আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তবু আমারে দেব না ভুলিতে....



'আমি চিরতরে দূরে চলে যাব, তবু আমারে দেব না ভুলিতে'_ এই আত্মপ্রত্যয় ছিল যার মরণোত্তর অস্তিত্ব নিয়ে, তিনি চিরবিদ্রোহী, চিরবিরহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। প্রেমে ও বিদ্রোহে, কোমলে-কঠিনে গড়া এক আশ্চর্য প্রতিভার নাম কাজী নজরুল ইসলাম। ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ যে ঝড়ের তীব্রতা নিয়ে তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন এই পৃথিবীতে, সেই 'জ্যৈষ্ঠের ঝড়' চিরতরে থেমে গেছে আজ থেকে ৩৪ বছর আগের এই দিনে (১২ ভাদ্র ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ)তবে থেমে যায়নি তার অবিস্মরণীয় কাব্য আর দর্শনের অভিযাত্রা। আজও দ্বিধাবিভক্ত সমাজে, শোষক আর শোষিতে বিভক্ত পৃথিবীতে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা, গান, প্রবন্ধ, গল্প-উপন্যাসসহ বিচিত্র রচনা মানবমুক্তির প্রেরণা জোগায়। তাই যথার্থ অহঙ্কারেই তিনি বলতে পেরেছিলেন 'আমারে দেব না ভুলিতে'।

তাকে কখনও ভোলা সম্ভব নয়। বাংলা কাব্যে আর গানে যে নতুন জোয়ার তিনি এনেছেন, শোষিত-বঞ্চিত মানুষের মুক্তির জন্য যে অবিস্মরণীয় প্রেরণাসঞ্চারী দ্রোহের বাণীতে উচ্চকিত করে তুলেছেন অবিভক্ত বাংলার কোটি কোটি মানুষের চিত্ত, সে বাণীর শাশ্বত দর্শন চিরপ্রাসঙ্গিক। ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসক-শোষকদের ভিত্তিমূল কাঁপিয়ে দিয়েছিল তার আগুন ঝরানো কবিতা আর শেকল ভাঙার গান। 'বিদ্রোহী' 'অগি্নবীণা', 'বিষের বাঁশী', 'ফণীমনসা', 'ভাঙার গান', 'সাম্যবাদী', 'প্রলয় শিখা'র মতো কবিতার ঝঙ্কারে শুধু শোষক-শাসকের ভিত্তিমূলই কাঁপেনি, কেঁপে উঠেছিল সমগ্র বাংলাও। কারণ এমন কবিতা প্রথম শুনল বাঙালি।

যখন রবীন্দ্রপ্রতিভার প্রখর দীপ্তিতে বাংলা কাব্যের দিগন্ত উদ্ভাসিত, যখন রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করে নতুন কবিতা লিখতে বিশ্বসাহিত্যের দিকে, এলিয়টের নেতিবাদী হতাশার দর্শনে নিমজ্জিত হচ্ছেন তিরিশি কবিরা, তখন নজরুল এলেন রবীন্দ্রপ্রভাবমুক্ত এমন এক নতুন উচ্চারণ নিয়ে, যা অবিভক্ত বাংলার মৃত্তিকা আর গণমানুষের সংলগ্নতায় একই সঙ্গে গণসাহিত্য আবার চিরকালের সাহিত্যও। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ স্বাগত জানালেন এই নতুন কবিকণ্ঠকে। 'বসন্ত' নাটক উৎসর্গ করলেন কারাবন্দি নজরুলকে। 'বিদ্রোহী' কবিতায় এমন আশ্চর্য এক নতুন সুর আর নতুন ছন্দের দোলা, হিন্দু-মুসলিম ঐতিহ্য আর পুরাণের এমন অপূর্ব প্রয়োগ, প্রেম আর বিদ্রোহের এমন আশ্চর্য সমন্বয়, এর তুলনা অতীতে ছিল না, পরবর্তীকালেও দেখা যায়নি। 'বল বীর/চির উন্নত মম শির।

শির নেহারী আমারই নত শির/ওই শিখর হিমাদ্রির'। এই 'আমি', থাকেনি ব্যক্তি আমি, এই আমি 'বল বীর' সম্বোধনের মধ্য দিয়ে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব সমগ্র মানবজাতির হয়ে গেছে। এই একটি মাত্র কবিতার মধ্যে নিহিত রয়েছে সমগ্র নজরুলের জীবনদর্শন আর অসাম্প্রদায়িক মানবিক মূল্যবোধ। কবিতার শেষে তিনি যে বলেন, 'বিদ্রোহী রণক্লান্ত/আমি সেই দিন হবো শান্ত/যবে অত্যাচারীর খৰ কৃপাণ ভিম রণভূমে রণিবে না/যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না...' সেই অত্যাচারীও পৃথিবীতে আছে, শোষিত-বঞ্চিতও আছে। সেই ধর্মের নামে ভণ্ডামি করা 'মোল্লা-পুরুত'-লোভীরা যেমন আছে, তেমনি হিংস্র সাম্প্রদায়িকতাও আছে, আর সেজন্যই এখনও প্রেরণার দীপ্ত শিখা অমর কবি নজরুল।

'বিদ্রোহী' কবিতার পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে অসাম্প্রদায়িক মানবতার বাণী, মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের অহঙ্কার আর চিরস্বাধীনতার স্বপ্ন। হিন্দু-মুসলমানের মিলিত ঐতিহ্য-ঝঙ্কারের পাশাপাশি 'কুমারী মেয়ের কাঁকন চুড়ির কঙ্কণ' ধ্বনিও গুঞ্জরিত এই একই কবিতায়। ফলে প্রেমে-দ্রোহে সমান্তরাল নজরুল সারাজীবন অসংখ্য দ্রোহের কবিতা আর প্রেমের কবিতা ও গানে মুখর ছিলেন ১৯৪২ সালের জুলাই মাসে চিরতরে স্তব্ধবাক হয়ে যাওয়ার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত। দোলনচাঁপা, সিন্ধু হিন্দোল, চক্রবাক, পুবের হাওয়ার মতো হৃদয় তোলপাড় করা প্রেমের কবিতার কবিকে শুধু 'বিদ্রোহী' বললে খণ্ডিত করা হয়। বাংলা গানে নতুন নতুন সুর আর রাগরাগিণীর এমন বিশাল সমুদ্র তিনি সৃষ্টি করে গেছেন, যা চিরঋণী করে রেখেছে বাংলা গানকে।

'যুগবাণী', 'রাজবন্দীর জবানবন্দী', 'রুদ্রমঙ্গল' 'দুর্দিনের যাত্রী'র প্রবন্ধগুলোতে বিশ শতকের প্রথম দিকের বাংলার রাজনৈতিক সামাজিক ইতিহাস ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির যে উজ্জ্বল চিত্র তিনি উৎকীর্ণ করে গেছেন, তাও তার অমরতারই অভিযাত্রী। ১৯২৬-এ কলকাতায় ভয়াবহ দাঙ্গায় আঁতকে উঠে লিখলেন অমর কবিতা 'কাণ্ডারি হুঁশিয়ার' লিখলেন অবিস্মরণীয় প্রবন্ধ 'ধর্ম ও রাষ্ট্র' হিন্দু-মুসলিম নয়, মানুষ ছিল তার কাছে বড় পরিচয়। তাই মানবতার লাঞ্ছনায় হয়েছেন ক্ষুব্ধ। অভিমান আর ক্ষোভ নজরুল সাহিত্যের সর্বত্র দেদীপ্যমান। 'তোমাদের পানে চাহি বন্ধু আর আমি জাগিব না/কোলাহল করি সারা দিনমান কারও ধ্যান ভাঙিব না।

/নিশ্চল নিশ্চুপ/আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধবিধুর ধূপ। ' সেই ধূপের মতোই নিভৃতে জ্বলেছেন ১৯৪২ থেকে ১৯৭৬ পর্যন্ত নির্বাক অবশিষ্ট জীবন। এই নীরবতার মধ্যেও গৌরবের আনন্দে অভিষিক্ত হয়েছেন তিনি বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধায়। তাকে ১৯৭২ সালে ঢাকায় স্থায়ীভাবে নিয়ে আসেন তিনি। মসজিদের পাশে চিরনিদ্রার স্বপ্ন ছিল কবির।

সে স্বপ্নও পূরণ হলো তার বাংলাদেশেই। তিনি ঘুমিয়ে আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশেই।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।