আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তুই আমার মেয়ে না

'তুই আমার মেয়ে না'। মৃত্যুর আগে রক্ত মাখা ছোরা হাতে নিজের মেয়েকে দেখে এ কথাটিই শুধু বলতে পেরেছিলেন এসবি ইন্সপেক্টর মাহফুজুর রহমানের স্ত্রী স্বপ্না রহমান। এর পর তিনি লুটিয়ে পড়েন মেঝের ওপর। এ সময় মায়ের গোঙ্গানির শব্দ শুনেই ঘুম ভেঙে যায় ৮ বছরের শিশু ঐহীর। রক্তাক্ত মাকে দেখতে পেয়ে ঐহী ভয়ে চিৎকার করে ওঠে।

এ সময় তার বড় বোন ঐশী তাকে ধমক দেয়। বাথরুমে নিয়ে আটকে রাখে তাকে। এর পর প্রথমে তার মায়ের শরীরে একের পর এক ছোরা বসাতে থাকে। পরে বাবার শরীরে দুবার ছুরিকাঘাত করে।

স্ত্রীসহ এসবি ইন্সপেক্টর খুনের ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ সেই রাতের নৃশংসতার এমন বর্ণনা পেয়েছে।

গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, হত্যার আগে দুজনের কফিতে ১০টি ঘুমের বড়ি মেশানো হয়। যে কারণে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন এসবি ইন্সপেক্টর মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমান নিজেদের রক্ষা করতে পারেননি। ঘুমের ঘোরেই তাদের মৃত্যু ঘটে। ওই কর্মকর্তা জানান, স্বপ্না রহমানকে যখন ছুরিকাঘাত করা হয়, তিনি একবার চৈতন্য ফিরে পেয়েছিলেন। কিন্তু চৈতন্য ফিরে পাননি ইন্সপেক্টর মাহফুজুর রহমান।

পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, জিজ্ঞাসাবাদে ঐশী মানসিকভাবে বেশ দৃঢ় ছিল। তার ভেতর অনুশোচনা দেখা যায়নি। ৫ ঘণ্টা চেষ্টা করেও পুলিশ তাকে কাঁদাতে পারেনি। তবে এক পর্যায় সে পুলিশকে জানায়, সে ভুল করেছে। মা-বাবার জন্য তার খারাপ লাগছে।

জেরার মুখে ঐশী : পুলিশ দম্পতি খুনের ঘটনায় তাদের মেয়ে ঐশী একাই জড়িত না-কি তার সঙ্গে আরও কেউ ছিল, তা এখনো স্পষ্ট ধারণা করতে পারেনি গোয়েন্দারা। পুলিশ এখনো ঘটনার সময়ে ঐশী ও সুমি ছাড়া তৃতীয় কোনো ব্যক্তির উপস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেনি। তবে পুলিশ সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে ঐশীর দুই বন্ধু জনি ও সাইদুলকে খুঁজছে। তাদের এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। ঐশীর অনেক তথ্যই পুলিশ বিশ্বাস করতে পারছে না।

গোয়েন্দা পুলিশের একটি সূত্র জানায়, অত্যন্ত স্মার্ট মেয়ে ঐশী। কোনো প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে যেতে চাইলে সে ইংরেজিতে ভিন্ন বিষয় নিয়ে অনর্গল কথা বলতে শুরু করে। সে একবার বলেছে, একাই হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছিল। আবার পরে বলেছে তার বন্ধুদের কথা। বুধবার রাতে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে তার ছোট ভাই ও কাজের মেয়ে সুমিকে নিয়ে সকালেই বাসা থেকে বেরিয়ে যায়।

ঐশী এ সময় জনি, সাইদুল ও রনির সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে। এ ছাড়া পারভেজ নামে আরেক বন্ধুকেও সে ফোন করে ঘটনা জানায়। গোয়েন্দা পুলিশ তার ফোনের কললিস্ট থেকে তার বন্ধুদের খোঁজ করতে থাকে। সূত্র জানায়, তার বন্ধু পারভেজ তাকে পুলিশের কাছে আত্দসমর্পণের জন্য পরামর্শ দেয়। এসএসসি পাস ঐশীর এ বন্ধুটিকে পুলিশ রবিবার আটক করার পর রাতেই আবার ছেড়ে দিয়েছে।

পুলিশ জানায়, এ ঘটনায় পারভেজের কোনো সংশ্লিষ্টতা না পাওয়ায় তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তবে ঐশীর বন্ধু জনি ও সাইদুল সম্পর্কে পুলিশের কাছে ভালো কোনো তথ্য নেই। পুরান ঢাকার এলিন মাল্টিমেডিয়া ড্যান্স গ্রুপের সদস্য জনি ও সাইদুলের সঙ্গেই বিভিন্ন ডিজে পার্টিতে যাতায়াত করত ঐশী। এ ছাড়া এরা দুজনই ইয়াবার খুচরা ব্যবসায়ী। গোয়েন্দারা জানতে পেরেছে, ঐশী তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা তাকে সীমান্ত পার করে দেওয়ার কথা বলেছিল।

সূত্র জানায়, তারা হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল কিনা পুলিশ এখনো নিশ্চিত হতে পারেনি। তবে তাদের খোঁজে পুলিশের একাধিক টিম রাজধানী ও তার আশপাশ এলাকায় অভিযান চালাচ্ছে। গোয়েন্দা পুলিশের একটি সূত্র জানায়, ঐশী জেরার মুখে বলেছে, ঘটনার রাতে তার দুই বন্ধু কৌশলে তাদের ফ্ল্যাটে প্রবেশ করে। এর পর তারা লুকিয়ে থাকে। তার মা-বাবা যখন গভীর ঘুমে, তখনই তার বন্ধুরা তার বাবা-মাকে হত্যা করে।

রিমান্ডে থাকা সুমি গোয়েন্দাদের বলেছে, সে ওই বাড়িতে আর কোনো ব্যক্তিকে দেখেনি। ঐশী একাই হত্যাকাণ্ড দুটি ঘটিয়েছে। তবে ঐহীর কাছ থেকে পুলিশ জেনেছে, সে এক ব্যক্তিকে দৌড়ে পালিয়ে যেতে দেখেছে। এ ধরনের বক্তব্যের পর গোয়েন্দা পুলিশকে ভাবিয়ে তোলে। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ঘটনার রাতে ইন্সপেক্টর মাহফুজুর রহমান বকাঝকা করেন তার মেয়েকে।

রাতে তিনি ঘুমিয়ে পড়েন ঐশীর রুমে। আর স্বপ্না তাদেও ছেলে ঐহীকে নিয়ে নিজেদের শয়নকক্ষে ঘুমুতে যান। এর আগে তাদের দেওয়া হয় ১০টি ঘুমের বড়ি মেশানো কফি। কাজের মেয়ে সুমি পুলিশকে জানায়, প্রথমে ঐশী তার মাকে ছুরিকাঘাত করে। এরই মাঝে ঐহীকে বাথরুমে আটকে রাখে ঐশী।

এরপরই ঐশী নিজ কক্ষে গিয়ে তার বাবাকে ছুরিকাঘাত করে। পরে সুমি এবং ঐশী দুজনে মিলে লাশ দুটি টেনে বাথরুমে নিয়ে যায়।

ঈদের আগে মায়ের শরবতে বিষ : পুলিশ জানতে পেরেছে ঘুমের ওষুধ অসংখ্যবার মাহফুজুর রহমানের কফিতে দেওয়া হয়েছিল। তবে তা ছিল পরিমাণে কম। ঈদের আগে মায়ের শরবতে বিষ মিশিয়ে দিয়েছিল ঐশী।

ওই যাত্রায় চিকিৎসা দেওয়া হলে স্বপ্না প্রাণে রক্ষা পান। ওই ঘটনার পর থেকে ঐশীর হাতের তৈরি কফি বা কোনো কিছুই গ্রহণ করতেন না মাহফুজ দম্পতি। বুধবার রাতে ঐশী নিজেই কফিতে ১০টি নাইটাস ঘুমের বড়ি মিশিয়ে কাজের মেয়ে সুমির মাধ্যমে পাঠানো হয়। সুমির হাতের তৈরি কফি ভেবে মাহফুজ দম্পতি সেই কফি পান করে গভীর ঘুমের ঢলে পড়েন।

ঐহী এসবির হেফাজতে : মাহফুজ দম্পতির ছেলে ঐহী এখন এসবির হেফাজতে রয়েছে।

সঙ্গে রয়েছেন তার মামা রবিউল আলম। আজ-কালের মধ্যে তাকে অভিভাবকের হাতে হস্তান্তর করা হবে।

প্রেস ব্রিফিং : ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম গতকাল প্রেস ব্রিফিংয়ে জানান, ঘটনার রাতে ঐশীর দুই বন্ধু গাড়ি নিয়ে ওই ভবনে আসে বলে ঐশী তাদের যে তথ্য দিয়েছে বাড়ির দারোয়ানদের কাছ থেকে ওই তথ্যের কোনো সত্যতা পায়নি পুলিশ। ঘটনার দিন ঐশীর বাবা ঐশীর কক্ষে ঘুমাচ্ছিলেন। আর তার মা ও ভাই ঘুমাচ্ছিল প্রধান শয়নকক্ষে।

ঐশী কফির সঙ্গে ১০টি করে ঘুমের বড়ি মিশিয়ে তার বাবা-মাকে খাওয়ায় বলে জানিয়েছে। মা স্বপ্না রহমানকে খুন করার সময় তিনি জেগে ওঠেন। কিন্তু ঘুমের ওষুধের প্রভাবে তিনি চিৎকার করতে পারছিলেন না। এ ঘটনায় ২০ থেকে ২৫ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে বলে জানান পুলিশের এ কর্মকর্তা।

ডিজে ক্লাবে ইয়াবায় হাতেখড়ি : টুইনটাওয়ারের ডিজে ক্লাবেই ঐশীর প্রথম ইয়াবায় হাতেখড়ি।

তিন বছর আগে এক ডিজে বান্ধবীর সঙ্গে ওই ক্লাবে তার যাওয়া। সেখানে এলিন মাল্টিমেডিয়া ড্যান্স গ্রুপের সদস্যদের সঙ্গে পরিচয়ের মধ্য দিয়ে সে খুঁজে পেয়েছিল ভিন্ন এক জীবন। ডিজে পার্টির বন্ধুদের সঙ্গে নিয়মিত ইয়াবা ছাড়াও গাঁজা সেবন, অবাধ মেলামেশা, একাধিক ছেলে বন্ধুর সঙ্গে সময় কাটানো- সব মিলিয়ে রঙিন এক দুনিয়ার সন্ধান পেয়েছিল ঐশী। চেষ্টা করেও যে জীবন থেকে তাকে ফেরানো যায়নি।

পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, ৫ বছর আগে গাঁজা সেবনকারী বন্ধুদের কাছ থেকে দূরে সরাতে রাজধানীর পূর্ব বনশ্রীর ফ্ল্যাট বিক্রি করে দিয়েছিলেন ইন্সপেক্টর মাহফুজ।

সেখান থেকে তারা চামেলিবাগের বাসায় ওঠেন। কিন্তু গাঁজা থেকে ইয়াবার দিকে ঝুঁকে পড়ে ঐশী। ঐশীর এই বখাটেপনা থেকে ফিরিয়ে আনতে তাকে বাসা থেকে বের হতে দিত না তার মা-বাবা। আর এ কারণে জীবন দিয়ে চরম মূল্য দিতে হলো তাদের দু'জনকে।

গোয়েন্দা পুলিশের একটি সূত্র জানায়, অত্যন্ত স্মার্ট মেয়ে ঐশী।

সায়েন্স নিয়ে তার জ্ঞান অনেক। ইংরেজীতে অনর্গল কথা বলে সবাইকে ভিন্ন দিকে নিয়ে যেতে পারে। তৃতীয় শ্রেনীতে পড়ার সময় থেকে ঐশী ডায়েরী লিখতো। বড় ধরণের একটি ডায়েরী তার কাছ থেকে উদ্ধার করেছে গোয়েন্দারা। যেখানে তিনি তার ছোট বেলা থেকে শুৃরু করে হত্যাকাণ্ডের রাত পর্যন্ত নানা কথা লিখা রয়েছে।

গোয়েন্দারা তাকে কোনো বিষয় জানতে চাইলেই তিনি ওই ডায়েরীর কথা পুলিশকে জানায়। বলে, ডায়েরী পড়লেই তা কথা জানতে পারবে তারা। তাই তাকে প্রশ্ন করার কোনো প্রয়োজন নেই। সূত্র জানায়, ডায়েরীতে ঐশী তার পরিবার ও বন্ধু বান্ধবদের বিষয়ে নানা তথ্য ছাড়াও বেশ কয়েক বছর আগেরকার বিভিন্ন পত্রিকার কাটিং রয়েছে। তার পছন্দের সাবজেক্ট বিজ্ঞান।

বিজ্ঞান সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া গেলেই সে পত্রিকা থেকে কেটে ডায়ের ীতে পেস্ট করে রাখতো।

 

 

সোর্স: http://www.bd-pratidin.com/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।