আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মগজ পাচার বা ব্রেন ড্রেন

প্রতি বছর ১০ ডিসেম্বর আলফ্রেড নোবেলের মৃত্যুবার্ষিকীতে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে নোবেল পুরস্কার প্রদানের মহোৎসব অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৭৯ সালের ১০ ডিসেম্বর নোবেল পুরস্কারের ইতিহাসে এক ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা ঘটে। গতানুগতিক ঐতিহ্য অনুযায়ী কালো স্যুটের সঙ্গে সাদা বো-টাই না পরে মঞ্চে বসা নোবেলবিজয়ীদের মধ্যে দেখা গেল একজনের পোশাক সম্পূর্ণ অন্যরকম। কালো লম্বা গলাবদ্ধ কোটের সঙ্গে সাদা সালোয়ার পরনে, পায়ে জরির নাগড়া জুতা, মাথায় সাদা পাগড়ি। হলভর্তি অতিথিদের সবার চোখ এই অন্যরকম পোশাকের মানুষটির দিকে।

যার নাম আবদুস সালাম, নোবেলবিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী প্রফেসর আবদুস সালাম। নোবেল ভোজসভার বক্তৃতাতেও তিনি পবিত্র কোরআনের আয়াত উদ্ধৃত করেছেন, তার গবেষণার সঙ্গে তার গভীর ধর্মীয় বিশ্বাসের কথাও উল্লেখ করেছেন, বলেছেন পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে তার গর্বের কথা। জানা যায়, ১৯৫১ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত তিনি বুদ্ধিবৃত্তির জগতে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিলেন। লাহোরের কর্মজীবনের পরিবেশে চরম হতাশাবোধ তাকে ইংল্যান্ডে ফিরে আসতে বাধ্য করে। তার ভাষায় তিনি অনিচ্ছা সত্ত্বেও 'মগজ পাচারের' শিকার হয়েছেন।

মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার ভ্লারীকান্দি গ্রামে ৩ এপ্রিল ১৯২৯ সালে ফজলুর রহমান খান জন্মগ্রহণ করেন। তাকে বিংশ শতকের শ্রেষ্ঠ প্রকৌশলী বলা হয়। শিকাগোর সিয়ার্স টাওয়ার (বর্তমানে উইওলস টাওয়ার) তার অনন্য কীর্তি। তিনি ১৯৭২ সালে 'ইঞ্জিনিয়ারিং নিউজ রেকর্ড'-এ ম্যান অব দি ইয়ার বিবেচিত হন এবং পাঁচবার স্থাপত্য শিল্পের সবচেয়ে বেশি অবদান রাখা ব্যক্তিত্ব হিসেবে অভিহিত হওয়ার গৌরব লাভ করেন। ১৯৭৪ সালে আমেরিকার 'নিউজ উইক' ম্যাগাজিন শিল্প ও স্থাপত্যের ওপর প্রচ্ছদ কাহিনীতে তাকে মার্কিন স্থাপত্যের শীর্ষে অবস্থানকারী ব্যক্তি হিসেবে বর্ণনা করা হয়।

স্থপতি ড. এফআর খান আন্তর্জাতিক গগনচুম্বী ও নগরায়ণ পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯৮২ সালের ২৬ মার্চ জেদ্দায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পর তার মরদেহ আমেরিকায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং শিকাগোতে সমাহিত করা হয়। জানা যায়, ১৯৫০ সালে তিনি আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯৫২ সালে তিনি ফুলব্রাইট ফেলোশিপ এবং ফোর্ড ফাউন্ডেশনের স্কলারশিপ নিয়ে উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে আমেরিকার ইলিনয়েস ইউনিভার্সিটিতে যান।

তিনিও যুক্তরাষ্ট্রের ব্রেন ড্রেনের শিকার।

১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাহাদাতবরণের পর ১৯৮২ সালে স্বৈরশাসক ক্ষমতা কুক্ষিগত করলে উচ্চশিক্ষার্থে পাড়ি জমাই নিউইয়র্কে। তখন আমি দ্বিতীয়বারের মতো ফজলুল হক হল ছাত্র সংসদের ভিপি ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির কোষাধ্যক্ষ ছিলাম। নিউইয়র্ক ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে এমবিএ করছি। যুক্তরাষ্ট্রে গ্রাজুয়েট প্রোগ্রামগুলোাতে সান্ধ্যকালীন শিফটে ক্লাস হয়।

আর আন্ডার গ্রাজুয়েট প্রোগ্রামগুলো দিনে হয়। কারণ, প্রায় আমেরিকানরা আন্ডারগ্রাজুয়েশন করে চাকরি বা নিজ নিজ কর্মে চলে যায়। পরবর্তীতে কোনো সময়ে এসে মাস্টার্স করেন। আর অনেকে সরাসরি মাস্টার্স বা পিএইচডি করেন। আমি ব্রুকলিন থেকে এসে অনেক রাত পর্যন্ত ক্লাস ও লাইব্রেরি ওয়ার্ক করতে হয় বলে গাড়ি নিয়ে আসি।

ওদিকে পার্কিং আইনের কারণে সন্ধ্যা ৬টার আগে রাস্তায় গাড়ি পার্ক করা যায় না। আর আমার ক্লাস শুরু হয় ৫টা ৫৫ মিনিটে। তাই প্রায় ৫০ জন ছাত্রের মধ্যে আমাকে ১০ মিনিট দেরি করার কারণে সবার পেছনে বসতে হতো। ড. হার্টম্যানের বিজনেস এনভায়রনমেন্ট ক্লাসে তিনি প্রথম ২০ মিনিট বিভিন্ন বিষয়ে ক্লাসে কমন আলোচনা করেন এবং সবাই তাতে অংশ নেন। সেদিনের আলোচ্য বিষয়টি ছিল Why America is the great country in the world. ক্লাসে এসে বসতে বসতেই অনেকের উত্তর শেষ।

ভাবতে থাকলাম কী বলা যায়। মনে মনে যেটা ভাবলাম দেখলাম অন্যরা তা বলে ফেলেছে। এমন করতে করতে আমার ডাক এলো। মি. হকিউই, প্রফেসর অবশ্য আমাকে আমার শেষ নাম 'হক'কে Hoque বলেন, বানানের সঙ্গে উচ্চারণ ঠিক রেখে। আমি বললাম, ব্রেন ড্রেন অ্যান্ড ডেসপারেট পিপল।

প্রফেসর বললেন, ব্রেন ড্রেন বুঝলাম কিন্তু ডেসপারেট পিপলটা ব্যাখ্যা দাও। বললাম, যারা চীনের কমিউনিজমকে পছন্দ করেনি সেই ধনাঢ্য ব্যক্তিরা চীন থেকে নৌকার মতো ছোট্ট জাহাজে করে চীন সাগর পাড়ি দিয়ে আটলান্টিক পার হয়ে নিউইয়র্কে এসেছে। সে নৌকাগুলো এখনো ডাউন টাউন, ম্যানহাটনের সাউথ স্ট্রিট সি পোর্টে বাঁধা আছে। যারা রাশিয়ার সসোলিজমকে বাস্তবমুখী শাসনব্যবস্থা বলে বিশ্বাস করেনি, যারা ইংল্যান্ডের কুইনস 'ল' মেনে নিতে পারেনি_ এভাবে পৃথিবীর ডেসপারেট লোকেরা এ দেশে এসে তাদের মতো করে দেশ বানিয়েছে। তাই তো তাদের পেছনের ইতিহাসে কোনো বর্বরতা নেই।

যেমন ইংল্যান্ডে কিংস বেঞ্চের সেকালের বিচারকরা আদালত অবমাননাকারীর দুই হাত কেটে আদালতের ফটকে পেরেক দিয়ে পুঁতে রাখতেন। এভাবে ব্যাখ্যা দিতে থাকলাম। প্রফেসর হার্টম্যান, তিনি অবশ্য ওয়াল স্ট্রিট র্জানালের কলামিস্ট ছিলেন। আর ব্রেন ড্রেনের কথা বলতে তিনি মাথা নেড়ে বলতে থাকলেন, আমি আয়ারল্যান্ডের। আমারও পরিকল্পনা ছিল দেশে ফিরে যাব।

কিন্তু আমেরিকান সরকার আমাকে গ্রিনকার্ড দিয়ে এখানেই আমার শেষ ঠিকানা করেছে। মূলত আমেরিকাতে পৃথিবীর যে কোনো দেশ থেকে মেধাবী শিক্ষার্থীরা আসতে চাইলে তাদের সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হয়। লেখাপড়া শেষ করার পর তাদের সে দেশের রেসিডেন্সি (গ্রিনকার্ড) এবং পরে নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। এমনকি ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের শিক্ষার্থীদের সরাসরি ইমিগ্রেন্ট ভিসা দিয়ে সপরিবারে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার ব্যবস্থা ছিল।

আমেরিকায় অনেক পলিটিসিয়ান যারা সে দেশের জন্মগত সন্তান নন যেমন, সাবেক সেক্রেটারি অফ স্টেট হেনরি কিসিঞ্জার (র্জামানি), মেডেলিন অলব্রাইট (চেকোস্লোভাকিয়া), ক্যালিফোর্নিয়ার সাবেক গভর্নর আরনল্ড সোয়ার্জনেগার (অস্ট্রিয়া), কলোরাডো থেকে সিনেট সদস্য মিশেল বেনেট (ভারত), হাওয়াই থেকে সিনেট সদস্য মিজি হারিনো (জাপান), মেরিল্যান্ড থেকে রিপ্রেজেন্টেটিভ ক্রিস ভেন হলেন (পাকিস্তান), নিউইর্কের সাবেক বেশ কয়েকজন মেয়র আব্রাহাম ব্রেমে (ইংল্যান্ড), রিচার্ড ক্রোকার (আয়ারল্যান্ড), থমাস এফ গিলোরি (আয়ারল্যান্ড), ভিনসেন্ট আর ইমপিলিট্টারি (ইতালি), উইলিয়াম ওডোয়ার (আয়ারল্যান্ড) প্রমুখ।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শুধু রাষ্ট্রপতিকে আমেরিকার জন্মগত নাগরিক হওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে। যদিও ২০০৮ সালে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী রিপাবলিকান দলের জন ম্যাককেইন জন্মগ্রহণ করেন পানামায়। তার বাবা ওই সময়ে পানামায় কর্মরত নৌবাহিনীর অফিসার ছিলেন। পানামা তখন যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বের মানচিত্রে ক্ষমতাধর রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি দিতে বিচারপতি থেকে শুরু করে সব শ্রেণী-পেশায় ব্রেন ড্রেনের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে।

এই তো সেদিনের কথা, আশির দশকেও আমরা অনেক মালয়েশিয়ান শিক্ষার্থীকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করতে দেখেছি। কিন্তু জীবন্ত কিংবদন্তি ড. মাহাথির বিন মোহাম্মদ তার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নাগরিকদের বহু অর্থ ব্যয় করে উন্নত বিশ্বে উচ্চতর শিক্ষার জন্য পাঠিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনি তার মেধাবী সন্তানদের দেশে ফিরিয়ে আনেন। এতে তার দেশের অনেক অর্থ ব্যয় হয়েছিল। কিন্তু তিনি তার অমূল্য সম্পদ মেধাকে পাচার থেকে বিরত করেছিলেন।

প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ জর্জ সোরসের প্রেসক্রিপশন না শুনে তিনি তার দেশের অর্থনীতিবিদদের কথা শুনে অর্থনৈতিক মন্দা থেকে দেশকে মুক্ত করতে পেরেছিলেন এবং মালয়েশিয়ার অর্থনীতিকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করেছিলেন। তাই আজ মালয়েশিয়া এত উন্নত।

'সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবেন। ' সংবিধানের ১৯ (১)। সংবিধানের ২৮ (১) 'কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।

(২) রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন। ' ও ২৯ (১) 'প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে। (২) কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের অযোগ্য হইবেন না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাহার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবে না'। সংবিধানের ১৯ অনুচ্ছেদের সাধারণ অর্থে বলা হয়, সব ক্ষেত্রে সুযোগের সমতার কথা আবার ২৯ অনুচ্ছেদে সরকারি নিয়োগ লাভে সুযোগের সমতার কথা বলা হয়। পাশাপাশি অনগ্রসর অংশের জন্য প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ বিষয়ে রাষ্ট্রকে বিশেষ বিধান প্রণয়নের জন্য ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।

আমরা যদি একটু পেছনের দিকে তাকাই তাহলে ১৯৭২ সালে সরকারি কর্মচারী নিয়োগে মাত্র ২০ ভাগ ছিল মেধা কোটা, ৪০ ভাগ জেলা কোটা, ৩০ ভাগ মুক্তিযোদ্ধা কোটা আর ১০ ভাগ ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত নারী কোটা। প্রগতিশীল এই বাংলাদেশে সামাজিক অবস্থান বিবর্তনশীল। পরিবর্তন আজ সময়ের দাবি। বর্তমানে মেধা কোটা ৪৫, মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০, নারী কোটা ১০, জেলা কোটা ১০ ও উপজাতি কোটা ৫।

সম্প্রতি শাহবাগে বিসিএস বঞ্চিতদের আন্দোলন নিয়ে বাংলাদেশের প্রথম এভারেস্ট জয়ী মুসা ইব্রাহিম নিজের ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, 'আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রিয় ও সম্মানীয় মুক্তিযোদ্ধারা শুধু নিজের কথা ভেবে, দেশে বৈষম্য সৃষ্টি হবে ভেবে তো মুক্তিযুদ্ধ করেননি।

বরং বৈষম্য দূর করে সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়েই তারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহীদ এবং মা-বোনদের সম্ভ্রমের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীনতাকে মনে হয় আমরা দিন দিন পদাবনত করে ফেলছি নানা অজুহাতে। কখনো মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট আবার কখনো প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা এ নিয়ে বাহাস আর ভালো লাগে না। একই ধরনের বাহাস শুরু হয়েছে মহান মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের সুযোগ-সুবিধা বা কোটা নিয়ে। একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে কোটা পদ্ধতির মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের অযথা মেধা নষ্ট করার এই দুরভিসন্ধি বন্ধ করার আহ্বান জানাচ্ছি।

আমি আমার মেধায় কোনো কাজ করতে পারলে করব, না হলে করব না। আমার বাবার মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়টুকু কোনো রাজনৈতিক দলের হাতিয়ার হতে পারে না। আমার বাবা পুরো দেশের জন্যই যুদ্ধ করেছিলেন। শুধু আমার জন্য নয়। '

মনে পড়ে, ২০১০ সালের ১৪ মার্চ থেকে ৫ জুন ২০১১ সাল পর্যন্ত ৪৪৯ দিন ভ্যানিটি ব্যাগ, মোবাইল ফোন, সোনার চেইন, পুকুরের মাটি চুরি এ ধরনের কাল্পনিক অভিযোগে কারান্তরীণ থাকাবস্থায় পত্রিকায় দেখেছিলাম মুজিবনগর কর্মচারী হিসেবে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় সাব-রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগ দেওয়া ১৯০ জনই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা।

তারা মুক্তিযোদ্ধার জাল সার্টিফিকেট দিয়ে চাকরি নিয়েছিলেন। এদের অনেকেই ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিলেন মায়ের কোলে দুধের শিশু। কে জানে এই ১৯০ জন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সন্তানেরা আবার কোথাও কোটার আনুকূল্যে সুবিধা নিয়েছেন কিনা তার তালাশ কে করবে! পরিসংখ্যানে দেখা যায়, স্বাধীনতার ৪২ বছর পরে এসেও প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা কত তা নিয়ে বিভিন্ন সরকারের সময় বিভিন্ন তালিকা হয়েছে। ১৯৮৬ সালে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের তালিকা অনুসারে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ৬৯ হাজার ৮৩৩ জন। এই তালিকা নিয়ে কোনো বিতর্ক কখনো হয়নি।

একই বছরে আরেকটি তালিকায় এক লাখ দুই হাজার ৪৫৮ জন মুক্তিযোদ্ধার কথা বলা হয়। পরে শেখ হাসিনার সরকারের (১৯৯৬-২০০১) আমলে একটি তালিকায় দুই লাখ দুই হাজার ৩০০ জন মুক্তিযোদ্ধার নাম প্রকাশিত হয়। দেশে এখন মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দুই লাখ চার হাজার ৮০০। ১৯৮৬ সালে এরশাদের শাসনামলে জাতীয় তালিকায় (গেজেট হিসেবে প্রকাশিত হয়নি) সংখ্যা ছিল এক লাখ দুই হাজার ৪৫৮। এই সংখ্যা বিশ্লেষণ করে বলা যায়, সরকারের গেজেটে ৪৩ থেকে ৪৫ হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার নাম ঢুকেছে।

সে হিসাবে ১৯৮৬ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। ১৯৮৮ সালে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের করা তালিকায় (ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট/ভারতীয় তালিকা) মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ৭০ হাজার ৮৯২। সে তুলনায় এখন পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বেড়েছে তিনগুণ। এ বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত ধারণাটা ছিল উল্টো। অর্থাৎ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জীবিত মুক্তিযোদ্ধার তালিকা কমতে থাকবে।

সম্ভবত বাড়তি সুবিধা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জীবিত কিংবা শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে।

ডিজিটাল সরকারের সূচনালগ্নেই ঘটে এ দেশের মেধাবী ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তার হত্যার ঘটনা শুরু হয় ২০২১ সাল পর্যন্ত সরকার পরিচালনার ষড়যন্ত্রের নীলনকশা। যে ঘটনা বাংলাদেশের ভাগ্যাকাশে ঘটবে বলে এই দেশের সন্তানেরা কখনো ভাবেনি, সেসব নারকীয় ঘটনা ঘটছে। সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যা-নির্যাতন, খুন-গুম-ক্রসফায়ার, পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারি, বিরোধী দলের শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার ও মিথ্যা মামলা, সোনার ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও টেন্ডারলীগ, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মুক্তি, বিচার বিভাগ দলীয়করণ, বার বার জ্বালানি ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি, ধর্ষণের রেকর্ড, সীমান্ত হত্যা, কাঁটাতারে ফেলানীর ঝুলন্ত লাশ, ৩৩ লাখ বিনিয়োগকারীর কপালে হাত, কুইক রেন্টালে বছরে ৩৫ হাজার কোটি টাকা লোপাট, ডেসটিনি-হলমার্ক-ইউনিপেটু কেলেঙ্কারি, কালো বিড়াল উপন্যাস, সরকারি দলের ৭১০১ মামলা প্রত্যাহার, রানা প্লাজা ধস ও ধাক্কা তত্ত্ব, গ্রামীণ ব্যাংক ব্যবচ্ছেদের প্রস্তুতি, শাহবাগীদের পালন, শাপলা চত্বরে হেফাজত কর্মীদের দমন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নেওয়া মেধাবীদের নির্যাতন ইত্যাদি। এমপি শাওনের পিস্তলের গুলিতে নিহত হলেন ইব্রাহিম, তাকে গ্রেফতার করা হলো না অথচ এমপি গোলাম মাওলা রনিকে আইওয়াশের জন্য গ্রেফতার করা হলো যদিও এমপি কামাল মজুমদার একই ধরনের কাণ্ড ঘটিয়ে পার পেয়ে যান।

জোট সরকারের সময়ে মেধা ও মননের উৎকৃষ্টতার নজির স্থাপনের জন্য ১৯৯৬ সালের আওয়ামী লীগ সরকারের সময়কালীন মৌখিক পরীক্ষার্থীদের জন্য যে ২০০ নম্বর ছিল তা পরিবর্তন করে ১০০ নম্বর করা হয়। পরীক্ষার্থীদের খাতা যেন চিহ্নিত না করা যায় সে জন্য লিথোকোডের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। মেধা কোটা ৪৫, মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০, জেলা কোটা ১০, নারী কোটা ১০ ও উপজাতি কোটা ৫ এর সব পরীক্ষার্থীকে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় মেধায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর কোটার আওতায় আনা হতো। কিন্তু এবারের প্রেক্ষাপটটি সম্পূর্ণ ভিন্নতর। রাজনীতিকরণ, দলীয়করণ ও স্বজনপ্রীতির নজিরবিহীন উদাহরণ সৃষ্টির জন্য ৩৪তম বিসিএস পরীক্ষায় মহাজোট সরকার প্রথমেই মৌখিক পরীক্ষায় পুনরায় ১০০ থেকে ২০০ করা হয়।

প্রিলিমিনারিতে কোটা ব্যবস্থাকে সনি্নবেশিত করেন। এ দেশের ভবিষ্যৎ মেধাবী প্রজন্ম মহাজোট সরকারের মেধা কেলেঙ্কারির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে গণজাগরণের স্থানে সমাবেত হলে তাদের ঐকান্তিক দাবি পদদলিত করা হয় র্যাব, পুলিশ ও ছাত্রলীগ দ্বারা। আমরা দেখেছি শাহবাগীদের আন্দোলনে মিডিয়ার স্বতঃস্ফূর্ততা আর আলোকচিত্র ধারণের প্রতিযোগিতা। ওই একই স্থানে যখন মেধার মেলা বসল, দলীয়করণের জন্য প্রাথমিক পর্যায়েই মেধাকে পেছনে ফেলে কোটাকে প্রাধান্য দেওয়া হলো, হতাশা ও বঞ্চনার কশাঘাতে আর যেন মেধা পাচার না হয় সেই আন্দোলনকারীদের আলোকচিত্র কাল হয়ে দাঁড়াল এ দেশের মেধাবী নক্ষত্রগুলোর ওপর। প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিলেন, ভিডিও ফুটেজ দেখে মেধাবী তারকাদের বঞ্চিত করা হবে তাদের স্বীয় অধিকার থেকে।

আমরা জানি, সব অসম্ভবকে সম্ভব করার দেশ বাংলাদেশ। তারই কাণ্ডারি মহাজোট সরকার। যেই জননেত্রী ১৭৩ দিন হরতাল করে, অর্ধ শত নাগরিকের জীবনহানি ঘটিয়ে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার করেছিলেন ২০০৬ সালে আমরা দেখেছি বিচারপতি এমএ আজিজকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মেনে না নেওয়ার কারণে ১/১১'র জন্ম দিয়েছিলেন। আজকে সেই একই ব্যক্তির মুখে তত্ত্বাবধায়ক সরকার হওয়া তো দূরের কথা, তার সরকারের অধীনে নির্বাচন করতেই হবে এ কথা যিনি বলতে পারেন, তার দ্বারা এ দেশের মেধাবীদের ধ্বংস করা অত্যন্ত গৌণ কাজ। সেই জন্যই দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া দেশের মেধাবীদের সংরক্ষণের জন্য বিশ্বায়নের যুগে বাংলাদেশকে একটি প্রগতিশীল রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে এক অনন্য আসনে আসীনের জন্য মেধার কোনো সীমানা নেই।

তাই তিনি বলেছেন, 'আগামীতে দেশের দায়িত্ব পেলে মেধার ভিত্তিতে চাকরি দেব। বর্তমান সরকারের আমলে বাদ দিলেও ক্ষমতায় গেলে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের মেধার ভিত্তিতে চাকরি দেওয়া হবে, কাউকে বাদ দেওয়া হবে না। এবং আমি আশা করব মৌখিক পরীক্ষা আবারও ২০০ থেকে ১০০-তে নয় বরং ৫০-এ হবে।

লেখক : সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ও আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক, বিএনপি

ই-মেইল : ehsanulhoquemilan@gmail.com

 

 

 

 

 

সোর্স: http://www.bd-pratidin.com/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।