আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কেন প্রাণের এই বেহুদা ক্ষয়?

জানি না কেন লিখি! তবু লিখি মনের খেয়ালে, পরিবর্তন করার মানসে, পরিবর্তিত হওয়ার মানসে। যদিও জানি সব ব্যর্থ হচ্ছে। তবুও আমি আছি সেদিনের সেই আলোকময় প্রত্যুষার আগমনের অপেক্ষায়

স্রষ্টার এক অপরূপ এবং অনন্য এক সৃষ্টি- মানুষ। কতই না ভালবাসার সাথে তিনি নিজ হাতে তাকে সৃষ্টি করেছেন। অতপর এর ভেতর নিজের রুহ থেকে ফুঁৎকার করে দিয়েছেন প্রাণ।

সকল সৃষ্টির উপরে দিয়েছেন এর শ্রেষ্ঠত্ব। অন্য কোন সৃষ্টি তাঁর কোন হুকুমকেই অগ্রাহ্য করতে পারে না। তাদের সে অধিকার নেই। কিন্তু আল্লাহর এই প্রিয় সৃষ্টিটাকে তিনি দিয়েছে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি। তাকে শিখিয়েছেন জ্ঞান-বিজ্ঞান।

কোনটা ভাল কোনটা মন্দ তাও বোঝার ক্ষমতা তাকে দিয়েছেন। সেই সাথে মানুষ কিভাবে সুখে শান্তিতে বসবাস করবে এই নিমিত্তে যুগে যুগে তিনি তাদের জন্য জীবন বিধান পাঠিয়েছেন। তাদেরকে পাঠিয়েছেন ফুল ফলে ভরা সুন্দর পৃথিবীতে। আরো সুন্দর ও আনন্দময় করার জন্য পাখির কণ্ঠে দিয়েছেন সুমধুর গান, মানুষকে শিখিয়েছেন সুর। আলোকিত করার জন্য দিয়েছেন সূর্যকে।

রাতে দিয়েছেন স্নিগ্ধ মায়াবী চাঁদের আলো। পৃথিবীকে সিক্ত রাখতে দিয়েছেন নদী ও সাগর। আকাশ থেকে বারিধার বর্ষণ করে প্রকৃতিকে জীবন্ত করে রাখছেন তিনিই। মানুষের সুবিধার্থে সকল প্রাণীকে দিয়েছেন তাদের অনুগত করে। কিন্তু সেই মানুষ কি করলো? এত কিছু পাওয়ার পরও তাদের বেশিরভাগই নিজেদেরকে অকৃতজ্ঞ হিসেবে প্রমাণ করলো।

তারা স্রষ্টার দেওয়া দিক নির্দেশনা প্রত্যাখ্যান করে নিজেরা আইন রচনা কোরল। আর তা তাদের সামগ্রিক জীবনে বাস্তবায়ন করার ফলশ্রুতিতে তারা নিজেরা অশান্তিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়ল। আল্লাহর দেওয়া সেই প্রাণ, সেই নেয়ামত তাদের কাছে হয়ে উঠল বোঝা। বিতৃঞ্চা আর হতাশায় তারা ডুবে গেল। জীবন সুন্দর, জীবন আনন্দের।

বেঁচে থাকার অনুভূতি অসামান্য। সব কিছু পেয়েও কিন্তু সে আনন্দকে তাদের অনেকেই ঠিক মত ভোগ করতে পারছে না। তারই একটি জাজ্জ্বল্যমান ঘটনা গত কয়েকদিন ধরে আমাদের দেশে আলোড়ন তুলেছে। তা হচ্ছে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমান হত্যাকা-। এখন পর্যন্ত ধারণা করা হচ্ছে তাদের হত্যাকারী তাদেরই ঔরসজাত কন্যা ঐশী রহমান।

আশ্চর্য হওয়ার বিষয় এখানেই। কারণ একটি সন্তানকে বাবা মা কি আদর যতেœ বড় করে তোলেন, মা বাবা সন্তানের কাছে কত প্রিয় তা নতুন করে বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন নেই। বিজ্ঞানের মতে মাত্র ২১ দিন বয়স থেকে একটি মানব শিশু তার মাকে চিনতে পারে, মায়ের অভাব অনুভব করে। অনেক প্রাণী আছে যারা সন্তান উৎপাদন করার পর তার সন্তানের দিকে ফিরে তাকায় না কিংবা তাকানোর প্রয়োজনও পড়ে না। কতক প্রাণী আছে যাদের জন্ম হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে দৌঁড়াতে পারে, নিজের খাবার নিজে যোগার করতে পারে।

আবার এমনও একপ্রকার পাখি আছে যারা আকাশে থেকে ডিম ছেড়ে দেয় এবং সেই ডিম মাটিতে পড়ার আগেই ফুটে বাচ্চা বের হয়ে সেই বাচ্চা উড়ে চলে যায়। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে তেমন নয়। একটি মানব শিশু জন্ম নেওয়ার পর তার মত অসহায় প্রাণী দুনিয়াতে আর একটাও নেই। জন্মের মুহূর্ত থেকেই তার প্রয়োজন হয় মা বাবার সাহায্য। জন্মলাভের মুহূর্তে যদি সে তার মায়ের সেবা না পায় তাহলে সে কিছুতেই বাঁচতে পারবে না।

একদিন পৃথিবীর আলো বাতাস দেখার সৌভাগ্য তার স্থায়ী হবে না। সেই মা বাবার সেবায় এরপর যত বড় হয় তত তাদের প্রয়োজনীয়তা বেড়ে যায় এবং তাদের উপর নির্ভরশীল হয়ে যায়। এই নির্ভরশীলতা থেকে তারা বাবা মাকে ভালোবাসে। মা বাবা ছাড়া তারা পৃথিবীতে আর কাউকে চেনে না। পরম মমতা এবং পরম নিশ্চিন্ত আশ্রয়স্থল বাবা মায়ের কোল।

আর মা বাবাও নিঃস্বার্থভাবে নিজেদের উজার করে সন্তানদের ভালবেসে থাকেন। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। সেই মহান স্রষ্টাই মা বাবার হৃদয়ে এই ভালবাসা জাগ্রত করে দিয়েছেন। এর বিনিময়ে ভালবাসা ছাড়া আর কিছুই তাদের কামনা নেই। কিন্তু সেই সন্তান যখন একই সাথে পিতা মাতাকে ঘুমের মধ্যে আঘাতের পর আঘাত করে হত্যা করতে পারে তাহলে অবাক হতেই হয়।

কিন্তু প্রশ্ন হোল কোন পরিস্থিতিতে গেলে মানুষের এই অবস্থা হয়, কেন এমন নৃশংস কাজ তারা করছে? আমাদের সমাজের দিকে তাকিয়ে দেখলে দেখতে পাই আমরাই এই পরিস্থিতির জনক। ভিনগ্রহ থেকে কোন প্রাণী কিংবা এলিয়েন এসে আমাদের এই দুরাবস্থা তৈরি করে দিয়ে যায় নি। ঐশীর পবিারের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই- বিত্তবান একটি পরিবার। যে পরিবারে আসলে অর্থের কোন অভাব ছিলো না। তার বাবা যাই করুক, যেভাবেই হোক অন্তত সন্তানদের পেছনে যে পয়সা খরচ করতেন তা সহজেই বোঝা যায়।

আমরা জানি বর্তমানকালে একটা ইংরেজী মাধ্যমের স্কুল-কলেজে ছেলে মেয়েদের পড়া-লেখা করাতে হলে কি পরিমাণ অর্থ খরচ করতে হয়। বাংলা মিডিয়ামে পড়াতে গিয়েই সাধারণ আয়ের অনেক পরিবার হিমশিম খায়। ঐশীর পিতা তাকে বাংলা মিডিয়াম নয়, ইংরেজী মিডিয়ামে পড়া লেখা করিয়েছেন। সেই সুবাদে তাদের মেয়ে সঙ্গ পেয়েছে আরো বিত্তশালী পরিবারের ছেলে মেয়েদের। তাদের সাথে তাল মিলিয়ে তাকেও নিশ্চয় তাদের সাথে পাল্লা দিতে হয়েছে।

সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে ঐশীর নিকট আত্মীয়দের ভাষ্যমতে জানা যায় মেয়েটি সাঙ্গ-পাঙ্গদের সাথে মিশে মাদকের সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে। রোজ সে দেরি করে বাসায় ফিরত। রাতেও বাইরে সময় কাটাত ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এই মেয়েটিই আবার আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। যদিও সে আত্মহত্যা করে নি, কিন্তু তার একটি সুইসাইডাল নোট উদ্ধার করা হয়েছে- যেখানে ১২ পাতার নোটে নিজের হতাশা, দুঃখ-কষ্ট, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির কথা লিখে রেখেছে।

এই নোটটি পড়লেই ঐশীর জীবনটাকে পড়া যায়। তার কাছে তার দুনিয়াটা এক সময় জান্নাত থেকেও উত্তম মনে হোত। কিন্তু একটা কষ্ট, শূন্যতা তাকে পীড়া দিত। সে কষ্টটা হতাশার, না পাওয়ার। আমাদের দেশে এরকম লাখো পরিবার আছে যাদের প্রাচুর্য, অর্থ-বিত্ত, জৌলুস দেখে আমরা মনে করি তারা বুঝি খুব সুখে আছে।

কিন্তু তারা সুখে আছে, আরাম আয়েশে আছে বটে, কিন্তু শান্তিতে নেই। কেন নেই? কারণ তারা শুধু ভোগ-বিলাসই পেয়েছে। আত্মিক উন্নতির জন্য কোন শিক্ষা তারা পায় নি। সমাজ, পরিবার তাদের ভোগ বিলাসই দিতে পেরেছে। কিন্তু তাদের আত্মার খোরাক দিতে পারে নি।

তারা অন্তসারশূন্য। ঠিক একটা পশু যেমন খায়, বাঁচে, বংশবৃদ্ধি করে অতপর সময় শেষে মারা যায় কিংবা মাটির সাথে মিশে যায়- তাদের ক্ষেত্রে ঠিক অনুরূপই ঘটে। তারা স্রষ্টার দেওয়া রুহ নিয়ে তার শুধু অবমাননাই করে। মানুষ পশু নয়, মানুষের আত্মা আছে। দেহের জন্য যেমন প্রয়োজন খাদ্য, ঠিক তেমনি আত্মার জন্যও দরকার খাদ্য।

আমাদের আধুনিক পরিবারগুলো দেহের জন্য উত্তম খাদ্য দিয়ে থাকে, দৈহিক সৌন্দর্যের জন্য প্রসাধনীর ব্যবস্থা করে- কিন্তু আত্মার জন্য নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে না। বস্তুবাদী সভ্যতার স্রোতে তারা তাদের নিজেদের ভাসিয়ে দেয়। আরো খাই, আরো খাই, আরো বেশী পেতে চাই, ভোগ করতে চাই- দেহের এই ক্ষুধা তাদের অন্তর্চক্ষুকে অন্ধ করে দেয়। একবার এই স্রোতে নিজেদেরকে ভাসিয়ে দিলে তারা তাতে অভ্যস্থ হয়ে পড়ে। এতে যদি কোন রকম ব্যঘাত ঘটে তখন তারা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে।

এই বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠার ফল হচ্ছে পরিবারে ভাঙ্গন, বিচ্ছেদ, সহিংসতা-অর্থাৎ অশান্তি। এসব দেখে আমাদের আত্মা শিউরে উঠে। পাশ্চাত্য সমাজে এসব কাজ কিন্তু অহরহ ঘটে থাকে। এই কয়েকদিন আগেও আমরা খবরে পড়েছি যে আমেরিকায় এক ব্যক্তি তার স্ত্রীকে ঠা-া মাথায় গুলি করে হত্যা করে তার ছবি তুলে ফেসবুকে আপ্লোড করে দিয়েছে। তারপর আবার তার পিতাকে আলাপ করে এ খবর জানিয়ে দিয়ে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পন করেছে।

সেসব দেশে প্রায়ই এই সব দিক-নির্দেশনাহীন, উদ্দেশ্যহীন মানুষ বাচ্চাদের স্কুলে প্রবেশ করে এলোপাথারী গুলি চালিয়ে ফুলের মত নিষ্পাপ শিশুদেরকে হত্যা করছে। পাশ্চাত্য সভ্যতা আজ আমাদের কাছে আদর্শ। তাদের সব কিছু আমরা অনুসরণ করি। এমনকি তাদের সমাজে প্রচলিত ধর্মহীনতাকেও আমরা গ্রহণ করছি। একপেশে আত্মাহীন, বস্তুবাদী, আত্মকেন্দ্রীক হয়ে উঠছি দিন দিন।

কিভাবে আরো কামানো যায়, আরো বেশী উপার্জন করা যায় এই চিন্তা আমাদের বিভোর করে রেখেছে। উদয়াস্ত পরিশ্রম আর ভোগ আমাদের জীবনের একমাত্র চাহিদা। কাকে মেরে, কার সম্পদ লুট করে ভোগ-দখল করা যায় তাই নিয়ে আমরা ব্যস্ত। পাপ-পূণ্য বিচার আমরা করি না। কারণ, আমরা তো ধর্মকেই বাদ দেওয়ার চেষ্টা করছি।

আমাদের শিক্ষা-ব্যবস্থা আমাদেরকে তাই শিখাচ্ছে। এমনকি আমরা পরকালীন জবাবদিহিতাকেও পরোয়া করি না। যারা আমাদের এই কাজে পথের কাটা হয়ে দাঁড়ায়, ঠাণ্ডা মাথায় আমরা তাদের খুন করি (উদাহরণ হিসেবে আমাদের দেশে সাম্প্রতিক যুবলীগ নেতা রিয়াজুল ইসলাম মিল্কি হত্যাকাণ্ডের কথা স্মরণ করতে পারি। মিল্কির হত্যাকারী তারেকও ২৪ ঘণ্টা না পেরোতেই সাথে আরো একজন নিয়ে কথিত ক্রস ফায়ারে নিহত হয়)। কিন্তু কেন এই অযাচিত জীবনের ক্ষয়? কেন স্রস্টার রুহের এই অবক্ষয়? কেন এই বেহুদা প্রাণহানী? নিজের অস্তিত্বের জানান দেওয়া, বেঁচে থাকাটা অনেক আনন্দের।

একটাই মাত্র মানুষের জীবন- কেন আমরা অকাতরে একে ধ্বংস করছি? আল্লাহর দেওয়া নেয়ামতকে কেন এত অবজ্ঞা? আমরা কি পারি না সত্যিকার মানুষ হয়ে উঠতে? পারি না পশুত্বকে জয় করে মানুষ হয়ে উঠতে?

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১০ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।