আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চীন লাল পতাকার দেশে (১ম পর্ব)

পথের প্রান্তে আমার তীর্থ নয় ,,,,,পথের পাশেই আছে মোর দেবালয়
ঐতিহাসিক তিয়েআনমেন স্কয়ার আমাদের এবারের গন্তব্য ছিল চীন। যা ছিল আমার বহুদিনের আকাঙ্খিত এক ভ্রমন পর্ব। যুগের পর যুগ দারিদ্রের যাঁতাকলে নিস্পেষিত আর আফিমের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা এক বিশাল দরিদ্র জন গোস্ঠিকে জাগিয়ে তুলেছিলেন চেয়ারম্যান মাও সে তুং ১৯৪৬ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত তাঁর নেতৃত্বে সংঘটিত বিপ্লবের মাধ্যমে, যা তাঁর পরবর্তী সুযোগ্য উত্তরসুরী চৌ এন লাই, দেং শিয়াও পিং, জিয়াং জেমিন ও আরো অন্যান্যদের হাত ধরে এখন অর্থনীতি আর পরাশক্তিতে আমেরিকার সাথে পাল্লা দিতে যাচ্ছে। ছোটো বেলা থেকেই চীন নামটার সাথে পরিচিত ছিলাম বিভিন্ন ভাবে। আব্বার একটা ছোট্ট অফিস ছিল বাসার মধ্যেই।

সেখানে দেখতাম আলপিন, জেমসক্লিপ, স্ট্যাপলার, কলম সবই চীনে তৈরী। আমি একদিন প্রশ্ন করায় আব্বা জানালো এগুলোতো তৈরী, চীনারা অনেক কিছু আবিস্কারও করেছে যেমন:কাগজ, ছাপাখানা, বারুদ, তোমার ভাইয়ার যে কম্পাস দেখেছো সেই কম্পাস,সকাল বিকাল যে চা খাচ্ছি সেই চা চিনি এছাড়াও এবার ঈদে তুমি যে সিল্কের ফ্রকটা পড়েছো সেই সিল্কসহ আরো অনেক কিছুই যা তুমি বড় হয়ে জানতে পারবে। ' আমি অবাক হয়ে গেলাম শুনে। সেই সুদুর চীনে যাচ্ছি আমরা অর্থাৎ স্বামী ছেলে আর আমি,এই তিন জন। সব কিছু গুছিয়ে তৈরী হোলাম বারো দিনের জন্য।

রাত বারোটায় যাত্রা শুরু অর্থাৎ উড়ার পালা। তারও দু ঘন্টা আগে বিমান বন্দরে হাজিরা দেয়া। সব ঝামেলা শেষ করে সিটে বসলাম প্লেনের। রাতের যে কোনো জার্নিতে আমি ঘুমাতে পারিনা। এটা পর্যটক হিসেবে আমার বিরাট এক ব্যার্থতা।

এতে সময় বাঁচে প্রচুর। কিন্ত আমি পারিনা। যাক এসব কথা। আমরা যাচ্ছি সিংগাপুর এয়ারলাইন্সে সিংগাপুর হয়ে বেজিং। বিরাট লম্বা জার্নি! সারাদিনের ছোটাছুটিতে ক্লান্ত শরীর ভেঙে আসছে, ঘুমাতে পারলে ভালোলাগতো।

কিন্ত ঘুম নেই চোখে। চার ঘন্টা পর খুব ভোরে চাংগি এয়ারপোর্টে নেমে ভাবলাম লাউন্জে সোফায় শুয়ে একটু ঘুমাবো, দুই ঘন্টা পরে বেজিং এর ফ্লাইট। কিন্ত কপাল খারাপ কোনো সোফা নয়, প্লাসটিকের শক্ত চেয়ার! এখানে কোনোভাবেই ঘুমানো সম্ভব নয়। তাই কি আর করা ! সুতরাং ডিউটি ফ্রি শপে কিছুক্ষন ঘোরাঘুরি করলাম, দেখছি শধু, কেনার কথা ভাবছিনা। ফেরার সময় যদি টাকা থাকে তখন দেখা যাবে।

কফি খাচ্ছি একটু পর পর ঘুম তাড়াতে! ঘুরছি ফিরছি ঠিকই কিন্ত আমাদের স্বামী স্ত্রীর মনে একটাই চিন্তা তা হলো চীনে ট্যাক্সি ড্রাইভার বুঝলে হয় আমরা কোথায় যেতে চাই। চিন্তার কারন সেদেশে সাধারন মানুষের মধ্যে ইংরাজী ভাষার প্রচলন নেই বল্লেই চলে। তার মধ্যে প্রত্যেকটা জিনিসের আবার দুটো নাম। একটা ইংরাজীতে একটা চীনা ভাষায়! কি যন্ত্রনা! ঢাকা থেকে চীনা ভাষায় ঠিকানা লিখে এনেছি। তারপরও এখানে একজন চীনা ছেলেকে দিয়ে আবার লিখিয়ে নিলাম।

হোটেলটা আগে থেকেই বুকিং দেয়া এটা একটা শান্তি। এবার ডাক আসলো বোর্ডিং এর বেজিং যাবার জন্য চেক ইন। এবারের প্লেনটা অনেক বড়। বেজিং যেতে ছয় ঘন্টা। বেশীর ভাগ মানুষই বলে ল্যান্ডিং এ ভয় লাগে, আমার লাগে টেইক অফ এর সময়।

মনে হয় এত বড় একটা জিনিস বাতাসে উড়ানো সোজা কথা নয়। যাই হোক দক্ষ পাইলট অল্পক্ষনের ভেতরেই তিরিশ হাজার ফুটের উপরে উঠিয়ে আনলো আমাদের। তবে এয়ার প্রেসারে কানের অবস্হা শোচনীয়,অনেক্ষন পর্যন্ত ভোঁ ভোঁ করছিল। জানালা দিয়ে দেখছি নীচে মেঘের খেলা, পেঁজা তুলোর মত নাকি বরফের পাহাড়! কোথাও সাদা, কোথাও বা ঘন কালো অন্ধকার। সামনের স্ক্রীনে দেখছি আমার পরিচিত মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড পার হয়ে যাচ্ছি।

দক্ষিন চীন সাগরের উপর দিয়ে যখন যাচ্ছি বাঁ দিকে দেখা যাচ্ছে সেই বিখ্যাত ভিয়েতনাম যারা শক্তিশালী মার্কিন বাহীনিকে গেরিলা যুদ্ধে পর্যদুস্ত করেছিল তাদের নিজস্ব মাটিতে। ম্যাপে যুদ্ধের সময় পরিচিতি পাওয়া শহরগুলোর নাম দেখছি; দানাং, হ্যানয়, এবং সায়গন যা এখন হো চি মিন সিটি নাম ধারন করেছে সে দেশের মহান নেতার নামে। তবে মেঘমালা না থাকলে মাঝে মাঝে খোলা চোখে অনেক নীচে নীল সমুদ্র আর মাটি দেখা যাচ্ছে। চীনের সমুদ্র সীমা থেকে এখন আমরা চীনের মেইন ল্যান্ডের উপর। হংকং এর উপরে এসে প্লেন বা দিকে নাক ঘুরিয়ে সোজা বেজিং এর দিকে যাচ্ছে তবে এখনো অনেক দুর।

প্লেনের ভেতরে এয়ার হোস্টেস কি কি খাবার দিচ্ছে কোনোটাই ভালো লাগছেনা। আমি শুধু বরফ শীতল টমেটোর জুস খাচ্ছি, যদিও খুশ খুশে কাশিটা জ্বালাচ্ছে কয়েকদিন ধরে। আমার ছেলেটা ঘুমাচ্ছে অঘোরে, স্বামীও ঝুমছে। শুধু আমি জেগে। ছয় ঘন্টা উড়ার পর আমরা আবার নীচে নামছি, এই তো এয়ারপোর্ট, রানওয়ে কিন্ত প্লেন নামছেনা কেন! বার বার নীচে নেমে আবার উপরে উঠে চক্কর দিচ্ছে !এবার মনে হতে লাগলো উঠা না, নামাটাই ভয়ের! পরে শুনলাম ক্লিয়ারেন্স পাচ্ছিলনা।

অত্যন্ত ব্যাস্ত এক বিশাল এয়ারপোর্ট। সেকেন্ডে সেকেন্ডে প্লেন উঠছে নামছে। যাক শেষ পর্যন্ত সেফ ল্যান্ডিং। নেমেই সোয়াইন ফ্লু চেকিং। তিন চারটা প্লেনের হাজার দুয়েক প্যসেন্জার ।

অনেকক্ষন লেগেছিল বের হতে। যা ছিল বিরক্তিকর। এখন সেই ট্যাক্সি পর্ব। বাহ্‌ চমকে তাকিয়ে দেখি কি ভাবে ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে যেতে হবে তা মেঝেতে একটু পর পর গাড়ীর চিন্হ দিয়ে লেখা আছে। বুঝলাম অলিম্পিকের অবদান।

ওটা ধরে ধরেই জায়গামত পৌছালাম। বিখ্যাত ট্যুরিস্ট এলাকা ওয়াংফুজিং আমরা যাবো তিয়েনআনমেন স্কয়ার এর কাছেই ট্যুরিস্ট সেন্টার ওয়াংফুজিং স্ট্রীট, আমরা যে হোটেলটায় উঠবো তার নামও ওয়াংফুজিং হোটেল। পর্যটকদের জন্য খুবই চমৎকার ঘরোয়া পরিবেশ এবং ঝকঝকে তকতকে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। দৈনিক পন্চাশ ডলার ভাড়া। তাছাড়া ম্যানেজারের থেকে কর্মচারীরা সবাই খুব আন্তরিক।

সবচেয়ে আসল কথা তারা প্রত্যেকে ইংরাজী বলতে পারে। সেখানে সব সাদা চামড়ার পর্যটক আমরাই বাদামী। তার মধ্যে আমেরিকানই বেশী। তিন জন মানুষ দশ দিন থাকবো অনেক ঘুরবো সুতরাং অনেক খরচ। যেখানে উঠলাম তার পাশেই ব্যাংক অব চায়না, ৫০ বছরের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী টুরিস্ট অফিস: চায়না ইন্টারন্যশনাল ট্রাভেল সার্ভিস,বড় বড় শপিং মল অর্থাৎ একজন পর্যটকের যা যা দরকার সব কিছুই।

আমি এমন দেখেছি যারা বিদেশে গিয়ে ফাইভ স্টার হোটেলে উঠে দামী খাবার খেয়ে প্রচুর কেনাকাটা করে দুদিনেই ঢাকায় ফিরে আসে। আর তাড়াহুড়া করে কি যে দেখে তা তারা নিজেরাই বলতে পারেনা। কিন্ত আমি যে মনে প্রানে ইবনে বতুতা! মনে হয় সব খুটে খুটে দেখি সময় নিয়ে। তবে আমারও কিছু লিমিটেশন আছে, বল্লেই তো আর সব হয়না। একবার দার্জিলিং ম্যালে এক ভদ্রলোক তার পুরোনো পরিচিত এক বান্ধবীকে বলতেই পারলোনা সে জলপাইগুড়ি থেকে আসতে আসতেই ৩টা কি কি পয়েন্ট দেখে এসেছে! সাথে থাকা ছোট ছেলেটাকে বলছে 'বল দিনি ভূতো আমরা যেন কি দেখে আসলুম'? ভুতো ও মিন মিন করছে, সেও বলতে পারছেনা কি দেখে এসেছে ! লোকটা তখনই আবার ৭ পয়েন্ট দেখার জন্য দৌড়াচ্ছে! পাগলের মত খালি দেখেই যাচ্ছে কিন্ত আসলে সে দেখছে কি ! আমরা একটু সময় নিয়েই বেড়াতে ভালোবাসি।

বেজিং এর একটি ব্যাস্ত সড়ক হোটেলে আসতে দুপুর গড়িয়ে গেল। ভীষন খিধে পেয়েছে। প্লেনের খাবার যা বেশিরভাগই খেতে পারিনি বিস্বাদ বলে, ম্যানেজারের ইংরাজী নাম রিচ সে জানালো তাদের রেস্টুরেন্ট চব্বিশ ঘন্টা খোলা। রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে রেস্টুরেন্টে আসলাম। বাহ্‌ খুব সুন্দর তো! রং ছাড়া কাঠের টেবিল আর দু পাশের ঐতিহ্যবাহী চিকন চিকন কাঠের বেন্চগুলো মনে হয় একশ বছরেরও বেশী পুরোনো।

কিন্ত এমন সুন্দর পলিশ আমরা মুখ দেখতে পারছিলাম। তাছাড়াও ছিল বড় বড় পুরোনো আমলের আরামদায়ক সোফা সেখানে বসে অনেকেই ল্যাপটপে কাজ করছে। তখন আমি ব্লগ লিখতাম না, না হলে সেখানকার ছবি তুলে আনতাম। সেখানেই আমি এক জোড়া বৃটিশ দম্পতির কাছে ব্লগ লেখার ধারনা পেয়েছিলাম। কাউন্টারে ছিল দারুন কিউট দুটো মেয়ে।

খুব আন্তরিক তাদের সার্ভিস। খেলাম ভাত আর চিকেন উইথ ক্যাপসিকাম। খিদের মুখে খেলাম,পরবর্তী দশটা দিন খাবারের কস্টটাই বেশি ছিল। চলবে সাথে থাকুন ********** লেখকঃ মাহজাবীন জুন বিশেষ ধন্যবাদ সকাল রয় কে দ্বিত্বীয় পর্ব Click This Link
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।