আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

"মহাসেননামা" : জেনে রাখুন কিছু অজানা ও অত্যাবশ্যকীয় তথ্য

এই ব্যস্ত শহরে কিছু একাকী পথচারি রাতের আ্ধাঁরে নিভৃতে হেঁটে বেড়ায় মানবতার খোঁজে,বিবেকের তাড়নায়। আমি তাদের একজন হিসেবে নিজেকে ভাবি। এই মুহূর্তে আমাদের চারপাশে সবচাইতে আলোচিত নাম "মহাসেন" যা সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের উপকূলবর্তী এলাকায় ১০০ কিলোমিটার গতিবেগে আঘাত হানবে। কৌতূহল থেকেই আপনাদের সাথে ঘূর্ণিঝড় বিষয়ক কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য শেয়ার করছি। ঘূর্ণিঝড় নামটি যেভাবে এল :- "ঘূর্ণিঝড়" (ঈুপষড়হব) নামটি সর্বপ্রথম বিজ্ঞানী হেনরি পিডিংটন ১৮৪৮ সালে তার লিখিত ঞযব ঝধরষড়ৎং ঐড়ৎহ- নড়ড়শ ভড়ৎ ঃযব ষড়ি ড়ভ ঝঃড়ৎসং গ্রন্থে ব্যবহার করেন।

ক্রান্তীয় অঞ্চলের সমুদ্রে সৃষ্ট বৃষ্টি, বজ্র ও প্রচন্ড ঘূর্ণি বাতাস সম্বলিত আবহাওয়ার একটি নিম্ন-চাপ প্রক্রিয়া (low pressure system) যা নিরক্ষীয় অঞ্চলে উৎপন্ন তাপকে মেরু অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত করে বলে একে ঘূর্ণিঝড় বলে অবিহিত করা হয়। এই ধরনের ঝড়ে বাতাস প্রবল বেগে ঘুরতে ঘুরতে ছুটে চলে। ঘুর্নন উত্তর গোলার্ধে ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে ঘড়ির কাঁটার দিকে। যখন বঙ্গোপসাগরে উৎপত্তি হয়ে ৭৪ মাইল (১১৯ কিলোমিটার) গতিবেগে বাতাস ঘূর্ণায়মান অবস্থায় মৌসুমী ঘূর্ণিঝড়ে রূপান্তরিত হয় তখন তা সাইক্লোন বা ঘূর্ণিবাত্যা নামে আখ্যায়িত হয়। এ সাইক্লোন বা ঘূর্ণিবাত্যাই আটলান্টিক মহাসাগরে হারিকেন নামে পরিচিত।

মজার ব্যাপার হল,ঘূর্ণিঝড় শুধু পৃথিবীতেই হয় না। এই জাতীয় ঝড় Jovian গ্রহগুলতেও দেখা যায় যেমন - নেপচুনের ছোট ডার্ক স্পট, যা জাদুকরের চোখ (Wizard's Eye) হিসাবেও পরিচিত। এই ডার্ক স্পটের ব্যাস সাধারনত গ্রেট ডার্ক স্পটের এক তৃতীয়াংশ। এটি দেখতে একটি চোখের মত, তাই এটার নাম "জাদুকরের চোখ"। মঙ্গলেও সাইক্লোনিক ঝড় দেখা যায় যার নাম "গ্রেট রেড স্পট"।

পৃথিবীর অবস্থান অনুযায়ী, যে সকল সাগর অক্ষাংশের ৫০۫ উত্তরে ও অক্ষাংশের ৩০۫ দক্ষিণে অবস্থিত, সে সব সাগরে ঘূর্ণিঝড় বেশি হয়। আর বাংলাদেশ উষ্ণম-লীয় অঞ্চল বলেই এখানে “ট্রপিক্যাল সাইক্লোন” বেশি হয়। ঘূর্ণিঝড় উপকূলে আঘাত হানলে যদিও দুর্যোগের সৃষ্টি হয়, কিন্ত্ত এটি আবহাওয়ার একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, যা পৃথিবীতে তাপের ভারসাম্য রক্ষা করে। গড়ে পৃথিবীতে প্রতি বছর প্রায় ৮০ টি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়। এর অধিকাংশই সমুদ্রে মিলিয়ে যায়, কিন্ত্ত যে অল্প সংখ্যক উপকূলে আঘাত হানে তা অনেক সময় ভয়াবহ ক্ষতি সাধন করে।

বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে কর্কটক্রান্তি রেখা অতিক্রম করেছে। এর প্রভাব আমাদের জলবায়ুর ওপর বিরাজমান। বাংলাদেশে প্রতিবছরে গ্রীষ্মের মৌসুমে কম আর বেশি কালবৈশাখী ঘূর্ণিঝড় দেখা যায়। ৬۫ – ৩০۫ উত্তর ও দক্ষিণ অক্ষাংশের মধ্যে অবস্থিত স্থানগুলোতে ঘূর্ণিঝড় প্রবাহিত হয়। কালবৈশাখী ঘূর্ণিঝড়ের উচ্চতা প্রায় ৮ কি.মি এবং ব্যাস ৩/৪ শত কি.মি. পর্যন্ত লক্ষ্য করা যায়।

মাঝে মাঝে এর বেশিও হতে পারে। এই ঘূর্ণিঝড় স্থান ভেদে বিভিন্ন নামে পরিচিত। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে গ্রীষ্মের মৌসুমে বায়ু প্রবাহের শুরুতেই কালবৈশাখী বা ঘূর্ণিঝড়, চীন সাগরে টাইফুন, ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জে বাগ্রইও, পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে হারিকেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে টর্নেডো। তবে বাংলাদেশের কালবৈশাখীকে ঘূর্ণিঝড় বলা চলে না; বরং এটি বজ্রবৃষ্টিসহ ঝড়। কালবৈশাখী যখন ঘণ্টায় ১২৯ কি. মি. বেগে চলে তখন তা টর্নেডোয় পরিণত হয়।

ঘূর্ণিঝড়ের প্রকৃতি ২ ধরনের- ১)নিম্নচাপ কেন্দ্রে কু_ লীর আকারে ঘুরে ঘুরে প্রবেশ করে । ২) নিজে পাক খেতে খেতে অয়ন বায়ুর গতিপথ অনুসরণ করে। সাধারণত পশ্চিম বা উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে এই ঝড় প্রবাহিত হয়। মার্চ/এপ্রিল মাস থেকে বাংলাদেশের কালবৈশাখীর সূত্রপাত হয়। মার্চ-এপ্রিল থেকে শুরু হয়ে জুন মাসের বর্ষাকালের আবির্ভাব না হওয়া পর্যন্ত এ ঝড় প্রায় সময় সংঘটিত হয়।

বাংলাদেশ, আসাম, মেঘালয়, পশ্চিমবঙ্গ এবং বিহারের কিছু অংশে নিম্নস্থ উষ্ণ-আর্দ্র বায়ু অপরাহ্নকালীন তাপ পরিচলনের ফলে সবেগে ঊর্ধ্বগামী হয় এবং স্থানে স্থানে উপরিস্থিত শীতল বায়ুস্তরকে ভেদ করতে সক্ষম হয়। এর ফলে আকস্মিকভাবে বায়ুর পরিবর্তন হয়। তথাপি, ঘূর্ণিঝড়ের প্রকৃত কারণরূপে নিম্নের প্রভাবকগুলোকে অভিহিত করা হয় : সমুদ্রের তাপমাত্রা :- ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির জন্য সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা কমপক্ষে ২৬-২৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস থাকা আবশ্যক এবং একটি নির্দিষ্ট গভীরতা(কমপক্ষে ৫০ মিটার)পর্যন্ত এ তাপমাত্রা থাকতে হয়। এজন্য আমরা দেখি সাধারণত কর্কট ও মকর ক্রান্তিরেখার কাছাকাছি সমুদ্র গুলিতে গ্রীষ্মকালে বা গ্রীষ্মের শেষে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়। অন্য কোথাও হয় না।

নিরক্ষরেখা থেকে দূরত্ব :- নিরক্ষীয় অঞ্চলে গ্রীষ্মকালে পৃথিবীপৃষ্ঠ উত্তপ্ত হয়ে গেলে উষ্ণ ও আর্দ্র বায়ু হালকা হয়ে উপরে উঠে যায়। এই শূন্যস্থান পূরণের জন্য মেরু অঞ্চল থেকে শীতল বায়ু উত্তর গোলার্ধে দক্ষিণে নিরক্ষরেখার দিকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে উত্তর দিকে প্রবাহিত হয়। কিন্ত্ত পৃথিবীর ঘূর্ণনের প্রভাবে সৃষ্ট করিওলিস শক্তির (coriolis force) কারণে এ বায়ু সোজাসুজি প্রবাহিত না হয়ে উত্তর গোলার্ধে ডান দিকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে বাম দিকে বেঁকে যায়। এ জন্য আমরা দেখি, উত্তর গোলার্ধে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে ঘড়ির কাঁটার দিকে ঘুরতে থাকে। নিরক্ষরেখার উপর এ শক্তির প্রভাব শূন্য।

কাজেই, এ অঞ্চলের তাপমাত্রা ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির অনুকূলে থাকলেও করিওলিস শক্তি ন্যূনতম থাকায়, নিরক্ষরেখার ০ ডিগ্রী থেকে ৫ ডিগ্রীর মধ্যে কোন ঘূর্ণিঝড় হতে দেখা যায় না। সাধারণত, নিরক্ষরেখার ১০ ডিগ্রী থেকে ৩০ ডিগ্রীর মধ্যে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়। বায়ুমন্ডলের আর্দ্রতা :- বায়ুমন্ডলের নিম্ন ও মধ্যস্তরে অধিক আর্দ্রতা ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বিরাজমান বিক্ষুব্ধ পরিস্থিতি ঘূর্ণিঝড় স্বতস্ফুর্তভাবে সৃষ্টি হতে পারে না। সমুদ্রে আগে থেকে বিরাজমান বিক্ষুব্ধ কোন পরিস্থিতি সৃষ্টি থাকলে, ঘূর্ণিঝড় সাধারণত সেটাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে।

এছাড়া, পশ্চিমমুখী নিম্ন বায়ুচাপসম্পন্ন পূবালী স্রোত (easterly waves), আবহাওয়ায় উচ্চতার সাথে সাথে বায়ুর গতি ও দিকের স্বল্প পরিবর্তন এবং দ্রুত শীতলীকরণের ফলে নির্গত তাপ ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির জন্য সহায়ক। নীচে প্রাকৃতিক দূর্যোগের দেশ হিসেবে চিহ্নিত বাংলাদেশে বয়ে যাওয়া সাইক্লোনের তালিকা দেয়া হলোঃ- (১) প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড় লায়লা _______২০১০ (২) অতি তীব্র ঘূর্ণিঝড় নার্গিস____২০০৮ (৩) অতি তীব্র ঘূর্ণিঝড় সিডর ____২০০৭ (৪) অতি তীব্র ঘূর্ণিঝড় মালা ____ ২০০৬ (৫) সেপ্টেম্বর টাইফুন জ্যাংসেন___২০০৬ (৬)নভেম্বর টাইফুন মুইফা ______ ২০০৪ (৭)মে উপকূলীয় ঘূর্ণিঝড় ২বি ___ ২০০২ (৮) এপ্রিল বাংলাদেশ সাইক্লোন __ ১৯৯১ (৯) নভেম্বর টাইফুন গে ______________________১৯৮৯ (১০) মে উপকূলীয় ঘূর্ণিঝড় ওয়ান ১বি ___________ ১৯৮৫ (১১) এপ্রিল সাইক্লোন ওয়ান ১বি ________________১৯৮২ (১২) মে উপকূলীয় ঘূর্ণিঝড় টু ২বি _______________১৯৮২ (১৩ অক্টোবর উপকূলীয় ঘূর্ণিঝড় থ্রী ৩বি ) _________১৯৮২ (১৪) ডিসেম্বর সাইক্লোন থ্রী ৩বি _________________১৯৮১ (১৫) অক্টোবর উপকূলীয় ঘূর্ণিঝড় ওয়ান ১বি_________১৯৮০ (১৬) ডিসেম্বর অজানা ঘূর্ণিঝড় ফোর ৪বি___________১৯৮০ (১৭) , ডিসেম্বর উপকূলীয় ঘূর্ণিঝড় ফাইভ ৫বি________১৯৮০ (১৮) সাইক্লোন ওড়িষ্যা __________________________১৯৭১ (১৯) নভেম্বর ভোলা সাইক্লোন___________________১৯৭০ ঘূর্ণিঝড়ের বিভিন্ন সংকেত অনুযায়ী করনীয় পদক্ষেপ :- সংকেত নং ১ ও ৩ (সতর্ক সংকেত) : ১) লম্বা সময়ের জন্য যেমন ৩-৪ দিনের জন্য দূরে কোথাও না যাওয়া ২) ঘূর্ণিঝড়ের পরবর্তী অবস্থা কী হয় সে দিকে খেয়াল রাখা সংকেত নং ২ ও ৪ (হুঁশিয়ারি সংকেত) : ১) এমন কোথাও না যাওয়া যেখান থেকে আসতে ১ দিনের বেশি সময় লাগবে৷ ২) ঘূর্ণিঝড় আসছে এই চিন্তা মাথায় রাখা৷ ৩) মূল্যবান ও ভাসমান জিনিসপত্র কোথায় আছে সেদিকে লক্ষ রাখা৷ ৪) ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়স্থলে অল্প সময়ের মধ্যে কীভাবে পৌঁছাতে হবে সে ব্যাপারে খোঁজ রাখা৷ ৫) গবাদি পশু বাড়ির কাছাকাছি রাখা৷ প্রয়োজনীয় উপকরণ হাতের কাছে রাখা৷ সংকেত নং ৫, ৬ ও ৭ : ১) রেডিও,টেলিভিশন ও অন্যান্য প্রচার মাধ্যমে প্রচারিত বিপদ সংকেত ও নির্দেশ শুনতে হবে৷ বিশেষ করে ঘূর্ণিঝড়ের অবস্থান কত দূরে, বাতাসের গতিবেগ কত এবং ঝড়টির স্থান পরিবর্তনের গতিবেগ কত ইত্যাদি ভালো করে শুনতে হবে৷ ২) পরিবারের সাথে থাকা এবং তাদের মানসিকভাবে সাহস দেয়া৷ মূল্যবান জিনিস ঘরের মেঝে খুঁড়ে অথবা শক্ত মাটির নিচে পুতে ফেলার ব্যবস্থা করা৷ ৩) শুকনো খাবার যেমন মুড়ি, চিড়া, গুড়, বিস্কুট, খাবার পানি, কিছু চাল, ডাল প্লাস্টিক পাত্রে ভরে ভালোভাবে মুখ বন্ধ করে নির্দিষ্ট জায়গায় গর্ত করে মাটির নিচে রাখার ব্যবস্থা করা৷ ৪) শিশু, বৃদ্ধ, প্রতিবন্ধী, গর্ভবতী ও অসুস্থদের ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা৷ ৫) গবাদি পশুদের নিকটবর্তী উঁচু জায়গা কিংবা কিল্লাতে নিয়ে যাওয়া অথবা তাদের বাঁধন খুলে দেয়া৷ ৬) মনে রাখতে হবে যে, অবস্থার অবনতি হলে এই বিপদ সংকেতের পরেই মহাবিপদ সংকেত আসবে এবং ঐ সময়ে চলাচল করা মোটেও সম্ভব হয় না৷ কাজেই আশ্রয়স্থলে যাওয়ার জন্য বিশেষ করে শারীরিকভাবে দুর্বলদের মহাবিপদ সংকেত পাওয়ার পূর্ব মুহূর্তেই স্থানান্তরের উপযুক্ত সময়৷ ৭) নৌকা, ইঞ্জিন চালিত নৌকা, ভেলা, ভাসমান দ্রব্য ও অন্যান্য যান প্রস্তুত করে গাছের সাথে ভালো করে বেঁধে রাখা৷ ৮) মাইক, মেগাফোন, হর্ণ বাজিয়ে কিংবা ঢোল পিটিয়ে রেডিও বা টেলিভিশনে প্রচারিত সংকেত ও ঘূর্ণিঝড়ের অবস্থান ও গতিবিধির খবরাখবর প্রচার করা৷ ৯) নিরাপদ আশ্রয়ে যাবার সময় প্রতিবেশীদের যাবার জন্য বলা৷ ১০) শক্ত ও মোটা দড়ি দিয়ে তৈরি করা মই বাড়ির বড় নারকেল বা তাল গাছের সাখে বেঁধে রাখা৷ কেউ যদি কোনো কারনে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে না পারে তবে জলোচ্ছ্বাসের সময় আশ্রয় নিতে পারবে৷ সংকেত নং ৮, ঌ, ১০ (মহাবিপদ সংকেত) : ১) এই সংকেত প্রচারের পর প্রথম ও প্রধান কাজ হলো সম্পদের কী ক্ষতি হচ্ছে সে চিন্তা না করে জীবন বাঁচানো৷ ২) এই সময়ে আবহাওয়া এতই দুর্যোগপূর্ণ থাকবে যে চলাচল করা খুবই কষ্টকর হবে৷ ৩) অল্প পথকে অনেক দূর বলে মনে হবে এবং অনেকসময় খারাপ আবহাওয়ার জন্য এই অল্প পথটুকু পার হওয়া বা অতিক্রম করা যায় না ৷এ সময়ে চলাচল করা উচিত নয় বিশেষ করে পানি পথে ৷ ৪) এ সময়ে ঝড়ো হাওয়ার গতিবেগ এত বেশি থাকে যে কাছের কোন বস্তুও দেখা যায় না৷ বৃষ্টির ফোটা শরীরে এত জোরে লাগে যে মনে হয় বড় বড় ঢিল কিংবা বন্দুকের গুলি লাগছে৷এ সময় বাতাস এত প্রবল থাকে যে গাছের ডাল, ঘরের টিন এ জাতীয় জিনিস বাতাসের প্রচণ্ড বেগে উড়তে থাকে৷ তাই আশ্রয় কেন্দ্রের বাইরে যাওয়া ও ঘোরাফেরা করা উচিত নয়৷ ৫) মহাবিপদ সংকেত দেয়ার আগে অথবা প্রথম অবস্থাতেই সময় নষ্ট না করে জীবন রক্ষার জন্য নিরাপদ স্থানে পৌঁছানো জরুরি৷ নিরাপদ স্থানে পৌঁছাতে না পারলেও কাছেই কোনো নারকেল কিংবা তাল অথবা শক্ত কোনো গাছে আশ্রয় নিতে হবে৷ ৬) মহাবিপদ সংকেত প্রদানের সাথে সাথে কেউ যদি নিরাপদ জায়গায় যেতে না চায় তাদেরকে জোর করে কিংবা বল প্রয়োগ করে হলেও নেয়ার ব্যবস্থা করা৷ সংকেত নং ১১ (যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন) দুর্গত এলাকার সাথে কোনো রকমের যোগাযোগ করা যায় না৷তাই এ সময়ে একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে জীবন বাঁচানো৷ আমরা ইতিমধ্যেই জেনে গেছি যে ঘূর্ণিঝড় মহাসেন আজকালের মধ্যেই আঘাত হানতে ধেয়ে আসছে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের দিকে। ঘূর্ণিঘড় মহাসেন ঘণ্টায় ২০ কিলোমিটার গতিবেগে এগিয়ে আসছে বাংলাদেশের উপকূলে। সবচেয়ে কাছে মংলা থেকে ৫৭৫ কি.মি দূরুত্বে অবস্থান করছে ঘূর্ণিঝড় ‘মহাসেন’। তবে বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠানের (স্পারসো) তথ্য মতে, ঘূর্ণিঝড় মহাসেন বাংলাদেশি উপকূলের দিকে আরো এগিয়ে এসেছে।

ঘূর্ণিঝড়টি মংলা বন্দর থেকে ৩২৫ কিলোমিটার, কক্সবাজার থেকে ৪২৬ কিমি, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ৪৬৩ কিমি দূরে অবস্থান করছে। অতএব এই মুহূর্তে আমাদের অবশ্য করনীয় হল ঃ- * দুর্যোগের সময় কোন এলাকার লোক কোন আশ্রয়ে যাবেন, গৃহপালিত পশুপাখি কোথায় রাখবেন, তা আগে ঠিক করে রাখুন এবং জায়গা চিনে রাখুন। * বাড়িতে, গ্রামে, রাস্তায় ও বাঁধের ওপর গাছ লাগান। * যথাসম্ভব উঁচু স্থানে শক্ত করে ঘর তৈরি করুন। পাকা ভিত্তির ওপর লোহার বা কাঠের পিলার এবং ফ্রেম দিয়ে তার উপর ছাউনি দিন।

ছাউনিতে টিন ব্যবহার না করাই ভালো। কারণ, ঝড়ের সময় টিন উড়ে মানুষ ও গবাদি পশুকে হতাহত করতে পারে। তবে ০.৫ মিমি পুরুত্ব বিশিষ্ট টিন ও জেহুক ব্যবহার করা যেতে পারে। * উঁচু জায়গায় টিউবওয়েল স্থাপন করুন, যাতে করে জলোচ্ছ্বাসের লোনা ও ময়লা পানি টিউবওয়েলে ঢুকতে না পারে। * জেলে নৌকা, লঞ্চ ও ট্রলারে রেডিও রাখুন।

সকাল, দুপুর ও বিকেলে আবহাওয়ার পূর্বাভাস শোনার অভ্যাস করুন। * সম্ভব হলে বাড়িতে কিছু প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম (ব্যান্ডেজ, ডেটল/স্যাভলন প্রভৃতি) রাখুন। * জলোচ্ছ্বাসের দূষিত পানির প্রকোপ থেকে রক্ষায় নানারকম শস্যের বীজ সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিন। * বাড়িতে এবং রাস্তায় নারকেল, কলাগাছ, বাঁশ, তাল, কড়ই ও অন্যান্য শক্ত গাছপালা লাগান। এসব গাছ ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের বেগ কমিয়ে দেয়।

এর ফলে মানুষ দুর্যোগের কবল থেকে বাঁচতে পারেন। * নারী-পুরুষ, ছেলে-মেয়ে প্রত্যেকেরই সাঁতার শেখা উচিৎ। * ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে বা অন্য আশ্রয়ে যাওয়ার সময় কী কী জরুরি জিনিস সঙ্গে নেওয়া যাবে এবং কী কী জিনিস মাটিতে পুঁতে রাখা হবে, তা ঠিক করে সে অনুসারে প্রস্তুতি নেওয়া উচিৎ। * আর্থিক সামর্থ্য থাকলে ঘরের মধ্যে একটি পাকা গর্ত করুন। জলোচ্ছ্বাসের আগে এই পাকা গর্তের মধ্যে অতি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাখতে পারবেন।

* ডায়রিয়া মহামারীর প্রতি সচেতন দৃষ্টি রাখতে হবে। শিশুদের ডায়রিয়া হলে কীভাবে খাবার স্যালাইন তৈরি করতে হবে, সে বিষয়ে পরিবারের সবাইকে প্রশিক্ষণ দিন। * ঘূর্ণিঝড় আশঙ্কার মাসগুলোতে বাড়িতে মুড়ি, চিড়া, বিস্কুট জাতীয় শুকনো খাবার রাখা ভালো। * নোংরা পানি কীভাবে ফিটকারি বা ফিল্টার দিয়ে খাবার ও ব্যবহারের উপযোগী করা যায়, সে বিষয়ে নারী এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিন। * ঘূর্ণিঝড়ের পরে বৃষ্টি হয়।

বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করুন। বৃষ্টির পানি নিরাপদ। মাটির বড় হাড়িতে বা ড্রামে পানি রেখে তার মুখ ভালোভাবে আটকে রাখতে হবে, যাতে করে পোকা-মাকড়, ময়লা-আবর্জনা ঢুকতে না পারে। এখন আসি, দুর্যোগ শেষ হবার পর করনীয় প্রসঙ্গে :- * আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণায় নিরাপদ না বলা পর্যন্ত বাড়ি বা আশ্রয়কেন্দ্রের বাইরে যাবেন না। * রাস্তা-ঘাটের ওপর উপড়েপড়া গাছপালা সরিয়ে ফেলুন, যাতে করে সহজে সাহায্যকারী দল আসতে পারে এবং দ্রুত যোগাযোগ সম্ভব হয়।

* আশ্রয়কেন্দ্র থেকে মানুষকে বাড়ি ফিরতে সাহায্য করুন এবং নিজের ভিটায় বা গ্রামে অন্যদের মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিন। * অতি দ্রুত উদ্ধার দল নিয়ে খাল, নদী, পুকুর ও সমুদ্রে ভাসা বা বনাঞ্চলে বা কাদার মধ্যে আটকেপড়া মানুষ বা গবাদিপশুকে উদ্ধার করুন। * গ্যাস সংযোগ কোথাও 'লিক' করেছে কি না, তা খোঁজ নিন। বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ভেজা থাকলে তা ব্যবহার করবেন না। * অফিসিয়াল সতর্কবার্তা বা পরামর্শের জন্য স্থানীয় রেডিও শুনতে থাকুন।

* যদি আপনার বাড়িঘর ছাড়তে হয়, বা ঘূর্ণিঝড়ের আগেই তা ছেড়ে থাকেন, তাহলে কর্তৃপক্ষের পরামর্শ ছাড়া ফিরবেন না। যে পথে ফেরার পরামর্শ দেয়া হয়, সে পথেই ফিরুন এবং তাড়াহুড়া করবেন না। কারন একবার ঘূর্ণিঝড় শেষ হলেও তা প্রবল বেগে অন্যদিক থেকে আসার সম্ভাবনা থাকে। * ক্ষতিগ্রস্ত বিদ্যুত লাইন, ব্রিজ-কালভার্ট, বিল্ডিং, গাছপালা থেকে সতর্ক থাকুন এবং বন্যার পানিতে নামবেন না। * সকল সতর্কবার্তার দিকে নজর রাখুন এবং দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শনে (সাইটসিয়িং) যাবেন না।

বরং প্রতিবেশীর খোঁজ নিন এবং প্রয়োজনে সম্ভব হলে তাদেরকে সহায়তা করুন। * ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্ত জনসাধারণ যাতে করে শুধুমাত্র এনজিও বা সরকারি সাহায্যের অপেক্ষায় বসে না থেকে নিজ উদ্যোগে অন্যকে সাহায্য করেন, সে বিষয়ে সচেষ্ট হতে হবে। * ত্রাণের মুখাপেক্ষী না হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সচেষ্ট হন। ত্রাণের পরিবর্তে কাজ করুন। কাজের সুযোগ সৃষ্টি করুন।

ত্রাণ যেন মানুষকে কর্মবিমুখ না করে কাজে উৎসাহী করে, সেভাবে ত্রাণ বিতরণ করতে হবে। * দ্বীপের বা চরের নিকটবর্তী কাদার মধ্যে আটকেপড়া মানুষ বা গবাদিপশু উদ্ধারের জন্য দলবদ্ধ হয়ে দড়ি ও নৌকার সাহায্যে উদ্ধার কাজ আরম্ভ করুন। কাদায় আটকেপড়া লোকের কাছে দড়ি বা বাঁশ পৌঁছে দিয়ে তাকে উদ্ধার কাজে সাহায্য করা যায়। * পুকুর বা নদীর পানি ফুটিয়ে পান করুন। বৃষ্টির পানি ধরে রাখুন।

* নারী, বৃদ্ধ, প্রতিবন্ধী ও অসুস্থ লোকদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় ত্রাণ বণ্টন (আলাদা লাইনে) করুন। * দ্রুত উৎপাদনশীল ধান ও শাকসব্জির জন্য জমি প্রস্তুত করুন, বীজ সংগ্রহ করুন এবং কৃষি কাজ শুরু করুন যাতে করে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি ফসল ঘরে আসে। পরিশেষে একটি কথা বলা যায় ১৯৯১ সাল আর ২০১৩ সাল এই দুই এর মধ্যে তুলনা করলে দেখা যাবে ৯১’র বাংলাদেশ এখন আর নাই। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে গেছে। সেই হিসেবে মানুষ এবং ঘর-বাড়ির ক্ষয় ক্ষতি কম হবে বলে আশা করা যায়।

তবে ফসলাদির ক্ষয়-ক্ষতি হবে। ***** সর্বশেষ সৃষ্টিকর্তার কাছে একাগ্র চিত্তে প্রার্থনা একটিই, যেন বাংলার নিরীহ জনপদে ভয়াল কোন দুর্যোগ না ঘনিয়ে আসে,ক্ষয়ক্ষতির পরিমান নাম-মাত্র হয়। "মহাসেনমহাশয়কে যেন আমরা নির্ভীক চিত্তে ও অদম্য মনোবলের মাধ্যমে প্রতিহত করতে পারি। এই মুহূর্তে সবচাইতে বেশি দরকার সকলের অপরাজেয় মানসিক প্রস্তুতি ও দুর্দম্য আত্মবিশ্বাস। সকল কিছুর উর্ধে জয় মানবতার,মানবজীবন ও লড়াকু জীবনীশক্তির হবেই হবে।

 ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.