আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দ্য সঙ্‌ ইন্টারন্যাশনাল



দুনিয়া খুঁজছে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রচারককে... মৃণালকান্তি দাস প্যারী কমিউনের হিরণ্যগর্ভে জন্ম যে সঙ্গীতের, ১১২বছর পেরিয়ে সেই সঙ্গীত ছুঁয়েছে গোটা দুনিয়ার শ্রমিকশ্রেণীর হৃদয়। এই কলকাতা পেরিয়ে সুদূর কারাকাসে, মস্কো থেকে হাভানা। বিশ্বের যে কোনো ভূখণ্ডে বিপ্লবী শ্রমিক শ্রেণীর হৃদয়ের শিরা-উপশিরায়, কন্ঠে আজও অনুরণিত হয় সেই ১১২বছরের ভুবনজোড়া সঙ্গীতের চির যৌবন সুরের নির্ঝর : জাগো জাগো সর্বহারা/অনশনবন্দী ক্রীতদাস...। দ্য সঙ্‌ ইন্টারন্যাশনাল ধ্বনিত হয়েছে জারের পিটার অ্যান্ড পল কারাগারে, নাৎসি জার্মানির ভয়ঙ্কর কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে, ইতালির ফ্যাসিস্ট মুসোলিনির নিষ্ঠুর জেলখানায়, ম্যাকার্থি আমলের আমেরিকার নি:সঙ্গ জেলখানায়, রবেন দ্বীপে নেলসন ম্যাণ্ডেলার অন্ধকূপে। উইন্টার প্যালেসে লালঝাণ্ডা তুলতে তুলতে এ গান গেয়েছে রাশিয়ার শ্রমিক, বার্লিনের রাইখস্ট্যাগে রক্তপতাকা উড্ডীন করতে করতে এ গান গেয়েছে সোভিয়েতের লালফৌজ, সায়গনের রাষ্ট্রপতি প্রাসাদে লালঝাণ্ডা উড়িয়ে এ গান গেয়েছে ভিয়েতকঙ গেরিলাফৌজ, লাতিন আমেরিকার অরণ্যে রাইফেল কাঁধে এ সুর শোনা গেছে ফিদেলের কন্ঠে।

এ সুর শুনেছি কলকাতার রাস্তায়, ইরাক-আফগানিস্তানে যুদ্ধের বিরুদ্ধে, প্রিয় কমরেড জ্যোতি বসুর শেষ বিদায়ে। দুনিয়া দেখেছে জেনেয়া রাস্তায় রক্ত আর থেতলানো মজ্জার পুরু বিছানায় ছটফট করতে করতে নিথর হয়ে যাওয়া ২৩বছরের সেই তরুণ! ক্ষুধার্ত ৬০০কোটির পৃথিবীর জন্য লড়াইয়ে নেমে রক্তাক্ত হতে হয়েছিলো কার্লোকে। এক মহাদেশ পেরিয়ে বহু দূরের আরেক মহাদেশের প্রায় শেষ প্রান্তে, ইতালির প্রমোদনগরী জেনেয়ার সেই তরুণই বিশ্বায়ন বিরোধী আন্দোলনের প্রথম শহীদ। সেদিন কার্লো জিওলানির মৃত্যু ছিলো পৃথিবীর সবচেয়ে অনাকাঙিক্ষত কোনো শোকবার্তা। ২০০১সালের সেই ঘটনায় আশ্চর্য নীরব শোকে এক হয়ে ‍‌গিয়েছিলো কলকাতা থেকে জেনেয়ার শোক মিছিল।

যে মিছিলেও ছিলো শুধু দ্য সঙ্‌ ইন্টারন্যাশনাল ধ্বনি। সেই ধ্বনিই এখন দুনিয়াজুড়ে তীব্র ক্রোধে আকাশ ছোঁয়া সাহসে যেন উচ্চারণ করছে কার্লো জিওলানির শেষ আহ্বান : তোমরা আট, আমরা ছ’শো। দীর্ঘস্থায়ী এবং ভয়ঙ্কর এক শ্রেণীযুদ্ধ চলছে বিশ্বজুড়ে। সাম্রাজ্যবাদ যত দ্রুত, যত তীব্র আগ্রাসনের বিশ্বায়নের কাজ গুটিয়ে আনছে, তার চাইতে অনেক আগ্রাসী চেহারায় দারিদ্র্য লাঞ্ছিত তৃতীয় বিশ্ব ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ছে দুনিয়াজুড়ে। এখন প্রথম বি‍‌শ্বের বিলাস আর প্রাচুর্যে উচ্ছল প্রতিটি শহরের মধ্যে একেকটি তৃতীয় বিশ্ব মাথা তুলছে।

অতি দ্রুত ছড়াচ্ছে তার সীমানা। মাত্র একদিনেই বদলে যাচ্ছে একের পর এক ব্যস্ততম শহরের আদল। যেমন বদলে গেছে বুদাপেষ্ট থেকে ম্যাঞ্চেস্টার। বি‍ক্ষোভ মিছিল, ধর্মঘটে। এই এপ্রিলেই।

বিভিন্ন সংবাদসংস্থা বলতে বাধ্য হয়েছে, গত কুড়ি বছরে এমন বিক্ষোভ দেখেনি ইউরোপ। এ যেন এক ‘অসন্তোষের শীত’। সংবাদসংস্থার ভাষায়, ‘নজিরবিহীন ধর্মঘটে আকাশ ভাঙা ধ্বনি : দ্য সঙ্‌ ইন্টারন্যাশনাল। ’ সাম্রাজ্যবাদী, নয়াউদারপন্থী আর্থিক বিশ্বায়নের সর্বনাশা পরিণামের বিরুদ্ধে সোচ্চার অসহিষ্ণুতার নির্ঘোষ উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে সারা দুনিয়াজুড়ে। বিশেষত পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে সমাজতন্ত্রের পতনের পর কর্মহীনতা, ক্ষুধা, শোষণ আর নিঃস্বতার বিশ্বায়ন অনেক বেশি হিংস্রতায় ছড়িয়ে পড়েছে।

দ্রুতহারে লাগামছাড়া বেসরকারীকরণে ও আর্থিক বাজারের বেপরোয়া বি-নিয়ন্ত্রণের ফলে কোপ পড়ছে শ্রমিকশ্রেণীর ওপর। বেতন কমানো হচ্ছে, সামাজিক সুরক্ষা ছেঁটে ফেলা হচ্ছে। মানুষ বুঝতে পারছে বিশ্বায়ন মানে দায়হীন শোষণ আর বঞ্চনা। স্বাভাবিকভাবেই সামাজিক সুরক্ষা ও শ্রমজীবী জনগণের জীবনজীবিকা ও অধিকারের ওপর আক্রমণ যত বাড়ছে, মেহনতী মানুষের আন্দোলন তত তীব্রতর হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। এমনকি শিল্পোন্নত ধনী দেশগুলিতেও আজ বড় বড় ধর্মঘট সংগঠিত হচ্ছে।

তারই বহিঃপ্রকাশ ফ্রান্স, জার্মানি, মার্কিন মুলুকে। গোটা দুনিয়ে যেন ফিরতে চাইছে প্যারী কমিউনের ইতিহাসে! দুনিয়া খুঁজছে ১৮১৬-র ৪ঠা অক্টোবরে এক শ্রমিক পরিবারে জন্ম নেওয়া সেই ইউগেন পতিয়ের ইতিহাস। ১৮৩০-এর জুলাই বিপ্লবের সময় মাত্র ১৪বছর বয়সে কাব্যসৃষ্টিতে হাতেখড়ি। আজীবন ফ্রান্সের বিপ্লবী আন্দোলনের কর্মী। প্যারী কমিউনের লড়াইয়ে সামনের সারির বিপ্লবী।

১৮৪৮-এর বিপ্লবের সমর্থনে একনিষ্ঠ প্রচারকের ভূমিকায়। প্যারী কমিউনের শেষ পর্বে যখন শ্রমিকশ্রেণী প্যারিসের অলি-গলিতে ব্যারিকেড যুদ্ধে জার্মান সেনাদের মদতপুষ্ট তিয়েরস্‌ বাহিনীকে রুখছেন, পতিয়ের ছিলেন সেই শেষ প্রতিরোধের অন্যতম নায়ক। নিজের সাথীদের উজ্জিবিত করতেন শ্রমিকশ্রেণীর জীবন নিয়ে গান, কবিতা লিখে। লেনিনের ভাষায় : ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রচারক’। ১৮৭১-এর ১৬ই মে প্যারী কমিউন ধ্বংস হয়ে গেলে, আত্মরক্ষার জন্য ইংল্যান্ডে পাড়ি দিতে হয় পতিয়েকে।

পশ্চাতে পরাস্ত বিপ্লবের যন্ত্রণা, সম্মুখে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। সাগর পথেই ইউগেন পতিয়ের রচনা দুনিয়াজোড়া শ্রমিকশ্রেণীর জাগরণের সেই অসামান্য কাব্য। প্যারী কমিউন রক্ষার শ্রমিকশ্রেণীর শেষ প্রতিরোধ ভেঙে পড়ার পর তিয়ের্‌স বাহিনীর সন্ত্রাস ও বধ্যভূমি ছিলো এই কালজয়ী সৃষ্টির আঁতুড় ঘর। এ দুনিয়ার শ্রমিকশ্রেণী যে কাব্যে ফিরে পায় সংগ্রামের আহ্বান, বিপ্লবের স্মৃতি, পরম জয়ের নিশ্চয়তা। দ্য সঙ্‌ ইন্টারন্যাশনাল রচনার কয়েক বছর পরেই মারা যান ইউগেন, ১৮৮৭সালের ৬ই নভেম্বর।

লেনিন প্রাভদায় নিবন্ধ লিখলেন ইউগেন পতিয়ের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে। ইউগেন পতিয়ের অসামান্য কাব্য রূপ পেল গানের ছন্দে। ইউগেনের মৃত্যুর সাত বছর পর পিয়ের দেজিতিয়ের সেই কবিতায় সুর বসালেন। দেজিতিয়েরের জন্ম বেলজিয়ামের ঘেন্ট শহরে। বাবা ছিলেন শ্রমিক।

কাজের খোঁজে দেজিতিয়েরের পরিবারকে চলে আসতে হয়েছিলো ফ্রান্সের বস্ত্রশিল্পকেন্দ্র লিল্‌ শহরে। বছর দু’য়েক লেখা পড়ার সুযোগ হলেও, ফ্রান্স-জার্মানি যুদ্ধের সময় লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে সেনাবাহিনীতে নাম লেখান দেজিতিয়ের। বিপন্ন প্যারী কমিউন রক্ষায় লিল্‌ শহরের শ্রমিকদের সঙ্গে পিয়েরেও যান প্যারিসের পথে। অবরুদ্ধ প্যারিসের প্রহরারত জার্মান বাহিনী প্রতিহত করে তাঁদের। ফিরে আসতে হয় লিল্‌ শহরে।

হতাশায় ভেঙে না পড়ে গড়ে তোলেন শ্রমিকদের নিয়ে লিল্‌ ওয়ার্কাস কয়্যার। যেকোন শ্রমিক সমাবেশেই ডাক পড়তো সেই ওয়ার্কাস কয়্যারের। ১৮৮৮-র ২৩শে জুন। ফ্রান্সের লিল্‌ শহরে সংবাদপত্রের হকার শ্রমিকদের একটি সমাবেশে দেজিতিয়েরের পরিচালনায় সর্বপ্রথম এই গান গাইলো ওয়ার্কাস কয়্যার। পতিয়ের কবিতা দেজিতিয়েরের সুরে গান হয়ে উঠলো।

দুনিয়ার মজদুরের এক মহান আন্তর্জাতিক সঙ্গীত। কার্ল মার্কসের ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’ যেন সহসা গান হয়ে বেজে উঠলো নিপীড়িত সর্বহারার হৃদয় তন্ত্রীতে। আলোড়িত লিল্‌ শহরের শ্রমিকরা ‘জাগো জাগো সর্বহারা/অনশনবন্দী ক্রীতদাস...’ ছাপালো ৬হাজার কপি। লিল্‌ শহরের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক সঙ্গীত ছড়িয়ে পড়লো উত্তর ফ্রান্সে, বেলজিয়ামে। প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরে যখন সেই গানের অর্থ বুঝতে পারে, ফ্রান্সের শাসকদল আন্তর্জাতিক সঙ্গীতের উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করে।

নিষেধাজ্ঞা জারি হয় প্রকাশ্যে আন্তর্জাতিক সঙ্গীত গাওয়া। অজুহাত, এই গানের পঞ্চম স্তবকে সরাসরি বিদ্রোহের আহ্বান জানানো হয়েছে। এমনকি সেনাদের প্ররোচিত করা হয়েছে : But soldiers. Bring the Tyrants Down. Break ranks! Surrender their defency to us and Make our cause your own! আন্তর্জাতিক সঙ্গীতের প্রকাশক গোসাল্যাঁ-কে ফ্রান্সের প্রশাসন কারারুদ্ধ করেছিলো। তবুও রোখা যায় নি দ্য সঙ্‌ ইন্টারন্যাশনাল ধ্বনি। ১৮৯৬-এ লিল্‌ শহরেই আয়োজিত ফ্রেঞ্চ ওয়ার্কার্স পার্টির জাতী কংগ্রেসে গাওয়া হয়েছিলো দ্য সঙ্‌ ইন্টারন্যাশনাল।

প্রতিনিধিদের হাতে হাতেই ছড়িয়ে পড়ে সঙ্গীতের কপি। কল-কারখানা-শ্রমিক মহল্লায়। ফ্রান্সের সীমানা ছাড়িয়ে গোটা ইউরোপে। অনুদিত হলো বিভিন্ন ইউরোপীয় ভাষায়। লেনিন সম্পাদিত ইস্কায় আংশিক অনুবাদ প্রকাশিত হলো ১৯০০সালে।

বিভিন্ন মার্কসবাদী দল স্বীকৃতি জানালো আন্তর্জাতিক সঙ্গীতকে। ১৯২০সালে রুশভাষায় আন্তর্জাতিক সঙ্গীত পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ করেন এক বিপ্লবী শ্রমিক আরকেসি কোৎস। রাশিয়ার বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠায় দেজিতিয়ের-এর সৃষ্ট সুরমূচ্ছনা বলশেভিকদের উদ্বুগ্ধ করে। বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত আন্তর্জাতিককে জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা দান করে। বিপ্লবে নিহত শ্রমিক ও সেনাদের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে সামরিক বাদ্যদল সুর তোলে আন্তর্জাতিক সঙ্গীত।

হাজার হাজার রুশের কন্ঠে একই সুর। সমুদ্রের ওপর দিক্‌দিগন্তরে ধাবিত ঊর্মিমালার মতো সে সঙ্গীত ছড়িয়ে গেলো— ধীর সুগম্ভীর। ১৯৪৪-এ হিটলারের আগ্রাসী অভিযানকালে অবশ্য সোভিয়েতকে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে গ্রহণ করতে হয়েছিলো অন্য আরেক জাতীয় সঙ্গীত। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গীত রূপে স্বীকৃত হয় আন্তর্জাতিক। দ্য সঙ্‌ ইন্টারন্যাশনালের সুরস্রষ্টা পিয়ের দেজিতিয়ের জীবনের শেষদিন পর্যন্ত যুক্ত থেকেছেন বৈপ্লবিক কাজে।

কিন্তু পারিবারিক অশান্তি, ঈর্ষা তাঁর পিছু ছাড়েনি। ভাই অ্যাদলফ দেজিতিয়ের আন্তর্জাতিক সঙ্গীতের জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে দাবি করেন, তিনিই সুরস্রষ্টা। অবশেষে ১৮বছরের মামলা শেষে পিয়ের আন্তর্জাতিক সঙ্গীতের সুরস্রষ্টার স্বীকৃতি অর্জন করেন। প্যারিসের উপকন্ঠে শ্রমিক বসতি সেন্ট দেনিসে কাটে তাঁর শেষ জীবন। ১৯২৫-এ ফ্রান্সের কমিউনিস্ট পার্টির সভ্যপদ পান।

সেন্ট দেনিসে গড়ে তোলেন শ্রমিকদের কয়্যার। ১৯২৮-এ বিপুল সংবর্ধনা পান রাশিয়ায়। ১৯৩২-এর ২৭শে সেপ্টেম্বর জীবনাবসান হয় এই কালজয়ী সুরস্রষ্টার। রয়ে যায় তাঁর সুর। আদি-অকৃত্রিম সেই সুর গ্রহণ করেন গোটা দুনিয়ার শ্রমিক-কৃষক-বুদ্ধিজীবী-ছাত্ররা।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।