয়ে কবি শহরের অন্তসার শুণ্যতাকে ফুটিয়ে তুলেছেন। একজন সমালোচক কবিতার অবক্ষয় নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে বৈরাগীর কবিতাটি তুলে ধরেন। তিনি কবিতাটিকে অশ্লীল বলে আখ্যা দেন এবং বলেন তেলাপোকাকে দোয়াতে চুবিয়ে সাদা কাগজে ছেড়ে দিলে একটি চিত্রকর্ম হয়, কাকতালীয়ভাবে তা চমৎকার দেখতে হয়ে উঠতে পারে ।

এই কবিতাটি তেমনি এক শিল্পকর্ম। এই সমালোচনার জবাবে মিমি তার ছদ্মনামে একটি প্রবন্ধ লিখে যাতে এই কবিতাটি সহ বৈরাগীর কিছু কবিতা তুলে আনে। সে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চারটি কাব্যগ্রন্থকে গদ্য-কবিতা হিসাবে চিহ্নিত করে এবং আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ’র উদাহারন তুলে ধরে বলেন এই কবিতাটি ও তেমনি এক গদ্য-কবিতা। প্রবন্ধটি প্রকাশিত হলে একদিন মিমি তার নামে একটি চিঠি পান যাতে বৈরাগীর ধন্যবাদসূচক বক্তব্য ছিল এবং বর্ননা ছিল কত কষ্ট করে সম্পাদকের মাধ্যমে তার ঠিকানা জোগাড় করেছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রিয় কবির চিঠি পেয়ে এবং তার প্রসংশা পেয়ে মিমি মুলধারার কবিতা ব্যাপকভাবে পড়তে থাকে।

নিজের লেখা কবিতাগুলো যে কতটা মানহীন আর দুর্বল গাথুনিতে লিখা তা উপলব্দি করতে থাকে। সে মুলত বৈরাগীর কবিতাকে অনুসরন করতে থাকে। এভাবে যদিও সবগুলো লেখা ছাপার অক্ষরের মুখ দেখতে পায় নি তবে বেশ কিছু কবিতা জমা হতে থাকে তার। এরপর সবগুলো লেখা যা কোথাও প্রকাশিত হয়েছে আর যা প্রকাশ হয়নি সব একত্রে করে একটি পান্ডুলিপি তৈরি করে ফেলে। সে প্রকাশকের সাথে যোগাযোগ করে ।

প্রকাশকরা নতুনদের কবিতার বই প্রকাশ করতে চান না কারণ এত ব্যবসায়িক ক্ষতি হয়। মিমি নিজ খরচে বইটি বের করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং একজন লেখককে দিয়ে একটি রিভিউ তৈরি করে প্রকাশ করে। কিন্তু বইটি পাঠক মহলে গৃহীত হলো না, কেউ বইটি নিয়ে আলোচনা করল না, কেউ বইটি কিনন না। ৬. যখন মিমির তৃতীয় সন্তান গর্ভে এলো তখন তার লেখক স্বত্ত্বা অনেকটাই দুরে চলে যায়। তার ভাবনা ঘর-গৃহস্থালীতে মগ্ন হয়ে উঠে।

দামী এপার্টমেন্ট, দামী গাড়ীর দিকে তার দৃষ্টি হারিয়ে যায়। তার স্বামী প্রকাশকের বিলটি পরিশোধ করে দেন। এভাবে সংসার তার হতাশায় মিমি’র লেখক স্বত্ত্বা হারিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু লেখালেখি এমন এক নেশা যা একবার কারো হৃদয়ে গভীরে ঢুকে গেলে আর কখনো ত্যাগ করা যায় না। আর সফল লেখকদের চাইতে ব্যর্থ লেখকদের লেখার প্রতি ভালবাসাটা প্রবল হয়।

মিমি’র পুরানো ভালবাসা ফিরে আসছিল। আর কাকতালীয়ভাবে এখানে এসে বৈরাগীর অদৃশ্য ছোঁয়াতে নিজেকে আবার পুরানো অবস্থায় ফিরে পেল। বৈরাগীর প্রতি তার আগ্রহটা নানাভাবে প্রকাশিত হতে থাকল। গৃহকর্ত্রীকে নানাভাবে প্রশ্ন করতে থাকল তার জবাবে তিনি বলেন,‘‘ খুব ভাল লেগেছে যে, তুমি কবির প্রতি খুব আগ্রহ দেখাচ্ছো। কিন্তু সে অন্তর্মূখী মানুষ।

যদি তুমি তাকে সমনাসামনি দেখতে পেতে , বুঝতে কি লাজুক সে। আমিতো তাকে প্রায় দুই বছর যাবৎ দেখছি। সে লোকালয় এড়িয়ে চলে। এই রুম দু’টি সে সারা বছরের জন্য ভাড়া নিয়ে রেখেছে, যখন মন চায় চলে আসে, বুকে সমুদ্রের বাতাসের স্পর্শে কেপে উঠে, মুক্ত বিহঙ্গের মতো নেচে উঠে হয়ত তার মন। আর সারাক্ষন কেবল পড়ে বা লেখে।

আর সত্যি বলছি এত বড় মনের মানুষ তুমি প্রতিদিন দেখতে পাবে না.....’’ -‘তিনি বড় মনের আর খুব ভাল!’ ‘‘ হ্যাঁ, আমি যখন তার সাথে গল্প করতে চাই,’ গৃহকর্ত্রী বলেন,‘ সে সময় দেয়। তার কোন লেখা যা প্রকাশিত হয়নি, ভেবে দেখো, আমি পড়তে চাইলে তেমন লেখাও পড়তে দেয়। জানো একবার সে বলছে, কিছুই লিখতে পারছে না। আমি বললাম, স্থান পরিবর্তন করো, নতুন পরিবেশে যাও। তারপর প্রায় দুই তিন মাস তার দেখা মেলেনি।

ফিরে এসে আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল যে, আমার পরামর্শে সে দারুন গতিতে আছে....” ৭. ‘ও আচ্ছা, তাহলে তিনি একটি স্পর্শকাতর চরিত্র, কি বলেন?’ ‘হ্যা, ঠিক আছে। তবে মাঝে মাঝে অ™ভুত আচরন করে যা সত্যিই স্পর্শকাতর। স্পর্শকারত! বাহ ভাল শব্দ ব্যবহার করেছেন। একদিন রাতে সম্ভবত কোন কবিতা শেষ করেছে সে তারপর সারারাত জোরে জোরে গলা ফাটিয়ে আবৃতি করে চলেছে। জানো তো, আমার থাকার জায়গা থেকে এখানকার যে কোন জোরের শব্দ শোনা যায়।

তারপর হলো কি, সে আমাকে ডেকে আনলো, ঘুম জড়ানো চোখ আমার বুঝ অবস্থা...। আমাকে কিনা শুনতে হবে তার কবিতা.. এত রাতে!!...’’ একজন উঠতি কবিকে নিয়ে নানা কথোপকথোনের এসব অংশ বিশেষ মাত্র। একদিন গৃহকর্ত্রী মিমির দৃষ্টি আকর্ষণ করল ওয়াল পেপারের দিকে যা কিনা বিছানার পিছনে ছিল বলে দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়েছিল। মিমি বলল,‘দেখি দেখি’। ‘এগুলো’ গৃহকর্ত্রী বললেন, মহিলাসুলভ চপলতা নিয়ে যেন গহীন গোপন ব্যাপারটি জেনে গেছেন,‘ যা ওয়াল পেপারে বা ও দেখ, ক্যালেন্ডারেও লিখা, এগুলো সবই তার কবিতার লাইনের প্রাথমিক অবস্থা।

এগুলো আর এরকম থাকেনি কিন্তু ইচ্ছা করলে পড়ে দেখতে পারো। আমার ধারণা সে সারা রাত হেটে বেড়ায়, পায়চারি করতেই থাকে, কোন ভাবনা চলে এলে সাথে সাথে লিখে রাখে দাড়িয়ে দাড়িয়ে, সকালে আবার মাথা থেকে হারিয়ে যায় এই ভয়ে। আমি অনেক লাইন এখানে লেখা দেখেছি যা পরে ম্যাগাজিনে ছাপার অক্ষরে দেখেছি। আবার কোন কোনটি কোথাও দেখিনি। আর কিছু দেখছি নতুন।

দেখো দেখো এগুলো আগে কোথাও দেখিনি। নিশ্চয়ই এগুলো কিছুদিন আগে লিখা। ’’ ‘ও আচ্ছা...’ মিমি বলে। এসব কথা শুনতে শুনতে সে আরো আবেগ প্রবন হয়ে উঠল। লেখালেখির দিকে গভীর ভাবে ঝুকে পরে।

,সে ভিতরের আবেগকে গভীর ভাবে উপলব্দি করতে লাগল। ৮. মিমির স্বামী হেলালউদ্দিন ঢালী ট্রলারে টেকনাফের দিকে যাওয়াটা বেশ উপভোগ করেন। চাদনী রাতে সমুদ্রের ঢেউয়ের যে অসাধারন রূপ ধরা দেয় সে দিকে তার খেয়াল নেই কিন্তু তিনি উপভোগ করেন যখন ঢেউয়ে এদিক ওদিক হেলে উঠে যানটি তখনকার ভয় পাওয়া মানুষগুলো, দেখতে তার বেশ ভাল লাগে। তিনি উপভোগ করেন প্রেমিক-প্রেমিকা, স্বামী-স্ত্রী কিভাবে ভয়ে পরস্পর জড়িয়ে ধরে। তার ইচ্ছা করে মিমিকে নিয়ে পাবলিক ট্রলারে করে সমুদ্র ভ্রমনে যেতে।

কিন্তু মিমি এসব পছন্দ করে না, কোন থ্রিল নেই তার মনে, সে আতংকগ্রস্থ হয়ে পরে। ফলে তাকে একাই যেতে হয়। ভ্রমনে আনন্দ পাওয়া নিয়ে দুজনের মতবিরোধের কারনে মিমি সমুদ্রে স্নান আর সৈকতে হেটে তার দীর্ঘসময় কাটিয়ে দেয়। সন্তানদের দেখাশুনা করার বাইরে তার হাতে চলে আসে অনেক অলস সময়। তার ভিতরকার লেখক স্বত্ত্বাটি জেগে উঠে প্রবল ভাবে।

বৈরাগীর কবিতা তাকে কেবল টানতেই থাকে। মাঝে মাঝে তার কবিতাগুলো নিজে লেখার প্রতিদ্বন্ধী হিসাবে দাড় করায়। নিজের লেখাকে যখন তার লেখার সামনে দাড় করায় তখন নিজেকে হাস্যকর মনে হয় আর গোমরে গোমরে ফুপিয়ে কেদে উঠে। তার ভোগবাদী জীবন, না এই উন্নত ভাববাদী জীবন , এই দুইয়ের সংকটে ভুগতে থাকে সে। হৃদয়ের এই অন্তর্দ্বন্ধের কারনে সে নিস্তব্ধ নিথর হয়ে গভীর মনোনিবেশ করে।

তার কানে কানে বৈরাগী কথা কয়, প্রতি মুহুর্তে যেন এই ফিসফিসানি বৃদ্ধি পেতে থাকে। কিন্তু এই কবিকে সে কখনো দেখেনি। সব ইমোশন কি বাস্তবতা খুজে পায়- নিজেই নিজেকে শুধায়। এই দ্বিমূখী দ্বন্ধে তার স্বামীর ভোগ বিলাসপূর্ণ জীবন হেরে যায়, তার স্বামীর প্রতি ভালবাসাটুকু ক্ষীন হতে হতে শুণ্যতে নেমে আসে। এখন স্বামী-স্ত্রী যেন উপকারী বন্ধু পরস্পর, আর্থিক ও দৈহিক।

কিন্তু মিমি হৃদয় এতটাই উতলা হয়ে উঠেছে যে, যখন তার স্বামীর একান্তে দৈহিক লেনদেন করে তখন তার মনে হয় বৈরাগীই তাকে জড়িয়ে আছে। চলবে...

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।