আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সাহিত্যের জন্যও তৈরি হয়ে গেছে ঈদের বাসন আর পূজার থালা।



পূজায় ও ঈদে সাহিত্যচর্চা মুসতাফা সায়ীদ বাঙালির সাহিত্যচর্চা হয় পূজায় ও ঈদে। ভারতের বাঙালিরা পূজায় সাহিত্য করেন, বাংলাদেশের বাঙালিরা ঈদে। বেশ স্পষ্ট হয়ে গেছে, বাংলা সাহিত্য মুসলমান ও হিন্দুর পরিচয়ে দুই ধারায় বহমান। ধর্মের পরিচয় বড় শক্তিশালী, তাই বাঙালি এক থাকতে পারে নাই, দুই ভূখণ্ডের দুই সীমানা তৈরি করে নিয়েছে যার যার পরিচয়ের পতাকা তুলে; ভাষা এক হয়েও বাঙালির রাজনৈতিক ভূখণ্ড এক থাকতে পারল না, এক থালায় ভাত খেতে পারল না তারা। হিন্দু বাঙালি মুসলমান বাঙালিকে, কিংবা মুসলমান বাঙালি হিন্দু বাঙালিকে আপন বলে জানে না ; তারা একত্রে ভাত খাবার মত দুই সহোদর নয়―তাই সাহিত্যের জন্যও তৈরি হয়ে গেছে ঈদের বাসন আর পূজার থালা।

দুই বাংলার অনেক লেখকশিল্পী মাঝে মাঝে একত্র হয়ে গলাগলির সরকারি-বেসরকারি অনুষ্ঠান করেন ; তখন তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন যে, রাজনীতির সীমানা বাঙালির সাংস্কৃতিক মিলনে কোন বাধা তৈরি করতে পারে নাই। এটা যে কত বড় একটা মিছা দেমাগ, ঈদে ও পূজায় বাঙালির স্বাতন্ত্র সাহিত্যচর্চা চোখে গুতা দিয়ে তা প্রমাণ করে দিয়েছে। দেখা যাবে একটা কি দুইটা পূজা সংখ্যার পেটমোটা সঙ্কলনে কোনমতে চেপেচুপে বাঙলাদেশের কোন এক-দুইজন কাঙাল লেখক-কবির একটা-দুইটা লেখা একটুখানি জায়গা করে নিতে পেরেছে ; উল্টা দিকে বাংলাদেশের ঈদের সঙ্কলনে পশ্চিমের দাদা-বাঙালির লেখার জন্য বেশ তোয়াজ-দেখানো জায়গা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সম্পাদকরা বোঝাতে চান, দেখ আমরা কত উদার আর অসাম্প্রদায়িক, আমরা দুই দেশের বাঙালিরা সংস্কৃতিচর্চাটা একসাথেই করছি। এত উঁচাদরের ভণ্ডামী কমই হয়।

কোন লেখকের কাছ থেকে, দুই বাংলার কোথাও এমন কথা শোনা যায় না—তাঁরা তাঁদের ধর্মের একটা বিশেষ পার্বণ নিয়ে সাহিত্যচর্চায় মাতবেন না—তাঁরা সাহিত্য করবেন এমন এক সামিয়ানার তলে যেখানে সব ধর্মবর্ণের মানুষ এসে হাজির হতে পারে। এই রকম চিন্তা সত্যি যদি কারো মাথায় কাজ করত তবে ঈদে ও পূজায় সাহিত্যচর্চার মাতলামিটা তৈরি হতে পারত না। ধর্মীয় উৎসবকে ঘিরে সাহিত্যচর্চার রেওয়াজ আপাতবিচারে নির্দোষ—কেননা, মধ্যযুগের শিল্পসাহিত্যের একটা অংশ ধর্মের সাথে যুক্ত; ধর্মের প্রয়োজনেই সেগুলি রচিত। ধর্মের আশ্রয়মুক্ত শিল্পসাহিত্যের স্বাধীন যাত্রা আধুনিক সময়ে এসেই কেবল ব্যাপকভাবে শুরু হয়েছে। ধর্মীয় উৎসবকে ঘিরে আধুনিক বাঙালির সাহিত্যচর্চা তখনই নির্দোষ হতো, যদি ঈদে ও পূজায় একই সাথে দুইদেশের পত্রিকাওয়ালারাই সাহিত্যের দুইটি করে সঙ্কলন প্রকাশ করতেন।

পশ্চিমবঙ্গ থেকে যেমন ঈদ-সঙ্কলন প্রকাশিত হয় না, বাংলাদেশ থেকেও কোন পত্রিকা পূজার সঙ্কলন প্রকাশ করে না। এতে করে সাফ সাফ জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে, ভারতের বাংলাসাহিত্য হিন্দুর আর বাংলাদেশের বাংলাসাহিত্য মুসলমানের। দেশকে রাজনৈতিক সীমানা দিয়ে খণ্ডিত করার মত সাহিত্যকেও ধর্মের সীমানা দিয়ে স্পষ্ট করে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। কাজেই ঈদে ও পূজায় সাহিত্যচর্চাকে নির্দোষ বিচার করা কোন বিচারই না ; তেমনি ঈদে ও পূজায় হিন্দু-মুসলমানে ভাগাভাগি করে সাহিত্য করা কোন অসাম্প্রদায়িকতাও না। বাংলাদেশ ভাগ হয়ে আছে ধর্মের নামে ভেদাভেদকে কেন্দ্র করেই।

ধর্মকে চাগিয়ে তুলে দেশ জুদা করে নেব, আবার দুই ধর্মের সম্প্রদায়ের মধ্যকার ফাঁকটা লেপে দিতেও চাইব, এটা আসলে ছেপের লেপন। ছেপ দিয়ে লেপ দেওয়া আসলে কোন লেপই না, ফাঁকটা টিকিয়ে রাখারই বুদ্ধি। ভিতরের গর্তকে, মুখের উপরের মাটিতে একটুখানি লেপ দিয়ে, ফাঁকাটা চোখের সামনে থেকে আড়াল করে রাখা হয়ত যায়, কিন্তু ধাক্কা লাগলে লেপের চল্টা উঠে যায়, ফাঁকাটা বেশি করে চোখে পড়ে তখন। পূজা ও ঈদে হিন্দু ও মুসলমান সাহিত্যিকদের দুই-একটা লেখা ভাগাভাগি করে ছাপিয়ে উদারতা দেখানোর চেষ্টার দিকে তাকালে চল্টা উঠে যাওয়া গর্ত প্রকটভাবে ধরা পড়ে। অসাম্প্রদায়িক বনার এই যে আনুষ্ঠানিক উদারতা, এর সবটাই মেকি।

মানুষ নিয়ত বিভেদমুখর ও ঐক্যপরায়ণ। নিজ স্বার্থের তাগিদে সে একা থাকতে চায়; আবার অবস্থার ফেরে একা বাঁচার চেষ্টা যখন সম্ভব হয় না, তখন অন্যের হাত ধরতে বাধ্য হয়। দুইজন মানুষের এই যে বিচ্ছিন্ন থাকা ও একত্র হওয়ার নিরšতর যাত্রা, এতে একজন আরেকজনের মধ্যে হারিয়ে যায় কি ? মোটেই হারায় না, বরং নিজের অস্তিত্ব প্রকটিত করার জন্যই এই ঐক্য। কাজেই, অসাম্প্রদায়িকতা বলতে পৃথিবীতে কিছু নাই। শ্রেণীতে শ্রেণীতে বিভক্ত মানুষ ঠ্যাকায় পড়ে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে বাঁচে মাত্র, এতে শ্রেণীর অস্তিত্ব ঘুচে যায় না, শ্রেণীর নতুন চেহারা তৈরি হয় কেবল।

অসাম্প্রদায়িকতা সেদিনই সম্ভব হবে, যেদিন শ্রেণী বলতে কিছু থাকবে না। শ্রেণীস্বার্থ আছে বলেই শ্রেণী আছে; সম্প্রদায় থাকলে সাম্প্রদায়িক মানসিকতাও থাকবে। হিন্দু ও মুসলমান দুইটি সম্প্রদায়ের পরিচয় যেখানে জাজ্জ্বল্যমান―তাদের একসাথে খানাপিনা আর সহবত হলে একে অসাম্প্রদায়িকতা বলে না, সাম্প্রদায়িক-সম্প্রীতি বলে; সভ্য-সমাজের এটি একটি গুণ; এটি না-থাকলে সমাজটি বর্বরদশা থেকে উঠে আসতে পারে নাই এখনো। আমরা কি বর্বর থাকতে চাই? আমরা কি শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থান চাই না? আর সাম্প্রদায়িক-সম্প্রীতি কেবল হিন্দু-মুসলমানেই কেন? সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলি কি দোষ করল? বাংলাদেশ-ভারত দুইখানেই তারা নিগৃহীত হচ্ছে কেন? তাদের ভাষা-সাহিত্য বিকাশে সহায়তার হাত কতটা বাড়ানো হচ্ছে? কিছু সংখ্যক ব্যক্তি নিজেদের অসাম্প্রদায়িক বলে জাহির করতে পছন্দ করেন। এতটাই তাঁরা আগ-বাড়িয়ে যান যে, বলে ফেলেন, সাতচল্লিশের বিভাজনটা ছিল মিথ্যা, তাই ওটা ভুলে যেতে হবে।

ইতিহাস না-লিখলে, বদল করে লিখলে, কিংবা চাপা দিলে একটা সত্যকে চাপা দেওয়া হয় মাত্র। সত্য চাপা দিলে তার পুনরাবৃত্তি ঘটার সমূহ আশঙ্কা। দ্বিজাতি তত্ত্ব ভুল ছিল, একাত্তুরে তা প্রমাণীত হয়ে গেছে; কিন্তু ধর্মের ভিত্তিতে হিন্দুস্তান-পাকিস্তান হওয়া নিষ্ঠুর হলেও সত্য; ওটা ভুলে যাওয়া যায় না; ভুলে যেতে চাইলে আরেকটা বড় ভুল হবে। আর ভাষা এক বলেই ভারতের হিন্দু আর বাংলাদেশের মুসলমান এক জাতি এবং দুই বাংলা এক হয়ে যাবে, এমন ভাবার বাস্তবতা নাই । জিও-পলিটিক্যাল কারণে যদিবা দুই বাংলা এক হতে হয়, সেটা হবে স্বাধীন দেশসমূহের যুক্তরাষ্ট্র ধরনের কিছু একটা; যেখানে সব দেশের সকল সম্প্রদায় নিজেদেরকে নিজেরাই নিয়ন্ত্রিত ও বিকশিত করবে।

বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়টি একদার ভারতবর্ষের হিন্দুসমাজেরই সবচাইতে অত্যাচারিত আর অপমানিত অংশ; হাজার বছরের নিগ্রহ থেকে বাঁচার জন্যই স্বাধীন আত্মবিকাশের তাগিদে সেই যুগের বাস্তবতা অনুযায়ী তারা ইসলাম কবুল করেছিল―সেটা ছিল শ্রেণীবিদ্রোহ, হয়েছে ধর্মের হাত ধরে। বিজয়ী মুসলমান বাদশা-আমির-ওমরাওদের রাজনৈতিক চাপ বিজিত হিন্দুদের উপর স¦ভাবতই ছিল। কিন্তু মুসলমান হিসাবে ধর্মাšতরিত নমশুদ্ররাও বাংলাদেশের যেসব পাড়ায় বা গ্রামে সংখ্যাগুরু ছিল, সেখানকার সংখ্যালঘু ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রীয়―তাদের এক সময়কার মনিবদের প্রতি―নতুন পাওয়া সামাজিক মর্যাদার স্বাদ গায়ে-গতরে উপলদ্ধি করার জন্য―অত্যাচার শুরু করে দেয়। এটা ছিল এতদিন অপমানিত হবার বিনিময়ে গায়ের ঝাল ঝাড়া। পুরানো যামানার কাগজপত্র ঘাঁটলে দেখা যায়, মুসলমানী আমলের পুরা সময়টাই উচ্চবর্ণের হিন্দুরা মুসলমান প্রধান এলাকায় নিগৃহিত হচ্ছে।

তার প্রতিক্রিয়া হিসাবে মুসলমানী যুগের পতনের পর ব্রিটিশের প্রতি বর্ণহিন্দুরা একচেটিয়া সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে ; তাদের শিক্ষা-দীক্ষা-সহায়তা গ্রহণ করে সম্প্রদায় হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে; সমাজের সকল সুবিধা দখল করে নিয়েছে। এর পাল্টা-প্রতিক্রিয়া হিসাবে মুসলমানদের হিন্দু-বিদ্বেষ ধারালো হয়েছে। কয়েক শ বছর পুরানো এই রেষারেষী মিটানো যাবে কেবল তখনই যখন দুইটি সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিকাশে আর কোন বাধা থাকবে না। ধর্ম একটা সময় ছিল ছোট ছোট গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে নিরাপদে বাঁচার জন্য অপরিহার্য। সেই গণ্ডি থেকে সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষকে পুঁজিবাদ ছুটিয়ে এনে বাধ্য করেছে এক কারখানার মজদুর কিংবা পুঁজিপতির হুঁকুবরদার হতে, সকলে এক চুলার রান্না খেতে বাধ্য হচ্ছে―জাতধর্মের জোর তাই আর টিকছে না।

কিন্তু ধর্ম-বর্ণের এই ঐক্যপ্রক্রিয়াটিকে সফল হতে দিচ্ছে না পুঁজিপতিরাই, ধর্মের জের টিকিয়ে রাখছে তারা বিভেদনীতিকে নিজ স্বার্থে কাজে লাগানোর জন্য। ভারতরাষ্ট্র কাগজেকলমেই ধর্মনিরপেক্ষ, বাস্তবে বহু জাতি ও ধর্মের বিশাল সীমানার বাসিন্দাদের হিন্দুত্বের নামে ডান্ডা পিটিয়ে এক রাখা হয়। পুঁজিবাদ বিকাশের আগের সমাজগুলিতে শ্রেণীতে শ্রেণীতে দ্বন্দ্বের সীমারেখা অনেক সময় স্পষ্ট দেখা যায় না, শ্রেণী-বিদ্রোহ নানা আবরণে নানা চেহারা ধারন করেছে। পুঁজিবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবার পর সামাজিক শ্রেণীভেদের সূক্ষ্ণতরসমূহ কমে গিয়ে স্থুল দাগে শ্রমিক ও পুঁজিপতি হিসাবে বিভাজিত এবং মাঝখানের স্তরগুলিও চেনা যায় সহজেই। বাংলার ধর্মান্তরিত মুসলমানরা ব্রিটিশের সময়ে হিন্দুসমাজের ইংরেজিশিক্ষিত উচ্চশ্রেণীর চাপে আত্মবিকাশে বাধাগ্রস্ত হয়েছে; আত্মবিকাশের তাগিদেই তারা আলাদা পূর্ববাংলা ও পরে পাকিস্তান চেয়েছিল।

আলাদা জাতিসত্ত্বা হিসাবে এখন তারা নিজ ভূখণ্ডে স্বশাসন করছে, তাদেরকে আবার এক ভাষার দাবিতে এক পাতে খাবার প্রস্তাব ইতিহাসকে পিছিয়ে নেবার প্রস্তাব মাত্র। এখানে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর আত্মবিকাশের অধিকার খর্ব হবার মত অবস্থা তৈরি করার জন্যই অসাম্প্রদায়িক সাজার ধারণাটি। আমাদের গরিব আত্মা, আমরা কথাটি তাই জোর দিয়ে বলতে পারি না। কিন্তু পারা আবশ্যক। তা করছি না বলেই, ধর্মব্যবসায়ীরা সাম্প্রদায়িক-সম্প্রীতি নষ্ট করার সুযোগ পায়।

ভাষা ও ধর্ম মোটামুটি এক, এরপরও মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমান সম্প্রদায় বৃহত্তর জাতি হিসাবে শীলিভূত হতে পারে নাই। দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তের ছিটিয়ে ছড়িয়ে থাকা ইহুদি ধর্মের অনুসারিদের একত্র করে কৃত্রিমভাবে বানানো ধর্মভিত্তিক রাস্ট্র ইজরাইলে সবার ভাষা এক নয়। কাজেই জাতি হয়ে ওঠার জন্য ভাষা কিংবা ধর্ম কোনটাই একমাত্র নির্ণায়ক নয়, তাই বলে এদের কোনটাকে বাতিল করাও যাবে না। প্রকৃতপক্ষে জাতির ধারণাটি চিরকালই একটি পরিবর্তনশীল প্রপঞ্চ যার পরিচয় নির্ণয় করার জন্য একক কোন চিরস্থায়ী চিহ্ন নাই। ট্যাঁকের জোর আর এলেমের জোর কম থাকলে মাথাটা সবসময় বড়র প্রতি নুয়ে থাকা ধরনের হয়।

আমাদের দেশের কিছু শিল্পী-সাহিত্যক বড়র অনুগ্রহ চাইতে গিয়ে অসাম্প্রদায়িকতার ভেক ধরেন, ওটা বড়র প্রতি অক্ষমের মাথা নত করা। বড়রা এই সুযোগটা নেন বাংলাদেশের বাজারটায় নিয়ন্ত্রণ আরেকটু বাড়াতে। অসাম্প্রদায়িকতার বুলি দাদাদের মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি মাত্র। ঘটনাটা যদি এমন হত বাংলাদেশের ভাষা আরবি-উর্দু-ফারসি কিংবা ইংরেজি, আমাদের শিল্পী-সাহিত্যকরা তখন ইরান-পাকিস্তান-আরব বা ইংরেজদেশে লাইন দিতেন। পশ্চিমবাংলা হিন্দুদের দেশ হওয়াতেই আমাদের কবি-শিল্পিদের অসাম্প্রদায়িক হওয়া জরুরি।

স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারত সহায় ছিল। একাত্তুরে ওইদেশে তাঁরা কিছুদিন খানাপিনা করার সুযোগ পেয়েছেন, এটারও তো একটা চক্ষুলজ্জা আছে। এঁদের না-আছে অধ্যবসায়শীল হবার বিবেক, না-আছে দেশের পাঠক-ভোক্তার প্রতি আস্থা। দাদাদের একটা সার্টিফিকেট পেলে, দেশে ওটা দেখিয়ে তাঁদের চাকরি বা বাজার ধরার একটা হিল্লা হয়। বাংলাদেশ যদি অর্থনীতি ও সার্বভৌমত্বের জোরে ভারত-রাষ্ট্রের চাইতে বেশি পোক্ত হত, চিত্রটি তখন ভিন্ন হত।

বাংলাদেশে যাঁরা সাহিত্যচর্চা করেন, তাঁদের অনেকে নিজেদের মুসলমান হিসাবে পরিচয় দিতে যেন সঙ্কুচিত। চালচলনে তাঁরা পারলে যেন হিন্দু হয়ে যেতে চান―তাই যদি কারো মা-বাবার দেওয়া নাম হয় লাল মিয়া, তিনি তা বদলে করেন লালিত্য লালিম, কালা মিয়াকে কৃষ্ণ কাঞ্চন কিংবা রাইসুল ইসলাম হয়ে যান ক্রিপটিক ক্রাইসু। আমরা যাদের বংশধর তারা ছিলেন চাঁড়াল আর বনুয়া, মেছুয়া আর জোলা। এখন কেবল নাম বদলালেই কি বংশের দাগ ধুয়ে যাবে, আর দাদারা আমাদের ঘরে তুলে নেবেন? তুলে নেবেনই যদি তবে সাতচল্লিশের ভাগাভাগির সময় জন্ম হত তিনটি দেশের। স্বাধীকারকামী বাংলার মানুষের আলাদা দেশ তখনই হত।

ইতিহাস ঘেঁটে আজকাল গবেষকরা তুলে আনছেন সেটা হতে দেন নাই দাদারাই। ভারতের নেতারা সহিষ্ণুতা কিংবা বুদ্ধিমত্তা কোনটারই পরিচয় দিতে পারেন নাই, এখনো পারছেন না। সাতচল্লিশের ভাঙচুরের পরও শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থানকারী কয়েকটি দেশের সম্মিলিত সংঘ হিসাবে নতুন আঞ্চলিক পরিচয় নিয়ে উপমহাদেশ মাথা তুলে দাঁড়াতে পারত। ভারত এগিয়ে আসতে পারত সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে পাকিস্তানকে সাম্রাজ্যবাদের সাথে গাঁটছড়া না-বাঁধার জন্য। ভারত-পাকিস্তানের সাথে হতে পারত চিরস্থায়ী অনাক্রমণ চুক্তি।

যদি সেটা হত, উপমাদেশের দেশগুলির সামরিকবরাদ্দ বাঁচিয়ে এখানকার জাতিগুলি আজ শিক্ষাদীক্ষায় উন্নত থাকত। কেন তা হল না? সদ্য হওয়া দুইটি দেশের মধ্যে এমন কি ঘটেছিল যুদ্ধ বাঁধানোর ? কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা কেন খরচ হচ্ছে যুদ্ধবাজির পিছনে? কে কার শত্রু? সাতচল্লিশের আগে তারা কি একত্র ছিল না? এখন আলাদা দেশ হয়ে একসাথে চলতে না-পারার কী কারণ? উপমহাদেশে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের অসম প্রতিযোগিতা চলছে, এর মূল দায়িত্ব ভারতের। বাংলাদেশ যে সার্বভৌম দেশ হিসাবে শক্তি অর্জন করতে পারছেনা, এর কারণ ভারত। ভারত রাষ্ট্র আসলে উপমহাদেশের অবদমিত জাতিসমূহের এক বিরাট জেলখানা, একই সাথে প্রতিবেশী দেশগুলির আত্মবিকাশের শত্র“। বাংলাদেশ মজবুত অর্থনীতি নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলে ভারতের জাতিগুলি স্বাধীন হবার ইন্ধন পাবে, ভারতীয় পুঁজিপতিদের পণ্য বিক্রয়ের আঞ্চলিক বাজার টুকরা টুকরা হয়ে যাবে; আলাদা সত্ত্বা নিয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়া জাতিরাষ্ট্রের শ্রমিকদের যাচ্ছেতাই মজুরিতে খাটানো যাবে না; সেখানকার কাঁচামাল পেতেও বসতে হবে দরকষাকষিতে।

এটা দাদারা না-বুঝবেন কেন? আমরা শিল্পসাহিত্য নিয়ে যতই গলাগলি করি আর রাখিবন্ধনে জড়াই না কেন, ভারত বাংলাদেশকে গঙ্গার পানি দেবে না, পাটের উচ্চতর গবেষণা করার সুযোগ বাংলাদেশের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে―তোমরা কাঁচাপাট তৈরি কর, আমরা তা মাঠ থেকে মাগনা দামে কিনে নেবো। গবেষণা করবে ভারত, তোমরা নয়। আর সে-জন্যই আন্তর্জাতিক পাট সংস্থা থেকে ভারত একগুঁয়ে দাবিতে সদস্যপদ তুলে নিয়ে ওটা বন্ধ করে দিয়েছে। বাংলাদেশ তার নিজের উৎপাদিত কাঁচামাল যথাযথ গবেষণা করে যদি বাণিজ্যপণ্য তৈরি করে ফেলতে পারে, বিশ্ব বাজারে তখন হয়ে উঠবে ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বি।

সে-সুবিধা বাংলাদেশকে ভারত কেন দেবে? ভারত নয় কেবল, মাথা তুলে দাঁড়ানোর সুযোগ কেউই বাংলাদেশকে দেবে না। কেউ কাউকে তা দেয় না। ওটা আদায় করে নিতে হয় যোগ্যতার বলে। বাংলাদেশের সাহিত্যের বাজারে প্রতিষ্ঠিত হতে চাইলে সেজন্য চোখ পোড়াতে হবে, আঙুল ক্ষয় করতে হবে। দাদাদের সার্টিফিকেটের জন্য যারা লাইন ধরেছেন, তাঁরা অক্ষম, সাহিত্যিক হিসাবে একেবারে নিচের সারির।

অবশ্য এঁরাই এখন গণমাধ্যমের কেষ্টবিষ্টু হয়ে দেদীপ্যমান। আধুনিক যুগে মানুষের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জায়গা একটাই, হয় আমরা শ্রমিক পক্ষের শক্তি হব, নয় পুঁজিপতির পক্ষের। ভারতের পুঁজিওয়ালাদের হাতে বাংলাদেশের বাজারটা তো তুলে দেওয়াই হয়েছে, এতে যে একটা চাপা আক্রোশ এখানকার জনগণের মধ্যে রয়েছে, দুই বাংলার শিল্পিসাহিত্যিকদের মাঝে মাঝে একত্রে সহবত করানো হয় সেই আক্রোশ একটু নরম করার জন্য। বাংলাদেশের জনগণ কোনদিনই ভারতের সাথে আত্মীয়তা খাটো করে দেখে না। জনগণ সবসময়ই চায়, দুই দেশের সীমানা ক্রমশ আলগা হয়ে আসুক।

কেবল পণ্য বিক্রয়ের বাজারটা চাই, এখানকার কাঁচামাল দখল করা চাই―এখানকার পণ্য ও শ্রমশক্তি ভারতে যাবে না, তা হলে আত্মীয়তা ঠিক থাকবে কী করে? শুধু শিল্পসাহিত্য লেনদেন করে তো সেটা ঠিক রাখা যাবে না। দুই বাংলা তখনই এক হওয়া সম্ভব যখন দুই দেশের বাসিন্দাদের স্বাধীন আত্মবিকাশের নিশ্চয়তা তৈরি হবে। আর সেই নিশ্চয়তা তৈরি করার জন্য ভারতের সকল জাতিসত্তার স্বাধীন আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের কার্যকর দাবি তুলতে হবে। বড় দেশের বাসিন্দা হিসাবে সেই দাবি তোলার দায়িত্ব দাদাদেরই। দুই বাংলা একত্র করার জন্য প্রাণ আইঢাই করছে, ভারতের সকল জাতিকে স্বাধীনতা দিয়ে তাদেরকে নিয়ে একটি কমনওয়েলথ তৈরি করার দাবি তাঁরা তুলছেন না কেন? আমরা চাই অবাধ শ্রমের যাতায়াত হোক।

কিন্তু ভারত কি সীমানা শিথিল করবে? জনগণের মধ্যে ঐক্যের ওটাই যে আসল জায়গা। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি একমাত্র তখনই সম্ভব, যখন এখানকার শ্রমিক ওখানে গিয়ে আর সেখানকরা শ্রমিক এখানে এসে মর্যাদা ও নিরাপদে রোজগারের সুযোগ পাবে। সেটা থাকলে লাল মিয়ার সাথে কৃষ্ণকুমারের দোস্তি হবেই হবে। ধর্মের ঠিকাদাররা তাদের মধ্যে তখন বিরোধ বাঁধাতে পারবে না। আলাদা দেশ হিসাবে নিজেদের মধ্যে সীমান্তুপ্রাচির যত মজবুত হবে, উপমহাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা তত বাড়তেই থাকবে, অর্থনীতি পিছানো আর জনগণ বঞ্চিত হতেই থাকবে―পোয়াবারো হবে কেবল আমেরিকার।

শিল্পসাহিত্য বাজারে বিকানোর পণ্য। ও নিয়ে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা লেনাদেনা হয়। ঈদে ও পূজায় সাহিত্যচর্চা ঘুচিয়ে দিলে টাকার কাঁড়ি ঘরে উঠবে না দুই দেশের সাহিত্যব্যাপারিদের। একারণে ঈদে ও পূজায় সাহিত্যচর্চার ধারা তৈরি হয়েছে, টিকেও আছে। বাজার ঠিক রাখার জন্য স¦তন্ত্র দেশ যেমন দরকার, বাজার সম্প্রসারণের জন্য একটু-আধটু উদারতা দেখানোও দরকার।

বাজার সম্প্রসারণের চিšতা থেকেই ঈদে ও পূজায় ভাগাভাগি করে অসাম্প্রদায়িক সাজা হয়। যদি টাকার খেলা না থাকতো, সাহিত্যচর্চা করা হত উভয় বাংলার মধ্যে একটা সমন¦য় রেখে যে, দুই বাংলার যাঁরা যাঁরা বাংলাভাষায় লেখালেখির কাজে যুক্ত, তাঁদের কাজ তুলে ধরা হবে―ওখানে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান পরিচয়টা মোটেই মাটি পাবে না, তখন উভয় বাংলার লেখালেখি চর্চা নিয়ে আলোচনা হত উন্মুক্তভাবে। বাংলাদেশের ও ভারতের সকল সম্প্রদায়ের সমসাময়িক সাহিত্যচর্চা নিয়ে একক মঞ্চ থেকে আলোচনা ও সমালোচনার রেওয়াজ রাখা তো দূরের কথা, চেষ্টাই করা হয় নাই। পশ্চিমবঙ্গে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশে কারা কারা লিখছেন তাঁদের কাউকেই ওখানকার পাঠক চেনেন না; লেখকদের মধ্যেও অনেকেই বাংলাদেশের লেখকদের চেনেন না, কেবল দুই-একজন কাউকে কাউকে চেনেন; তা-ও হয়তো বিশেষ কোনো গোত্রীয় সম্পর্কের কারণে; কিংবা শুধু নামটাই জানেন হয়তো, বই পড়েন নি কোনো। পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের সাহিত্য নিয়ে বাংলাদেশে কেউ কেউ মাঝে মাঝে আলোচনা করেন।

কিন্তু তা করেন প্রধানত ছাও লেখকগণ, যারা চাইছেন দাদাদের সাহিত্য নিয়ে দুই-এক কথা লিখে নজর টানতে, প্রতিষ্ঠার সিঁড়ি সহজে টপকাবার জন্য; পশ্চিমবঙ্গের কোন ধাড়ি লেখকের লেখা নিয়ে আলোচনা করে সে দেশে একটা ঠিকানা তৈরি করার সুযোগ হয়তো পাওয়া যেতে পারে, সেই উদ্দেশ্যে। সাহিত্যের পণ্যগুলি কেমন পয়দা হচ্ছে, ওগুলি কতটা গেলা যায়, সেই উদ্দেশ্যে কোন আলোচনাই কেউ করেন না। যদি তা করা হত, এ দেশের পাঠকরা জানতে পারতেন, গঙ্গোপধ্যায়-বন্দ্যোপাধ্যায় আর বসু-রায়দের সাহিত্য ষোল আনাই রূপচাঁদা মাছ নয়। ওদেশে বাংলাদেশের সাহিত্যচর্চা নিয়ে আলোচনা করা হোক, এই উদারতা আশা করা অবাস্তব। কিন্তু বাংলাদেশের লেখকগণ ওদেশের লেখকদের লেখা নিয়ে কথা বলা প্রয়োজন ছিল, প্রয়োজান আছে; এটা করা জরুরি।

কারণ এইদেশে ভারতীয় বইয়ের বাজার একচেটিয়া। নির্বিচারে বই এসে বাজার দখল করে নেবে, লেখকরা চেয়ে চেয়ে তা দেখবেন―কি আসছে, পাঠকরা কি পড়ছে, যাচাই করা হবে না―এটা চলতে দেওয়া উচিৎ ছিল না। বই জ্ঞানের আধার, সে জ্ঞান যেখান থেকেই আসুক, পথ বন্ধ করা উচিৎ নয়—এমন একটা তর্ক বাজারে চালু রয়েছে। সব বইই কি জ্ঞানের আধার? আর জ্ঞান কি মাগনা বিরতণ করা হয়? অন্য দেশ থেকে বই আসছে পণ্য হিসাবেই, এবং বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে। তাহলে কী আসছে তা যাচাই করা হবে না কেন? দেশের লেখকরা যে চুপ মেরে থাকেন, তার কারণ বিদেশি বইয়ে কি রয়েছে তা যাচাই করার মত এদেশের লেখকদের যোগ্যতা নাই।

ভারতীয় যেসব লেখকের সাহিত্য বাংলাদেশের বাজার দখল করে রেখেছে, সেগুলি কতটা মানসম্পন্ন, বাংলাদেশের সাহিত্য সেসবের তুলনায় কতটা পিছানো বা আগানো, তা তুলে ধরা বাংলাদেশের লেখকদেরই এটা দায়িত্ব। কিন্তু বাংলাদেশের লেখকগণ দাদাদের বই নিয়ে কথা বলার ঝুঁকি নিতে চান না; যদি বিরূপ কিছু বলে ফেলতে হয়, তখন পশ্চিমের ধাউস কাগজের একটুখানি পাতা বরাদ্দ পাবার হয়তো বারোটা বাজবে; দাদাদের সাথে যে খানিকটা সহবত হয়, ওটা টুটে যাবে। ফল এই দাঁড়িয়েছে, একদিকে ভারতীয় বই ও পত্রপত্রিকা একচেটিযা বাংলাদেশের বাজার কব্জা করে নিয়েছে ; অন্যদিকে বাংলাদেশের লেখকগণ ওপার বাংলায় অচেনাই থাকছেন। বইয়ের বাজারের রাস্তার ময়লা সরানোর জন্য ঝাঁটা তো কেবল একটি—বই নিয়ে নিয়মিত আলোচনা করা। সেই ঝাঁটাটা লুকিয়ে রাখা হয়েছে, অনেকের কপালেই তার বাড়ি পড়বে, হয়ত সেই ডরে।

ঈদে সাহিত্যচর্চার রেওয়াজ চালু থাকা অন্তত বাংলাদেশের মানুষের কাছে আশা করার নয়। বাংলাদেশ একুশে ফেব্রুয়ারির সূতিকাগার থেকে বার হয়ে বেড়ে ওঠেছে। ভাষাআন্দোলন বাংলাদেশের সকল ধর্ম-বর্ণ ও সম্প্রদায়ের সম্মিলিত আন্দোলন। সাহিত্যচর্চার জন্য এমন দিগন্তপ্রসারিত মঞ্চ আর নাই। এদেশের পত্রিকা-সম্পাদকদের খুলির ভিতরে ধর্ম নিয়ে বাণিজ্য করার ধান্ধাবাজী যদি কামড়ে না থাকত, পূজায় বাবুদের মণ্ডামেঠাই বেচার হাঁকাহাঁকির মত মিয়ারাও সাহিত্যের সেমাই-পোলাও নিয়ে ফিরিওয়ালাগিরিতে বসে যেতেন না।

ধর্মীয় উৎসবে জামাকাপড় আর খাবার সামগ্রী কেনার পাশাপাশি যদি সাহিত্য কেনার জন্য এক-দুইশ টাকার বাড়তি বরাদ্দ বছরে একবার জনসাধারণের জন্য ধরে দেওয়া যায়, তখন ব্যপারটা মন্দ হয় না—আর দশটা পণ্যসামগ্রির সাথে মুদিখানায় সাহিত্যটাও তুলে রাখার সুযোগ তৈরি হয়, লেখালেখি ফিরি করে দুইটা টাকার মুখ দেখার মওকা পাওয়া যায়। মওকাটা কাজে লাগাতেই পশ্চিমবঙ্গে পূজায় সাহিত্য করার জন্ম। এই বুদ্ধিটা বাংলাভাষায় লেখালেখি করাকে পেশা হয়ে উঠতে পারার সুযোগ করে দিয়েছে। সে-বিচারে এ উদ্যোগকে সাধুবাদই দিতে হবে। কিন্তু যদি বিচার করা যায়, অন্তত মুহূর্তের জন্যও ভাবনা করার অবসর কেউ নিতে চায়, দেখা যাবে ধর্মীয় উৎসবে জামাকাপড় আর খাবার সামগ্রীর মত সাহিত্যটা ঠিক একই রকমের আনন্দ দেবার পণ্য নয়।

যদিও সাহিত্যের উদ্দেশ্য আনন্দ পাওয়া, তবু খাওয়া-পরার আনন্দ আর সাহিত্যের আনন্দ ঠিক এক নয়। সাহিত্যে আনন্দ তৈরি হবার কারণ এর ভিতর মানুষ তার নিজেকে দেখতে পায়। এই আনন্দ যেন অনেকটা নিজের ফটো নিজে দেখার মতো। ফটোগ্রাফারের কাছে গিয়ে যখন ফটো তুলে দেবার বায়না করা হয়, বলা হয় ছবিটা যেন সুন্দর হয়। তাই পোজ দেবার আগে গালে মুখে প্রসাধনের ছোপ লাগে, আলো ফেলে মুখের ছাপ-ছোপ-গর্তগুলি আড়াল করা হয়।

সাহিত্যের ভিতর মানুষ তার নিজেকে দেখতে পায় বলে আনন্দিত হয়, এটা সত্য। কিন্তু এখানে সে নিজেকে আড়াল করতে চায় না, ফটোগ্রাফারের কাছে গিয়ে প্রসাধন মেখে যেমন সে করে। এখানেই ফটোগ্রাফি আর সাহিত্যের মধ্যকার পার্থক্য। সাহিত্যের মধ্যে মানুষ নিজেকে বাড়তি প্রসাধন দিয়ে আড়াল করে দেখতে চায় না, একেবারে চাঁছাছোলাভাবে নিজের দাগ আর গর্তেভরা সত্যিকারের চেহারাটাই দেখতে চায়। দেখে আর কল্পনা করে, এই খুঁতঅলা মানুষটার বদলে যদি একটি নিখুঁত মানুষ সে হতে পারতো।

সাহিত্য একই সাথে নিজেকে দেখায়, আবার নিজেকে আরো ভালোভাবে পাবার কল্পনাকেও দেখায়। জামাকাপড় ও খাবারসামগ্রী পাবার আনন্দের সাথে সাহিত্যের আনন্দের এই পার্থক্যটা যদি স্বীকার করা হয়, তবে স্বীকার করতে হবে সাহিত্য মুদিখানায় বিক্রির জন্য পয়দা হয় না। তখন ধর্মীয় উৎসবে কোরমা-পোলাওয়ের উপকরণ আর শাড়ি-পাঞ্জাবির সাথে একটা ঈদ বা পূজার সাহিত্যসংখ্যা কিনে ফেলার মত করে দেখার সুযোগ চলে যায়। কারণ, নিজেকে দেখা তো সহজ কাজ না। আমরা নিজের চোখে নিজের পিঠ দেখি না, ঘাড় দেখি না, পশ্চাদংশ দেখি না; আমরা আমাদের অর্ধেকটা দেখতে পাই কেবল।

নিজের গোটা শরীর দেখতে চাইলে অন্য কৌশল চাই; আয়না চাই সামনে ও পিছনে, উপরে ও নিচে। মানুষ তার নিজেকে দেখে অন্যের ভিতর, অন্যকে নিজের মধ্যে। মানুষই মানুষের আয়না হয়, যখন নিজেকে দেখে এবং অন্যকেও দেখে, একা করে এবং সামাজিকভাবে সবার অংশ হয়ে। সমগ্র নিজেকে দেখার পর নিজের খুঁতের বদল একটি নিখুঁত মানুষের কল্পনা করার যোগ্যতা গভীর সাধনার বলে আয়ত্ত করা যায়। বাল্মিকী মুনির নামে আমরা অবনত মস্তক কেন হই, তিনি সেই কঠিন কাজটি করতে পেরেছেন বলে।

মাঝ-বয়সে এসে যখন মনে হলো, রক্তপাত-পরসম্পদ লুণ্ঠন করে করে এই যে জীবনটা পার হল, কার জন্য তা করা হল ? ধিক্কারে মন ভারাক্রান্ত হল। সংসারজীবনে থাকার মত স্বান্তনা রইল না। দুষ্কর্মভরা নিজের গতজীবনটা খুঁটিয়ে দেখতে চাইলেন, অনুশোচনার আগুনে নিজেকে পোড়ালেন; আর ভাবলেন—কেমন হত, যদি তিনি হতে পারতেন কোন এক কল্পিত পূর্ণমানবের মত? তাঁর সমসাময়িক সময়ের কোন এক চরিত্র—রামচন্দ্রের—তাঁর কল্পনা-বি¯তারে সহায়ক হল। কল্পনার সেই পূর্ণমানব রামচন্দ্রের ছবি ফুটিয়ে তুলতে কাটিয়ে দিলেন বাকিটা জীবন। আমরা বাল্মিকী কাছে কৃতজ্ঞতায় হাঁটু গেড়ে বসি তাঁর কল্পনার প্রতিভার কারণেই।

তাঁর এই কল্পনা ফসলিত হতে পারতই না, যদি না তিনি তাঁর নিজেকে আর সমসাময়িক সময়কে ভাল করে দেখতে পারতেন। বাস্তবকে দখল করার উপায় আর তা কল্পনায় ফলিয়ে তোলার যোগ্যতা ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে আলাদা। সময়ের বদলের সাথে সেই যোগ্যতাতেও কী বদল আসে না? রামের চরিত্র কথায় ফুটিয়ে তোলার জন্য বাল্মিকী মুনির সাধনা বর্ষজীবী ছিল না, ছিল বহু-বর্ষজীবী। সেই সাধনার ফল পুণ্যলাভের উৎসব তৈরি করে দিয়েছে। আমাদের সময়ে এসে সাহিত্যটা উৎসবের উপাচারে পর্যবসিত হয়ে গেছে ; পুণ্যলাভের সাধনা হিসাবে আর তা রইল না; যা রইল, তার ফসল বছরে বছরে ফলে, প্রতি ঈদে আর পূজায়—জামা-কাপড়ের মত।

যদি তা না হত তবে একই লেখকের পক্ষে প্রতিবছর কয়েকটা পত্রিকার পেট ফোলানোর দায়িত্ব নেবার কথা নয়। এই অভিযোগ খণ্ডন করার জন্য অনেক কথাই বলা যেতে পারে। বলা যাবে যে, সময় বদলে গেছে, বদল এসেছে মানুষের প্রয়োজনে ও রুচিতে। মানুষ এখন মুহূর্তের সাহিত্য চায়। সাহিত্য হবে এক লহমায় আনন্দ লুটে ছুড়ে ফেলার জন্য, ওর দিকে আর পাঠক ফিরেও তাকাবে না।

এই রকম এক বিশাল খাদকগোষ্ঠীর জন্য চাই চটজলদির সাহিত্য করার লেখকমহল। লেখকরা এখন মহলে মহলে বিভাজিত, যেমন বিভাজিত পাঠকগাষ্ঠী, গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে, শ্রেণিস¦ভাব অনুসারে। লেখালেখি এখন একটি স্বয়ংসম্পূর্ণূ মজদুরি, পেশাদারি কাজ। আরো বলা যায়, বাল্মিকী মুনি দীর্ঘ সাধনায় যা লাভ করেছেন, আজ তা কম সময়েই সম্ভব। এখনকার মানুষ উন্নত প্রযুক্তি-প্রকৌশল আয়ত্ত করে হাজার বছরকে একদিনে কমিয়ে এনেছে―এখন বাল্মিকী-সাধনা অপ্রয়োজনীয়।

এসব যুক্তির জবাব দেওয়া যাবে না কেন? পরিবর্তন যা আসে মানুষ কি তা সব মেনে নেয়? মেনে নিলেও চিরকাল কি তা টেকে? মানুষ কি পরিবর্তন হওয়া বিষয়টাকেও আবার পরিবর্তীত করে ফেলে না ? আবার বদলাতে গিয়ে তা কী উপায়ে করে? কত হাজার বছর হল রামায়ণ দ্বিতীয়টি রচিত হল না। মানুষ একটা রামায়ণ নিয়েই তৃপ্ত রইল। কিন্তু নতুন রামায়ণ তৈরি হবার প্রয়োজন নাই, একথা তো বলা যাবে না। প্রতিদিন মানুষ বদলে যাচ্ছে, এই বদলের সঙ্গে তার জীবন ও চারপাশের জগৎ যেভাবে বদলে চলছে, তাকে দেখার আকাক্সক্ষাও বয়ে চলেছে একই সঙ্গে। তাই বদলে যাওয়া সময়ে রাজা রামের চরিত্রের জায়গায় বসে গেছে ঢোঁড়াই।

ঢোঁড়াইকে ফুটিয়ে তোলার সাধনা তো বর্ষজীবী কিছু ছিল না। কিন্তু তার পর যেন সময় থমকে গেল। চটজলদির সাহিত্য করার যুগ এলো, এলো সাহিত্যের বাজার ধরার সাধনা। এই বাজারের সাহিত্য আর নিজেকে দেখতে আগ্রহী নয়, এখনকার সাহিত্য যেন চায় না এখনকার মানুষের জীবন নিয়ে কল্পনা করতে। কথাটার সবটা সাঁচা হল না।

কারণ, এখনকার সাহিত্য, যা পূজা ও ঈদে একশ টাকায় এক ডজন করে এক সাথে আসে, সেখানেও নিজেকে দেখার ব্যাপার আছে। তবে এই নিজেকে দেখা একেবারে অন্যরকম এক ব্যাপার। এখানে ব্যক্তি নিজেকে দেখে একা একজন আলাদা মানুষ হিসাবে। তার সমাজ নাই, তার চারপাশে মানুষজন আছে কি নাই তা বোঝা যায় না। সে এমন এক ব্যক্তিমানুষ যার নতুন করে বাঁচার জন্য কোন কল্পনা নাই।

সে যেন স্বয়ম্ভু, নিরাবলম্বকাল ও সমাজ থেকে। মানুষ যেহেতু প্রাণী, আর দশটা প্রাণীর মতো কাল ও সমাজের বাইরে তারও একটা ব্যক্তিগত জীবন আছে, আশা-আকাক্সক্ষা আছে। এখনকার সাহিত্যে যেসব মানুষের চরিত্র পাওয়া যায়, সেগুলি কাল ও সমাজনিরপেক্ষ এই ব্যক্তিমানুষ। তার কিছু করার মত কাজ নাই, সে দেখে ও দেখায় কেবল নিজের জীবনকে, তার ভাবনাগুলিই আজকালকার সাহিত্যে ফুলে-ফেঁপে আসতে থাকে। ব্যক্তির আকাক্সক্ষা পূরনের নানা কারসাজি নানাভাবে পয়দা করা গেলেই তা সাহিত্য হয়ে যায় ঈদে ও পূজায়।

কাজেই ঈদে ও পূজায় সাহিত্যের কাগজগুলির বাজার ধরার জন্য প্রধান আকর্ষণ থাকে কোন কাগজ কতগুলি করে উপন্যাস নামের ব্যক্তিমানুষের গুহ্যজীবনের কেচ্ছা ছাপাতে পারল। কিন্তু কেবল এইটুকু বলা হলে সত্যের একটা অংশ আড়াল করা হয়। ঈদে ও পূজায় আরো এক ধরনের কেচ্ছাকাহিনী ছাপানো হয়, সেগুলি দায়বদ্ধতার আর সমাজসচেতনতার। সে এক মজার চিজ। এসব সাহিত্যে না-থাকে সমাজ, না-থাকে রাজনীতি, না-থাকে ইতিহাস; এগুলি পড়তে বসে ধাঁধাঁয় পড়ার অবস্থা ঘটে।

সাহিত্যের পাত্রপাত্রীরা সমাজের জন্য জান কবুল করে, কিন্তু নিজেরা ব্যক্তিমানুষটাই হয়ে উঠতে পারে না। ব্যক্তি হয়ে উঠতে হলে তার চারপাশের ব্যক্তিদের দেখতে হয়, তাদের সাথে নানা সম্পর্কে আটকা পড়তে হয়। সেই সামাজিক স

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।