২০০৭ সালের সেই ছাত্র বিক্ষোভের কারণ অনুসন্ধানে গঠিত শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি গত বছর ৬ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে প্রতিবেদন দেয়।
বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দীন আহমদ ও সেনাপ্রধান সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদসহ ছয়জনকে প্রচলিত আইনে বিচারের মুখোমুখী করার সুপারিশ করা হয় ওই প্রতিবেদনে।
এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে প্রতিবেদনে ১৩টি সুপারিশ ও ১১টি পর্যবেক্ষণ রাখে কমিটি।
সুপারিশের বাস্তাবায়ন না হওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করে কমিটির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কমিটি তদন্ত করে সুপারিশ দিয়েছে। বাস্তবায়নের কাজ মন্ত্রণালয়ের।
আমরা আমাদের কাজ করেছি। নাউ দে হ্যাভ টু এক্সিকিউট ইট। ”
তিনি জানান, পরবর্তী বৈঠকে সুপারিশ বাস্তবায়নের বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের কাছে জানতে চাইবে কমিটি।
অবশ্য শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলছেন, কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নের দায়িত্ব শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ‘একার নয়’। সব সুপারিশ বাস্তবায়নের এখতিয়ারও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নেই বলে জানিয়েছেন তিনি।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে মন্ত্রী বলেন, “সংসদীয় কমিটির সবগুলো সুপারিশ আমাদের আওতায় নেই। পুলিশের বিরুদ্ধে তো আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি না। ”
নাহিদ বলেন, কমিটি যেসব সুপারিশ করেছে সেগুলো সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে জানিয়ে দেয়া হয়েছে।
“এখন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় যদি কাজ না করে তবে আমাদের কিছু করার নেই। ”
জিমনেসিয়ামে কয়েকজন ছাত্রের সঙ্গে সেনাসদস্যদের তর্কাতর্কির জের ধরে ২০০৭ সালের ২০ থেকে ২৩ অগাস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর ব্যাপক নির্যাতন চালায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।
চার জন শিক্ষকসহ বহু ছাত্রকে সে সময় গ্রেপ্তার করা হয়। বিভিন্ন মামলায় আসামি করা হয় তাদের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ অসন্তোষের প্রকাশ ঘটে সারাদেশে ছাত্রবিক্ষোভের মাধ্যমে। ফলে পিছু হটে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয় সেনা সমর্থিত ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
ওই ঘটনার পর তখনকার সেনানিয়ন্ত্রিত সরকার একটি বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিটি করলেও সংসদীয় কমিটি তা গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেনি।
বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি একটি উপ কমিটি করে ওই ঘটনার অনুসন্ধান শুরু করে। ২০১০ সালের ১৯ অগাস্ট কাজ শুরুর পর মেনন নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের উপ-কমিটি বিভিন্ন সেনা কর্মকর্তা, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের বক্তব্য শোনে।
ওই ঘটনায় নির্যাতিত শিক্ষক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা খুব আশা করেছিলাম সরকার সংসদীয় কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন করবে। তা না হওয়ায় আমরা মর্মাহত। ”
২০০৭ সালের ওই ঘটনা তদন্তের জন্য সংসদীয় কমিটির কাছে আবেদন করা এই শিক্ষক বলেন, “সংসদীয় কমিটিকে আমরা কৃতজ্ঞতা জানাই।
তাদের সুপারিশ বাস্তবায়ন না হলেও তাদের অনুসন্ধান একটা রেকর্ড হয়ে থাকল। ”
সংসদীয় উপ-কমিটি ওই ঘটনায় নির্যাতিত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সাক্ষ্য গ্রহণের পাশাপাশি সাবেক প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দীন আহমদ ও সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদকে তলব করে।
ফখরুদ্দীন আহমদ ই-মেইলে সংসদীয় কমিটির কাছে দাবি করেন, তিনি ওই ঘটনায় জড়িত নন। মইন উ আহমেদও টেলিকনফারেন্সে নিজের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেন। তারা দুজনেই বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন।
তদন্ত শেষে ফখরুদ্দীন ও মইনসহ ছয় জনের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করে সংসদীয় কমিটি।
বাকি চারজন হলেন- সে সময় প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা পরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) দায়িত্বে থাকা মেজর জেনারেল এ টি এম আমিন, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফজলুল বারী, কর্নেল শামসুল আলম।
এছাড়া দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার জন্য পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নূর মোহাম্মদের বিরুদ্ধেও বিধিগত ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়।
কমিটির পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ডিজিএফআইয়ের সরাসরি হস্তক্ষেপে অগাস্টের ওই ঘটনা ঘটে। ডিজিএফআই তাদের দায়িত্বে বাইরে গিয়ে ওই কাজে অংশ নেয়।
এছাড়া পুলিশ ও র্যাবের ‘বাড়াবাড়িও’ দায়ী ছিল। ওই ঘটনায় ডিজিএফআই ‘ক্ষমার অযোগ্য’ অপরাধ করেছে।
সে সময় নির্যাতনের শিকার বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মানবেন্দ্র দেব বলেন, “সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদনকে আমরা সেসময়ই স্বাগত জানিয়েছিলাম। কিন্তু এতোদিনেও সুপারিশ বাস্তাবায়ন না হওয়ায় প্রমান হয় যে সরকারের সদিচ্ছা নেই। ”
মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ বাস্তাবয়নের ‘সামর্থ্য’ ও ‘যোগ্যতা’ নিয়েও প্রশ্ন তোলেন ওই ঘটনায় কারাভোগ করা সাবেক এই ছাত্রনেতা।
তিনি বলেন, “সংসদীয় কমিটির শুধু দায়ীদের শাস্তির সুপারিশ করেনি। তারা সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করারও সুপারিশ করেছিল। সেটাও কি বাস্তবায়ন হয়ছে?”
বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সুপারিশ বাস্তবায়ন করার কাজ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। ছাত্র অধিকার সংশ্লিষ্ট যে কোনো সুপারিশ বাস্তাবায়ন করা দরকার। ”
কমিটির ১৩ দফা সুপারিশ
১. ওই ঘটনার জন্য প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দীন আহমেদ ও সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদ দায়ী।
একইসঙ্গে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার মেজর জেনারেল এটি এম আমিন, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফজলুল বারী, কর্নেল শামসুল আলমসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে দায়ী করা যায়। এছাড়া দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার জন্য পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নূর মোহাম্মদ এর বিষয়ে বিধিগত ব্যবস্থা নিতে হবে।
২. নির্যাতিত ছাত্র-শিক্ষকদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা ও দণ্ড মওকুফের পাশাপাশি সরকারিভাবে আইনি সহায়তা দেয়া প্রয়োজন।
৩. নির্যাতিতদের সরকারিভাবে চিকিৎসা সহায়তা ও দায়ীদের কাছ থেকে ওই অর্থ আদায় করার সুপারিশ করা হলো।
৪. ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কোনো সেনা ক্যাম্প স্থাপন করতে হলে সিন্ডিকেটের অনুমোদন নেয়া বাধ্যতামূলক করতে হবে।
৫. রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিহত রিক্সা চালকের পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতা দিতে হবে।
৬. ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স সংশোধন এবং সার্বভৌম সংসদ ছাড়া কোনো পর্যায়ে এর পরিবর্তনের সুযোগ বন্ধ করতে আইন করা প্রয়োজন।
৭. বিশ্ববিদ্যালয়ে সহিংস ঘটনায় নির্যাতিত শিক্ষক-ছাত্রদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার হলেও ভবিষ্যতে অনেকের হয়রানির শিকার হওয়ার আশংকা রয়েছে। তাদের হয়রানি প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
৮. ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্বশাসন সংক্রান্ত অধ্যাদেশটি কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
১৯৭৫ পরবর্তীকালে বহিঃস্থ ও অভ্যন্তরীণ উভয় কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্বশাসনের ধারণাটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে।
৯. একটি দক্ষ প্রক্টরিয়াল বডি গঠনও এ জাতীয় অনভিপ্রেত ঘটনা প্রতিরোধে কার্যকর ফল দিতে পারে।
১০. প্রতিরক্ষা বাহিনীর শৃঙ্খলা রক্ষায় তাদের নিজস্ব গোয়েন্দা সংস্থা থাকতে পারে, কিন্তু বেসামরিক বিষয়ে বিশেষ করে রাজনৈতিক বিষয়ে ডিজিএফআইয়ের হস্তক্ষেপ অবিলম্বে বন্ধ করা প্রয়োজন।
১১. টিএফ সেল, যৌথ বাহিনীর জিজ্ঞাসাবাদ সেল ইত্যাদি অবিলম্বে বন্ধ করার সুপারিশ করা হলো।
১২. ভবিষ্যতে যে কোনো ব্যক্তিকে সংসদীয় কমিটি তলব করলে উপস্থিত হওয়া বাধ্যতামূলক করতে আইন প্রণয়নের সুপারিশ করা হলো।
১৩. ডাকসু নির্বাচনসহ সকল ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়মিত করতে হবে। যাতে যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে উঠতে পারে এবং ছাত্রদের স্বার্থ রক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।