আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অ-তে অংক, গ-তে গণিত।

এই ব্লগের কোন লেখা আমার অনুমতি ব্যতীত কোথাও ব্যবহার না করার অনুরোধ করছি

অ-তে অজগর এবং আ-তে আম এর যুগ শেষ হয়ে এসেছে। কিছুদিন আগে একটি বর্ণমালার বইতে দেখলাম ক-তে কি-বোর্ড, ম-তে মাউস ইত্যাদি কম্পিউটারের যন্ত্রাংশ দিয়ে সাজানো হয়েছে শিশুদের বর্ণমালা শেখার ভুবন। উদ্যোগ প্রশংসনীয়, সন্দেহ নেই, কিন্তু ফলপ্রসু কতখানি? যেই শিশুকে শেখাতে হবে বর্ণমালা, সেই শিশুকে বর্ণমালা শেখানোর জন্য অনেক কম্পিটারের যন্ত্রাংশের সঙ্গে পরিচিত করিয়ে দিতে হবে, পরিচয় করিয়ে দেয়াও এক বিরাট ঝকমারি। বিশেষত সেইসব শিশুদের জন্য, যারা প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসে শিখবে মাতৃভাষার বর্ণমালা। তবু্ও আমার কাছে ভালোই লেগেছে সেই বর্ণমালার বইটি, কারণ, নতুনত্বের ছোঁয়া আছে সেখানে।

কিন্তু আমাদের সমাজের জন্য শিশুদের কম্পিউটারের চেয়েও বেশি যে ব্যাপারটির সঙ্গে পরিচিত করা প্রয়োজন, সেটি হচ্ছে গণিত। কম্পিউটারের বিস্ময়কর ক্ষমতা দাঁড়িয়ে আছে গণিতের যুক্তির উপর ভিত্তি করে, দক্ষ জাতি গঠনে কম্পিউটারের ভূমিকার চেয়ে অনেক অনেক বেশি প্রয়োজন গণিতের শিক্ষণ। শিশুদের বর্ণমালার ভেতর তাই বলে দিয়ে দিতে বলছি না ক-তে ক্যালকুলাস ধরণের কোন তৃতীয় শ্রেণীর ফ্যান্টাসি, বলছি না শিশুদের গণিতে দক্ষ করে তুলতেও, শুধু বলছি, শিশুদেরকে গণিতের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে। গণিতে আগ্রহী শিশুরা যখন কৈশোরে-তারুণ্যে পা দেবে, গণিতের ফলিত ব্যবহারগুলোর প্রতি তারা আগ্রহ বোধ করবে, এবং যখন তারা যৌবনে পৌঁছাবে, অন্তত আর কিছু না হোক, সবার গণিত ভীতিটুকু দূর হয়ে গিয়ে সেখানে গণিতের প্রতি একটা মমতা সৃষ্টি হবে। যখন মাধ্যমিক শ্রেণীতে পড়তাম, বাংলাদেশের ছাত্র-ছাত্রীদের ইংরেজির দৈন্যদশা দেখে একদিন স্যারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, স্যার, বাংলাদেশের সব স্কুল-কলেজ ইংলিশ মিডিয়াম করে দিলে কেমন হতো? তাহলে সবাই ছোটবেলা থেকেই ইংরেজি বলে বলে অভ্যস্ত হয়ে যেতো এবং ইংরেজিকে একটি বিষয় নয়, ভাষা হিসেবেই নিতো? স্যার বলেছিলেন, আগে তো আমাদের শিখতে হবে ইংরেজিতে কথা বলা, তাহলে না ছাত্রদের শেখাতে পারব, আমরা নিজেরাই তো ইংরেজিতে কথা বলতে পারি না।

তাঁর কথাগুলো সত্য ছিল, প্রয়োজন আছে শিক্ষকবৃন্দের যথাযথ ট্রেনিংয়ের, নইলে তাঁরা শেখাতে পারবেন না ছাত্রদের। যতদূর জানি, শিক্ষা বোর্ডগুলো আয়োজন করে কিছু নাম-কা-ওয়াস্তে ট্রেনিংয়ের, যেখানে ট্রেনিংয়ের চেয়ে সময় নষ্টের পরিমাণই বেশি। তবুও সেইসব ট্রেনিং-কর্মশালাগুলো প্রশংসার দাবিদার, কারণ, তাদের চেষ্টায় ত্রুটি নেই, ত্রুটি তাদের ব্যবস্থাপনায়। আর এই ব্যাবস্থাপনার দুর্বলতার প্রধান কারণ হচ্ছে শিক্ষকদের নিজেদের আগ্রহের অভাব। ভেবে দেখুন, আমরা চাচ্ছি দেশের নবীন প্রজন্মকে গণিতে উৎসাহিত করতে, অথচ, শিক্ষকগণ নিজেরাই এতে উৎসাহী নন, কী করে তবে ধরা দেবে সেই কাঙ্খিত ফলাফল? অনেক নামকরা স্কুলের জনপ্রিয় শিক্ষকদের দেখেছি, বইয়ের অঙ্ক তাঁরা খুবই ভালো পারেন, কিন্তু পারেন না সামান্য একটা যুক্তি দাঁড় করাতে।

বইয়ের অঙ্ক করিয়ে করিয়ে একেকজন প্রাইভেট ছাত্র-ছাত্রীর ভিড় সামলাতে পারছেন না, অথচ, তাঁর সামান্য গাণিতিক যুক্তি ব্যবহার করার ক্ষমতাটুকুও জন্মায়নি! কী লাভ গণিতের এমন ব্যবহার দিয়ে? পরীক্ষা পাশের জন্য যদি গণিত শিখতে হয়, তবে এই জাতির দুর্ভোগ তো প্রত্যাশিত। কিন্তু শিক্ষকদেরই বা এমন গণিত বিমুখতার কারণ কী? আমার মতে, বাংলাদেশের সব পেশাজীবির অধিকাংশ মানুষেরই কথা বলার প্রিয় বিষয়বস্তু হচ্ছে রাজনীতি, তারপর হয়তো ধর্ম, তারপর হয়তো আরও অনেক অনেক কিছু, যার কোন গাণিতিক মূল্য নেই। আর যে জিনিসের গাণিতিক মূল্য নেই, সেই জিনিসের মাধ্যমে জাতীয় সমৃদ্ধি অর্জন সম্ভব নয়। এই কথাগুলো এই জন্যে বললাম যে, সামহোয়ার ইন ব্লগ সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বাঙ্গালীর ব্লগ। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-ছাত্র-আইনজীবি-আমলা-শিক্ষক সহ অনেক অনেক পেশাজীবি মানুষ এখানে আসেন, ব্লগ লিখেন, আলোচনা করেন, ছড়িয়ে দিতে চান তাঁদের মধ্যকার সব কথা।

কিন্তু এতসব পেশাজীবির মানুষ কী নিয়ে আলোচনা করেন? বিষয়বস্তু গাণিতিক বিচারে মর্মান্তিক অথচ নির্মম সত্য- রাজনীতি, ধর্ম, আস্তিক, নাস্তিক.....ইত্যাদি। ব্লগে শিক্ষিত মানুষের আড্ডা, অথচ গণিতের ব্যাপারে আগ্রহী আছেন খুব কম মানুষই। যে দেশের সব শ্রেণীর মানুষের প্রথম আলোচনার বিষয়বস্তু হচ্ছে রাজনীতি, সে দেশের উন্নতি প্রশ্নবিদ্ধ বৈকি। কেন এই উদাসীনতা গণিতের প্রতি? মেধার অভাব? না। অভাব মানসিকতার, অভাব আগ্রহের, অভাব গণিতের প্রতি ভালোবাসার।

এই সমস্যা সৃষ্টি হতো না যদি না সকল ব্লগারগণ ছোটবেলা থেকেই গণিতের আনন্দ নিয়ে বড় হতেন, শুদ্ধ যুক্তিতে বিশ্বাস করতেন। কেন ব্লগে এত গালাগালি? প্রধান কারণ হচ্ছে শুদ্ধ যুক্তি ব্যবহারে অক্ষমতা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, যাহার যোগ্যতা যত অল্প তাহার আড়ম্বর তত বেশি। এই ব্লগের অন্তত ৯৫% ব্লগার পাওয়া যাবে, যাঁরা ব্লগ জীবনে গণিত নিয়ে একটিও পোস্ট দেননি। অন্যদিকে, অন্তত ৯০% শতাংশ ব্লগার পাওয়া যাবে, যাঁরা অন্তত একটি হলেও রাজনৈতিক বা আস্তিক-নাস্তিক বিষয়ক পোস্ট দিয়েছেন।

অশিক্ষিত বাস মালিকগণ বা হোটেল মালিকগণও লিখে রাখেন, এখানে রাজনৈতিক আলোচনা নিষিদ্ধ, কারণ, এটা তাঁরাও বোঝেন, রাজনৈতিক আলোচনা ক্ষতি ব্যতীত লাভ কিছুই দেয় না। অথচ, এখানে আমরা ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারের মেলা বসিয়ে বসে আছি, রাজনীতি আর ধর্মের গ্যাঁড়াকলে ব্লগ অস্থির। পরিহার করা প্রয়োজন এই অস্থিরতা, বর্জন করা দরকার এই অসুস্থতা, ব্লগে ফিরিয়ে আনা উচিৎ সুস্থ পরিবেশ। সুস্থতা চাই মননে, সুস্থতা চাই প্রগতিতে, সুস্থতা চাই ব্লগে শিক্ষনীয় সব পোস্টের মাধ্যমে। বিনোদনের প্রয়োজন আছে, কিন্তু সেটা হতে হবে সাময়িক এবং সীমিত।

ব্লগারদের দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে প্রতিটি সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ, পাড়া-মহল্লা এবং অসংখ্য পরিবার। যদি ব্লগাররাই শুরু করতে পারি গণিতের বিপ্লব, শুদ্ধতা আসবেই পুরো সমাজ জুড়ে। গণিতকে আনন্দময় করে তুলতে কয়েকজন ব্লগার নিরলসভাবে পোস্ট করে যাচ্ছেন, যাঁদের মধ্যে আছেন- সাপিয়েন্স, ম্যাভেরিক, (অ)ভদ্র ছেলে, পগলা জগাই ও আরও অনেকে যাঁদের নাম এই মূহুর্তে স্মরণ করতে পারছি না। মূল্য দেয়া হয় না গণিতের পোস্টগুলোকে এই ব্লগে, রাজনৈতিক পোস্টে যত কমেন্ট হয়, গণিতের পোস্টে এর সিকিভাগও হয় না, আমাদের দৈন্যতা প্রকট করে তুলে এমন পরিসংখ্যান। কী করে করা যেতে পারে এই অদ্ভূত মানসিকতার পরিবর্তন? আসুন, আজ থেকে অন্তত মাসের একটি দিন আমরা রাজনৈতিক-ধর্মীয়-অর্থহীণ পোস্ট দেয়া বন্ধ রাখি, অন্তত একটি দিন আমরা ব্লগীয় গণিত দিবস হিসেবে পালন করি, যেদিন কেউ গণিত ব্যাতীত অন্য কিছু নিয়ে পোস্ট দিবেন না।

দুঃখজনক হলেও সত্য যে সেদিন পোস্টের সংখ্যা ২০টির বেশি হবে না। অথচ, প্রতিদিন সামহোয়ারের গড় পোস্ট সংখ্যা কত? পরিস্কার করে দেয় এসব চিন্তা আমাদের দীনতাকে, বুঝতে পারি, কতটাই না পিছিয়ে আছি আধুনিক বিশ্ব থেকে। গণিতকে ভালোবাসতেই হবে, নইলে তাল মেলাতে পারব না আমরা আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে। একটি দিন, মাসে না হোক, ষান্মাসিক হোক, হোক শুধুই গণিতের। আমাদের শ্লোগান থাকুক সেদিনের জন্যঃ অ-তে অংক, গ-তে গণিত।

এই দেশ আমাদেরও, ইচ্ছেমত অনেক অনেক সংখ্যাকে সহজে গুণ করে ফেলার পদ্ধতি না জানা স্বল্পশিক্ষিত রাজনীতিবিদদেরই শুধু নয়। আজ সচেতনতা সৃষ্টি হোক, কাল গণিতের জোয়ার আসবে, পরশু পাব প্রোগ্রামিং কন্টেস্টের উন্ন্মুক্ত দুয়ার, তরশু দেশে আসতেই হবে প্রযুক্তিতে উদ্ভাসিত নতুন আলোর কিরণ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।