আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিদ্যুৎ-পানি-গ্যাস সমস্যা নিয়ে লিখতে বসেছি মাত্র হঠাৎ টেবিল-বাতিটি নিভে গেল

:::

বিদ্যুৎ-পানি-গ্যাস সমস্যা নিয়ে লিখতে বসেছি মাত্র হঠাৎ টেবিল-বাতিটি নিভে গেল। ভাবলাম আলো আসতে অন্তত যে দু’ঘন্টা সময় লাগবে তাতে একবার ক্লাবে গিয়ে ঘুরে আসা যাক। আড্ডাও দেয়া যাবে, টেলিভিশনে আইপিএল টি টুয়েন্টি ক্রিকেট খেলাও দেখা যাবে। সেখানে বন্ধু-বান্ধবের টেবিলে বসতেই একজন এতদিন পরে এ সময়ে আসার হেতু জিজ্ঞাসা করলে আসল কারণটি জানালাম। সঙ্গে সঙ্গে সে আমাকে অনেকটা তিরস্কারের সুরেই বলল বিদ্যুৎ আসা-যাওয়ার রুটিনে এক ঘন্টার পরিবর্তে দু’ঘন্টা করার সরকারি কারণটা না জানার কারণেই আমি এতদূরে ক্লাবে এসে ভুল করেছি।

এক এলাকায় বিদ্যুৎ গেলে যাতে সেখানকার লোকজন পার্শ্ববর্তী বিদ্যুৎময় এলাকার বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন পরিচিত প্রতিবেশীদের বাড়িতে বেড়াতে এবং তাদের গেলে পূর্বোক্ত এলাকায় বেড়াতে আসার যথেষ্ট সময় পায় সে সুবিধাদানই নতুন রুটিনের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য। এতে জনগণের দুর্ভোগ যেমন লাঘব হবে তেমনি বন্ধুত্ব ও আত্মীয়তার বন্ধন দৃঢ় হবে, সামাজিক যোগাযোগ এবং হৃদ্যতাও গভীরতর হবে। আমার সন্ধিগ্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে সে বলল আমাদের এ সহজ কথা বোঝা দরকার যে সকল কারিগরিধর্মী মন্ত্রণালয় বা বিভাগের কাজকর্ম সরকার কম বুঝে সেখানে উপদেষ্টা, পরামর্শক নিয়োগ করা হয় এবং তাদের সুচিন্তিত সুপারিশ অনুযায়ী ‘ডিজিটাল টাইম’ এরমতই এসব বিদ্যুৎ রুটিন প্রবর্তন/পরিবর্তন করা হয়। তারপর আলোচনা যখন পানি ও গ্যাস সংকটের দিকে মোড় নিল তখন খেলা দেখার অজুহাতে টেবিল পরিবর্তন করে টিভির সামনে বাকি সময়টুকু কাটিয়ে বাসায় ফিরলাম। পুনরায় লিখতে বসার পর একটা কথা মনে হল সকল সংকটের সময়ই এদেশের মানুষ প্রথমে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে, তারপর সমস্যা নিরসনের আশায় বুক বাঁধে এরপর নিজস্ব দুর্ভোগের উপর নানান হাসি-ঠাট্টার গল্প/চুটকি বানায় অবশেষে বিক্ষোভ এবং সর্বশেষ আন্দোলনে নামে।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে গল্প-চুটকির পর্যায় শেষ হয়ে এখন প্রায় বিক্ষোভের দ্বারপ্রান্তে আমরা। স্থানে স্থানে পানি-বিদ্যুতের জন্য তা দৃশ্যমান। পানি বণ্টন ব্যবস্থা ও সমস্যা সামলাতে ইতিমধ্যে সেনাবাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। পাঁচটি সার কারখানা বন্ধ করে সাশ্রয়ী গ্যাস দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির চেষ্টা করা হচ্ছে। এমনকি বিইআরসি দু’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া সকল সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও গৃহস্থালীকে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদার সময় শীতাতপ ব্যবস্থা বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে।

এগুলো অবশ্যই সাময়িক ব্যবস্থা, এতে মূল সমস্যা অর্থাৎ বিদ্যুৎ, পানি বা গ্যাস উৎপাদন ও সরবরাহ বাড়ানোর বিষয়টির সুরাহা হবে না। তবে মানুষের অপরিসীম দুঃখ-কষ্ট ছাড়াও বিদ্যুৎ ও গ্যাসের অভাবে সার্বিকভাবে দেশের শিল্প ও বিনিয়োগ খাতের কি পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে এবং সার কারখানাগুলো বন্ধ করায় মোট কত শত কোটি টাকার সার উৎপাদন ব্যাহত হবে তার একটি হিসাব থাকা দরকার। এদিকে সংবাদে প্রকাশ, জ্বালানি খাতে উন্নয়নের জন্য সাময়িক দায়িত্বে থাকা জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ সচিব গ্যাসের দাম বাড়ানোর কথা বলেছেন। কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, ভারত, পাকিস্তান ও থাইল্যান্ডে তুলনামূলকভাবে গ্যাসের দর বেশি। ঐসব দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় এমনকি উৎপাদন খরচ যে আমাদের চেয়ে বেশি সে কথায় না গিয়েও একটা কথা বলতে হয়- বর্তমান উৎপাদন বাড়ানোর জন্য তথা বিদ্যমান সংকট মোকাবিলার জন্য এটি মোটেও প্রধান বাধা নয়।

যাইহোক, একইদিন অর্থাৎ ৪ এপ্রিল অর্থমন্ত্রী মহোদয় অন্ততঃ কিছুটা হলেও আশার বাণী শুনিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন চলতি মাস শেষে বিদ্যুৎ ও গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সরকার একটি সময় নিবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করবে। তাতে কি পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে, কখন টেন্ডার আহ্বান করা হবে, কখন চুক্তি হবে এবং কখন উৎপাদন শুরু হবে সব কিছুই উল্লেখ থাকবে। গ্যাসের ক্ষেত্রে অবশ্য গ্যাস কি পরিমাণ পাওয়া যাবে তা সঠিকভাবে বলা না গেলেও তার উন্নয়নের জন্য পাঁচটি প্রকল্পের ঘোষণা করা হবে। প্রকৃতপক্ষে এক্ষেত্রে সংকট দীর্ঘ ৪/৫ বছর থেকেই তীব্র এবং ক্রমে আরো তীব্রতর হচ্ছে।

বিশেষ করে এটিকে ক্ষমতাসীন দল তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে তদ্রƒপ চিহ্নিত করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সমাধানের প্রতিজ্ঞা করা সত্ত্বেও অদ্যাবধি সমস্যাটির প্রকৃত আকার-পরিধি, এ সম্পর্কে সরকার গৃহীত প্রকল্প, কার্যক্রম বা এর নিরসনে সুনির্দিষ্ট সময়ভিত্তিক পরিকল্পনার ব্যাপারে জনগণ সম্যক অবগত নয়। অর্থমন্ত্রী কর্তৃক উল্লেখিত বক্তব্যে মানুষ দেরিতে হলেও (এটি কমপক্ষে এক বছর আগে হলে ভাল হত) অন্ততঃ সমস্যা সমাধানের একটি দিক-নির্দেশনা জানতে পারবে এবং সেভাবে মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারবে। এতদিন লোকজনকে বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন রকম সান্ত¡নামূলক কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছিল বিদ্যুৎ, গ্যাস সমস্যা যদিও অতি অল্প সময়ে সমাধান করা সম্ভব নয় তবুও সরকার ক্ষমতা গ্রহণের এক বছরের মধ্যে এ সংকটকে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা হবে, ভাড়াভিত্তিক ৫০০ মেগাওয়াট বাড়তি বিদ্যুৎ সেচ মৌসুমের আগেই (মার্চ মাসের মধ্যেই) পাওয়া যাবে এবং সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে আরও অতিরিক্ত এক হাজার মেগাওয়াট বছরের মাঝামাঝি জাতীয় গ্রীডে যোগ হবে। যার ফলশ্রুতিতে সারাদেশে মোট বিদ্যুৎ ঘাটতি সর্বোচ্চ ব্যবহারের সময় চারশত মেগাওয়াটের বেশি হবে না।

কিন্তু সে অনুসারে কাজ হয়নি এবং হবার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। এতদিন কেন হয়নি, যথাসময়ে টেন্ডার আহ্বান করতে কিংবা চুক্তি করতে কেন বিলম্ব হলো, কিংবা চুক্তিকারীরা কেন যথাসময়ে বিদ্যুৎ, গ্যাস উৎপাদনে ব্যর্থ হলো সেসব প্রশ্ন করার এবং ব্যাখ্যা শোনার এখন সময় নয় এবং জনসাধারণ তার জন্য মোটেও আগ্রহী নয়। এসব সমস্যায় জনগণের জীবন প্রায় ওষ্ঠাগত। তারা ধৈর্য্যরে প্রায় শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে। তাই চলতি মাসান্তে যখন প্রতিশ্রুত সেই সমস্যা নিরসনের সময় নির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করা হবে তখন জনগণ তার সময়ানুবর্তী বাস্তবায়ন ও ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করবে, কোন ব্যাখ্যা বা ভাষণের জন্য নয়।

এতএব, সাধু সাবধান! এ প্রসঙ্গে একটা কথা না বললে নয়, জনগণ বিগত নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের দিন বদলের সনদ নামক নির্বাচনী ইশতেহারে বিশ্বাস স্থাপন করে তাদেরকে তিন-চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় বিজয়ী করেছে বটে কিন্তু তাদের চিরন্তন সমর্থনদানের কোন গ্যারান্টি দেয়নি বরং উক্ত ইশতেহারের মাধ্যমে দল তাদেরকে ‘পারফরমেন্স গ্যারান্টি’ দিয়েছে। সুতরাং এই গ্যারান্টি রক্ষা করার দায়িত্ব সরকারের। কৃষি, শিক্ষা, খাদ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা ক্ষেত্রে ইতিবাচক অর্জন সত্ত্বেও বলতে হয় প্রাত্যহিক জীবনে সরকার অত্যাবশ্যকীয় বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানির সংকট যথাশীঘ্র নিরসন করতে ব্যর্থ হলে বিগত নির্বাচনের অভূতপূর্ব জনসমর্থন বুঝে উঠার আগেই অবিশ্বাস্য গতিতে হাওয়ায় বিলীন হয়ে যাবে। আমাদের বিশ্বাস সে সম্পর্কে সরকার যথার্থ সচেতন এবং সমস্যা সমাধানের স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী সব রকমের পরিকল্পনা আছে তাদের। ইতিপূর্বে সরকার ভারত, চীনসহ বিভিন্ন দেশের সাহায্য ও সহযোগিতা চেয়েছে এক্ষেত্রে।

পুঁজিঘন এ খাতে বৈদেশিক পুঁজি আকর্ষণ করার জন্য বিদেশে একাধিক ‘রোড শো’এরও আয়োজন করা হয়েছে। ভারত থেকে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির একটি সমঝোতাও হয়েছে। অন্যদিকে দেশে জনগণকে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী বাতিতে অভ্যস্ত করার জন্য বিনামূল্যে তাদেরকে কয়েক লক্ষ এনার্জি বাল্ব প্রদানের জন্য তিন-চার মাস আগে একটি জরিপ করে তালিকা করা হয়েছে। এসবই ঠিক আছে। তবে সর্বাগ্রে প্রয়োজন একটি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কার্যতালিকা প্রণয়ন ও অবিলম্বে তার বাস্তবায়ন।

বর্তমান মাসের শেষে সরকার নিশ্চয়ই বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানি সংকট উত্তরণের জন্য তেমনি একটি কার্যপরিকল্পনা ঘোষণা করবে বলে আশা করা যায়। তবুও নিম্নে কতিপয় প্রস্তাব রাখা হল যাতে সেগুলো সরকারি বিবেচনা থেকে বাদ না যায়: ১. অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রণীত প্রকল্পসমূহ বিদেশী ঋণ বা বিনিয়োগের জন্য অপেক্ষা না করে নিজস্ব অর্থেই বাস্তবায়ন করতে হবে। এগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে টেন্ডার আহ্বান, মূল্যায়ন বা কার্যাদেশ প্রদানে কোনরূপ বিলম্ব বা অনিয়ম করা যাবে না। ২. বর্তমান বিদ্যুৎ, গ্যাস বা পানি সরবরাহের যে কার্যক্রমতা আছে- তার সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। ৩. বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী যে বাল্ব সরকার বিনামূল্যে জনসাধারণের নিকট বণ্টন করার কথা তা অনতিবিলম্বে কার্যকর করা প্রয়োজন।

এতে শুধু যে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে জনসচেতনতা বাড়বে তা নয় জনগণও দুঃসময়ে সরকারের একাগ্রতা ও সদিচ্ছার পরিচয় পেয়ে কিছুটা আশ্বস্ত হবে। ৪. বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির অপচয় রোধে অনেক উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের মত এখানেও জনসচেতনতা বাড়ানোর জন্য ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে। ৫. ভারত থেকে যে বিদ্যুৎ ক্রয়ের সমঝোতা হয়েছে তা যথাশীঘ্র জাতীয় গ্রীডে আনয়নের ব্যবস্থা করতে হবে। ভুটান ও নেপালের সাথেও অনুরূপ ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে দীর্ঘমেয়াদে নিজের ক্ষমতা বাড়িয়েই এ সংকটের উত্তরণ হবে মূল লক্ষ্য।

৬. পানির সরবরাহ বৃদ্ধিকল্পে ক্রমান্বয়ে ভূগর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরতা কমিয়ে ভূউপরিস্থ বিশেষ করে বর্ষাকালে ধরে রাখা বৃষ্টির পানির উপর জোর দিতে হবে। একই সঙ্গে যেসব নদী থেকে পানি সংগ্রহ করে শোধনের ব্যবস্থা করা হয় সেগুলোকে দ্রুত দূষণমুক্ত করতে হবে এবং শোধনের ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। শেষকথা এই যে এসব সমস্যা সমাধান সময়সাপেক্ষ ও বিপুল ব্যয়সাপেক্ষ বলে জনগণকে ধৈর্য ধারণ করার উপদেশ দেয়ার চেয়ে সেগুলো সমাধানের ছোট-বড় পদক্ষেপ গ্রহণ করে কর্তৃপক্ষের নিরন্তর প্রচেষ্টার ও ঐকান্তিকতার ব্যাপারে মানুষের আস্থা লাভের একটা বাতাবরণ সৃষ্টি করতে হবে যাতে ভবিষ্যতে দীর্ঘমেয়াদী ও বৃহৎ প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়নে জনগণের সমর্থন ও সহযোগিতা অব্যাহত থাকে। [লেখক: সাবেক শিল্প সচিব] সুত্রঃ জাতীয় দৈনিক পত্রিকা থেকে সংগ্রহীত

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।