আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আঙ্গুল-বন্দনা



হাতের আঙ্গুল মানুষের আদিম অস্ত্র ও যন্ত্র। সুপ্রাচীন কাল থেকে বর্তমান বিজ্ঞানের যুগেও আঙ্গুলের মতো এতো প্রতীকী ভাষা মানব দেহের অন্য কোনো অঙ্গ দিয়ে এতো ব্যঞ্জনাময়ভাবে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হয়নি। হাতের পাচ আঙ্গুলের জীবতাত্ত্বিক গঠন বিন্যাসও শৈল্পিক মানে উন্নীত। পাচটি আঙ্গুলে রয়েছে মোট ১৪টি হাড়; যাকে ইংরেজিতে বলা হয় ফ্যালানজেস। কারণ এগুলো প্রাচীন গ্রিক সেনাবাহিনীর র‌্যাঙ্ক অনুযায়ী গ্রন্থিত, সুবিন্যস্ত।

এ ১৪টি হাড় ছোট থেকে বড় ক্রমানুসারে শক্ত অথচ নমনীয় লিগামেন্ট দিয়ে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত। গ্রিক সেনাবাহিনীর গঠন বিন্যাসকে এক সময় ফ্যালাঙ্কস বলা হতো। কারণ তা হাতের আঙ্গুলের হাড়ের মতো ১৪টি সারিতে বিন্যস্ত থাকতো। প্রাচীনকালে ধর্ম ও তান্ত্রিক সাধনায় আঙ্গুলের বিশেষ প্রভাব ছিল। শয়তানের কুদৃষ্টি নষ্ট করার প্রক্রিয়া হিসাবে খৃস্টানদের সুসমাচার লুকে (১১:২০) ঈশ্বরের আঙ্গুল এক কথা উল্লেখ রয়েছে।

অন্যদিকে আঙ্গুলের সঙ্গে ক্ষমতার সম্পর্কের বর্ণনাও অতি সুপ্রাচীন। ক্ষমতাসীনদের অঙ্গুলি হেলনে এখনো ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। আয়ত্তের বাইরে গিয়ে আঙ্গুল উচিয়ে কথা বলাটা এখনো বলাটা এখনো বিপজ্জনক প্রমাণিত হতে পারে। ট্রাই করতে পারেন! দেহ ও মনের সম্পর্কের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ফিলিপাইনের নব্য চিকিৎসা পদ্ধতি প্রাণিক হিলিং এর মতে, আঙ্গুলের নিজস্ব শারীরিক ভাষা রয়েছে এবং হাতের আঙ্গুলগুলোর সঙ্গে মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গের ও মনের আবেগের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। একটি আঙ্গুল এক এক ধরনের আবেগ নিয়ন্ত্রণে সক্ষম।

তবে আঙ্গুলের যতোগুলো অভিব্যক্তি বা প্রতীকী ভাষা রয়েছে তার সবচেয়ে বেশি প্রতিফলন দেখা যায় শাস্ত্রীয় নৃত্যকলায়। এখানে অভিব্যক্তিময় হস্তকর্মকে বলা হয় মুদ্রা। আর মুদ্রা মূলত আঙ্গুলের প্রতীকী ভাষা। বলা হয়ে থাকে : যেখানে হস্ত, সেখানেই দৃষ্টি; যেখানে দৃষ্টি সেখানেই মনের গতি; যেখানে মন সেখানেই ভাব; যেখানে ভাব সেখানেই রস। আর রস সম্পাদনই হচ্ছে নৃত্যের লক্ষ্য।

মুদ্রা দুপ্রকার : সংযুক্ত ও অসংযুক্ত। এক হাতের সাহায্যে নিষ্পন্ন মুদ্রাকে বলা হয় অসংযুক্ত মুদ্রা আর দুহাতের সাহায্যে নিষ্পন্ন মুদ্রাকে বলা হয় সংযুক্ত মুদ্রা। অবশ্য 'নাট্যশাস্ত্র' ও 'অভিনয় দর্পণ' নামক সুবিখ্যাত গ্রন্থদ্বয়ে মুদ্রার সংখ্যা, গঠন ও প্রয়োগ কলায় পার্থক্য দেখানো হয়েছে। নাট্য শাস্ত্রে চব্বিশ প্রকার অসংযুক্ত মুদ্রা হচ্ছে : পতাক, ত্রিপতাক, কর্তরীমুখ, অর্ধচন্দ্র, অরাল, শুকতু-, মুষ্টি, শিখর, কপিত্থ, কটকামুখ, সূচী, পদ্মকোষ, স্বর্পশীর্ষ, মৃগশীর্ষ, কাঙ্গুল, অলপদ্ম, চতুর, ভ্রমর, হংসাস্য, হংসপক্ষ, সন্দংশ, মুকুল, ঊর্ণনাভ ও তাম্রচূড়। অন্য দিকে অভিনয় দর্পণে বর্ণিত আটাশ প্রকার অসংযুক্ত মুদ্রা হচ্ছে : পতাক, ত্রিপতাক, অর্ধপতাক, কর্তরীমুখ, ময়ূর, অর্ধচন্দ্র, শুকতু-, মুষ্টি, শিখর, কপিত্থ, কটকামুখ, সূচী, চন্দ্রকলা, পদ্মকোষ, স্বর্পশীর্ষ, মৃগশীর্ষ, সিংহমুখ, কাঙ্গুল, আলপদ্ম, চতুর, ভ্রমর, হংসাস্য, হংসপক্ষ, সন্দংশ, মুকুল, তাম্রচূড় ও ত্রিশুল।

আবার নাট্য শাস্ত্র মতে সংযুক্ত মুদ্রা তের হলেও অভিনয় দর্পণে ২৩ প্রকার সংযুক্ত মুদ্রার অস্তিত্ব রয়েছে। তবে প্রতিটি মুদ্রা দিয়ে বহু ধরনের অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলা সম্ভব। যেমন, হাতের আঙ্গুলগুলো পরস্পর সংশ্লিষ্ট অবস্থায় প্রসারিত হলে এবং অঙ্গুষ্ঠ কুঞ্চিত অবস্থায় থাকলে যে মুদ্রা হয় তার নাম পতাক। প্রারম্ভ, মেঘ, বন, রাত্রি, নদী, পবন, শয্যা, তুরঙ্গ, যাত্রার উদ্যোগ, তালপত্র, আশীর্বাদ, সূর্যকিরণ, জ্যোৎস্না প্রভৃতি বোঝাতে পতাক ব্যবহৃত হয়। তেমনি ভাবে বাকি মুদ্রাগুলো দিয়ে হাজারো প্রতীকী ভাষা বা অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলা সম্ভব।

আঙ্গুলের প্রতীকী বিশ্ব এখনো বিশ্বের জনগোষ্ঠীকে শাসন করে। অবশ্য আঙ্গুলের গঠন প্রকৃতির মাঝের সমতা থাকলেও এর ব্যাকরণে কোনো স্থিরতা নেই। তাই মার্কিনী প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা জাতিকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখালে এর অর্থ দাঁড়াবে -- সব ঠিক আছে। কিন্তু আমাদের দেশে কেউ বুড়ো আঙ্গুল দেখালে ধুন্ধুমার লেগে যাবে। মধ্যপ্রাচ্যসহ আমাদের দেশে বুড়ো আঙ্গুল দেখানো রীতিমতো ঔদ্ধত্যের পরিচয়।

স্যাটেলাইট চ্যানেলে বিপিএল-এর বিজ্ঞাপনে মডেলরা বুড়ো আঙ্গুল আর তর্জনীর অগ্রভাগ মিলিয়ে বৃত্ত একে দেখায়। এর অর্থ ঠিক আছে। কিন্তু লাতিন আমেরিকায় এটা রীতিমতো অপমানজনক। ফ্রান্সে এর মানে জিরো বা মূল্যহীন। আমাদের দেশে অথবা আমাদের হাতের পাঁচটি আঙ্গুল বা থাবা সামনে বাড়িয়ে দেয়ার অর্থ থামো।

কিন্তু গ্রিসে এ সাংকেতিক ভাষার অর্থ হচ্ছে বিবাদের শুরু। পশ্চিম আফ্রিকায় এর মানে অত্যন্ত অপমানজনক। মার্কিনীরা সাধারণত তর্জনী সামান্য উঁচিয়ে বুড়ো আঙ্গুলটা সামান্য বাড়িয়ে ওয়েটারদের ডাকে। কিন্তু জাপানে এভাবে ডাকাটা বিপজ্জনক। আবার একই ইঙ্গিতে জার্মান ওয়েটাররা স্মিত হেসে আরো দুটো ড্রিংকস টেবিলে হাজির করবে।

আমাদের দেশে তর্জনী উঁচিয়ে কথা বলাটা ঔদ্ধত্য অথবা খবরদারিত্বের প্রকাশ। মালয়েশিয়ায়ও তাই। কেউ কপালে বুড়ো আঙ্গুল ঠেকিয়ে বসে থাকলে ডাচরা ধরে নেবে লোকটির মাথার স্ক্রু ঢিলা, কিন্তু মাকির্নীরা ভাববে লোকটি স্মার্ট। কনিষ্ঠা আর তর্জনী উঁচিয়ে মাঝের অনামিকা ও মধ্যমাকে ভাজ করে নামিয়ে রাখলে আফ্রিকান ভাববে বিপদ আসন্ন কিন্তু ইতালিয়ান ভাববে যার দিকে ইঙ্গিত ছুড়ে দেয়া হয়েছে তার স্ত্রী/ স্বামী অবিশ্বস্ত হয়ে গেছে। আঙ্গুলের প্রতীকী ভাষা বিশ্বব্যাপী অনুসৃত হলেও এটা সর্বজনীন নয়।

অঞ্চলকে ভেদে মানুষ নিজ নিজ প্রথার আলোকে আঙ্গুলের ভাষা বোঝে এবং এ প্রতীকী ভাষা শব্দের চেয়েও বেশি কার্যকর।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।